উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন #পর্ব২০ #আফিয়া_আফরোজ_আহি

0
129

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব২০
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পর পর মন মাতানো দমকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে নীরবে। প্রতিদিন এই স্নিদ্ধ হাওয়ায় মন ভালো হলেও আজকে ঘটনা যেন তার বিপরীত। মন মেজাজ একটুও ভালো নেই। ব্যালকনি জুড়ে বেলি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে আছে। তবে আমার এতে একটুও আগ্রহ নেই। মনের মধ্যে চলছে অস্থিরতা। তখনকার ঘটনা মনে পড়ে গেল।

বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছি গেট দিয়ে প্রবেশ করা যুবকটির পানে। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। ব্লু শার্ট কালো প্যান্ট পরিহিত যুবকটা অর কেউ নয় স্বয়ং ইভান নামক মানুষটা। ইভান ভাই এগিয়ে আসছে বাড়ির ভিতরে। তিনি যতো এগিয়ে আসছে ততো ভয় হচ্ছে। মানুষটা কেন এলো? ভোলোই তো নিজেকে, নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছিলাম। মুহূর্তেই উৎসব মুখর পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। বিগত চার বছর পর ছেলেকে দেখে বড় আম্মু তাকে জড়িয়ে নিলেন। ইভান ভাই যতই খারাপ হোক ছেলে তো তাই মান অভিমান ভুলে গেলেন। বড় আব্বু মুখ ফিরিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। একে একে সবাই ইভান ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। আমি তাকে দেখে পিছিয়ে যাচ্ছি। আমি এই নিকৃষ্ট মানুষটার সামনাসামনি হতে চাইনা। পিছাতে পিছাতে এক সময় কারো বলিষ্ঠ বুকের সাথে পিঠে ধাক্কা লাগলো। মানুষটা আমায় আগলে নিলেন। এই সময় পিছু ঘুরে দেখার প্রয়োজন মনে হলো না। মনে হচ্ছে আমি কোনো এক ঘোরের মাঝে ডুবে গিয়েছি। পিছনে থাকা মানুষটা আমায় তার দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। গালে হাত রেখে ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে? এরকম উদভ্রান্তের ন্যায় পিছনে যাচ্ছিলি কেন? পড়ে গেলে কি হতো সে খেয়াল আছে?”

আমি আদ্র ভাইয়ের প্রশ্নের জবাব দেয়ার মত অবস্থায় নেই। ক্যাবলার মতো আদ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আদ্র ভাই পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে রোদ সোনা কথা বলছিস না কেন?”

আমি আদ্র ভাইকে ইশারা করলাম। আদ্র ভাই সেদিকে তাকিয়ে ইভান ভাইকে দেখে আমায় তার সাথে আগলে নিলেন। আমার মাথা তার বুকে চেপে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“আমার রৌদ্রময়ী তো এতটা ভীতু না। সে তো অনেক স্ট্রং মেয়ে। তাহলে তুই ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? অতীত মনে করতে নেই। অতীতে যা হয়েছে তা হয়েছে কিন্ত বর্তমানে তোর পাশে আদ্র আছে। তোর কোনো ভয় নেই। আমি তোর গাঁয়ে একটা আঁচড়ও কাউকে দিতে দিবো না”

আদ্র ভাই আমাকে বুঝাচ্ছেন। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিলাম। সত্যিই তো আমি তো এখন আগের রোদ নেই যে ভীতু, এখনকার রোদ আঘাত দিলে পাল্টা আঘাত হানতে জানে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে হাল্কা করলাম। ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। আদ্র ভাই আমাকে তার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“ঠিক আছিস?”

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। আদ্র ভাইয়ের কাছ থেকে চলে আসতে নিলে উনি হাত ধরে আটকে দিলেন।
“কোথায় যাচ্ছিস?”

