#অনপেখিত
পর্ব ৭
লিখা Sidratul Muntaz
সন্ধ্যায় ফারদিনরা বাড়ি ফিরে এলো। তারা উর্মি আর উজানকেও বেড়াতে নিয়ে গেছিল। উর্মি-উজান হলো জামাল চাচার দুই ছেলে-মেয়ের নাম। উর্মির বয়স চৌদ্দ আর উজানের এগারো। তাদের সাথে মেহেকের বেশ ভালোই সম্পর্ক। মেহেক উর্মিকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল তারা কোথায় ঘুরতে গেছিল, সারাদিন কি কি করেছে, কি খেয়েছে, আরও নানান প্রশ্ন। সবশেষে জিজ্ঞেস করল ফারদিন সারাদিন কার সাথে ছিল। সুজানার সাথে নাকি সব বন্ধুদের সাথেই। উর্মি মনে হয় মেহেকের প্রশ্নের অর্থ বুঝে ফেলল। খুব সাবধানী কণ্ঠে বলল,” জানেন মেহেক আপু, ফারদিন ভাই কিন্তু সুজি আপারে সারাদিন কোলে নিয়াই ঘুরছে।”
এই কথা শুনে মেহেকের মুখ মেঘে ঢাকা আকাশের মতো অন্ধকার হয়ে গেল।
” মানে?” আহত কণ্ঠে জানতে চাইল সে।
উর্মি ফিসফিস করে বলল,” হো। সুজি আপায় পানিতে নামতে ভয় পাইতাছিল। তখন ফারদিন ভাই সবার সামনে তারে কান্দে নিয়া সাতার কাটছে। আমরা নৌকায় উঠছি। কিন্তু ওরা আলাদা কইরা স্পিড বোটে চড়ছে। সুজি আপার লগে জড়ায় ধইরা ফারদিন ভাইয়ের মোবাইলে ছবিও আছে।”
” আর কি কি করেছে ওরা?”
” একটু পর পর আড়ালে গিয়া খালি কথা কয় দুইজনে। আর সুজি আপা খালি কান্দে। কান্দে আর টিস্যু দিয়া নাক মুছে।”
” কাঁদে কেন?”
” ওইডা তো আমি জানি না। আমারে কি আর কইছে ক্যান কান্দে? কিন্তু আমি দেখছি কানতে।”
” আর কিছু দেখিসনি? আচ্ছা, তোর ফারদিন ভাই কি সুজিকে চুমু-টুমু দিয়েছে? ”
এই প্রশ্ন শুনে উর্মি লজ্জায় হেসে দিল।মুখ চেপে হাসি থামিয়ে বলল,” কি জানি? দিলেও কি আর আমার সামনে দিবো? কিন্তু আমার মনে হয় দিছে। ওরা তো সারাদিন একজন-আরেকজনের লগে চিপকায় আছিল। দেইখা মনে হইবো, আপনে কেউ না। সুজি আপাই ফারদিন ভাইয়ের বউ।”
মেহেকের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল উর্মির থেকে কথাগুলো শুনে। ইচ্ছে করছিল ওই সুজির বাচ্চার ঘাড় ধরে এনে ড্রেনের পানিতে চুবাতে। কত্তবড় বেয়াদব মেয়ে হলে আরেকজনের বরের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে! তার বাপ-মা কি তাকে শিক্ষা দেয়নি? ইশশ, মেহেক যদি পারতো ওই সুজির খাবারে ইঁদুরের ঔষধ মিশিয়ে দিতো। উর্মি বলেছিল ফারদিনের মোবাইলে সুজির সাথে জড়িয়ে ধরা ছবি আছে। সেই ছবি যদি একবার দাদুকে দেখানো যায় তাহলে ফারদিন থাকবে অলটাইম দৌড়ের উপর। ফারদিন ওয়াশরুমে ঢুকেছিল গোসল করতে। ওর মোবাইলটা বিছানায় রাখা ছিল। মেহেক সাবধানে বিছানা থেকে মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। বারান্দার