মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ #২২তম_পর্ব

0
28

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২২তম_পর্ব

“সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না ছোকরা। দরকার হলে আমি নিজেই তাকে পৌছে দিবো”

নীলাদ্রির কঠিন বাক্য তীব্রভাবে আঘাত করলো আহাশের অন্তঃসত্ত্বাকে। সেও কঠিন কন্ঠে বললো,
“আপনার সাথে পিউ আপু যাবে কেন? সে আমার সাথে বেরিয়েছে আজ। আজকে সে আমার সাথেই থাকবে”

হাটুর বয়সী ছোকড়ার এমন তর্কযুদ্ধের আহবান সহ্য হলো না নীলাদ্রির। সেও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। তার স্বর ধাঁরালো হলো,
“কেনো! বডিগার্ড তুমি পিউয়ের। উট্টিন্না ছোকরা, মুখে যেন ফুলঝুড়ি। এই, আমি দিয়ে আসবো পিউকে। তোমার ডিউটি শেষ বাড়ি যাও”

নীলাদ্রির পাল্টা উত্তরে একপ্রকার শীতল যুদ্ধ শুররু হয়ে গেলো আহাশ এবং নীলাদ্রির মাঝে। মাঝে যাতাকলের বাদামটি হলো পিউ। এর মাঝে সে ভুলেই গেলো তাকে যে ঐন্দ্রিলা ডেকেছে। একটা সময় সে দুজনকেই শান্ত করতে চেঁচিয়ে উঠলো,
“আমাকে কারোর দিয়ে আসতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো”
“না, আমি তোমাকে দিয়ে আসবো”

একসাথেই চেঁচিয়ে উঠলো তারা। এর মাঝেই পিউয়ের ফোন বাজলো। ঐন্দ্রিলা ফোন করছে তাকে। হন্তদন্ত হয়ে ফোন ধরতেই ওপাশের রুদ্র স্বর শোনা গেলো,
“বার্গারের প্যাটি হওয়া হয়ে গেলে কি মহারানী উপরে আসবেন”

***

ঐন্দ্রিলার ঘরে পিউ বসে আছে। আহাশ আর নীলাদ্রিকে নিজের যুদ্ধের মাঝে একরকম ফেলে এসেছে সে। ঐন্দ্রিলা কঠিন নয়নে তাকিয়ে আছে পিউয়ের দিকে। পিউ কাচুমাচু করে বললো,
“কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?”
“আমি তোকে কখন আসতে বলেছি? এটা তোর সময় হলো! ভাইয়াকে দেখলে কি তুই জগৎ ভুলে যাস নাকি!”

পিউয়ের স্বর আরোও নরম হলো,
“এমন করিস কেনো তুই! জানিস তো নীলাদ্রি ভাইয়ের কষ্ট দেখলে আমার মন ঠিক থাকে নাম বেঁচারা কাঁদছিলো”
“ঐ ছাগলের কান্না, কান্না আর আমার কান্না তো তেজপাতা”
“এমনে বলিস না”
“বাদ দে, কথা সেটা না। কথা হচ্ছে আমি অভ্রের নামে নারী নির্যাতনের মামলা করবো”

ঐন্দ্রিলার কথায় চোখ বড় বড় হয়ে গেলো পিউয়ের। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“ও তোকেও ঘুষি দিছে?”
“না”
“তাহলে চড় মারছে?”
“না”
“তাহলে? কেস কেনো করবি?”
“কারণ ওর উপর আমি রেগে আছি। খুব রেগে আছি। ও কি ভাবে নিজেকে! আমি ওর হাতের পুতুল? ইচ্ছে হলো আদর করলো, ইচ্ছে হলো আমাকে ছুড়ে মারলো। কি ভাবে নিজেকে?”

পিউ ঐন্দ্রিলার কথার আগামাথা খুজে পাচ্ছে না। কেমন খেই হারিয়ে ফেলছে। হতবিহ্বল স্বরে শুধালো,
“আসলে খুলে বল তো হয়েছে কি!”

