#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব১৮
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
ক্লান্ত শরীরে মেডিকেল থেকে ফিরেই ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শরীর আর চলছে না। ইদানিং মেডিকেলের প্রেসার যাচ্ছে অনেক। পড়াশোনায় ডুবে রয়েছি বহুদিন। পড়া, মেডিকেল এর প্রেসারে অনেক দিন ঠিকমতো সবাই মিলে আড্ডা দেওয়াও হয়নি। তবে এই ব্যস্ততার মাঝেও আদ্র ভাই মানুষটার সাথে কথা বাদ যায়নি। ফোন দিলেই বলতাম,
“পড়ছি, এখন কথা বলতে পারবো না”
উনি বলতেন,
“ভিডিও কল দিচ্ছি রিসিভ কর”
“বললাম তো কথা বলতে পারবো না। অনেক পড়া জমে আছে”
“তোকে কথা বলতে কে বলেছে? আমি বলবো তুই শুনে যা। তাতেও যদি সমস্যা হয় তাহলে আমি কোনো কথা বলবো না শুধু দেখে যাবো”
ঘন্টার পর ঘন্টা এভাবেই কলে আমাদের সময় কেটে যেত। আদ্র ভাই কোলে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করত আর মাঝে মাঝে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। জিজ্ঞেস করলে তার একটাই উত্তর,
“রৌদ্রময়ীকে দেখার আকাশ সম তৃষ্ণা আমার এ জীবনে মিটবে না”
লজ্জায় গালগুলো লাল হয়ে যেত। এই মানুষটা আমায় বড্ড লজ্জা দেয়। এমনও দিন গেছে উনার সাথে কথা বলতে বলতে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছি। আদ্র ভাই আস্তে করে ডেকে বলতো,
“বিছানায় যেয়ে ঘুমা। এতো প্রেসার নিতে হবে না”
আমি ঘুমিয়ে যেতাম তিনি আমায় পাহারা দিতেন। এমন অনেক সকাল গেছে যেগুলো আমার তাকে দিয়ে শুরু হয়েছে। আদ্র নামক মানুষটা আস্ত একটা ভালোবাসা। তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি খুব শীঘ্রই তাকে মনের কথা জানাবো। অনেক তো তাকে অপেক্ষায় রাখলাম। এবার তার অপেক্ষায় অবসান ঘটবে। একটা মানুষ আমাকে ১২ বছর যাবত ভালোবাসে কিন্তু আমি সেটা জানতামও না। মনে পড়ে গেল সেদিনর ঘটনা। সেবার আদ্র ভাইদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বিকেলে আদ্র ভাইয়ের ফ্রেন্ডরা এলো। সবাই মিলে গল্প করছে। আমি রান্না ঘরে ফুপ্পিকে সাহায্য করছি। এমন সময় আদ্র ভাইয়ের ফ্রেন্ড মিহি আপু এসে আমায় টেনে নিয়ে তাঁদের আড্ডায় বসালো। বড় ভাইয়া আপুদের মাঝে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। মিহি আপু সেটা বুজতে পেরে বলল,
“লজ্জা পেয়েও না। আমরা তোমার বড় ভাই বোনের মতোই। মন খুলে কথা বলো”
আমি আর মিহি আপু গল্প করছি এমন সময় পাশ থেকে আদ্র ভাইয়ের এক ফ্রেন্ড বলে উঠলো,
“কিরে দোস্ত এটা আমাদের ভাবি নাকি?”
আদ্র ভাই চোখ রাঙালেন তাকে। আদ্র ভাইয়ের চোখ রাঙানো দেখে ভাইয়াটার অবস্থা করুণ। তিনি আর কোনো কথা বলনি। খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই আড্ডা দিতে ছাদে চলল। তাঁদের সাথে আমাকেও নিয়ে এলো।ছাদে এসে সবাই বায়না করলো আদ্র ভাইয়ের গান শুনবে। আদ্র ভাই বলল,
“অনেক দিন প্রাকটিস করা হয়না। সুর, তাল ভুলে গেছি”
সবাই মিলে আদ্র ভাইকে জোর করছে কিন্তু উনি নাকোচ করছে। শেষে মিহি আপু বলল,
“রোদ তুমি আদ্র কে বলোনা। দেখবে তোমার কথা ফেলতে পারবে না”
“আমি বলবো? উনি আমার কথা শুনবে?”
“আরে তুমি বলেই দেখো না”
মিহি আপুর কথা মতো আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আদ্র ভাই সবাই যেহেতু এতো করে বলছে একটা গান শুনাও”
আমার দিকে তাকিয়ে আদ্র ভাই মানা করলেন না। তার এক বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“যা রুম থেকে গিটার নিয়ে আয়”
গিটার আনলে আদ্র ভাই প্রথমে টিউন তুলার চেষ্টা করছে। অনেক দিন এগুলো ধরা হয়না। আদ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে গান ধরলেন,
“তুমি বৃষ্টি চেয়েছো বলে
কতো মেঘের ভেঙেছি মন,
আমি নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি..