দরজাও আটকে দিল। তারপর ফারদিনের মোবাইলের লক খুলে গ্যালারিতে ঢুকলো আজকের ছবিগুলো দেখার জন্য। অনেকগুলো ছবি। বেশিরভাগই গ্রুপ ফটো। বন্ধুরা একসাথে সেলফি তুলেছে। শুধু সুজি আর ফারদিনেরও কয়েকটা ছবি আছে। তবে সুজির সাথে ফারদিন যেভাবে ছবি তুলেছে, আনজীর,ওয়াসীমও একইভাবে ছবি তুলেছে। তাই ব্যাপারটা মেহেকের কাছে তেমন খারাপ লাগল না। কিন্তু ফারদিন সুজিকে পিঠে উঠিয়ে সাতার কাটার ভিডিওটা দেখে মেহেকের একদম মন ভেঙে গেল। স্পিড বোটে যখন ওরা উঠেছিল, কেউ একজন তাদের ভিডিও করছিল। সেই ভিডিওতে সুজি পেছন থেকে ফারদিনকে জাপটে ধরে ছিল। অন্য একটা ভিডিও দেখে মেহেকের সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগল। ভিডিওটি করেছে পূর্বিতা। ওরা একটা মাঠের মতো জায়গায় বসে ছিল। কে কি করছে তার সবকিছুর ভিডিওতে রেকর্ড করা হচ্ছিল। আনজীর দূরবিন চোখে লাগিয়ে কি যেন খুঁজছে। পূর্বিতা আনজীরকে নিয়ে কিছুক্ষণ বকবক করল। তারপর চলে গেল ওয়াসীমের কাছে। ওয়াসীম নিজেও কিছু একটা ভিডিও করছিল। পূর্বিতা ওয়াসীমের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফারদিন আর সুজির দিকে ক্যামেরা তাক করল। সেই দৃশ্য দেখে মেহেকের চোখ ছলকে পানি চলে এলো। ফারদিন সুজির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। সুজির লম্বা, তরঙ্গায়িত চুলগুলো হাতে নিয়ে খেলছে। একটা সময় মুখ ডুবিয়ে চুলের ঘ্রাণ নিল। তারপর বলল,” কি শ্যাম্পু লাগিয়েছিস? এতো ঘ্রাণ কেন?”
মেহেকের প্রায় কান্না পেয়ে গেল। সে পুরো ভিডিওটা শেষ করতে পারল না। নিজেকে পাগল মনে হচ্ছিল। ফারদিন ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার আগেই মেহেক মোবাইলটা জায়গামতো রেখে চুপচাপ বিছানায় বসে রইল।ফারদিন গোসল শেষ করে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হলো। মেহেককে দেখেই হাসি মুখে বলল,” হাই।”
মেহেক জবাব দিল না। ফারদিন বিছানায় বসে বলল,” পাখি পছন্দ হয়েছে?”
” হুম। সুন্দর। ”
” কেউ তো একটা থ্যাংকসও দিল না।”
মেহেকের তখন রেগে-মেগে বলতে ইচ্ছে করল,” তোর মতো বেঈমানকে আবার থ্যাংকস কিসের? তুই শুধু খাবি চড়। উল্টা-পাল্টা ছেঁচা লাগানো চড়।”
ফারদিনের হাসি হাসি চেহারাটা দেখতেই বিরক্ত লাগছে। মেহেক উঠে চলে যাচ্ছিল। ফারদিন ওর হাত ধরে বলল,” আরে কোথায় যাচ্ছো?”
অন্যসময় হলে মেহেক এখন খুশির জোয়ারে হাবুডুবু খেতো। ফারদিন তার হাত ধরেছে! এরচেয়ে খুশির ঘটনা আর কি হতে পারে? কিন্তু এখন খুশিটা লাগছে না। মেহেক থমথমে কণ্ঠে বলল,” পাশের রুমে যাচ্ছি।”
” কেন?”
