” ভাইয়া,লাইট নেভাবেন না দয়া করে। আমি অন্ধকারে ভয় পাই।”
রিনরিনে কোমল কণ্ঠ। ফারদিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল বধূবেশির দিকে। বাসর ঘরে বসে সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী তার নব স্বামীকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করছে, ব্যাপারটা অদ্ভুত। প্রথম পরিচয়েই নববধূর মুখে ভাইয়া ডাক শুনলে যে কেউ হতাশ হবে। তবে ফারদিন হতাশ হলো না, সে বিরক্ত হলো। কঠিনভাবে বিরক্ত। সে রূঢ় কণ্ঠে বলল,” লাইট নেভানো ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না। তাই লাইট বন্ধ থাকবে। কিছু করার নেই।”
মেয়েটির চেহারায় ভয় এবং আতঙ্কের একটা গভীর ছাপ স্পষ্ট হলো। সে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো,” ভাইয়া প্লিজ…”
ফারদিন থামল। লক্ষ্য করল, মেয়েটির কণ্ঠনালী কাঁপছে। বড় বড় কাজল মাখা চোখে অশ্রুরেখা ভেসে উঠছে। নারীজাতির অন্যতম সমস্যা। উনিশ থেকে বিশ হলেই কেঁদে ভাসানো। আচ্ছা এই মেয়েটির বয়স কত হবে? দাদু বলেছিলেন আঠারো। আসলেই কি তাই?
ফারদিন সুইচবোর্ড থেকে হাত সরিয়ে সোফায় বসল। কিছুটা নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,”বয়স কত তোমার?”
মেয়েটা মাথা নামিয়ে উত্তর দিল,” ষোল।”
ফারদিনের মাথায় বজ্রপাত হলো। বিস্মিত চোখে ধিক করে জ্বলে উঠল আক্রোশের আগুন। দাদু তবে মিথ্যেই বলেছিলেন। মেয়েটাকে এখন আরও বেশি বিরক্ত লাগছে তার। শেষমেষ কি-না বাল্যবিবাহ করতে হলো? বাল্যবিবাহ?
ফারদিন গলা ঝেড়ে ক্রোধান্বিত স্বরে বলল,” তুমি এই ঘরে থাকতে পারবে না। বের হয়ে যাও।”
মেয়েটা চ’মকাল। কিছুই বুঝতে না পারা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল ফারদিনের দিকে। একটু পর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,” থাক, লাইট নিভিয়ে দিন। অন্ধকারেই আমি ঘুমাবো। সমস্যা হবে না কোনো।”
ফারদিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অতি নিষ্ঠুর গলায় বলল,” লাইট এমনিতেও বন্ধ হবে৷ কিন্তু তোমাকে বাইরে যেতে হবে। এই ঘরে তুমি থাকতে পারবে না।”
অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মেহেক। মানুষটা কি বলছে এসব? নতুন বউকে বুঝি কেউ এইভাবে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলে? সে আমতা-আমতা করে কোনমতে বলল,” কিন্তু বাইরে তো অনেক মানুষ। আমি পাশের ঘরে গেলে যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে, তখন তাদের কি উত্তর দিবো?”
” সত্যি কথাই বলবে। তোমাকে আমার পছন্দ হয়নি তাই ঘর থেকে বের করে দিয়েছি। পারবে না বলতে?”
