#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৯
ভার্সিটিতে তৌসিফ ছেড়ে গেলো সেই কত ঘন্টা আগে। পৌষ ক্যাফেটেরিয়াতে থেকে একটা সিঙ্গারা নিয়ে খেতে খেতে বের হলো। উদ্দেশ্য গার্ডেন এরিয়াতে যাওয়া। ওখানেই বসবে একটু। আরেকটা গ্লাস শুরু হবে আবার ঘন্টা খানিক পর। পথিমধ্যে আদিত্য’র সামনাসামনি পরে গেলো পৌষ। আদিত্য ও চোখ তুলে তাকিয়েছে। চোখাচোখি হতেই পৌষ অসস্তিতে পরলো। মোটেও এখন এর সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই পৌষ। একেতো বর্তমান সম্পর্ক দুই হলো তিক্ত অভিজ্ঞতা। আদিত্য যে জঘন্য কাজ করতে যাচ্ছিলো তা ভাবলেই পৌষ’র অন্তর আত্মা কাঁপতে থাকে। বন্ধুদের সাথে নেশা করা অবস্থায় স্বীকার করা দৃশ্য টা যেন আজও চোখে ভাসে। পৌষ যথাসম্ভব সাইড কেটে যেতে নিলেই আদিত্য হঠাৎ ডাকলো,
— পুষি?
পৌষ ঘুরে দাঁড়ালো সটান হয়ে। সম্মুখে আদিত্য। পৌষ’র দৃষ্টি তখন শক্ত। চোয়ালে দাঁত কামড়ে আছে। আদিত্য কিছু বলার আগেই পৌষ বলে উঠলো,
— ডোন্ট কল মি দ্যাট।
আদিত্য সহজ গলায় ই বললো,
— সিনিয়র তোমার আমি।
— জানি। সম্মান বজায় রাখুন আপনি আমিও রাখব। ইট মা’রবেন তো পাটকেল আমিও মা’রব। দূরে থাকবেন আমার থেকে।
বলেই পিছন ফিরে যেতে নিলো ওমনিই শুনা গেলো আদিত্যের গলা,
— দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি। কথা ছিলো একটু।
পৌষ আগেই শুনেছে আদিত্য চলে যাবে। ভেবেছিলো চলেই গিয়েছে কিন্তু এখনও যে যায় নি তা জানতো না। কাটকাট গলায় ওভাবেই বললো পৌষ,
— কথা শুনতে ইচ্ছুক নই আমি।
বলেই গটগট পায়ে এগিয়ে গেলো। পেছনে আদিত্য হতাশ দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইলো। ওর সত্যি ই কিছু কথা ছিলো আর কথাগুলো জরুরি ও বটে কিন্তু এই মেয়ে শুনলে তো।
গার্ডেন এরিয়াতে বসে মেজাজ খারাপ বেড়ে গেলো পৌষ’র। সামনেই ঘাসের উপর গোল হয়ে বসা আদিত্য’র বন্ধুরা। পৌষ’কে দেখেই তাদের নজর আটকালো। যথেষ্ট সিনিয়র হওয়াতে ওদের আশেপাশে আবার জুনিয়র দিয়েও ভরা। চ্যালামি করতে হবে না?
পৌষ উঠে যেতে নিলেই হঠাৎ ডাক পরলো। রাগে যেন চোখে পানি জমে যাচ্ছে পৌষ’র। পা চালালো সামনের দিকে তখনই কেউ একজন পেছন থেকে ওর হাত টেনে ধরে। কানে ভেসে আসে ওদের কণ্ঠ,
— কোথায় যাচ্ছো পৌষ? ক্লাস তো শুরু হয় নি। ভাইরা ডাকে ওখানে। চলো। শুনে যাও।
কটমটিয়ে পেছনে তাকালো পৌষ। ওর এক ব্যাচ সিনিয়র ধরেছে ওর হাতটা। ঝাটকা মে-রে হাত সরিয়েই দাঁত চেপে পৌষ বলে উঠলো,
— হাত ধরবেন না ভাইয়া।
ছেলেটা অল্প হেসে কিছু বলার আগেই দু’জন ছেলে উঠে এলো। পৌষ’কে দেখেই বললো,
— কি হয়েছে হাত ধরলে?