তুমি যাওনি কিছুই বলে
আজও পাল্টে ফেলিনি মন,
শুধু নিজের বলতে তোমায় চেয়েছি…
তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কতো ভালোবেসেছি, ওও…
তুমি জানতেই পারো না তোমায়
কতো ভালোবেসেছি”
আদ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে পুরো গানটা শেষ করলো। আমি চোখ বন্ধ করে পুরোটা সময় তার গান শুনছিলাম। মনে হচ্ছে আদ্র ভাই গানটা কাউকে মিন করে গাইছে। গানের প্রতিটা লাইন যেন নির্দিষ্ট কাউকে ডেডিকেট করা। আদ্র ভাইয়ের গানের কণ্ঠ দুর্দান্ত। যে কোনো মানুষ তার গানের প্রেমে পড়তে বাধ্য। আদ্র ভাইয়ের গান শেষে সবাই তাকে ঘিরে ধরলো। আমি উঠে একপাশে চলে এলাম। তাঁদের বন্ধুদের মাঝে নিজেকে কেমন বেমানান লাগছে। দাঁড়িয়ে আছি হটাৎ পাশে এসে দাঁড়ালো মিহি আপু।
“কিছু বলবেন আপু?”
“শোন রোদ তোমাকে কিছু কথা বলছি মন দিয়ে শোনো”
আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। আপু পুনরায় বলা শুরু করলো,
“আদ্রর সাথে আমার বন্ধুত্ব স্কুল জীবন থেকে। আমার সব বন্ধুরা মেয়েদের সাথে মিশলেও ওকে কখনো কোনো মেয়ের আশেপাশে দেখিনি।। কোনো মেয়ে ওর আশেপাশে ঘুরলে বলতো আমার একজন আছে, আমি তাকে অনেক ভালোবাসি। আমি তাকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। কম মেয়ে ওর জন্য কলেজ ভার্সিটিতে পাগলামি করেনি। কিন্তু ও বরাবরই সেগুলো পাত্তা দিতো না। এক দিন সবাই মিলে ওকে পাকড়াও করলাম।
“আজকে তোকে বলতেই হবে কে সেই মেয়ে যাকে তুই এতো ভলোবাসিস?”
ওর স্পষ্ট জবাব,
“সে আমার রৌদ্রময়ী”
সেদিন থেকে ওর শুরু হলো সব সময়ই ওর মুখে লেগে থাকতো আমার রৌদ্রময়ী এমন, আমার রৌদ্রময়ী অমন। সারাদিন ওর মুখে শুধু রৌদ্রময়ীর কথা। যখন জানতে পারলো ওর রৌদ্রময়ী অন্য কাউকে পছন্দ করে তখন তার সেকি কান্না। একটা ছেলেও যে এভাবে অসহায়ের মতো কাঁন্না করতে পারে ওকে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতাম না।তুমি নিশ্চই বুঝতে পারছো রৌদ্রময়ীটা কে? বিগত ১২ টা বছর ধরে ও তোমাকে ভালোবেসে গেছে। এক তরফা ভালোবেসে ছেলেটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমি বন্ধু হিসেবে চাইবো আমার বন্ধু যেন ভালো থাকে। তাই তোমার কাছে আমার রিকোয়েস্ট তুমি ওকে কষ্ট দিও না। আমার বন্ধুটা তোমায় অনেক ভালোবাসে”
মিহি আপু থামলো। আমি বেক্কলের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছি। ১২ টা বছর ধরে মানুষটা আমায় ভালোবাসে আর আমি তাকে বুঝতেই পারলাম না। মিহি আপুর সামনে কিছু বললাম না। দূর থেকে আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। মানুষটার মুখে লেগে আছে স্নিগ্ধ হাসি। কি সুন্দর সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। এই হাসির প্রেমে যে কতো রমণী পড়ছে তার হিসেব নেই। কিন্তু এই মানুষটা শুধু আমার প্রেমেই পড়েছে। নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।
——-
ক্লান্ত শরীরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙলো ফোনের শব্দে। পাশে রাখা ফোন অনবরত বেজে চলেছে। হাতড়িয়ে ফোন নিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই আদ্র ভাইয়ের নাম ভেসে উঠলো। এতক্ষন যেই মানুষটাকে নিয়ে জল্পনা কল্পনা করছিলাম তার ফোন। ফোন রিসিভ করে কানে ধরে চোখ বুজে রইলাম। নীরবে কেটে গেল কিছু মুহুর্ত। প্রথমে আদ্র ভাই কথা শুরু করলেন,
“ঘুমোচ্ছিস?”
