প্রেমসুধা #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ২৮

0
48

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৮

— হানিই! হানিই!

এক প্রকার চাপা স্বরে ধমকে পৌষ’কে ডাকছে তৌসিফ। পৌষ’কে ড্রপ করে তৌসিফ যাবে সাইডে। আজ মিটিং আছে তার দুটো কিন্তু পৌষ’র আসার নাম গন্ধ নেই। তৌসিফ মোজা পায়ে ড্রয়িং রুমে চপ্পল পরে বসে আছে। এরমধ্যেই মাথায় হিজাব পেঁচিয়ে মাস্ক আর ব্যগ হাতে বেরিয়ে এলো পৌষ। চোখ তুলে যেই না তৌসিফ ডাকবে ওমনিই খেয়াল করলো পৌষ’কে। লম্বা একটা গোড়ালি পর্যন্ত সুতির গাউন পরা পৌষ। তৌসিফ ই এনেছিলো। সাদা গাউনটার মাঝে কমলা রঙের বড় এক ফুল করা। হাতের কাজ করাতে সাধারণ দেখতে গাউনটার চরা দাম নিয়েছে। কমলা রং একজনের কাছে বিষাক্ত ছিলো। কেন জানি সহ্য ই হতো না। এটা পরলে নাকি মেয়ে মেয়ে লাগে কিন্তু জীবনে প্রথম তৌসিফে’র মনে হয়েছিলো এই রঙটা ওর তোতাপাখির উপর ভালো মানাবে আর হলো ও কিন্তু তাই। মাথায় সাদা রঙের একটা একদমই সাদাসিধা সুতির হিজাব পেঁচিয়ে থাকার পরও দেখতে মায়াবী দেখাচ্ছে তার তোতাপাখি’কে। সারাক্ষণ ঠোঁটের আগায় তার কথা লেগে থাকে। এই যে, এখনও বুয়ার সাথে কথা বলছে। কি যে এত কথা বলে আল্লাহ মালুম। তৌসিফ গলা ছেড়ে ডাকলো,

— হানিই প্লিজ গিফ মাই সুজ।

পৌষ একপলক পিছনে তাকিয়ে জুতার আলমারির কাছে গেলো। কালো রঙের একটা লোফার বের করে তৌসিফে’র সামনে রেখে নিচে হাটু গেড়ে বসলো। তৌসিফ নিরদ্বিধায় পা গলিয়ে দিলো লোফারে। পৌষ পরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তৌসিফে’র দিকে না তাকিয়েই ফাঁকা গলায় জানালো,

— সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে।

তৌসিফ চমকালো। এমন চমক ই খেলো যেন মনে হলো ভর রাস্তায় মুখের উপর পরে গিয়েছে ও। চোয়ালটা ফাঁক হতে নিলেও হলো না। তার হঠাৎ ই মনে হলো সারাজীবনের ঘষামাজা আজ বুঝি সার্থক। উফফ! বউটা বলে কি?
তৌসিফে’র পরণে সাদা শার্ট কালো গেবাডিং এর সাথে ইন করা। তার উপর ব্লেজার। হাতে তার ব্লাক ওয়াচ। মাথার চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে রাখা, একটু বেড়েছে কি না। গম্ভীর্জে ভরপুর পুরুষ মুখটাতে পুরুষত্বের স্পষ্ট ছাপ।
এই মুখ আর পেটানো ফিট শরীরটাতে মানুষ তাকে বরাবরই প্রশংসা করে। বন্ধু বান্ধব সব ঠিলা হয়ে লুজবুজ অবস্থা। তৌসিফ’কে দেখলেই তাদের চোখ চক্ষুর বড় বড় হয়ে যায়। সেবার এক বন্ধুর ভাতিজির জন্য ও প্রস্তাব পেয়েছিলো। আশ্চর্য ও হয়েছিলো বটে। দিন শেষে কথা কিন্তু একটাই। তোমার টাকা তো দুনিয়া আছে। দুনিয়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পরে মানুষ অথচ সহায় বিপত্তি ই যেন তাদের একমাত্র অবলম্বন।