— কেন ধরবে?
একজন আচমকা ওর হাত খামচে ধরতেই পৌষ ছাড়াতে চাইলো। পারলো না। বাকিরা বসে তখনও মজা দেখছে। পৌষ রাগে লাল হয়ে বলে উঠলো,
— হাত ছাড়েন বলছি!
— কি হবে হাত ধরলে?
আচমকা একজন আর্তনাদ করে উঠলো। বাকিরা বুঝে উঠতে পারলো না। এত দ্রুত সব ঘটলো যে কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারে নি। হাত ধরে রাখা ছেলেটা আস্তে করে হাতটা ছেড়ে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। পৌষ জায়গা মতো কিক মে’রেছে। বাকি দু’জন তখনও হা হয়ে আছে। পৌষ একবার সামনে তাকালো। আদিত্য’র বন্ধুরা তখনও বসে আছে। এদিকে আসে নি। পৌষ বাকি দু’টোর দিকে তাকিয়ে বললো,
— এরপর থেকে হাত ধরা থেকে সাবধান। মনে যাতে থাকে।
রাগে হিসহিসিয় করতে করতে ক্লাসে চলে যায় পৌষ। ও যেতেই আদিত্য’র বন্ধুরা উঠে এলো। আহত ছেলেটাকে ধরে বললো,
— চল।
— কই যাব ভাই?
— ওদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের কাছে। বিচার তো দিতেই হবে। সিনিয়রের গায়ে হাত তুলে। মেয়ের সাহস কত?
ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়ালো বহু কষ্টে। জুনিয়র তিনজনকে নিয়ে আদিত্য’র বন্ধুরা হাটা দিলো চেয়ারম্যানের রুমে। তাদের মুখে তখনও বাঁকা হাসি।
.
চলমান ক্লাসে হঠাৎ ই পিয়ন এসে নক করলো। উপস্থিত প্রফেসর কারণ জিজ্ঞেস করতেই শুনা গেলো,
— পৌষরাত হক। তাকে চেয়ারম্যান ডাকছেন। এখনই।
গলাটা যেন শুকিয়ে এলো পৌষ’র। নিজের নাম শোনামাত্র ই বুকটা ধক্কর ধক্কর শুরু করেছে। তবুও উঠে হাঁটা দিলো ও। দাঁত দিয়ে নখ কামড়ে ঢুকলো চেয়ারম্যানের রুমে।
উপস্থিত সেখানে মাঠের ছেলেগুলো। রাগে যেন দপদপ করে জ্বলছে পৌষ’র শরীর। তবুও ভদ্রতার খাতিরে সালাম জানালো চেয়ারম্যান’কে। চেয়ারম্যান গম্ভীর তখন৷ নিজের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়রকে মে’রেছে পৌষরাত সেই বিচার নিয়ে এসেছে অন্য ডিপার্টমেন্ট। খুবই বাজে এক পরিস্থিতি। ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। চেয়ারম্যান গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
— পৌষরাত তুমি এটা করেছো?
পৌষ চমকালো। মাথা নেড়ে সায় জানালো। এই কাজ সে ই করেছে। স্বীকারোক্তি শুনে চেয়ারম্যানের চোয়াল ভারী হলো। কঠিন দৃষ্টি ফেলে বললেন,
— এখনই সরি বলো ওদের। তোমার সিনিয়র তারা। তাদের আঘাত করো তুমি!