” ঘুমাবো।”
ফারদিন টেনে এনে মেহেককে বিছানায় বসিয়ে বলল,” যেতে হবে না তো। এখানেই থাকো। নাহলে মাঝরাতে আবার ক্ষিদে পেলে আমি তোমাকে পাশের রুমে ডাকতে যেতে পারবো না।”
মেহেক মনে মনে বলল,” কেন? যার কোলে শুতে গিয়েছিলেন সে আপনাকে রান্না করে খাওয়াতে পারে না? আমার কাছেই কেন খাওয়ার জন্য আসতে হয়? আমি কি আপনার রাধুনি হই?”
” মেহেক তোমার কি এখনও মনখারাপ? আচ্ছা কি হয়েছে আমাকে বলোতো?”
” কিছু হয়নি।”
” শিউর?”
” হুম।”
” তাহলে হোসনেয়ারা চাচী যে বললেন তুমি নাকি সারাদিন কিছু খাওনি? এটা কি ধরণের কথা মেহেক? না খেয়ে কিভাবে থাকো?”
” খেতে ইচ্ছে করছে না। ক্ষিদে নেই।”
” এই কথা বললে তো হবে না। চলো খেতে যাবে।”
” উহুম। আমি যাবো না।”
” নিশ্চয়ই যাবে তুমি।”
ফারদিন চোখ রাঙালো। মেহেক মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আমি যাবো না, যাবো না কোথাও যাবো না। আপনি এমন করছেন কেন আমার সাথে? আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না!”
ফারদিন থতমত খেয়ে গেল মেহেকের অদ্ভুত আচরণে। মেহেক বিছানায় বসে কাঁদতে লাগল। ফারদিন ওর পাশে বসে সিরিয়াস হয়ে বলল,” তোমার কি হয়েছে মেহেক?”
মেহেক কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল,” জানেন, ছোটবেলায় যখন আমি জন্মেছিলাম সাতদিন আব্বা আমাকে কোলে নেয়নি। কারণ আমি মেয়ে। আর তিনি ছেলে সন্তান প্রত্যাশা করেছিলেন। আমাকে নিয়ে আব্বা খুশি ছিলেন না। মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন একটা ছেলে সন্তান। শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার অপরাধে আমি আব্বার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি জন্ম থেকেই। আমার আব্বা আমার সামনে আমার চাচাতো ভাইদের আদর করতেন। তাদের নিয়ে ঘুরতে যেতেন। আমাকে কখনও নিতেন না। প্রায় সবকিছু থেকেই আমাকে বঞ্চিত করতেন। কারণ আমি মেয়ে! এটাই আমার একমাত্র অপরাধ। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম। মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য নিজেকে ধিক্কার দিতাম। ভেবেছিলাম, বিয়ের পর হয়তো আমার এই অবহেলার জীবনটা বদলে যাবে। আমি যাকে ভালোবাসবো সেও শুধু আমাকেই ভালোবাসবে। কিন্তু হলো না। কারণ আমি মেয়ে এবং আমি মেহেক। পোড়া কপালী মেহেক। আমার কপালে ভালোবাসা কখনও সয় না।”
ফারদিন হতভম্ব হয়ে কথাগুলো শুনছিল। মেহেক চোখ বন্ধ করে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে লাগল। ফারদিন ওকে দুইহাতে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,” মেহেক, এই মেয়ে এদিকে তাকাও।”