তৌসিফ উঠে দাঁড়িয়ে পৌষ’র কুনুই ধরে নিজের কাছে আনলো অতঃপর পৌষ’র হাতে থাকা মাস্কটা ওর হিজাবের ভেতর দিয়ে কানে পরিয়ে দিতে দিতে বললো,

— আমার তোতাপাখিটাকেও অনেক সুন্দর লাগছে।

— আমি তো আপনার মতো ফর্সা না।

— উমম। আমার শীতের কোকিল পাখি তুমি।

পৌষ ধুরুম করে একটা গুতা মা’রলো তৌসিফের পেটে। তৌসিফ আচমকা গুতাতে অল্প ব্যথা পেয়ে বলে উঠলো,

— কি করলাম?

কটমট তাকিয়ে পৌষ বললো,

— আমি ওমন কাইল্লা?

তৌসিফ বুঝলো তার বউ ইমোশন বুঝে নি, সে বুঝেছে রঙ। কি আর করার বউ’কে টেনে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আচ্ছা আমার এলব্রাটস তুমি। একদম সাদা।

পৌষ এবারেও ধাক্কা মারলো। কিচেনে যেতে যেতে বললো,

— আমি ঠ্যাং কি বগের মতো লম্বা! শা’লা…

বলেই জিভ কাটলো। তৌসিফ বোধহয় শুনে নি নাহলে লাগাতো এক ধমক। কিচেন থেকে হাতে ব্যগ নিয়ে বেরুলো পৌষ। তৌসিফ তখন পৌষ’র ভার্সিটি ব্যগ হাতে তুলেছে। দু’জন বেরিয়ে যেতেই বুয়াগুলো ফুসুরফাসুর লাগালো। তাদের মামা’কে এভাবে দেখা হয় নি কোনদিন।

গাড়িতে ও মুখখানা ফুলিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো পৌষ। তাদের মাঝে দূরত্ব ও আছে। পৌষ একদম সেটিয়ে বসে আছে। তৌসিফ চোখের সান গ্লাসটা নামিয়ে পৌষ’কে এক টান দিতেই ও হুমড়ি খেয়ে পরলো। তৌসিফ ওকে নিজের কাছে লাগিয়ে নিলো। পৌষ কথা বলে না। বলবেও না। তৌসিফ হঠাৎ ই ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— হানি এমন গাল ফুলিয়ে রাখলে তো আমার আদর আদর পায়।

পৌষ ও ফিসফিস করে বললো,

— সমস্যা কি তাহলে? আমাকে নামিয়ে দিন এরপর ড্রাইভারকে আদর করুন।

— কিহ!

জোরে ধমক দিলো তৌসিফ। পৌষ হু হা করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে হেলে পরলো যেন। তৌসিফ তাকিয়ে রইলো ওর পানে। এই মেয়ে এত পাঁজি। আচমকা গাড়িটা ঝাঁকি দিতেই পৌষ গিয়ে গিয়ে জানালার কাঁচে বারি খেলো। তৌসিফ ধরার সুযোগ পেলো না। “মা” বলে উঠতেই তৌসিফ তারাতাড়ি টেনে ধরলো। হিজাবের উপর দিয়েই হাত ডলতে লাগলো ওর মাথায়। ড্রাইভার’কে ধমকে উঠতেই পৌষ ওর বাহু ধরে বললো,

— উফ। দোষ আমার অথচ ধমকাচ্ছেন ওনাকে।

ড্রাইভার তবুও মাফ চাইলো। পৌষ সরস গলায় বললো,

— আরে আমি সরি। আপনার দোষ নেই।

তৌসিফ ওর মাথায় হাত রেখেই বললো,

— হানি, মাথায় পানি দিই? হিজাবটা খুলে দেই? গাড়িতেই পানি আছে।

— আরে না না লাগবে না। ঠিক আছে।

তৌসিফের মন মানলো না৷ পৌষ মুখ চেপে হাসছে তখনও। আচ্ছা মেয়েটা তো অনেকটা ব্যথা পেয়েছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। এর কারণ টা কি? ওর কষ্ট দেখার তো মানুষ আছে। এই যে স্বয়ং তৌসিফ আছে। ও কেন নিজের কষ্ট লুকিয়ে বেড়ায়? সেদিন জ্বরের ঘোরে কাঁদলো আর গতদিন….।
গাড়িটা ভার্সিটির সামনে থামতেই পৌষ টাটা দিয়ে নেমে গেলো। ওকে আশ্চর্য করে দিয়ে তৌসিফ ও নামলো। পৌষ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। পৌষ জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিলো না। তৌসিফ ওকে নিয়ে সোজা ঢুকলো মেডিক্যাল সার্ভিসে। পৌষ’র চক্ষু চড়কগাছ। এই ব্যাটা সুধরাবার নয়। পৌষ’র মনটাই বলছিলো তৌসিফ তালুকদার কেরামতি দেখাবে। এই নাও ঠ্যালা। মাথায় টোকা খাওয়ানোর পর ডক্টর দেখাও। লজ্জা ই পাচ্ছে পৌষ। বার দুই এক না ও করলো লাভ হলো না।

তৌসিফ ঢুকেই জানালো,

— মাথায় অনেক জোরে গাড়ির গ্লাসে বারি খেয়েছে। আমি রাতে এক্সে করিয়ে নিব। আপনি আপাতত ব্যথা কমান৷

মাথা চারবার চক্কর দিলো পৌষ’র। এই লোকের মাথার তার দুই একটা ছেড়া আছে। উপস্থিত ডক্টর ঠান্ডা আইসের ব্যাগটা ওর মাথায় ধরে রাখতে বললো। একটা পেইন কিলার জোর করে তৌসিফ খাওয়ালো। পৌষ না করতেই মুখ চেপে গিলালো। রাগে, দুঃখে কান্না পায় পৌষ’র। চোখ দিয়ে পানি পরেও যেন পরে না। তৌসিফ অবশ্য ওর ভেজা চোখ দেখেছে। তাতে তার যায় আসে না। বউ তার কলিজার টুকরো। তোতাপাখিটা সারাক্ষণ ত ত করে। এর ব্যথা লাগলেই তো অসুস্থ হবে তখন কে তার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান করবে?

সব কাহিনি শেষ করে পৌষ’রা বের হতে নিলেই উপস্থিত একটা মহিলা জিজ্ঞেস করলো,

— কি হন তোমার?

পৌষ মুখটা ভেঙিয়ে বললো,

— মামাতো ভাই।

তৌসিফ চোখ এমন ভাবে রাঙালো যে পৌষ’র ভেতরের ছোট্ট কলিজাটা ধরফর করতে লাগলো। বদলের মতো হেসে পৌষ বলে উঠলো,

— হে হে জামাই লাগে।

মহিলাটি অল্প হেসে বললেন,

— অনেক ভালোবাসে তাই না? সামান্যতেই যা করলো।

পৌষ শূন্য গলায় বললো,

— উনি একটু আলগা পিরিত সবসময় ই আমাকে দেখায়।

তৌসিফ এবার দাঁড়ালো না টানতে টানতে বাইরে আনলো ওকে। পৌষ খিলখিল করে হাসছে তখন। পেছনে মহিলাটাও হাসলেন। মেয়েটা চঞ্চল!
তৌসিফ গাড়িতে উঠতেই পৌষ জানালার ফাঁক দিয়ে ডাকলো,

— ওওও জামাই?

চকিত দৃষ্টি ফেলে তাকালো তৌসিফ। এই মেয়ে একটা বদর! পৌষ জানালা দিয়ে মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে বললো,

— কি?

— সোজা ক্লাসে যাবে। নিতে আসব।

— যাব না।

— কি করবে তাহলে.?

— বটতলায় প্রেম করব।

— এক চটকানা লাগাবো গালে। মাথা ঠিক হয়ে যাবে।

— মাথার নাট বল্টু খুলে গিয়েছে আগেই।

তৌসিফ কপালে হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে বললো,

— হানিই? কি চাই বলো।

— সামনের সিটে লাঞ্চ দিয়েছি। ঐ ব্যগে আছে। খেয়ে নিবেন। ঠিক আছে?

অবাক হয়ে তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,

— কেন?

— আসলে আমার পাতানো জামাই দুপুরে বাইরে খায় তাই তার জন্য রান্না করেছি। তাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব আপনার। কি পারবেন না?

তৌসিফ হেসে মাথা নাড়ালো। পৌষ মাথা বের করে ড্রাইভারের সামনে সিটি বাজাতেই ড্রাইভার তাকালো। পৌষ ভেটকি দিয়ে বললো,

— আমার জামাই’কে ভালোমতো পৌছে দিবেন।

— জ্বি জ্বি।

ড্রাইভার বিব্রত। তৌসিফে’র গাল থেকে হাসি সরছে না। ও হাত নেড়ে বিদায় দিলো পৌষ’কে। পৌষ ঢুকতেই তৌসিফের গাড়িও চলতে লাগলো।
অনুভূতি গুলো এলোমেলো। তা গোছাতে বসলো তৌসিফ। সত্যি ই এলোমেলো এক অনুভূতি। এই মেয়ে ওকে জাদু করেছে।
এভাবে বাসা থেকে ছোট থাকাকালীন মা টিফিন দিতো। মা নেই যত্ন ও নেই। পিয়াসী কখনো এতটা ভাবতো না। কত দিন গেলো তৌসিফ না খেয়েই অফিস করলো। না সময় ছিলো না ছিলো বাইরের খাবার খাওয়ার ইচ্ছে।
_______________________

দুপুর তিনটা নাগাদ মিটিং শেষ হলো। তৌসিফে’র আজ ক্ষুধা লেগেছে সাথে তাড়া ও আছে। বউ টিফিন দিয়েছে। রুমে ঢুকে গায়ের ব্লেজার খুলেই ইমু’কে বললো,

— আমার বাসা থেকে লাঞ্চ দিয়েছে। সার্ভ করতে বলো।

ইমু অবাক হলো বটে। এই প্রথম বলে কথা। এখানে কাজ করে বছর হলো ভালোই। তৌসিফ এক ধমক দিতেই ইমু দৌড়ে বের হলো। মুখ, হাত ধুঁয়ে সেন্টার টেবিলে বসলো তৌসিফ। বাটিগুলো সাজিয়ে রাখা। ভাত, করলা ভাজি, চিংড়ির দোপিজি সাথে ডাল। পাশে ছোট্ট একটা বক্স। ঢাকনা খুলতেই সালাদ দেখা গেলো। তৌসিফে’র ঠোঁট জুড়ে তখন প্রাপ্তির ছাপ। এমনিতে কম খেলেও আজ পুরোটা সাবার করলো। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে পানি পান করতেই ইমু নক করলো। তৌসিফ তাকে আসতে বলতেই ইমু ঢুকলো। হাতে তার ছোট্ট একটা চিরকুট। তৌসিফ’কে দিয়ে বললো,

— স্যার খাবারের ব্যাগে ছিলো।

তৌসিফ ভ্রুঁ কুঁচকে হাতে নিলো রঙিন চিরকুটটা তাতে গোটাগোটা অক্ষরে লিখা,

” ও মামাতো ভাই, আমার একমাত্র জামাই, আপনার জন্য লাঞ্চ দিলাম। খাবেন কিন্তু পুরোটা। একটা ভাতের দানা ও বাকি থাকে তাহলে আপনার মাথার চুল বাকি থাকবে না। ইটস লাউড এন্ড ক্লিয়ার।”

#চলবে…..

[ই-বুক মেলা চলছে বইটই অ্যাপে। সেখানে আপনাদের প্রিয় চরিত্র নিয়ে আছে “প্রাণ প্রিয়” ই-বুক। এখন ক্রয়ে পাবেন ২৫% ছাড়।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here