পৌষে’র নাকের পাটা ফুলে উঠলো। মাথা উঁচু করে বলতে চাইলো,
— স্যার ওনারা……
ধমকে ওকে চুপ করালো চেয়ারম্যান। পৌষ ও ত্যাড়া কম না। ও মাফ চাইলো না। চেয়ারম্যান ওর দিকটা শুনতে ও চাইছে না। রেগে এবার চেয়ারম্যান বলে উঠলো,
— আস্ক সরি দু দ্যাম পৌষরাত অর এলস আই উইল কল ইউর গার্ডিয়ান।
রাগে চোখ লাল হয়ে এলো পৌষ’র। দাঁত চেপে মুখে “সরি” উচ্চারণ করলো। চেয়ারম্যান ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। পৌষরাত সোজা বেরিয়ে নেমে গেলো। ওর পা থেমে নেই। একদম গিয়ে হাজির হলো সিনিয়রদের ডিপার্টমেন্টে। তাদের চেয়ারম্যানের রুমে ঢুকে নাক লাল করে বিচার দিলো,
— স্যার মাঠে ভাইয়ারা জুনিয়র পাঠিয়ে আমার সাথে বেয়াদবি করিয়েছে। তারা আমার হাত টেনে ধরেছিলো। আমি নিজেকে রক্ষা করতে পা চালিয়েছিলাম। এখন আপনিই বিচার করুন।
একদমে বলে থামলো পৌষ। নিজের লাল হওয়া কবজিটা ও দেখাতে ভুললো না। ওদের চেয়ারম্যান কড়া লোক। পৌষ’কে বসিয়ে পানি খাওয়ালেন। ডেকে পাঠালেন ছেলেগুলোকে আনতে। আফসোস তারা ডিপার্টমেন্টে নেই। পৌষ জানে ওরা কোথায় কিন্তু বলবে না। ওর কথা একটাই, তোরা আমার ডিপার্টমেন্টে ঢুকে আমাকে দিয়ে মাফ চাইয়েছিস আমি তোদের ডিপার্টমেন্টে ঢুকে বিচার চাইলাম। ব্যাস বরাবর।
আচমকাই কেবিনে নক হলো। পৌষ তখন সোফায় বসা৷ সাথে একজন টিচার। চেয়ারম্যান অনুমতি দিতেই পৌষ’র জম ঢুকলো দরজা দিয়ে। তৌসিফ’কে এই মুহুর্তে মোটেও আশা করে নি সে। হঠাৎ ই খেয়াল হলো ওর ক্লাস টাইম শেষ। নিশ্চিত এই ব্যাটা ওকে নিতে এসেছে। কিন্তু দশ কথার এক কথা, তৌসিফ জানলো কিভাবে পৌষ এখানে?
চেয়ারম্যান ওকে দেখে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলো। দু’জন গলাগলি ও করলো। পাশে থাকা টিচারের সাথে কথা বললো তৌসিফ। পৌষ কিন্তু তখনও হাতে পানির গ্লাস বসা। তৌসিফ হঠাৎ ই ওর হাত থেকে গ্লাসটা সরালো। চেয়ারম্যান তৌসিফে’র জন্য কফি আনতে বলতেই তৌসিফ বললো,
— আজ না৷ অন্য একদিন।
চেয়ারম্যান বসলেন। তৌসিফ হেসে বললো,
— বউ নিয়ে যাব তাহলে।
চেয়ারম্যান ক্যাট ক্যাট করে হেসে উঠলো। জানালো,
— ওদের বিচার কাল করছি আজ যাও তবে বউ নিয়ে। কফির দাওয়াত কিন্তু রইলো।
তৌসিফ উঠলো তবে পৌষ’র হাতটা নিজের হাতে নিয়ে। পৌষ ও দাঁড়িয়ে গেলো। তৌসিফ হাসিমুখে চেয়ারম্যান আর উপস্থিত টিচারের সাথে হাত মিলিয়ে পৌষ’কে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
ক্যাম্পাস তখন খালির দিকে। বিকেল গড়িয়েছে বলে কথা। পৌষ একদম শান্ত ভাবেই তৌসিফে’র হাত ধরে হাঁটছে। কোন তারাহুরো নেই ওদের মাঝে। গাড়িতে উঠেও পৌষ চুপ রইলো। তৌসিফ ই শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি নাকি সিনিয়রদের গায়ে হাত তুলেছো হানি?
— না।
তৌসিফ অবাক স্বরে বললো,
— চেয়ারম্যান মিথ্যা বলবে আমাকে?
— হাত না পা মে’রেছি?
— কিহ! কোথায়.?