“রুমে যাচ্ছি। এখানে দমবন্ধ হয়ে আসছে”

“ঠিক আছে যা”

সেই যে ঘরে এসে দরজার বন্ধ করেছি আর বের হয়নি। সবাই এসে অনেকবার ডেকে গেছে কিন্তু আমি মাথা ব্যাথার বাহানা দিয়ে তাঁদের পাঠিয়ে দিয়েছি। ইভা অনেক বার এসে ডেকে গেছে ওরা সবাই মিলে মেহেদী পড়ছে আমাকেও ডেকেছে তবে আমি মানা করে দিয়েছি। এখন নিচে গেলেই ইভান নামক মানুষটার মুখোমুখি হতে হবে। আমি চাইনা তার মুখোমুখি হতে। একটু আগে রাতে খাবার খাওয়ার জন্য আম্মু ডাকতে এলে খাবো না বলে দিয়েছি। আমি কোনো মতেই নিচে নামবো না। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় দরজার কেউ কড়া নাড়ছে। রুমে এসে ভিতর থেকেই জিজ্ঞেস করলাম,
“কে?”

“আমি”

আদ্র ভাইয়ের গলার স্বর শুনে দরজা খুলে দিলাম। এই মুহূর্তে এই মানুষটাকে আমার বড্ড প্রয়োজন।কারণ সে যে আমার মন খারাপের মেডিসিন। তাকে ছাড়া ইদানিং কিছুই ভালো লাগে না। আদ্র ভাইয়ের হাতে ট্রে। ট্রে তে খাবার দেখে অবাক হলাম। আদ্র ভাই খাবারটা টেবিলে রেখে সোফায় বসলেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“খাবার কার জন্য?”

“আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য”

“আমি খাবো না, এগুলো নিয়ে যাও”

“মাইর খাওয়ার আগে পাশে এসে বস”

কি আর করার ভদ্র মেয়ের মতো তার পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। আদ্র ভাই প্লেট হাতে নিয়ে খাবার মাখানো শুরু করলো।
“আমাকে দাও আমি খেয়ে নিচ্ছি”

“কথা না বলে মুখ খোল”

আদ্র ভাই খুব যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। মানুষ এতটা যত্ন করে কাউকে ভালোবাসতে পারে? অবশ্যই পারে। আদ্র ভাই তার বড় প্রমান। আদ্র ভাই খাওয়ানো শেষ করে যত্নের সহিত মুখ মুছিয়ে দিলেন। হাত ধুয়ে পাশে বসলেন।
“হাত দে”

“হাত দিয়ে তুমি কি করবে?”

“তোর ভবিষ্যত বাণী করবো। কথা না বলে হাত দে”

হাত বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। আদ্র ভাই হাত উল্টো পালটে দেখলেন। অতঃপর হাক ছেড়ে ইভা কে ডাকলেন। ইভা এসে বলল,
“ভাইয়া ডাকছিলে?”

“হ্যাঁ। একটা মেহেদির কোণ নিয়ে আয় তো”

ইভা দৌড়ে যেয়ে নিয়ে এলো। আদ্র ভাইয়ের হাতে মেহেদীর কোনটা দিয়ে চলে গেল। আমি আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ের তার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছি। উনি মেহেদির কোণ ঘুরিয়ের ফিরিয়ে দেখছেন।
“মেহেদী দিয়ে তুমি কি করবে?”

“দেখতে থাক”

আদ্র ভাই আমার হাত কুশনের ওপর রেখে মনোযোগ দিয়ে কি যেন করছে। ভালো মতো খেয়াল করে দেখলাম উনি হাতে মেহেদী পড়াচ্ছেন। কিন্তু অবাক করা কান্ড হলো আদ্র ভাই ছেলে হয়েও যথেষ্ট ভালো করে মেহেদী দিচ্ছেন। উনার প্রতিভা দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। দীর্ঘ সময় নিয়ে উনি মেহেদী পড়ানো শেষ করলেন। এক পাশে ছোট্ট করে তার নামের প্রথম অক্ষর লিখে দিলেন। চোখে চোখ রেখে বললেন,
“সবার হাত মেহেদীর রঙে রাঙা থাকবে আর আমার রৌদ্রময়ীর হাত ফেকাশে থাকবে এটা কখনোই হতে পারে না। রৌদ্রময়ীর হাত রাঙা হবে আমার ভালোবাসার ছোঁয়ায়”

আমি মুগ্ধ চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি। একজন মানুষের ভালোবাসা না পেয়ে নিজেকে অনেক অভাগিনী মনে হয়েছিলো। কিন্তু এখন নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। কারন আদ্র ভাইয়ের মতো একজন মানুষ যে আমায় তার সকল সত্ত্বা উজার্ করে ভালোবাসে। তার ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর সকল কিছু তুচ্ছ। হটাৎ মাথায় দুস্টু বুদ্ধি এলো। আদ্র ভাইকে একটু জ্বালাবো। উনার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“এর আগে কতজনকে এভাবে মেহেদী পড়িয়েছো শুনি?”

