#প্রিয়তোষ
পর্ব ১৯
লিখা Sidratul Muntaz
নোরা অনিককে অনেকক্ষণ ধরে ফোন করছে। অনিক ফোন ধরছে না। নোরার রাগ লাগছে। এতোবড় একটা ডিসিশন অনিক ওকে না জানিয়ে কি করে নিতে পারল? সে জবাব চাইবে অনিকের কাছে। আরো কয়েকবার রিং হওয়ার পর অনিক ফোন ধরে খুব বিনীত গলায় বলল” হ্যালো!”
নোরার রাগান্বিত কণ্ঠ, ” এতোক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি ফোন ধরছিলে না কেন?”
” সরি। পাশের রুমে শার্ট ইস্ত্রি করছিলাম। ফোনটা সাইলেন্ট ছিল তাই..”
” বাদ দাও। আগে বলো তুমি আমাদের ভার্সিটি থেকে রিজাইন কেন করেছো?”
” চাকরিটা আমার আর দরকার নেই তাই।”
” দরকার নেই মানে? এতো ভালো চাকরি কেন দরকার নেই? নতুন চাকরি পেয়েছো?”
” না, এখনও পাইনি।”
” তাহলে কেন ছাড়লে চাকরিটা?নাকি আমার মুখ দেখতে চাওনা?”
” ছি নোরা! এইটা কি ধরণের কথা? আমি তোমার মুখ দেখতে চাইবো না?”
” তাহলে চাকরি কেন ছাড়লে?”
” আমি চাইনা তোমার আমার মধ্যে শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্কটা আর থাকুক। এজন্যই তো মা তোমাকে অপমান করার সুযোগ পেয়েছিল।”
” মানে? তুমি এই সামান্য কারণে এতো ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিলে?”
” সামান্য কারণ না নোরা। এটা আমার কাছে অনেকবড় কারণ। তোমার অপমান মানে আমার অপমান। আমি চাইনা এই বিষয়টা নিয়ে আর কখনো তোমাকে কারো কাছে অপমানিত হতে হোক। অন্তত আমি সেটা টলরেট করবো না।”
নোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,” বুঝেছি। শার্ট ইস্ত্রি করছিলে কেন? কোথাও যাচ্ছো?”
” হ্যাঁ। আজ একটা চাকরির ভাইবা আছে। খুব ভালো চাকরি। ভাইবাতে পাশ করলেই কনফার্ম হয়ে যাবে। স্যালারি চল্লিশ হাজার টাকা। দোয়া করো।”
” ওয়াও! নিশ্চয়ই দোয়া করি। কখন ইন্টারভিউ? ”
” আজ সন্ধ্যায়।”
” সন্ধ্যায়? কোন জায়গায়?”
” বসুন্ধরাতে।”
” আজকে তো বসুন্ধরাতে আমারও যাওয়ার কথা।”
” তাই? কেন?”
” আজকে অর্পি আপুর মেহেন্দী। বসুন্ধরার কোনো এক রেস্টুরেন্টে আয়োজন করা হয়েছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যাবো না।”
” যাবেনা কেন? যাও, ঘুরে এসো। কাজিনদের সাথে থাকলে ভালো লাগবে।”
” হুম। এখন ভাবছি যাবো। আসার সময় তুমি আমাকে ড্রপ করে নিতে পারবেনা?”
” অবশ্যই। এটা তো আমার সৌভাগ্য।”
নোরা হেসে বলল,” অনেকরাত হবে কিন্তু।”
” কতরাত?”