— টুনটুনিতে।
তৌসিফ হা হয়ে গেলো। ওর বউ এটা বলে কি? ফাঁকা এক ঢোক গিলতেও ভুললো না ও।
_______________________
হক বাড়ীতে আজ হৈ চৈ পরেছে। বড় চাচা নিজে আজ তৌসিফ’কে কল দিয়েছিলো। তৌসিফ তাকেও না করতে দুইবার ভাবে নি কিন্তু যখনই উনি বললেন,
— দু’জন এসে ঘুরে যাও।
তখনই তৌসিফ রাজি হলো। দুইজন এসে ঘুরে যাবে তা জানিয়েছে। চাচা’র মনে অন্য কথা। সে জানে একবার আনতে পারলেই হলো। পৌষ নিজেই গড়িয়ে কেঁদে হলেও থেকে যাবে। তখন নাহয় জামাই বউ দু’জন ই থাকলো। তৌসিফ যে বউ ছ্যাচ্চর তা বড় চাচা ঢের বুঝেছেন। মুখের উপর কিভাবে বলে দিলো,
” না বউ পাঠাব না। বউ ছাড়া ঘুম হয় না আমার”।
চাচা তো এটা শুনে নিজেই লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। শা”লার জামাই!
শ্রেয়া বাচ্চাদের সাথে বসা। তখনই হেমন্ত বাড়ীতে প্রবেশ করলো। বাবা তাকে ফোন করে আগেই বলেছে। হেমন্ত ও সোজা বাজার হয়ে এসেছে। বড় মাছগুলো রান্না ঘরে রাখতেই ড্রয়িং রুমে বসা শ্রেয়া’র নাকে যেন গন্ধটা ধাক্কা খেলো। মুখ কুঁচকে রুমে চলে গেলো ও।
কেউ ততটা খেয়াল করলো না অবশ্য। ইনি,মিনি উঠে গেলো মাছ দেখতে। পিহা’র টিচার এসেছে সে পড়ছে এখন।
বড় মাছটার দিকে তাকিয়ে হেমন্ত’কে জিজ্ঞেস করলো,
— হেমু বাই মাছ কি ঘুমায়?
হেমন্ত দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
— মাছ’কে জিজ্ঞেস কর।
— মাছ কতা বলে হেমু বাই?
— হু বলে তো।
দু’টোর গালে দুটো চুমু দিয়ে হেমন্ত রুমে গেলো। শ্রেয়া হেলান দিয়ে বই পড়ছে। হেমন্ত হাত পা ধুঁয়ে এসেছে নিচে থেকে। শ্রেয়া’র কাছে হাসিমুখে এগিয়ে আসতে নিলেই নাক চেপে ধরে শ্রেয়া। হেমন্ত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে শ্রেয়ু?
— উউউ। গন্ধ। গোসল করে আসুন৷ গন্ধ মাছের।
হেমন্ত বউয়ের মন রাখতে গোসলে ঢুকলো। দশ মিনিটে গোসল সেরেই এক লাফে বউয়ের কোল ঘেষে শুয়ে পরলো। পেটে হাত দিয়ে বললো,
— বাবা’র কলিজা কি করে?
শ্রেয়া হেমন্তের ভেজা চুলে হাত বুলালো। মানুষ টা এত কেয়ারিং কেন? হেমন্ত শ্রেয়া’র হাতে চুমু দিয়ে বললো,
— ফ্রুটস খেয়েছিলে?
— হুম।
— একটা ডাব কেটে আনি।
শ্রেয়া জানে না বললেও কাজে দিবে না। হেমন্ত নিচে গিয়ে ডাব একটা কেটে পানি নিয়ে রুমে এলো। এই সময়টাতে ডাবের পানি বাবু’র জন্য উপকারী। শ্রেয়া পানিতে চুমুক দিলো। জিজ্ঞেস করলো,
— মলাই নেই?
— আছে তো।
— দিন তাহলে।
— আগে পানি খাও।
শ্রেয়া মুখ চোখা করলো। ও জানে এখন পানি শেষ ন করলে মলাই দিবে ন হেমন্ত।
#চলবে….
[পর্বটা অতিরিক্ত ছোট বলে দুঃখীত।]