“তুই প্রথম তুই’ই শেষে”

“তাহলেই এতো সুন্দর করে দিলে কিভাবে?”

“একটু আগে পাক্কা এক ঘন্টা বসে মেহেদির ভিডিও দেখে শিখেছি। তারপর তোর ওপর এপ্লাই করতে এসেছি। কেমন হয়েছে বলতো? পছন্দ হয়েছে?”

আমি আদ্র ভাইয়ের দিকে মুখ বেজার করে তাকালাম। আমার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে তার মুখে আঁধার নেমে এলো।
“পছন্দ হয়নি? তাহলে ধুয়ে ফেল। আমি আবার দিয়ে দিবো। তাও মন খারাপ করিস না প্লিজ”

আদ্র ভাইয়ের অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি মারাত্মক কোনো ভুল করে ফেলেছেন। আদ্র ভাইয়ের করুণ অবস্থা দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। ফিক করে হেসে দিলাম।
“সত্যি বলতে তোমার মেহেদী দেওয়া অনেক সুন্দর হয়েছে”

“সত্যি বলছিস? নাকি আমার মন রক্ষার জন্য বলছিস”

“সত্যি বলছি”

আদ্র ভাই পাশে বসতে বসতে বলল,
“আমার কষ্ট সার্থক হলো”

আদ্র ভাইয়ের মুখে ফুটে আছে মুচকি হাসি। সেই হাসিতেই আটকে গেল আমার নয়ন জোড়া। এতটা স্নিগ্ধ সেই হাসি যার মায়ায় পড়ে যাচ্ছি আমি বারংবার। আদ্র ভাই শুরু করলেন তার গল্পের সমাহার। আদ্র ভাই আমার মন ভালো করার জন্য এটা সেটা বলে আমাকে হাসাচ্ছেন। আমিও খিলখিল করে তার কথায় হাসছি। হাসি যেন থামছেই না। আদ্র ভাই মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছেন আমার হাসির দিকে। আমিতো আমার মতো হেসেই যাচ্ছি। আদ্র ভাই হুট্ করে গাল টেনে দিয়ে বলল,
“এভাবেই হাসি খুশি থাকবি সবসময়”

আরো কিছুক্ষণ গল্প চলল। গল্প শেষে আদ্র ভাই চলে গেলেন। মনটা এখন ফুরফুরে। নিজেকে হাল্কা লাগছে। মাথা থেকে সকল চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমতে চেষ্টা করলাম। মুহূর্তের মাঝে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম।
—–

সকালের ফুরফুরে হাওয়া। রোদের আলো মুখে পড়তেই ঘুমটা হাল্কা হয়ে গেল। পিটপিট করে তাকাতেই নিজরে এলো স্নিগ্ধ সকাল। ব্যালকনিতে যেয়ে দাঁড়াতেই হিমেল হাওয়া মন ছুঁয়ে গেল। বাগানে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে আছে। দেখেই লোভ লেগে গেল। ইচ্ছে করছে ফুলগুলো ছুঁয়ে দেই। যেই ভাবা সেই কাজ। বাগানে চলে এলাম। খুব সকাল হওয়ায় এখনো সবাই উঠেনি। বাগানে ঘুরে ঘুরে ফুলগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছি। পুরো বাগান জুড়ে বিচরণ হচ্ছে আমার। হটাৎ কেউ সামনে এসে দাঁড়ালো। মুখ তুলে দেখলাম আদ্র ভাই।
“এতো সকালে এখানে কি করছসি?”

“ঘুমভেঙ্গে গেছে তাই ব্যালকনিতে এলাম। ব্যালকনি থেকে ফুলগুলো দেখে লোভ লেগে গেল। তাই ছুঁয়ে দিতে এলাম”

আদ্র ভাই আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। পাশে থাকা গোলাপ গাছ থেকে একটা গোলাপ ছিঁড়ে নিয়ে আমার কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
“আমার ফুলেররানী”

#চলবে?

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন। ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here