প্রায় কান্না পেয়ে গেল মেহেকের। এমন বদ স্বভাবের একটা মানুষ তার স্বামী? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
ফারদিন রুক্ষ স্বরে বলল,” বাচ্চা-কাচ্চার মতো কেঁদে কোনো লাভ নেই। সময় নষ্ট না করে আমার বিছানা ছাড়ো। আমাকে ঘুমাতে হবে। প্রচন্ড ক্লান্ত আমি। সারারাত তোমার সাথে বসে তামাশা করার সময় নেই।”
মেয়েটি অভিমানী চোখে তাকাল। লোকটা এমন তিতা তিতা কথা বলছে কেন? দেখতে তো খুব মিষ্টি। ওই সুন্দর মুখের সাথে এমন কটূ কথাগুলো একটুও মানাচ্ছে না।
মেয়েটা মুখ অন্ধকার করে বিছানা থেকে তার শাড়ির ব্যাগ তুলে নিল। শাড়িটা তাকে রাতে পরার জন্য দেওয়া হয়েছিল। ফারদিন জহুরি চোখে মেয়েটাকে দেখল একবার। মোটামুটি লম্বাই বলা যায়। শাড়ি পরার কারণে তাকে স্বাস্থ্যবতী মনে হলেও সত্যিকার অর্থে সে বেশ রোগা-পাতলা। এর আগে ফারদিন ছবিতে দেখেছিল। সামনা-সামনি কখনও দেখা হয়নি তাদের। মেয়েটাও হয়তো ফারদিনকে এই প্রথমবার দেখছে। মেয়েটি যে ছবির চেয়ে বাস্তবে দেখতে বেশি সুন্দর এতে সন্দেহ নেই।
ফারদিন কাছে এসে বলল,” এই বিয়েতে আমার সম্মতি ছিল না। এটা কি তুমি জানতে?”
মেয়েটি হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ফারদিন বিস্ময় নিয়ে বলল,” তবুও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলে কিভাবে?”
ষোড়শী নিশ্চুপ। ফারদিন কাঠখোট্টা গলায় বলল,” কথা বলো। ইডিয়েট নাকি তুমি?”
” আমার আব্বার কথায় রাজি হয়েছি।”
” বাহ, তোমার আব্বা বলল আর তুমিও একটা অপরিচিত ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে?”
” বিয়ে তো অপরিচিত’র মধ্যেই হয়, তাই না?”
” তুমি জানো আমি যে তোমার থেকে দশ বছরের বড়?”
মেয়েটা অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,”জানি। আমার আব্বা আম্মার চেয়ে পনেরো বছরের বড় ছিলেন। তাদেরও তো বিয়ে হয়েছে৷”
” সেটা অনেক আগের কথা। এখনকার দিনে এসব হয় না৷ তাছাড়া বয়সের এতো পার্থক্য থাকা মানে বিরাট ব্যাপার। আমার অনেক কিছুই তোমার পছন্দ হবে না।”
” কিন্তু আমার তো আপনাকে পছন্দ হয়েছে!”
কথাটা বলেই মাথা নিচু করে রইল মেয়েটি। তার নির্লিপ্ত জবানবন্দীতে ফারদিন থতমত খেল। গ্রামের মেয়ে বলে তাকে সহজ, সরল আর বোকা ভেবেছিল ফারদিন। কিন্তু এই মুহুর্তে মেয়েটিকে মোটেও বোকা মনে হচ্ছে না।
ফারদিন বলল,” কি যেন নাম তোমার?”
” মেহেক ইমরোজ।”
মেহেক বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফারদিন বলল,” শোনো মেহেক ইমরোজ, বাইরে কাউকে দেখলে বোলো আমার ঘরে যেনো জগভর্তি পানি রেখে যায়। আর প্রয়োজন ছাড়া তুমি এই ঘরে আসবে না।”
” ঠিকাছে ভাইয়া।”
আবারও ‘ভাইয়া’ ডাক শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকাল ফারদিন। দরাজ গলায় বলল,” কথায় কথায় আমাকে ভাইয়া ডাকবে না। শুনতে খুব উইয়ার্ড লাগে।”
” আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়। ভাইয়া না ডাকলে আর কি ডাকবো?”
” সবকিছুই তো বোঝো। তাহলে বরকে যে ভাইয়া ডাকতে হয় না, এই সামান্য কমন সেন্সটা নেই?”
মেহেক লাজুক মুখে বলল,” ঠিকাছে, এখন থেকে তাহলে বর ডাকব।”
ফারদিন বলল,”না।”
মেহেক প্রশ্ন করল,” তাহলে স্বামী ডাকি?”
ফারদিন হতভম্ব। মেয়েটা কি ফাজলামি করছে তার সাথে? সে খিটমিট করে বলল,” কিচ্ছু ডাকতে হবে না। গেট লস্ট।”
” আচ্ছা স্বামী….”
বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল মেহেক। তার আচরণে বিব্রত ফারদিন। মেয়েটা পুরো বাচ্চা। এইরকম একটা মেয়েকে যে কি বুঝে দাদু তার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন, কে জানে?
বউ পালার বয়সে একটা আস্তো বাচ্চা পালতে হবে তাকে। ব্যাপারটা ভেবেই বিরক্ত বিরক্ত লাগছে। ফারদিন তার ফোন থেকে সুজানার ছবিটা বের করল। ইশ, এই বিয়ের কথা যখন সুজানা জানতে পারবে কি হবে তখন? সে কি অনেক কষ্ট পাবে? ফারদিনও তো কষ্ট পাচ্ছে।
লাইট নিভিয়ে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিল ফারদিন। দুই চোখ জুড়ে তার রাজ্যের ক্লান্তি। কতদিন শান্তিতে ঘুমায় না সে। আমেরিকা থেকে আসার পর যখন দাদু বলল তাকে বিয়ে করতে হবে তখন থেকেই ঘুম, শান্তি সব লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। আজকে সে একটু আরাম করে ঘুমাতে চায়। অনেকদিনের ঘুম একসাথে ঘুমিয়ে নিতে হবে। আহ! ঘুমে এতো শান্তি!
চোখ প্রায় লেগেই এসেছিল ফারদিনের। মোমবাতির আবছা আলোয় মেহেক তার রূপবান স্বামীকে মুগ্ধ চোখে দেখছিল। ঘুমালে কাউকে এতো মোহনীয় লাগে বুঝি? হঠাৎ চোখ মেলে তাকালো ফারদিন। মেহেককে মোমবাতি হাতে তার মুখের উপর ঝুঁকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকতে দেখে আ’তঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মেহেক খিলখিল করে হেসে বলল,” আরে আমি মেহেক। আপনার জন্য পানি এনেছি ভাইয়া! না স্যরি, স্বামী। আপনার জন্য পানি এনেছি স্বামী।”
কথা শেষ করেই লাজুক ভঙ্গিতে কানের পেছনে চুল গুঁজল মেহেক।
ফারদিনের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে রাগী গলায় ধমক দিয়ে বলল,” লাইট জ্বালাও দ্রুত!”
মেহেক দৌড়ে গিয়ে লাইট জ্বেলে দিল। দুইশো বিশ ভোল্টের ফকফকে আলোয় ফারদিন ভালো করে দেখতে পেল মেহেককে। বেনারসি বদলে বেগুনী সুতির শাড়ি পরেছে সে। মুখে এখন কোনো প্রসাধন নেই। মেকাপ তুলে ফেলেছে। চুল খোলা। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো একপিঠ রেশমি চুলের অর্ধেকটাই সামনে আনা। যতই বড়দের মতো সাজার চেষ্টা করুক, এই মেয়েকে পুরো বাচ্চাই লাগছে দেখতে। মনে হচ্ছে সে ফারদিনের বউ নয়, ছোটবোন।
“তুমি এখানে কি করছো? আর মোমবাতি কেনো জ্বালিয়েছো?”
মেহেক মোমবাতি ফু দিয়ে নিভিয়ে বলল,” অন্ধকারে লাইট জ্বালালে আপনি জেগে যেতেন। যাতে আপনার ঘুমে ডিস্টার্ব না হয় তাই মোমবাতি নিয়ে এসেছি।”
” তাহলে মোমবাতি আমার মুখের সামনে ধরে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলে কেনো ওইভাবে?”
মেহেক এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল। ওর ওই গাঁ অদ্ভুত হাসিতে ফারদিনের মেজাজ আরও চড়ে গেল। রাগে ফেটে উঠলো। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” খবরদার হাসবে না।”
মেহেকের মুখ সাথে সাথে গম্ভীর হয়ে গেল। উফ, যদি বিয়ের আগে একবার দেখে নিতো মেয়েটিকে তাহলে ফারদিন জীবনেও বিয়েতে রাজি হতো না। এই বিয়ে তার জীবন-মরণের প্রশ্ন৷ সারাজীবন অসম বয়সী একটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে সে কাটাবে কি করে? তাদের মধ্যে বোঝাপড়াটাই বা হবে কিভাবে?
আমেরিকায় বেড়ে উঠা ফারদিনের রুচি কখনোই মেহেকের রুচির সাথে মিলবে না। বয়সের পাশাপাশি তাদের মধ্যে আরও অনেক ব্যবধান আছে। আকাশ-পাতাল ব্যবধান! তার উপর আছে সুজানা। তাকেই বা কি করে বোঝাবে ফারদিন?
মেহেক বলল,” স্বামী আপনার জন্য পানি।”
” পানি আমার মাথায় ঢালো।”
ফারদিন মাথা এগিয়ে দিল। মেহেক ভ্যাবাচেকা খেয়ে দুই কদম পিছিয়ে ফ্যাকাশে গলায় বলল,” ছি, কি বলছেন? আপনার তো ঠান্ডা লেগে যাবে স্বামী।”
” আরেকবার স্বামী ডাকলে খুব খারাপ হবে।”
মেহেক মুচকি হেসে ক্ষীণ গলায় বলল,” তাহলে কি কলিজা ডাকব?”
মেহেকের এমন রসিকতায় ফারদিন ভ*য়ংকর রেগে গেল। ভরাট কণ্ঠে সে এমন জোরে ধমক দিল যে মেহেক ভয়ে কাঁচের জগ নিয়েই কোনোমতে দৌড়ে পালালো।
বাইরে এসে বুকে হাত রেখে হাঁপাতে লাগল সে। বাপরে বাপ! এমন ভয়ংকর ধমক জীবনেও খায়নি৷ তার মেজাজি আব্বাও তাকে কখনও এমন করে ধমক দেয়নি।
ফারদিনের রাগ অনেক বেশি এই কথা বিয়ের আগেই জানতো মেহেক। ফারদিন তাদের বাড়িতে তাকে দেখতে এসেছিল। মেহেক দরজার আড়ালে লুকিয়ে দেখেছিল। প্রতি কথায় ভাবীর সাথে রাগ ঝারছিল সে। নাকের ডগা চব্বিশ ঘণ্টা লাল হয়েই থাকে। সেদিন থেকে মেহেক তার নাম দিয়েছে বোম্বাই মরিচ।
সেদিন ইচ্ছে করেই পাত্রপক্ষের সামনে যায়নি মেহেক। তার মনে হচ্ছিল সামনে গেলেই ওই রাগী বোম্বাই মরিচ তাকে চিবিয়ে খেয়ে নিবে। ফারদিনের চৌখা নাকের ডগা, সারাক্ষণ কপাল কুচকে রাখা, সরু চোখে তাকানো, এইসব দেখে মেহেকের কিশোরী মনে দামামা বাজতে শুরু করেছিল। এই কাঠখোট্টা স্বভাবের অতিরিক্ত রাগী মানুষটিকে ছোট্ট মেহেক সামলাবে কি করে?
সত্যি বলতে, প্রথম দর্শনেই মেহেক তার হবু স্বামীর প্রেমে পড়েছে। মেহেককে দরজার বাইরে কাঁচের জগ হাতে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেল তিশা। সম্পর্কে সে ফারদিনের ভাবি তবে আপন না। ফারদিনের চাচাতো ভাইয়ের বউ। মেহেকের পেছনে দাঁড়িয়ে তিশা বলল,” আরে মেহেক, তুমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
মেহেক হঠাৎ তিশার কণ্ঠ শুনে একটু চ’মকাল৷ তারপর ধাতস্থ হয়ে বলল,” আপু আপনি?”
” ভয় পেয়েছো নাকি?” হেসে ফেললো তিশা।
” আমি তোমার আপু না, ভাবি হই বুঝেছো?”
মেহেক অপ্রস্তুতভাবে মাথা নাড়ল। এই বাড়িতে কেবল এই মেয়েটির সঙ্গেই তার একটু খাতির হয়েছে। বিয়ের আগে মেয়েটি একবার তাদের বাড়ি এসেছিল৷ তাকে আংটি পরিয়ে গেছে। তিশা হাসি মুখে বলল,” তুমি বাইরে কি করছো?”
মেহেক আমতা-আমতা শুরু করল। সে উত্তর দিতে পারছে না দেখে তিশা নিজেই বলল,” ফারদিনের জন্য পানি আনতে গেছিলে?”
” জ্বী, পানি।”
আশেপাশে তাকাল মেহেক। বাড়িটা নীরব লাগছে। অতিথিরা কি চলে গেছে? মেহেক রান্নাঘর থেকে পানি আনার সময় কাউকে দেখেনি। কাজের মেয়ে লিয়া তাকে পানি ঢেলে দিয়েছে। মেহেক জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা মেহমানরা কি সব চলে গেছে ভাবি?”
” হ্যাঁ। গেস্টরা তো সেই কখন চলে গেছে। দাদুও ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমার ভাইয়াও ঘুম।”
মেহেক উৎফুল্ল হয়ে বলল,” তাহলে ভাবি, আপনি আমার সাথে চলুন। আমি আর আপনি একসাথে থাকবো।”
” মানে কি? আজকে না তোমার বাসররাত? তুমি আমার সাথে থাকবে কেন?”
মেহেক গোমরা মুখে বলল,” উনি তো আমাকে বের করে দিয়েছে ভাবি।”
” মানে কি?”
” বলেছেন আমাকে নাকি উনার পছন্দ হয়নি।”
” এগুলো কোন ধরণের কথা? আসোতো।”
রাগে ফেটে পড়ল তিশা। মেহেকের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,”ছেলেটা নাটক শুরু করেছে নাকি? নতুন বউকে কেউ বাসরঘর থেকে বের করে দেয়? এটা তো খুব অন্যায়!”
ফারদিন একটা বালিশ মাথায় চেপে ঘুমাচ্ছিল। তিশা শব্দ করে ডাকলো,” ফারদিন, এইযে দেবরসাহেব। কি হচ্ছে এইসব?”
ফারদিন চোখমুখ কুচকে দারুণ বিরক্তিসূচক কণ্ঠে উত্তর দিল,” কি?”
” তোমার বউ বাইরে কি করে?”
” আমি কি জানি কি করে?”
” মানে? নিজের বউকে ঘরে রাখতে না পারলে বিয়ে করেছো কেন?”
” বিয়ে করেছি দেখে কি এখন বউ কোলে নিয়ে বসে থাকতে হবে? আজব!”
” অবশ্যই। বউ তো কোলে নিয়ে রাখারই জিনিস। ওঠো, বউকে কোলে নাও।”
তাদের কথোপকথন শুনে মেহেক লজ্জায় গুটিশুটি হয়ে গেল। ফারদিন বলল,” এতো শখ নেই আমার।”
” এইসব বললে তো হবে না। এই বিছানা কি তোমার একার? এই রুমটা কি তোমার একার? আজকে থেকে মেহেকও সবকিছুর সমান ভাগীদার। তুমি ওকে এইভাবে বের করে দিতে পারো না।”
ফারদিন বক্র দৃষ্টিতে একবার মেহেকের দিকে তাকালো। মেহেক ভয়ে তিশার পেছনে মুখ লুকালো। তিশা অভয় দিয়ে বলল,” কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো!”
তারপর ফারদিনের উদ্দেশ্যে বলল,” দেবরসাহেব, মেহেককে তোমার বিছানায় থাকতে দাও। নাহলে কিন্তু দাদুকে ডাকবো আমি।”
” ভাবী, তুমিও শুরু করেছো? মানে আমার ঘরে কি আমার কোনো স্বাধীনতা নেই?”
” বিয়ের পর সব স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়। এটাই নিয়ম।”
” এই মেয়ে কি তোমাকে উকিল হিসেবে ভাড়া করে এনেছে?”
” ভাড়া করে আনবে কেনো? বড়বোন হিসেবে আমি ওর পাশে দাঁড়িয়েছি। বাচ্চা মেয়েটাকে একলা পেয়ে তুমি নির্যাতন করছিলে।”
” নির্যাতন কখন করলাম?”
তিশা ধমক দেওয়ার মতো বলল,” মাঝরাতে তুমি ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছো৷ এইটা কি নির্যাতন করা নয়? দাদুকে যদি এইসব একবার বলি..”
” বার-বার দাদুকে কেনো টানছো? তুমি নিজেও কি দাদুর থেকে কম? ওকে বলো আমার ঘরে আমি লাইট অফ করে ঘুমাবো। এই নিয়ে কোনো রেস্ট্রিকশন চলবে না। ওর থাকতে ইচ্ছে হলে থাকবে নাহলে চলে যাবে।”
তিশা মেহেকের দিকে তাকালো,” ও। ঝামেলাটা তাহলে লাইট নিয়ে? মেহেক, লাইট বন্ধ থাকলে তোমার কোনো প্রবলেম আছে? আসলে ফারদিন আলোর মধ্যে একটুও ঘুমাতে পারে না।
মেহেক মাথা নিচু করে না বলল। তিশা বলল,” এইতো, দেখেছো? ওর কোনো প্রবলেম নেই। লক্ষী একটা মেয়ে। শুয়ে পড়ো তোমরা। গুড নাইট। আমি তাহলে গেলাম। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে ডেকো মেহেক৷ ভয় পেয়ো না।”
” ঠিকাছে ভাবি।”
ফারদিন বিরক্তিসূচক শব্দ করে বিছানার একপ্রান্তে গিয়ে শুয়ে রইল। মেহেক দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে সন্তর্পণে ফারদিনের পাশে এসে শুলো। কিন্তু তার খুব শীত লাগছিল। এসি’র তাপমাত্রা নিশ্চয়ই বিশ এর নিচে। কাঁথা ফারদিনের কাছে। মেহেক বলতে চাইল,” আমি কি একটু কাঁথাটা নিতে পারি?”
এই কথা বলার জন্য সে যেই না মুখ খুলতে যাবে অমনি ফারদিন বলে উঠলো,” আমাকে শায়েস্তা করার জন্য ভাবিকে ডেকে এনেছো? আমি তোমাকে নির্যাতন করেছি তাই না? প্রথম দিনই এতো মিথ্যা?”
মেহেক অসহায়ের মতো বলল,” আমি কি করবো? আপনিই তো বলেছেন, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে যেনো বলি আপনি আমাকে বের করে দিয়েছেন। আমি তো ভাবিকে সেটাই বলেছি। আর আমি মিথ্যা বলিনি..”
ফারদিন ধমক দিয়ে উঠলো,” আর কোনো কথা না। কীপ সাইলেন্স।”
মেহেক মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করে গেল। শাড়ি দিয়েই কোনোমতে নিজেকে ঢেকে রাখল। খাটাশের কাছে কাঁথা চেয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে নিজের শাড়িই ভালো। ভোরবেলা ফারদিনের ঘুম ভাঙলো মেহেকের চুলের পানির ঝাপটায়। রেগে-মেগে সে উঠে বসলো।
ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে৷ এতো দ্রুত ফারদিন জীবনে ঘুম থেকে উঠেনি৷ তার ঘুম ভাঙার সময় এগারোটা কি বারোটা। আজকে এই মেয়েটার জন্য তার ঘুমটাও পরিপূর্ণ হলো না।তুমুল বিরক্তি নিয়ে ফারদিন বলল,” এই মেয়ে, তোমার সমস্যা কি?”
মেহেক নিচু গলায় বলল,” কিছু না। আপনি উঠলেন কেন? কেউ ডেকেছে আপনাকে?”
” তুমি এতো সকালে গোসল করে কি বুঝাতে চাইছো?”
” কি বুঝাবো আবার?আম্মা বলেছে তাই আমি গোসল করেছি। এখানে এতো ধ’মকানোর কি আছে? নাকি আপনার বাড়িতে আপনার অনুমতি ছাড়া গোসলও করা যাবে না?”
ফারদিন অবাক! মেয়েটা কি ফটাফট কথার জবাব দিচ্ছে। একে দেখতে সোজা-সরল মনে হয়, ততটা সোজা-সরল এই মেয়ে না!
” তোমার আম্মা তোমাকে বলেছে এতো সকালে গোসল করতে?”
” হুম। বিয়ের পর তো মেয়েদের সকালেই গোসল করতে হয়। আপনি কি কিছুই জানেন না?”
এই কথা বলে মেহেক নির্বিকার ভঙ্গিতে চুল ঝারতে লাগল। পানির ঝাপটা ফারদিনের নাকমুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। ফারদিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে কাছে এনে দুইটা থাপ্পড় লাগাতে। এমন ফালতু কাজ করার জন্য সে অবশ্যই দুইটা থাপ্পড় ডিজার্ভ করে।
দরজায় করাঘাত হচ্ছে। ফারদিন আগের মতো কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো আবার। যে-ই আসুক, সে তাকাবে না। তিশা ঘরে ঢুকেই মেহেককে উদ্দেশ্য করে বলল,” ওয়াও, তোমাকে সুন্দর লাগছে মেহেক। গোসল করেছো নাকি?”
মেহেক মাথা নাড়ল। তিশা বলল,”ঠিকাছে, তুমি ডাইনিং রুমে যাও। নাস্তা দেওয়া হবে। আমি আসছি।”
” আচ্ছা ভাবি।”
সে চলে যেতেই তিশা বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো।গলা পরিষ্কার করে কাশি দিল। যেই কাশির অন্য নাম এটেনশন। ফারদিন তাকাল না। ঘুমের ভাণ ধরে পড়ে রইল। সে নিশ্চিত ভাবি এখন তাকে টিজ করবে। সেটাই হলো।
তিশা সামান্য ঝুঁকে এসে বলল ,” কি ব্যাপার দেবরসাহেব? বাচ্চা মেয়েটাকে সকাল সকাল গোসল করিয়ে ছাড়লে? অথচ রাতে তো ঘর থেকেই বের করে দিচ্ছিলে।”
ফারদিন বিব্রত গলায় বলল,” ভাবি, তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই না।”
” আরে লজ্জার কিছু নেই। এমন সুন্দর দেখতে মিষ্টি একটা বউ পাশে শুয়ে থাকবে আর তুমি তাকে ছুঁয়েও দেখবে না… এটা তো সাধু-সন্ন্যাসীর পক্ষেও অসম্ভব। ”
” ভাবী বিশ্বাস করো, সারারাত আমি ঘুমানো ছাড়া অন্যকিছুই করিনি। ”
তিশা হাসিতে ভে★ঙে পড়ল। ফারদিন অসহায়বোধ করছে। পাশাপাশি রাগও হচ্ছে ব্যাপক। কি আশ্চর্য, কিছু না করেও সে আসামি হয়ে গেছে। ওই পাকনা মেয়ে শুধু দুইটা না, দশটা চড় ডিজার্ভ করে। অসহ্য!
#অনপেখিত
#পর্ব_১
Sidratul Muntaz