” বারোটার উপরে বাজতে পারে।”
” সমস্যা নেই। আমার ইন্টারভিউ হয়তো নয়টা নাগাদ শেষ হয়ে যাবে। তারপর আমি তোমাকে ফোন করবো। তুমি এ্যাড্রেস দিও, আমি সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করবো।”
” আচ্ছা ঠিকাছে, রাখছি তাহলে।”
” আচ্ছা।”
ফোনটা রেখেই অনিক মুচকি হাসল। আজ অনেকদিন পর নোরার সাথে বাইকে চড়ার সুযোগ হচ্ছে। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে? সন্ধ্যায় নোরা মেহেন্দির অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য খুব সুন্দর করে সাজল। কালো রঙের একটা গর্জিয়াস সেলোয়ার কামিজ, মুখে মেকাপের প্রলেপ,খোলা লালচে চুলগুলো কার্ল করে একসাইডে আটকানো। নিজের রুপে নিজেরই মুগ্ধ হতে ইচ্ছে করছে। এই অবস্থায় অনিকের সামনে গেলে কি হবে? অনিক তো গাধার মতো তাকিয়ে থাকবে। আর সেই তাকানো দেখে নোরা লজ্জারাঙা হবে।
নোরা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেই হাসছিল। হঠাৎ অনিকের ফোন এলো। নোরা ফোন ধরে বলল,” হ্যালো!”
” বের হয়েছো?”
” না। রেডি হচ্ছি। আর এখন তোমার সাথে যেতে পারবো না। আমাকে বাবা নিয়ে দিয়ে আসবে। আসার সময় তোমার সাথে আসবো।”
” ওহ। তাহলে কি আমি চলে যাবো?”
” হুম চলে যাও।”
” আচ্ছা, সাবধানে যেও।”
” আচ্ছা।”
অনিক ইন্টারভিউরুমের সামনে অপেক্ষা করছে। জায়গাটায় প্রচন্ড ভীড়। তার পরনে আকাশী রঙের ফরমাল শার্ট আর কালো রঙের ফরমাল প্যান্ট। নেভি ব্লু রঙের টাই। শার্টের হাতা ফোল্ড করা। হাতে খয়েরী মোলাটের একটা ফাইল। বামহাতে এ্যাশ কালার ঘড়ি। হাতে সাদা টিস্যু। বারবার ঘেমে যাচ্ছে সে। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম টিস্যুতে মুছছে। ভীড়ের মধ্যে বসে থাকতে তার গরম লাগছে। এতো গরমেও মানুষ বসে বসে চা খাচ্ছে। তার উপর একটু পর পর দাড়োয়ান ওর কাছে ডিশে করে চা নিয়ে আসছে। প্রায় বারবার জিজ্ঞেস করছে,” চা খাইবেন স্যার?”
অনিক কয়েকবার ভদ্রভাষায় না করেছে। কিন্তু লোকটা নাছোরবান্দা। যেন চা খাইয়েই ছাড়বে। আরো একবার জিজ্ঞেস করতে এলো,” স্যার দেই এককাপ চা?”
অনিক এবার জবাবই দিলনা। কিন্তু তার বলতে ইচ্ছে করছিল,” কাছে এসো, চা তোমার মাথায় ঢালি।”
অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। অনিকের সিরিয়াল এখনো আসেনি। ঘড়িতে নয়টা বাজতে চলল। আর কত? যেখানে এক পোস্টের জন্য এতো মানুষ ডাকা হয়েছে সেখানে তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বললেই চলে। টাই লুজ করে পা মেলে বসল৷ তার সবকিছু অসহ্যবোধ হচ্ছে।
প্রায় দেড়ঘণ্টা পর যখন রাত সাড়ে দশটা বাজে তখন জানা গেল ইন্টারভিউয়ের যে মেইন অফিসার, মিঃ শফিকুল মোর্শেদ এখনো আসেন নি। অনিকের এতো মেজাজ খারাপ হল! ইচ্ছে করল সবকিছু ভেঙে ফেলতে। এমন হলে সে নোরার কাছে যাবে কখন? অনিকের মাথা ধরে আসছে।
কিছুক্ষণ পর জানা গেল, মোর্শেদ সাহেব মাত্র প্রবেশ করেছেন। চারদিকে হৈচৈ বেঁধে গেল। ইন্টারভিউয়ের কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। কোর্ট পড়া ভদ্রলোক হাসিমুখে ভেতরে যেতে যেতে বললেন,” সরি, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছি। আসলে রাস্তায় এতো জ্যাম!”
অনিকের এই কথাটাও বিরক্ত লাগল। সবার প্রথমেই তার নাম ডাকা হল,” মিঃ অনিক আবেদিন।”
অনিক ইন্টারভিউ রুমে যখন ঢুকবে তখন রাত এগারোটা বাজে। আর তখনি নোরার ফোন আসল। অনিক ফোনটা কেটে দিয়ে ম্যাসেজ করল,” আধঘণ্টা অপেক্ষা করো, আমি আসছি। তুমি আমাকে এ্যাড্রেস সেন্ড করে রাখো। আর রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার দরকার নেই, ভিতরেই থাকো। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।”
এদিকে নোরা অলরেডি বের হয়ে গেছে। সে খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়েই অনিককে ফোন করছিল। অনিকের ম্যাসেজ দেখে সে আবারও ফোন করতে লাগল। কিন্তু অনিক ফোন সাইলেন্ট করে পকেটে রেখে দিয়েছে।
নোরার যে কি বিরক্ত লাগছে। সম্পুর্ণ রাস্তায় সে শুধু একা। ঘোর অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। বাসে যে উঠবে তারও উপায় নেই। বাস পাওয়া যাচ্ছেনা। তার ফোনে ইন্টারনেটও নেই যে একটা উবার কল করবে। অনিকের জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব না। আবার একা একা বাড়ি ফিরে যাওয়াও সম্ভব না। ভীড় বাসে ওরা মহিলা উঠাতে চায়না।
খালি বাসে উঠতে নোরার নিজেরই ভয় লাগে। মোটামোটি ভীড় কম আর সম্পুর্ণ খালিও না এমন বাস পাওয়া যাচ্ছে না। কি একটা মুশকিল। নোরা রাস্তার একপাশ দিয়ে হাটতে লাগল৷ হঠাৎ নোরার মনে হল কেউ তাকে ফলো করছে। তার পেছনে তিনজন মুখোশধারী ছেলে। ওদের দেখে নোরার ভেতরটা শিউরে উঠল। ওরা কি নোরাকেই ফলো করছে। নোরা জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। একবার তার মনে হল ছেলেগুলো আলভী,শিপন আর আরিফ। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল না। আলভীরা তো ভালো হয়ে গিয়েছিল। ওরা এমনকাজ করবেনা।
তারপর আবার মনে হল কুকুরের লেজ কোনোদিন সোজা হয়না। নোরা বুকের মধ্যে জোরালো ধাক্কা অনুভব করল। নিজের অজান্তেই সে কখন জানি দৌড়াতে শুরু করে দিয়েছে। ছেলেগুলো এখন আর ওর পেছনে আসছে না। নোরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অনিককে আবার ফোন করা শুরু করল। অনেকবার ফোন করল। কিন্তু নো রেসপন্স।
নোরা ফোনটা ব্যাগে ভরে আবার হাটতে লাগল। সামনেই একটা সিএনজি পেয়ে গেল। নোরা ভাবল সিএনজি করেই চলে যাবে। সিএনজিওয়ালার সাথে কথা হল৷ সিএনজিওয়ালা ওকে নিয়ে যেতে রাজি হল। নোরা সিএনজিতে বসে ক্রমাগত দোয়া পড়ছে। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। বাবাকে কি একটা ফোন করবে? বাবা এইসময় প্রেশারের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। কি দরকার এই অবস্থায় বাবাকে জ্বালানোর?
মাকেও টেনশন দিতে ইচ্ছে করছে না। সে তো সবাইকে বলে এসেছিল অনিকের সাথে ফিরবে। কিন্তু সেই অনিকেরই এখন খোঁজ নেই। হঠাৎ সিএনজি ওয়াল একটা নীরব জায়গায় গাড়ি থামাল। নোরা জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে?”
” বুঝতাসি না। টায়ার পাংচার হইসে মনে হয়। চেঞ্জ করতে হইবো।”
” হায় হায় কি বলেন? কতক্ষণ লাগবে?”
” বেশিসময় লাগবো না। অপেক্ষা করেন।”
সিএনজিওয়ালা একথা বলে কোথায় যেন চলে গেল। নোরার এখন সন্দেহ হচ্ছে। এটা কোনো ফাদ নয়তো? ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে আরো কয়েকবার অনিককে ফোন করল। বাবার নম্বরেও ডায়াল করল। মাকেও করল। কিন্তু কেউই আজ ফোন ধরছেনা।
হঠাৎ নোরা খেয়াল করল সেই মুখোশধারী তিনজন তাকে তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। নোরা ভয়ে শব্দ করতে যাবে তার আগেই ওর মুখ চেপে ধরা হল। নোরার হাত-পা ভয়ে শিথিল হয়ে আসছে৷ তাকে কোথায় তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে নিজেও জানেনা।
ইন্টারভিউ শেষ করে বাহিরে বের হল অনিক। ফোনটা হাতে নিতেই দেখল নোরার অনেকগুলো মিসডকল। অনিকের খোটকা লাগল। কোনো বিপদ হয়নি তো? জলদি কলব্যাক করল। কিন্তু এবার নোরা ফোন ধরছে না। অনিক কলব্যাক করতেই লাগল। শুধু রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে। অনিকের অস্থির লাগতে শুরু করল। ফোনটা রিসিভ হল অনেকক্ষণ পর। অনিক বিচলিতগলায় বলল,” নোরা, কোথায় তুমি?”
নোরার ভাঙা ভাঙা কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। নোরার এমন কণ্ঠ শুনে অনিকের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। অনিক বলল,” হ্যালো নোরা, কি হয়েছে তোমার? তুমি কোথায় আছো আমাকে বলো!”
নোরা অস্পষ্টভাবে বলল,” গ্রীন, গ্রীন সাইনবোর্ড,গ্রীন সাইনবোর্ড,ভ্যাসলিনের এড। তাসনিয়া ফারিনের।”
নোরা প্রত্যেকটা শব্দের শেষে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। অনিক যেটুকু বুঝল, নোরা এমন একটা জায়গায় আছে যেখানে গ্রীন সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে ভ্যাসলিনের এড দেওয়া। আর মডেল তাসনিয়া ফারিন। অনিক ফোন কাটল না। লাইনে থেকেই বাইক চালানো শুরু করল। নোরাদের বাসার দিকে যেতে লাগল। পথে নিশ্চয়ই কোথাও গ্রীন সাইনবোর্ড দেখা যাবে। অনিক বাইক চালাচ্ছে আর বলছে, ” নোরা তুমি প্লিজ কথা বলতে থাকো। ফোন কেটো না নোরা আমি আসছি। খুব জলদি আসছি।”
নোরা এখনও আর্তনাদের শব্দ করছে। প্রতিটা শব্দ অনিকের বুকের মধ্যে আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো দপদপ করে জ্বলছে। অনিক দিশেহারার মতো বাইক চালাচ্ছে। একটা সময় থেমে গেল। দেখল বিশাল সাইনবোর্ড। জায়গাটা একদম নিরব। নোরার বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে। অনিক বাইক ছেড়ে দিল। এতো জোরে ছাড়ল যে বাইকটা কাত হয়ে পড়ে গেল। অনিকের সেই হুশ নেই।
সে উন্মাদের মতো আশেপাশে নোরাকে খুঁজছে। হঠাৎ দেখল ঝোপঝাড়ের নিচে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে এক নিথর দেহ। অবস্থা ক্ষত-বিক্ষত। অনিক স্তব্ধ হয়ে গেল। অনুভূতিশুন্য চাহনি নিয়ে ধীরপায়ে হেলতে দুলতে এগুতে লাগল। মেয়েটা যেন তার নোরা না হয়। এই কামনাই মনে মনে পুষছে সে।কাছে যেতেই বুঝতে পারল মেয়েটা নোরা!
অনিকের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে। বুকের ভেতরটা নিভু নিভু করছে। নোরার গালে হাত দিয়ে কয়েকবার ডাকল,” নোরা, এই নোরা, নোরা!”
নোরার কোনো সাড়াশব্দ নেই। অজ্ঞান হয়ে গেছে হয়তো। কি হয়েছে ওর সাথে? খুব ভয়ানক কিছু? অনিকের মাথা ফেটে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে নোরাকে কোলে তুলল সে। নোরার শরীর থেকে রক্তের স্রোতধারা বাহিত হচ্ছে।
অনিক ওকে নিয়ে দৌড়াতে লাগল। একটা গাড়ি, শুধু একটা গাড়ি এখন তার খুব প্রয়োজন। কিন্তু দেশে এমন কোনো স্বহৃদয়বান নেই, যে তার ধর্ষিতা প্রেমিকাকে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে হসলিটাল পর্যন্ত পৌছে দিবে। তাকে বাচতে দিবে। ধর্ষিতাদের কি আদৌ বাচার অধিকার আছে?
অনিক চিৎকার করে গাড়ি খুঁজতে লাগল৷ বাইকে নোরাকে উঠানো যাবেনা। এই অবস্থায় নোরা বাইক থেকে পড়ে যাবে। কেউ তাদের নিতে চাইছে না। যেই আসছে সেই-ই চলে যাচ্ছে। যেন পালিয়ে বাচতে চাচ্ছে। রাস্তায় একটা মানুষও নেই। কি করবে অনিক? তারপর একটা বয়োবৃদ্ধ রিকশাওয়ালার দেখা পেল। রিকশাওয়ালা নির্দ্বিধায় ওদেরকে রিকশাতে তুলে নিল। অনিক নোরাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বারবার বলছে,” কিচ্ছু হবে না নোরা, এইযে আর একটু।”
রিকশাওয়াল ওদের কাছাকাছি একটা হসপিটালে নামাল। অনিকের রিকশা ভাড়া দেওয়ার কথা মাথায় ছিলনা। সে নোরাকে কোলে করে হসপিটালে ঢুকে গেল। রিকশাওয়ালাও আর ডাকলেন না। মনে মনে দোয়া করতে লাগলেন, মেয়েটাকে যেন বাঁচানো যায়।
টানা সাতদিন অবজারভেশনে রাখার পর নোরা রেসপন্স করতে শুরু করল। হিতাহিতজ্ঞান ফিরে পেল। এতোদিন অনিক শুধু পাগলের মতো খুঁজে যাচ্ছে আলভী,শিপন আর আরিফদের। যদিও নোরা মুখে ওদের নাম নেয়নি। কিভাবে নিবে? সে তো কথা বলার মতো অবস্থাতেই ছিলনা। তবুও অনিক নিশ্চিত এই দুর্ঘটনার পেছনে ওরাই আছে।
পুলিশ অপেক্ষা করছে নোরার জ্ঞান ফেরার। ওর সাথে সাথে কথা না বলে তেমন কোনো স্টেপ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তবে অনিক একা হাতেই সব সামলাচ্ছে। সে অনেক জায়গায় খোঁজ লাগিয়েছে। এই ঘটনার পর থেকে ওই তিনজন একেবারে নিখোঁজ। সেদিনের পর থেকে ওদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। নোরার বাবা আনিস প্রথমদিনই স্ট্রোক করে বসেন। এখন তিনি হসপিটালে ভর্তি।
লীরার শরীরও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সারাক্ষণ খালি কান্নাকাটি করে। হসপিটালেই দিনযাপন করছেন উনি। অসুস্থ মেয়ে আর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে। লীরা হসপিটালের করিডোরে হাঁটাহাটি করছিলেন। হঠাৎ খবর এলো নোরার জ্ঞান ফিরেছে।
এতোদিন অপেক্ষার পর এমন একটা সুসংবাদ পেয়ে লীরা সবার আগে অনিককে ফোন দিলেন। অনিক আধঘণ্টার মধ্যে হসপিটালে হাজির হলো। অনিক কেবিনে ঢুকতেই দেখল নোরার নিস্তব্ধ দুটি চোখ। তার ভেতরটা কেঁদে উঠতে চাইল। অচিরেই চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে উঠল। সে এক শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি। লীরা অনিককে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। অনিকের কাছে গিয়ে বললেন,” বাবা, মেয়েটা তো কথা বলছে না। কতক্ষণ ধরে চেষ্টা করলাম। একটা শব্দ পর্যন্ত করল না। শুধু চেয়ে থাকে। কিচ্ছু বলেনা। ও কি আর কোনোদিন কথা বলবে না বাবা?”
অনিক সঙ্গে সঙ্গে বলল,” কথা বলবে আন্টি। নিশ্চয়ই কথা বলবে। ওকে কথা বলতেই হবে।”
লীরা কাঁদতে কাঁদতে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। মেয়ের এ অবস্থা উনার সহ্য হচ্ছেনা। অনিক নোরার পাশে গিয়ে বসল। ওর হাতটা ধরে সেই হাতে একটা চুমু দিল। তার ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও শপথ করছে, নোরার এ অবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের উপযুক্ত শাস্তি সে দিয়েই ছাড়বে। এ পর্যন্ত কয়বার যে অচেতন নোরার হাত ধরে এ শপথ করেছে সে তার হিসেব নেই। আজ আবারও করল।
নোরার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদুগলায় ডাকল,” নোরা, এই নোরা। কথা বলবে না নোরা? আমার সাথেও কথা বলবে না? অবশ্য না বলাটাই তো স্বাভাবিক। তোমার এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। শুধু আমিই। সেদিন ইন্টারভিউটা যদি না দিতে যেতাম তাহলে হয়তো আজও তুমি সুস্থ থাকতে, স্বাভাবিক থাকতে। আমার উপর ভরসা করেই তো তুমি রাতেরবেলা বাসা থেকে বের হওয়ার সাহস দেখিয়েছো, অথচ সেই আমিই তোমার হাতটা ধরতে পারলাম না।
যখন তোমার আমাকে সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল। তখনি তোমার কাছে আমি পৌঁছাতে পারলাম না। পৌঁছালাম কখন? সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর। খুব ভালো হতো যদি মানুষের আগে থেকে ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা থাকতো। বিশ্বাস করো নোরা আমি যদি কোনোভাবে খালি একবার জানতে পারতাম তোমার সাথে এতোবড় একটা অন্যায় হতে যাচ্ছে তাহলে কক্ষনো তোমাকে একা ছাড়তাম না। সারাখন পাহাড়া দিয়ে রাখতাম। চুলোয় যাক আমার চাকরি, চুলোয় যাক ইন্টারভিউ। কিচ্ছু পরোয়া করতাম না। সেই চাকরিটা আমি ঠিকই পেয়েছিলাম জানো নোরা।
তিনদিনের মাথাতেই লেটার এসেছিল। যখন তুমি হসপিটালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিলে আর সেজন্য দায়ী আমার ওই ইন্টারভিউ, ওই চাকরি। আমার কি মাথা ঠিক থাকার কথা? আমি লেটারটাকে কুচি কুচি করে কাটলাম। তারপর ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম। কোনোদিন করবো না ওই চাকরি আমি। কোনোদিন না। যে চাকরির জন্য আমার তোমাকে হারাতে হয়, এমন চাকরি আমার দরকার নেই। আমার শুধু তোমাকে দরকার নোরা। বড্ড দরকার। তোমার আগের সেই চঞ্চলতা, সেই উচ্ছ্বাস,তোমার হাসিমাখা মুখ সবকিছু আমার দরকার। কতদিন হয়ে গেছে তোমার কণ্ঠস্বর শুনিনা। একবার কথা বলো না নোরা প্লিজ! আমি আর পারছি না। এরপর তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো। প্লিজ কথা বলো না নোরা প্লিজ।”
অনিক খানিক চুপ মারল। তার গলা ভেঙে আসছে। বুকের মধ্যে তীব্র এক ব্যথা অনুভব হচ্ছে। চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর আবার বলল,” কষ্ট পেও না নোরা। সবকিছু আমি ঠিক করে দিবো। আবার আগের মতো। যারা তোমার সাথে এই অন্যায় করেছে তাদেরকে তোমার পায়ের সামনে এনে ফেলবো ওয়াদা করছি। তুমি নিজহাতে ওদের শিরচ্ছেদ করবে। ”
নোরা হঠাৎ মৃদু হাসল। অনিক নোরার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে একটা গভীর চুমু দিয়ে বলল,” আসছি, অনেক কাজ আমার। তুমি রেস্ট নাও। বাই।”
নোরা কিছু বলল না। হাসিমাখা মুখ বজায় রাখল। অনিক দরজার বাইরে গিয়ে লীরার সাথে কি যেন কথা বলছে। নোরা সেদিকে কর্ণপাত করলনা। সাতদিন আগের ঘটনাগুলো ওর আবার মনে পড়ছে। শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে। হাত-পা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সারাদিন নোরা একটাও কথা বলেনি।
সন্ধ্যায় আবার লীরা ফোন করে জানাল নোরা কথা বলছে, আর অনিকের সাথে কথা বলতে চাইছে। অনিক নিজের ঘরে শুয়ে ছিল৷ এই খবর শুনে জলদি উঠে তৈরি হতে লাগল হসপিটালে যাওয়ার জন্য। নোরা তার সাথে কথা বলতে চাইছে। এরচেয়ে ভালো সংবাদ এই মুহুর্তে আর কিচ্ছু হতে পারেনা। হঠাৎ দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। অনিক দরজা খুলে দেখল মা এসেছে। অনিক কোনো বলল না। দরজাটা খোলা রেখে শার্ট পড়তে লাগল। ইলোরা বললেন,” কোথাও বের হচ্ছিস নাকি?”
” হুম।”
” যাচ্ছিস কোথায়?”
” কাজ আছে।”
” আমি জানি তো কি কাজ।”
অনিক বিরক্তগলায় বলল,” জানলে ভালো। এতো প্রশ্ন করছো কেন?”
” তোর সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”
” পরে শুনবো।”
” এখনি শুনতে হবে।”
অনিক উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল। ইলোরা জোরগলায় ডাকলেন,” অনিক!”
অনিক থামল এবং দ্বিগুণ বিরক্তিমাখা গলায় বলল,” কি?”
ইলোরা ছেলের সামনে এসে ওর কাধে হাত রেখে বললেন,” বোস এখানে।”
” মা আমার তাড়া আছে। আমাকে যেতে হবে। পরে এসে শুনবো তোমার কথা।”
” তোকে আমি বসতে বলেছি।”
ওদের চেচামেচির শব্দে আনিকা ছুটে আসল। ইলোরা আনিকাকে দেখে কিছু বললেন না। অনিকের দিকে তাকিয়ে বললেন,” আজ তিথিকে আমি আংটি পরিয়ে এসেছি। এ মাসের মধ্যেই তোদের বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই।”
অনিক ভ্রু কুঁচকে বলল,” হোয়াট?”
একই সাথে আনিকাও বলল,” মানে?”
ইলোরা ছেলে-মেয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন,” এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি কি আমার ছেলেকে সারাজীবন অবিবাহিত রাখবো নাকি? তার উপর বয়সও বেড়ে যাচ্ছে। আর কিছুদিন পরেই সাতাইশে পা রাখবে৷ এই বয়স বিয়ে করার জন্য যথার্থ।”
অনিক কিছু বলতে পারলনা। তার প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে সামনে থাকা কাচের জগে একটা জোরে ঘুষি মারতে। জগটা ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। আর তার হাত হবে ক্ষত-বিক্ষত। এতেই যেন শান্তি লাগবে। আনিকা বলল,” মা তুমি এই কথা এখন কিভাবে বলছো? পরিস্থিতি কি তোমার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে? নোরার এই ভয়ংকর অবস্থা, ভাই কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কোনো ধারণা নেই তোমার? ছেলেটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখো মরার মতো বেঁচে আছে।”
ইলোরা বললেন,” আমি আমার ছেলেকে দেখেছি। আর সেজন্যই বলছি, ওর ভালোর জন্য বলছি। কোনো ধর্ষিতা মেয়েকে নিশ্চয়ই আমি বাড়ির বউ করবো না! তাহলে শুধু শুধু অপেক্ষা করে লাভ কি? কার জন্য অপেক্ষা? তিথির সাথে বিয়েটা হয়ে যাক!”
আনিকা কপালে হাত ঠেঁকাল। সে কাকে কি বুঝাচ্ছে? ইলোরা আবার বললেন,” অনিক ধর্ষকদের খুজে বের করতে নোরাকে সাহায্য করছে তো করুক। আমার তো সেটা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। ধর্ষকরা ধরা পড়লে উপযুক্ত শাস্তি পাবে এটাই তো অনিক চায়। কিন্তু তার জন্য বিয়েটা আটকে থাকবে কেন? আগে বিয়েটা হয়ে যাক তারপর..”
অনিক হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে রাগে ফুসতে ফুসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ইলোরা পিছু ডাকলেন, অনিক শুনল না। আনিকা মায়ের কাছে হাতজোড় করে বলল,” মাফ চাই তোমার কাছে। দয়া করে ছেলেটাকে একটু শান্তি দাও।”
তারপর সেও ঘর থেকে বের হয়ে গেল। অনিক হসপিটালে গিয়ে দেখল পুলিশের সাথে নোরা কথা বলছে। এইটা দেখে সে আর ভেতরে ঢুকল না। নোরা সেদিনরাতের ঘটনা পুলিশের কাছে বর্ণনা করছে। সে এখন ভেতরে গেলে নোরা অপ্রস্তুতবোধ করবে। হয়তো সবকিছু বলতেও চাইবে না।
অনিক বাহিরে দাঁড়িয়েই সবটা শোনার চেষ্টা করল। যেটুকু শুনল তার ব্যাখ্যা এই, ওরা তিনজন ছিল। আর তিনজনই মুখোশধারী। মাঝরাস্তায় সিএনজি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ওরা নোরাকে সিএনজি থেকে তুলে নেয়। নোরার ধারণা সিএনজিওয়ালাও এর সাথে যুক্ত। পুলিশরা সিএনজির বর্ণনা চাইলেন।
নোরা অস্পষ্ট বর্ণনা দিল। ছেলেগুলো ওকে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে প্রথমেই হাত-পা বাধল। নোরা ততক্ষণে কাবু হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকারে তিনজনই মুখোশ খুলেছিল তবে চেহারা দেখা যায়নি। কিন্তু কণ্ঠ শুনে যতটুকু বুঝেছে, ওরা আলভী,শিপন আর আরিফই। ফোনটা নোরার হাতে ছিল। কেউ একজন ফোনটা হাত থেকে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ধর্ষণের পর ওরা নোরাকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওর ফোন বাজার শব্দ শুনে তিনজনই ছুটে পালায়।
নোরা ফোনের উৎস বরাবর চারদিক হাতড়াতে হাতড়াতে ফোন খুজে বের করে। তখনো অনিকের ফোন বাজছিল। নোরা রিসিভ করে অনিককে ঘটনা জানায়। এরপর আর কি হয়েছিল তার মনে নেই। নোরার জবানবন্দি শোনার পর অনিকের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। শরীরের রগ ফুলে উঠছে। আলভীদের সামনে পেলে এখন সে ঠিক কি করতো নিজেও জানেনা। সবকয়টাকে খুন করে ফেলতো। জানোয়ারের মতো বেরধক পিটিয়ে খু*ন।
চলবে