ঐন্দ্রিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আস্তে ধীরে দুদিনের সব কিছু খুলে বললো। পিউয়ের থুতনিতে হাত চলে গেলো। এখন সে ভাববে। ভাবার সময় সে কথা বলে না। অনেকসময় ভেবে বললো,
“দোস্ত মামলা তো জন্ডিস”
“মানে?”
“মানে অভ্র তোর প্রতি ডেস্পারেট। ব্যাপারটা আমার সন্দেহ ছিলো। কিন্তু এখন কেনো যেনো সত্যি লাগতেছে। ও সত্যি তোরে ভালো টালো বাসে না তো?”

পিউয়ের প্রশ্নে চুপ করে রইলো ঐন্দ্রিলা। মলিন স্বরে বললো,
“ভালোবাসা বুঝি এমন হয়!”
“সুন্দর ভালোবাসার নমুনাতো দেখলি ই। প্রথমে পিয়াল আর তারপর সৌরভ। মিষ্টতা দেখিয়ে তাদের ভালোবাসায় ছিলো শুধু স্বার্থ। আসলে ভালোবাসা কেমন হয় সেটা আমরা কেউ জানি না। কাব্যিক ভালোবাসা তো অনেক সুন্দর হয়। কিন্তু বাস্তব জীবনে কাব্যের স্থান নেই। আমাকে দেখ, এক আস্তো পাগলকে ভালোবাসি। অথচ সেই পাগলের মনে কি চলে জানি না। সে যদি আমাকে ভালোবাসে তাহলে ভেবে দেখ সেই ভালোবাসা কেমন হবে! নিশ্চয়ই ওই গদ্য পদ্যের প্রেমিকের মত হবে না। প্রতিটা মানুষ আলাদা। অভ্র মানুষটাই সবার থেকে আলাদা। উড়াধুরা পাব্লিক। ওর ভালোবাসাও উড়াধুরা হবে। আমি বলি কি! অনেক তো মিষ্টি ভালোবাসার পেছনে ছুটেছিস, এবার একটু কড়া নিমপাতা ভালোবাসা সেবন কর। নিমপাতা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তাই নিমপাতা ভালোবাসাও ভালই হবার কথা”

পিউয়ের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো ঐন্দ্রিলা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ম্লান স্বরে বললো,
“ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ডরায় পিউ। আচ্ছা, বলতো একবার বিশ্বাস ভাঙ্গলে কি আবার বিশ্বাস করা যায়! একবার হৃদয় ভাঙ্গলে কি আবার ভালোবাসা যায়? আমার যে ভয় হয়। আমার ভাঙ্গা কাঁচে হাটতে পারবো না। পঁচা শামুকে তো দুবার পা কেটেছে।”

পিউয়ের কাছে উত্তর নেই। ঐন্দ্রিলা জানালার দিকে চেয়ে আছে। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। আজ বোধহয় বৃষ্টি থামবে না।

******

জরুরি কাজে আহাশকে বাসায় যেতে হয়েছে। তীব্র বৃষ্টিতে রিক্সা পাওয়া গেলো না। তাই নীলাদ্রি নিজ দায়িত্বে পৌছে দিতে এলো পিউকে। হেটে হেটে এসেছে তারা। পুরোটা সময় পিউয়ের মাথায় ছাতি ধরেছিলো সে। ফলে কাঁধের একাংশ তার ভিজে গেছে। পিউকে গেটের ভেতর অবধি পৌছে দিলো সে। পিউ ভেতরে ঢোকার সময় একবার ডাকলো,
“পিউ”
“কিছু বলবেন নীলাদ্রি ভাই!”
“আচ্ছা, ঐ ছোকরা তোমার আগে পিছে ঘুরে কেনো!”
“কে আহাশ!”
“হ্যা”

পিউ হাসলো। সহাস্য স্বরে বললো,
“আসলে দেশে এসেছে অনেকদিন পর তো তাই বায়না করেছে আমার সাথে থাকবে”
“মানে কি তুমি টুরিস্ট গাইড নাকি?”
“আপনি ওকে দেখলেই এতো চেতেন কেনো নীলাদ্রি ভাই?”

হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো পিউ। ভেবেছিলো মানুষটি উত্তর দিবে না। কিন্তু ভুল সে স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“কারণ আমার ভালো লাগে না তাকে। তোমার সাথে ঘেষাঘেষি করে। ইচ্ছে করে একটা চড় লাগাই। কিন্তু আমি চড় দিতে পারি না। আমি একজন সভ্য মানুষ। তাই সংযম করেছি”

নীলাদ্রির এমন উত্তরে পিউ ভাষাহারা হলো। বুদ্ধিমান পিউয়ের বুদ্ধিলোপ হলো। কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
“সে আমার ছোট ভাইয়ের মত”
“তাতে কি পিউ, সেও একটা পুরুষ। বয়স তো গ্যাদা না তার। কেনো তুমি তার সাথে এতো মেলামেশা করবে?”

নীলাদ্রির কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না পিউ। খানিকটা অধিকারবোধ প্রকাশ পেলো কি। বিমূঢ় স্বরে শুধালো,
“পুরুষ তো আপনিও নীলাদ্রি ভাই”
“আমি আর ওই ছোকরা এক?”
“আলাদা বুঝি?”

এবার থেমে গেলো নীলাদ্রি। তার মুখখানা শক্ত। পিউকে সে উত্তর দিলো না। কোনো কথাও বললো না। একরকম বিনা বিদায়ে হনহন করে হাটা দিলো সে বাড়ির দিকে। পিউ দাঁড়িয়ে আছে কেঁচিগেটের কাছে। এশার আযানের ধ্বনি কানে আসছে। বৃষ্টি এখনো থামে নি। ভাগ্যিস। নয়তো চোখের অশ্রু ধরা খেয়ে যেত।

****

রাত এখন বারোটা সতেরো। অভ্র সেই সকালে বেরিয়েছে এখনো ফিরে নি। সবাই মিনিটে মিনিটে জামাইয়ের খোঁজ নিচ্ছে। ফলে বিরক্ত হয়ে গেছে ঐন্দ্রিলা। বিরক্তির শেষ সীমা পার হলো যখন সাবেরা শুধালো,
“অভ্রকে একটা ফোন দিয়ে দেখতে পারছো না। ছেলেটা দুপুরে কিছু খেয়েছে কি না স্ত্রী হিসেবে জানা উচিত না তোমার?”

ব্যাস, বোমার মত ফাঁটলো ঐন্দ্রিলা। একপ্রকার রুক্ষ স্বরে বললো,
“সে আপনার আদরের জামাই। আমার ঠেকা পড়ে নি তার খোঁজ নিতে”

সাবেরা বেকুব হয়ে গেলো মেয়ের কথায়। সে কি খুব বেশি কিছু বলেছে! সালাম সাহেব দু-তিন বার ফোন করেছে কিন্তু ছেলেটার ফোন বন্ধ। মধ্যরাত এখনো তার ফোন বন্ধ। বাড়ির প্রতিটা প্রাণী ঘুমে থাকলেও ঐন্দ্রিলার ঘুম আসছে না। এটার যথার্থ কারণ আছে। আগামীকাল তারা শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। নাইওরে এসে জামাই বিলুপ্ত হয়ে গেলে শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাবার জো থাকবে না। তার রাগ হচ্ছে অভ্রের উপর। এতো দায়িত্বজ্ঞানহীন একটা পুরুষ কি করে হয়! একবার বাড়ি আসুক মাথা ফাটিয়ে দিবে। কিন্তু ছেলেটা বাসায় তো আসছে না। সময় বাড়ার সাথে সাথে চিন্তাও বাড়ছে। ছেলেটার তো স্বভাব ভালো না। কোথাও মারামারি করে পড়ে আছে কি কে জানে! বন্ধু বলতে তো তরুন আর বিল্লাল। তাদের কি একবার ফোন করবে ঐন্দ্রিলা! সাতপাঁচ ভাবছিলো ঠিক তখনই তার মোবাইল খানা কর্কশ স্বরে বেজে উঠলো। কেঁপে উঠলো ঐন্দ্রিলা। বিল্লালের নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোনখানা ধরতেই বিল্লাল বলে উঠলো,
“ভাবীআপু একটু নিচে আসো। তাড়াতাড়ি”

বিল্লালের কথা শুনেই নিচে নেমে এলো ঐন্দ্রিলা। মেইন গেট খুলতেই দেখলো তরুন এবং বিল্লাল দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ঘাড়ের উপর ভর করে আছে অভ্র। অভ্র যেনো হুশেই নেই। ঐন্দ্রিলা অবাক স্বরে শুধালো,
“কি হয়েছে ওর?”
“বললে মারবে না তো?”

ঐন্দ্রিলা প্রথমে বুঝতে না পারলেও একটু পর ঠিক বুঝলো যখন উৎকট বিশ্রী গন্ধ নাকে এলো। ঐন্দ্রিলা সাথে সাথে নাক চাপলো। কঠিন নয়নে তাকালো বিল্লাল আর তরুনের দিকে। বিল্লাল অসহায় স্বরে বললো,
“আমরা বারণ করেছি। এই বেদ্দপ শুনে নি! এখন ওকে কোথায় রাখবো?”
“আমার মাথায় রাখো। অসহ্য”

বিল্লাল এবং তরুন অসহায় মুখে চাইলো একে অপরের দিকে। ঐন্দ্রিলা ফোঁশ ফোঁশ করে বেশ কবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“এটাকে আমার ঘরে নিয়ে আসো। আমার দ্বারা এই হাতিকে ঘর অবধি নেওয়া সম্ভব না। আর একটা শব্দ যাতে না হয়। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না”

বিল্লাল, তরুন মাথা কাত করে ভালো বাচ্চার মত কাজ করলো। অভ্রকে চুপিসারে ঘরে শুইয়ে তারা পা টিপে টিপে বের হলো বাড়ি থেকে। এর মাঝে একবার হ্যাপির খপ্পড়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু ঐন্দ্রিলা তাকে লুকাতে সাহায্য করেছিলো। দরজা দিয়ে কোনো মতে ঘরে আসলো ঐন্দ্রিলা। তড়তড় করে ঘামছে সে। বুক ধকধক করহছে। এরমাঝে আধো সজাগ, আধো বেহুশ অভ্র নড়েচড়ে উঠলো। বিড়বিড় কিছু বললো। কিন্তু বুঝা গেলো না জড়তার জন্য। ঐন্দ্রিলা মুখখানা তার একটা কাছে যেতেই মানুষটি চোখ মিললো। হাসলো মৃদু। তার হাসি খুব বিচিত্র। ঐন্দ্রিলা খানিকটা অপ্রস্তুত হলো বটেই। কিন্তু সেই অপ্রস্তুতবোধ বিমূঢ়তায় পরিণত হলো যখন অভ্রের হাতখানা নির্বিঘ্নে তার চুলের ভেতর গলিয়ে ঘাড়ে চলে গেলো। বিনা ভনীতায় কাছে টেনে নিয়ে এলো ঐন্দ্রিলাকে সে। ঐন্দ্রিলা চমকালো, থমকালো। কিন্তু এটূকুতেই সীমাবদ্ধ রইলো না অভ্র। মধ্যকার দূরত্ব অচিরেই ঘুচিয়ে ঐন্দ্রিলার পাতলা অধরজোড়ায় উষ্ণ ঠোঁট মিশিয়ে দিলো সে……

চলবে

(বইটই তে চলছে ই-বুক মেলা। প্রমোকোড ব্যাবহারে আমার সব বই এ পেয়ে যাবেন ২৫% ছাড়। মাত্র ৪৫ টাকায় চাঁদ বলে হাতটি ধরো, ৩৮ টাকায় বাদলা দিনের প্রথম বসন্ত, ৩০ টাকায় অনুরক্ত ক্যানভাস আর আমার প্রথম বই তন্দ্রাবিলাসী মাত্র ৬৪ টাকায়। দেরি না করে এখনই পড়ে নিন সব বই)

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here