ঘুম ঘুম কণ্ঠে জবাব দিলাম,
“হু”
“সমানে যে ঈশিতার বিয়ে সে খেয়াল আছে? প্রতিবার তো ফাংশনের আগে ড্রেসের জন্য পা*গল হয়ে যেতি। আজকে সবাই শপিংয়ে এলো তুই এলি না কেন?”
“ভালো লাগছে না। মেডিকেল থেকে এসে অনেক ক্লান্ত লাগছিলো তাই ঘুমিয়ে পড়ছি”
“দুপুরে খেয়েছিস?”
“না”
“এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে উঠে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে। নাহয় শরীর খারাপ করবে। আর শপিংয়ের কি করবি?”
“তুমি তোমার পছন্দ মতো ড্রেস নিয়ে এসো”
“আমি আনলে তোর পছন্দ হবে?”
“অবশ্যই হবে”
“এতো বিশ্বাস?”
“অনেক”
“ঠিক আছে। তুই উঠে ফ্রেশ হয়ে খাবার খা। তোর শপিং তোর কাছে পৌঁছে যাবে”
আদ্র ভাই ফোন কেটে দিলো। উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।
রাতের খাবার খেয়ে এসে পড়ছি। আজকের পড়া গুলো কমপ্লিট হয়নি। তাই খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। এমন সময় পাশে রাখা ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠলো। পড়ায় ব্যাঘাত ঘটায় কপাল কুঁচকে এলো। ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই আদ্র ভাইয়ের কণ্ঠ।
“তাড়াতাড়ি নিচে নাম”
“এতো রাতে নিচে নেমে কি করবো? পড়ছি ডিসটার্ব করো না তো”
“তুই নামবি নাকি আমি আসবো?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“তুমি নিচে আছো?”
“হ্যাঁ, মেডাম। দয়া করে নিচে এলে এই অধম বান্দা উপকৃত হতো”
“আসছি”
বলে বিছানায় রাখা ওড়না সুন্দর করে গাঁয়ে জড়িয়ে দৌড়ে লাগলাম। গেট খুলে বাহিরে এসে দেখি আদ্র ভাই গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। শার্টের হাঁটা কনুই পর্যন্ত গোটানো। শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খোলা। উস্কোখুস্ক চুল, এলোমেলো শার্ট সব মিলিয়ে তাকে অন্যরকম লাগছে। এই অন্যরকমের মাঝে এক আলাদা সৌন্দর্য আছে। এগিয়ে গেলাম আদ্র ভাইয়ের কাছে। আদ্র ভাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আদ্র ভাইয়ের কাছে যেতেই কয়েকটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলো।
“এগুলোর মাঝে তোর শপিং আছে। দেখে বলিস পছন্দ হয়েছে কিনা?”
“তুমি এতো রাতে কষ্ট করে এলে? পড়ে দিয়ে দিলেই তো হতো”
“রৌদ্রময়ীকে এক ঝলক দেখার লোভ যে আমার বড্ড। তাই তাকে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি”
“রাতে খেয়েছো?”
“না, বাসায় যেয়ে খাবো”
আদ্র ভাইয়ের হাত ধরে বললাম,
“বাসায় চলো খেয়ে তারপর যাবে”
আদ্র ভাই তার দুই হাত আমার গালে রাখলো। চোখে চোখ রেখে বলল,
“যেদিন রৌদ্রময়ী ভালোবেসে পরম যত্নে আমার জন্য রান্না করবে সেদিন খাবো। এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাসায় আম্মু অপেক্ষা করেছে”
মন খারাপ করে বললাম,
“ঠিক আছে যাও। সাবধানে যেও”
আদ্র ভাই চলে গেলেন। রুমে এসে একে একে ব্যাগ গুলো থেকে জিনিস বের করছি। সব গুলো জিনিসই সুন্দর। আদ্র ভাইয়ের পছন্দ আছে বলতে হবে। ব্যাগ গুলো কাবার্ডে তুলে রেখে পড়ায় মন দিলাম। পড়ার মাঝে আদ্র ভাইয়ের কল। তাকে কলে রেখে পড়া শেষ করলাম। পড়া শেষে তাকে বিদায় দিয়ে কল কেটে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে চেক করতেই স্ক্রিনের সামনে ভেসে উঠলো অচেনা নাম্বার থেকে আসা বার্তা,
“আমি ফিরে আসছি, খুব শীঘ্রই ফিরে আসছি”
#চলবে?
(আপনাদের অপেক্ষায় রাখার জন্য দুঃখিত। ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। পর্বটা কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ)