অনপেখিত পর্ব ২ লিখা: Sidratul Muntaz

0
130

#অনপেখিত
পর্ব ২
লিখা: Sidratul Muntaz

এখনও তেমন কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। মেহেক তিশার সাথে রান্নাঘরে এসেছে। লিয়া সিংকের ওপর পিড়ি রেখে রুটি বেলছে। মেয়েটির বয়স বারো বছর। সে এই বাড়ির স্থায়ী কাজের লোক না। লিয়ার মা এই বাড়িতে কাজ করেন।তিনি আপাতত অসুস্থ আছেন। তাই লিয়াকে পাঠিয়েছেন। বাচ্চা মেয়ে হলেও লিয়া কাজ ভালোই পারে। সুন্দর করে গোল গোল রুটি বেলতে পারে।

এদিকে মেহেক জীবনে কখনও রান্নাঘরে পা রাখেনি। সে গ্রামের মেয়ে হলেও তার আব্বা বেশ পয়সাওয়ালা। বলতে গেলে ছোটখাটো জমিদার। বাবার বাড়িতে খুব আদর-যত্নেই লালিত-পালিত হয়েছে মেহেক। ছোটবেলা থেকে খুব উড়নচণ্ডী হওয়ায় লেখাপড়াটাও ঠিকমতো করা হয়নি। গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে মেহেক। তার পেছনে ছেলে-পেলেরা লাইন লাগিয়ে রাখে।

ক্লাস এইটে পড়া অবস্থায় বখাটেদের যন্ত্রণায় তাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া মেহেকেরও লেখাপড়ায় তেমন আগ্রহ ছিল না। তাই মেহেকের বাবা মোজাম্মেল শাহ ঠিক করলেন লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে এবার মেয়েকে বিয়ে দিবেন। তবে শুধুমাত্র এই কারণেই যে মোজাম্মেল সাহেব মেহেককে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা কিন্তু না। এর পেছনে আরও একটা বড় কারণ ছিল। সেটাই মূল কারণ। কিন্তু সেই মূল কারণের কথা মেহেকের শ্বশুরবাড়ির কেউ এখনও জানে না।

মেহেক যতই সুন্দরী হোক, ক্লাস এইট পাশটাও করেনি সে। সেভেন পাশ একটি মেয়ের জন্য ভালো পাত্র পাওয়া খুব সহজ কথা নয়। মেহেকের জন্য কোনো ভালো ঘর থেকে প্রস্তাব আসে না। আর যারা প্রস্তাব দেয় তারা হয় হতদরিদ্র, নাহলে পাত্রের বয়স বেশি, মাথায় টাক নতুবা পাত্র গন্ডমুর্খ। আর যার সবদিক দিয়ে মোটামুটি ঠিকাছে, তাকে আবার মেহেকের পছন্দ হয় না। সব মিলিয়ে ব্যাটে বলে মিলছিলই না।

শেষমেষ পাওয়া গেল আমেরিকা ফেরত, ডিগ্রীধারী ব্রিলিয়ান্ট, সুদর্শন, বড়লোকের নাতি ফারদিন হাসানকে। ফারদিনকে একবার দেখেই মেহেক বিয়েতে মত দিয়ে ফেললো। মোজাম্মেল সাহেবও আকাশের তারার মতো জামাই পেয়ে বেজায় খুশি। কোনোমতে মেয়েকে এই ছেলের ঘাড়ে গছিয়ে দিতে পারলেই ল্যাঠা চুকে যায়। সেটাই করলেন তিনি। যত সংক্ষিপ্ত উপায়ে সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললেন।

ফারদিন এখনও মেহেকের সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। মেহেক যে লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভা সেটাও ফারদিনের অজানা। সে মেহেককে একটা বিশেষ কারণে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে।

তিশা চপিং বোর্ডে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ কাটছিল। মেহেক এই জিনিস টিভি ছাড়া অন্যকোথাও দেখেনি। তার মা-চাচীরা তো বটি দিয়েই সব কাজ করে৷ মেহেক জানে সে কিছু করতে পারবে না৷ তাও ভদ্রতার খাতিরে বলল,” ভাবি, দিন আমি কেটে দেই।”

” আরে না, না, তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো তো। আমাদের সাথে গল্প করো তাহলেই হবে। কাজ করার দরকার নেই।”

” কি গল্প করবো?”

” তোমার বাড়ির কথা বলো। কয় ভাই-বোন যেনো তোমরা?”

” আমার কোনো ভাই-বোন নেই। আমি একা।”

” তাই? তাহলে নিশ্চয়ই খুব আদরের মেয়ে।”

” হুম। কিন্তু আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা আমার চেয়ে আমার চাচীর ছেলেদের বেশি আদর করে। আসলে বাবার ছেলের খুব শখ ছিল তো।”

” আহারে, থাক কষ্ট পেয়ো না। আমার দেবর কিন্তু খুব ভালো। দেখো ও তোমাকে অনেক আদর করবে।”

এই কথা শুনে পেছন থেকে লিয়া ফিক করে হেসে দিল। আর মেহেকের মুখ লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে উঠলো। যেনো গালে কেউ আলতা ঘষে দিয়েছে। তিশা পেছনে তাকিয়ে লিয়াকে ধমক দিল,” এই বড়দের কথা তুই শুনছিস কেন? কাজ কর মন দিয়ে।”

গল্প-গুজব করতে করতে সময় কেটে গেল। ডাইনিং টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। শুধু ফারদিন নেই। এটা নিত্যদিনের ঘটনা। সে কারো সাথে ব্রেকফাস্ট করে না৷ তার খাবার উপরে দিয়ে আসা হয়।

আজকে ফারদিনের দাদু আরশাদ সাহেব আদেশ করলেন,” বিলেতিয়ানা এখানে চলবে না। তিশা,ওকে বলো নিচে এসে আমাদের সাথে খেতে। কোনো ভদ্রবাড়ির ছেলে কি বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমায়?”

তিশা নরম সুরে বলল,” দাদাজান, আমি এখনি মেহেককে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ও গিয়ে ফারদিনকে ডেকে আনবে।”

” হুম।”

তিশার কথা বলার ধরণ শুনে মনে হলো দাদাশ্বশুরকে সে ভালোই সমীহ করে। আর কালকে ফারদিনের ভাব-গতিক দেখে মনে হলো সেও দাদুকে ভালোই ভয় পায়। সুতরাং, এই দাদুমশাই হলো মেহেকের প্রধান অস্ত্র।

ফারদিনকে বাগে আনতে হলে আগে এই দাদুমশাইকে হাত করতে হবে। মেহেক ব্যাপারটা ভালো মতো মগজে ঢুকিয়ে নিল।

তিশা মেহেকের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” যাও তো মেহেক, যেভাবে পারো ফারদিনকে ডেকে আনো। ও কিন্তু সহজে বিছানা ছেঁড়ে উঠবে না। তুমি প্রয়োজনে ওর বিছানায় পানি ঢেলে দিবে।”

” পানি ঢালবো?”

” হ্যাঁ! তোমার ভাই ঘুম থেকে না উঠলে আমি তো এটাই করি।”

মেহেক মুখ টিপে হাসতে হাসতে ফারদিনের ঘরে গেল। না, সে ফারদিনকে পানি ঢেলে উঠাবে না। তার এতো সুন্দর দেখতে একটা মাত্র বর। সে কিছুতেই তার বরকে কষ্ট দিতে পারে না। আদর করে ডাকবে। ফারদিনের কাছে গিয়ে বেশ শক্ত করে তার গালে চুমু বসিয়ে দিল মেহেক।

ফারদিন গালে হাত রেখে প্রায় লাফিয়ে উঠল। মেহেক ততক্ষণে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ফারদিন নির্বাক। এখনও ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেনি। যখন পারল, তার চোখ থেকে আগুনের হল্কা বের হতে লাগল। সে চেঁচিয়ে বলল,” তুমি এই মাত্র এটা কি করলে?”

মেহেক বিরক্ত গলায় বলল,”উফফ, এতো জোরে বলছেন কেন? এখন কিন্তু আরেকটা দিবো। এবার আর গালে না, ঠোঁটে। তখন বুঝবেন। চেঁচাতেও পারবেন না।”

ফারদিন তার জীবদ্দশায় এতোটা বিচলিত আর হতবাক কখনও হয়নি। সে বিস্মায়াবিষ্ট দৃষ্টিতে চেয়েই রইল ষোল বছরের পুচকী মেয়েটির দিকে। মেহেক স্বাভাবিক গলায় বলল,” দাদু ডাকছে, দ্রুত আসুন।”

ফটাফট রুম থেকে বের হয়ে গেল মেহেক। ফারদিন হাঁ করে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ে তো তাকে জ্বালিয়ে মারবে মনে হচ্ছে। মাত্র একটা রাত গেল না, তাতেই এই অবস্থা!

মেহেক ডাইনিং রুমে আসতেই তিশা জিজ্ঞেস করল,”ফারদিন কই?”

হাসি হাসি কণ্ঠে উত্তর দিল মেহেক,” আসছে।”

কিন্তু অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ফারদিনের আসার কোনো নাম নেই।আরশাদ সাহেব বললেন,” কি ব্যাপার মেহেক? এখনও তো আসলো না ফারদিন।”

মেহেক শুকনো মুখে বলল,” আমিও বুঝতে পারছি না দাদু। মনে হয় আমি চলে আসার পর উনি আবার ঘুমিয়ে গেছেন।”

” দাদু ডাকছি এই কথা বলোনি তুমি?”

” বলেছি ভাবী।”

“যাও তো আবার। ডেকে নিয়ে এসো।”

মেহেক ঢোক গিলল। যেই কান্ড করে এসেছে, সে আর ওই ঘরে যেতে পারবে না। মেহেকের ইতস্তত মুখ দেখে আরশাদ সাগেব বললেন,”এই লিয়া, যাও তো। ফারদিনকে ডেকে নিয়ে এসো।”

লিয়া ডাকতে গেল। একটু পরেই ফারদিন হাতমুখ ধুঁয়ে টেবিলে বসলো। সবাইকে হাসি মুখে বলল,” গুড মর্ণিং দাদু, গুড মর্ণিং ভাইয়া, গুড মর্ণিং ভাবী।”

ফারদিনের চাচাতো ভাই ফাহিম উত্তর দিল,” গুড মর্ণিং। এতো দেরি লাগলো কেন তোর?”

ফারদিন ভারী অবাক হয়ে বলল,” দেরী কোথায়? লিয়া ডাকার সাথে সাথেই তো এলাম।”

আরশাদ সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,” মেহেক যখন ডাকতে গেল তখন আসলে না কেন?”

ফারদিন ভ্রু কুঁচকে বিস্মিত হওয়ার ভাণ করে বলল,” মেহেক আবার আমাকে কখন ডাকতে গেল?”

ফাহিম বলল,” মানে? ও তোকে ডাকতে যায়নি?”

” উহুম।”

আরশাদ সাহেব মেহেকের দিকে তাকালেন। মেহেক হতভম্ব হয়ে দ্রুত প্রতিবাদ করল,” মিথ্যে বলছেন কেন? আমি আপনাকে ডাকিনি?”

” কখন ডাকলে? আমি তো জেগেই ছিলাম। ডাকলে কি শুনতাম না?” ফারদিন ঠোঁট উল্টাল।

মেহেকের চেহারায় অসীম বিস্ময়। তিশা বলল,” আচ্ছা বুঝেছি। দাদু, ও আসলে ফারদিনকে একটু ভয় পায়৷ তাই বোধহয় না ডেকেই চলে এসেছে।আমারই ওকে পাঠানো উচিৎ হয়নি। নিজেরই যাওয়া উচিৎ ছিল।”

আরশাদ মেহেকের দিকে চেয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন,” এটা বললেই হতো মেহেক। তোমার মিথ্যা বলার দরকার ছিল না। প্রথমেই লিয়াকে পাঠিয়ে দিলে হতো।”

মেহেক দেখল ফারদিন মৃদু হাসছে। সে ফারদিনের পেছনে এসে ফিসফিস করে বলল,” এভাবে মিথ্যে বললে একদিন আপনার সব দাঁত পড়ে যাবে। তখন দেখবেন।”

” তাই ? তাহলে সত্যিটা কি আমার বলা উচিৎ ছিল?আমাকে কিভাবে ডেকেছিলে সেটা সবার সামনে বলব?”

” না!”

ফারদিন মুচকি হেসে ব্রেডে কামড় দিল। মেহেকের মুখ এতোটুকু হয়ে গেল। রাগে, জেদে ইচ্ছে করলো ফারদিনের চুলগুলো খামচে ধরতে। প্রথমদিনেই সে দাদুর কাছে মিথ্যুক হয়ে গেল। এভাবে চলতে থাকলে দাদুকে হাতে রাখবে কি করে?

বিকালে ফারদিন দাদুর ঘরে উঁকি দিল,” দাদু আসবো?”

” ফারদিন, আয়।”

ফারদিন দাদুর খাটের কাছে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে বলল,”দাদু, তোমাকে যে বলেছিলাম সেই কাজটা কি হয়েছে?”

” হুম, হুম, সব হয়ে গেছে। তোর শ্বশুরমশাই বিয়ের দিনই আমার হাতে দলিল দিয়ে গেছিলেন। কোটি কোটি টাকার প্রোপার্টি তুই ফ্রীতে পাচ্ছিস। কত সৌভাগ্য দেখেছিস?”

” ফ্রীতে কেন? আমি তো জায়গাটা কিনতে চেয়েছিলাম।”

” আরে, তুই উনার মেয়েকে বিয়ে করেছিস না? একটা ভালো গিফট তো তোর এমনিই পাওনা ছিল।”

” তুমি কি আমাকে কঠিন মামলায় ফাসিয়ে জেল খাটানোর প্ল্যান করছো দাদু? প্রথমে বাল্যবিবাহ।এখন আবার যৌতুক। মানে কি হচ্ছে আমার সাথে এইসব? যে কাজগুলো আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি সেগুলোই কেন আমাকে করতে হচ্ছে?”

” যৌতুকের প্রসঙ্গ আসলো কিভাবে? আরে এইটাকে যৌতুক বলে না গাঁধা। আমরা কি চাপ দিয়ে জোর করে মোজাম্মেল শাহের কাছ থেকে এই জমি হাতিয়ে নিয়েছি? উনি খুশি মনে তোকে এটা গিফট করেছে।”

” আমি তো গিফট চাইনি।।”

” তুই চাইবি কেন? বললাম তো উনি নিজের ইচ্ছায় দিয়েছে।”
” কেন নিজের ইচ্ছায় দিবেন? তুমি উনাকে ফোন করে বলে দাও আমার কোনো গিফট চাই না। আমি জায়গার দাম দিতে চাই।”

” আরশাদ সাহেব কঠোর ভঙ্গিতে বললেন,” এইটা কিন্তু বেয়াদবি হবে। উনি তোকে খুশি মনে দিয়েছেন। আর তুই ফিরিয়ে দিবি?”

” আমার কারো দান চাই না। এই জায়গা আমার নিজের। আমি নিজের টাকায় কিনতে চাই দাদু। তাছাড়া ওই লোকটাকে আমার একদম পছন্দ হয়নি। তার থেকে আমি কোনো উপহার নিতে চাই না।”

” পছন্দ হয়নি কেন?”

” উনার চিন্তাভাবনা অত্যন্ত বাজে। নাহলে পিচ্চি মেয়েটিকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চাইতেন না।”

” তোর কথা বার্তা আমার মাথায় ঢুকছে না। এখানে বাজে মানসিকতার প্রসঙ্গ আসলো কিভাবে?”

” অবশ্যই প্রসঙ্গ আসে দাদু। তুমিই বলো এই মেয়ে সংসারের কিছু বোঝে? ওর এখন লেখাপড়ার সময়। স্কুল কলেজে দাপাদাপি করার সময়। ওর বয়সে আমি বিয়ের কথা চিন্তাও করতে পারিনি।”

” আরে, তুই আর ও কি এক হলি? মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে দ্রুত বড় হয়। জানিস না? আর গ্রামের মেয়েরা তো শহরের মেয়েদের তুলনায় ম্যাচিউরও বেশি হয়। তুই মেহেকের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর। মেয়েটা কিন্তু খারাপ না। আর ওর এখন যেই বয়স, তুই চাইলেই ওকে নিজের মতো গড়ে ফেলতে পারিস। প্রয়োজনে ওকে আমেরিকা নিয়ে যা। তোর মনের মতো তৈরী করে নে।”

দাদু কথা বলেই যাচ্ছেন। ফারদিন এসবে কর্ণপাত করছে না। তার মনোযোগ ল্যাপটপ স্ক্রিনে। মেহেকের উপর তার কখনও ইন্টারেস্ট জন্মাবে না। এটা সে ভালো করেই জানে।

মেহেককে সে শুধুই বিয়ে করেছে এই জায়গাটা পাওয়ার জন্য। জায়গাটির ছবি এখন ফারদিন ল্যাপটপে দেখছে। প্রায় পনেরোশো বর্গফিটের একটি বাগানবাড়ী। এই জায়গার সাথে ফারদিনের অনেক স্মৃতি জড়িত। এইখানেই তার শৈশব কেটেছে। দিনগুলো স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে। ফারদিনের চোখ ভিজে যাচ্ছে। আহ দিনগুলো! কোথায় হারিয়ে গেল সেই সোনালী শৈশব। এখন এই সবুজ মাঠজুড়ে শুধুই খা খা। বুকের ভেতরেও শূন্যতা খুব করে টের পায় ফারদিন।

তার মা-বাবা আমেরিকা যাওয়ার সময় এই সবকিছু মোজাম্মেল শাহের কাছে বিক্রি করে গিয়েছিলেন। প্রায় পনেরো বছর পর ফারদিন আমেরিকা থেকে এসে জানতে পারল তার শৈশবের সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটি এখন একটি বিদেশী কোম্পানির দখলে। সেখানে বড় বড় দালান উঠবে। গাছ-পালা কেটে ফেলা হবে। ফারদিনের পছন্দের বকুল গাছ, আমতলা, তেতুলতলা,হাজার-হাজার শৈশব স্মৃতি সব হারিয়ে যাবে৷ এটা ফারদিন মেনে নিতে পারছিল না। সে এই জায়গাটা কিনে নেওয়ার জন্য উঠে-পরে লাগলো।

কিন্তু মোজাম্মেল শাহ জায়গা বিক্রি করবেন না। ফারদিন যখন বিশেষভাবে অনুরোধ করল তখন তিনি শর্ত দিলেন তার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। ফারদিন এক কথায় রাজি হয়ে গেছিল। এই জায়গার জন্য সে জীবন দিতে প্রস্তুত। আর বিয়ে তো অতি সামান্য বিষয়। কিন্তু বিয়ের আগে ফারদিন জানতো না, তার হবু বউয়ের বয়স মাত্র ষোল এবং সে মাত্র সেভেন পাশ। ফারদিনকে জানানো হয়েছিল, মেহেক আঠারো বছরের এইচএসসি পাশ করা মেয়ে। এখনও ফারদিন সেটাই জানে। শুধু বিয়ের রাতে মেহেককে জিজ্ঞেস করার পর জানতে পেরেছিল তার বয়স আঠারো নয়, ষোল। লেখাপড়ার ব্যাপারটা এখনও ফারদিন ধরতে পারেনি।

মেহেক বিছানার চাদর ঠিক করছিল। ফারদিন ঘরে ঢুকতেই মেহেক দুইহাত কোমড়ে ঠেঁকিয়ে বলল,” আপনি দাদুর সামনে আমাকে মিথ্যুক বানালেন কেন?”

” তুমি আমাকে রাগালে কেন?”

বেশ ভারী কণ্ঠ ফারদিনের। মেহেক একটু থতমত খেল। তারপর পুনরায় তর্ক করার ভঙ্গিতে বলল,” একশোবার রাগাবো। আরও বেশি করে রাগাবো। দেখি আপনি কি করেন।”

ফারদিন আচমকা মেহেকের দিকে এগিয়ে এলো। মেহেক দ্রুত সরে যেতে চাইল কিন্তু একেবারে দেয়ালের সঙ্গে তার পিঠ লেগে গেল। ফারদিন কটমট করে বলল,” খবরদার আমাকে রাগানোর চেষ্টা করো না। এমন অবস্থা করব যে বাপ ডেকেও পার পাবে না।”

মেহেক জোর করে হাসার চেষ্টা করল। বলল,” বাপ ডাকবো কেন? আপনি তো আমার বর। বরকে কেউ বাপ ডাকে?”

” কালরাতে তো ভাই ডাকছিলে।”

মেহেক এইবার ফিক করে হেসে দিল,” সে তো আপনাকে রাগানোর জন্য। ”

” আমাকে রাগানোর খুব শখ তাই না তোমার?”

” হুম। অনেক শখ! রাগলে আপনাকে দারুণ লাগে। একদম লাল টমেটো।”

ফারদিন কড়া দৃষ্টিতে তাকাল। মেহেক সেই কড়া দৃষ্টির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে ফারদিনের গাল দু’টো টিপে দিয়েই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ফারদিন তার আচরণে অবাক। মেয়েটির সাহস ধীরে ধীরে বাড়ছে। কিছু একটা করতেই হবে।

ঘড়িতে রাত এগারোটা। বিছানার দুই প্রান্তে শুয়ে আছে দু’জন। মেহেক আর ফারদিন। ফারদিনের হাতে মোবাইল ফোন। মেহেকের চোখে ঘুম নেই। সে আঁড়চোখে দেখার চেষ্টা করছে ফারদিন মোবাইলে কি করে? ফারদিন ব্যাপারটা লক্ষ্য করেই ফোনের স্ক্রিন আড়াল করে ফেলল।

মেহেক হঠাৎ ফারদিনের দিকে ঘুরে বলে উঠলো,” আচ্ছা, আপনার কি গার্লফ্রেন্ড আছে?”

ফারদিন কড়া দৃষ্টিতে তাকালো৷ মেহেকের চেহারায় মহা উৎসাহ দেখে সে পাশ কাটানো গলায় উত্তর দিল,” না।”

” মিথ্যে বলছেন কেন?”

” তোমার সাথে মিথ্যে কেন বলবো?”

” আরে, বউয়ের সাথে তো মানুষ মিথ্যে কথাই বলে। গার্লফ্রন্ড থাকলেও কি আপনি তা স্বীকার করবেন?”

” জানোই যখন স্বীকার করবো না তাহলে জিজ্ঞেস করলে কেন?”

” এমনি। মন চাইলো হঠাৎ। ”

” তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?”

” না। তবে একজন প্রেমিক ছিল।”

” বয়ফ্রেন্ড আর প্রেমিক আলাদা নাকি?”

” আলাদাই তো। বয়ফ্রেন্ড মানে যার সাথে আমি প্রেম করেছি। আর প্রেমিক মানে যার সাথে প্রেম হতে হতেও হয়নি। কিন্তু মনে মনে দু’জনই পছন্দ করতাম।”

মেহেক উদাসীন কণ্ঠে বলতে লাগল,” জানেন সে আমাদের গ্রামেরই ছেলে। নাম মুহিবুল ইসলাম। আমি ডাকতাম মুহিব ভাই। তার বাবার একটা ফার্মেসী আছে। সেই ফার্মেসীতে রিচার্জ, বিকাশ সবকিছু করা যায়। ক্যান্ডি, টফিও পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে আম্মার ফোনে রিচার্জ করার জন্য আর বিকাশে কাউকে টাকা পাঠানোর জন্য অথবা আমার পিচ্চি কাজিনদের জন্য টফি কিনতে আমিই মুহিব ভাইয়ের দোকানে যেতাম। তিনি আমাকে অযথা দাঁড় করিয়ে রাখতেন। সব কাস্টমার বিদায় করার পর আমাকে জিজ্ঞেস করতেন,” কি খবর মেহু?” আমি হেসে বলতাম,” ভালো মুহিব ভাই। আপনি কেমন আছেন?” তখন তিনি কি বলতেন জানেন? এতোক্ষণ ভালো ছিলেন না৷ আমাকে দেখে ভালো হয়ে গেছেন। আমি নাকি উনার নাপা এক্সট্রা। হাহাহা।”

ফারদিন বিরসমুখে বলল,” বাহ, ভালোই তো চলছিল। প্রেম করলে না কেন?”

” কিভাবে করবো? আব্বা জেনে গিয়েছিল তো। তারপরই আমার বিয়ে ঠিক করলেন। আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল।”

” এখনও কি তোমার মুহিব ভাইয়ের কথা মনে পড়ে? ফিরে যেতে চাও? যদি বলো তাহলে ব্যবস্থা করব।”

” ছি, না, না। পাগল নাকি?”

মেহেক এমনভাবে মুখ কুচকালো যেন ফারদিন সবচেয়ে জঘন্যতম কথাটি বলে ফেলেছে।

” আব্বা যেদিন আমার বিয়ে ঠিক করেছেন সেদিন থেকেই মুহিব ভাই ডিলিট। আমি ঠিক করেছি প্রেম-টেম সব বিয়ের পরেই করবো। একেবারে নিজের বরের সাথে। মনে মনে তো আমি আপনাকেই ভালোবেসেছি।”

ফারদিন দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ল। মেয়েটা কি তার সাথে ফাজলামি করছে নাকি সত্যি বলছে? ঠিক বুঝতে পারছে না ফারদিন। একটু পর বলল,” আমাকে তো তুমি দেখোইনি। না দেখেই ভালোবেসে ফেললে?”

মেহেক মুখ টিপে হাসলো। ফারদিন তো আর জানে না মেহেক লুকিয়ে লুকিয়ে আগেই ফারদিনকে দেখে নিয়েছিল। যেদিন ফারদিন তাদের বাড়ি এসেছিল সেদিনই। তখন থেকেই ফারদিনকে নিয়ে মেহেকের স্বপ্ন দেখা শুরু। আর ফারদিন যে তাকে বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছে এটাও সে জানে। কিন্তু মাইশা আপু বিয়ের পর স্বামীকে বশে রাখার ১০১টা পদ্ধতি মেহেককে শিখিয়ে দিয়েছে৷ মেহেক প্রতিদিন একটা একটা করে প্রয়োগ করবে৷ তারপর একদিন ফারদিনও মেহেকের প্রেমে পাগল হয়ে যাবে। এজন্যই তো সে ফারদিনকে নির্ভয়ে বিয়ে করেছে।

মেহেক লক্ষ্য করল ফারদিন তার মোবাইলটা মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়ে গেছে। মেহেকও শুয়ে পড়ল। এখন শুধু অপেক্ষা। ফারদিনের ঘুম গাঢ় হলেই মেহেক মোবাইলটা চেক করবে। তাহলেই জানা যাবে লোকটার গার্লফ্রেন্ড আছে কি নেই। মনে তো হয় কমপক্ষে সাত-আটটা গার্লফ্রেন্ড আছে। কি সুন্দর নায়কের মতো চেহারা। এরই যদি গার্লফ্রেন্ড না থাকে তাহলে পৃথিবীর কোনো পুরুষেরই গার্লফ্রেন্ড থাকার কথা না।

প্রায় আধঘন্টা পর মেহেক মৃদু কণ্ঠে ডাকল,” শুনছেন। এইযে, শুনছেন?”

নাহ, কোনো জবাব নেই। মেহেক বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে ফারদিনের কাছে গেল। মোবাইলটা ঠিক ওর মাথার কাছে। মেহেক আরও একবার ডাকল,” স্বামী! শুনছেন? ও স্বামী!”

কোনো সাড়া নেই। মেহেক সাবধানে ফোনটা হাতে নিয়ে ফেলল। তারপর এক ছুটে বারান্দায় চলে এলো। এখনও বুক ধুকপুক করছে। দ্রুতহাতে মোবাইলের লক খুলল। সে আগে থেকেই এই ফোনের লক জানে। ফারদিনকে কয়েকবার লক খুলতে দেখেছে সে। সর্বপ্রথম হোয়াটসঅ্যাপ চেক করল। বেশিরভাগ বিদেশী নাম্বার। মেহেক এতোটাই মোবাইলে মগ্ন ছিল যে ফারদিন কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালই করেনি। ফারদিন মনোযোগ আকর্ষণের জন্য হালকা কাশল।

মেহেকের টনক নড়লো না। ভ্রু কুচকে সে মোবাইল দেখায় ব্যস্ত। ফারদিন বলল,” মেহেক, কি করছো তুমি?”

” দেখছি।”

মনোযোগী মেহেক উত্তর দিল বেখেয়ালে। ফারদিন বলল,” কি দেখছো?”

এইবার মেহেক কোনো উত্তর দিল না। একটু পর হঠাৎ কি মনে করে ফারদিনের দিকে তাকাল। আর তাকিয়েই চমকে উঠল। এতো বেশি চমকে উঠল যে চিৎকার দিয়ে মোবাইল ফেলেই দৌড়ে পালালো। ফারদিন মেঝে থেকে মোবাইলটা কুড়িয়ে নিল। গ্লাস প্রটেক্টর ফেটে গেছে। কেমন বিরক্ত লাগে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here