মেহেক তাকাল না। দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আজকে সে খুব কাঁদবে। তার জন্মটাই বোধ হয় কাঁদার জন্য হয়েছিল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠানের বকুল গাছটির নিচে এসে দাঁড়ালো মেহেক। তার চোখের কার্ণিশ হতে ধাবমান অবাধ জলরাশি কিছুতেই থামছে না! মেহেক দুইহাতে চোখ মুছছে তো মুহুর্তেই আবার ভিজে যাচ্ছে। বিয়ের দিন আম্মাকে বিদায় দেওয়ার সময়ও মেহেক ঠিক এভাবেই কেঁদেছিল। বাসররাতে ফারদিন যখন তাকে ঘর থেকে বের করে দিল তখনও সে কেঁদেছিল। সুজি যখন প্রথমবার ওদের বাড়িতে এলো আর ফারদিন তাকে কোলে নিয়ে বেডরুমে ঢুকলো তখন গেস্টরুমের দরজা আটকে মেহেক চিৎকার করে কেঁদেছিল। আবদ্ধ ঘরের দেয়ালগুলো তার সেই হাহাকারের সাক্ষী! বাঁধভাঙা এই কান্নার সাক্ষী! আর আজকের কান্নার সাক্ষী এই অপূর্ব সুন্দর বকুল গাছ। সাদা সাদা বকুল ফুলগুলো তারার মতো দেখাচ্ছে। কিছু ফুল ঝরে পড়ে আছে সবুজ ঘাসে উপর। হলদে আলোয় ফুলগুলোকে দেখলে মনে হয় আকাশ থেকে খসে পড়া তারা। এই সুন্দর ফুলগুলোও যেনো মেহেকের কান্নার সঙ্গী। তারাও মেহেকের দুঃখে হতাশ হয়ে কাঁদছে।
ফারদিনকে যেদিন মেহেক প্রথমবার দেখেছিল সেদিনও কেঁদেছিল। তখন ফারদিনের গাঁয়ে ছিল টকটকে লাল শার্ট। কালো জিন্স। উজ্জ্বল শ্যামলাবর্ণের লম্বাটে, দীর্ঘদেহী এক অপরিচিত পুরুষ। মেহেকের আজও বুক কেঁপে উঠে সেই দিনের কথা মনে পড়লে। ফারদিনের সরু নাকের ডগায় যেন তেজের হলকা ছিল। মাঝারী আকৃতির ঘন পল্লবে বেষ্টিত চোখ দু’টি অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলছিল। ওই দৃষ্টি কারো উপর নিক্ষিপ্ত হলে সেই মানুষটি অবলীলায় নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। তার ঠোঁট ছিল কালচে, তাও কত মাধুর্য সেই ঠোঁটে। চেহারার গড়ন লম্বাটে, মাথা ভর্তি খাড়া চুল। অতি সাধারণ চেহারা নিয়েও ফারদিন যেনো অসাধারণ! মুচকি হাসলে তার চেহারা যে কি মিষ্টি দেখায়! মেহেকের মনে হচ্ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর পুরুষকে সে দেখে নিয়েছে। খুশিতে কান্না পেল মেহেকের। প্রথমবারের মতো ফারদিনকে দেখে সে কাঁদলো। আনন্দের কান্না! ভালোবাসলো, সুখের ভালোবাসা! কিন্তু কে জানতো? এই সুখের ভালোবাসাই তাকে প্রতি মুহুর্তে দুঃখের সাগরে ভাসাবে। এইতো মেহেক ভাসছে, দুঃখের বোঝা বইতে না পেরে ডুবে যাচ্ছে। তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
ফারদিন প্রচ্ছন্নভাবে মেহেকের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। মুখে হাত রেখে নীরব দর্শকের মতো দেখছিল মেহেকের কান্না। মেহেক তাকে লক্ষ্য করেনি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ফারদিন গলা ঝেড়ে হালকা কাশির মতো শব্দ করতেই মেহেক চমকে পেছনে তাকালো। ফারদিনকে দেখে দ্রুত চোখ মুছল। ফারদিন নিষ্পলক চেয়ে রইল মেহেকের গোলাপী মুখটার দিকে। এতোক্ষণ ধরে কাঁদার ফল। মেহেকের ফরসা,মসৃণ, মিষ্টি মুখখানা গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে। এই অবস্থায় তাকে আরও মায়াবী দেখাচ্ছে।
ফারদিন যথেষ্ট বিনয়ের সাথেই প্রশ্নটা করল,” তুমি কি আমার উপর কোনো কারণে রেগে আছো মেহেক?”
” না,না, আপনার উপর আমি কেন রাগ করতে যাবো?
”
” তাহলে কাঁদছো কেন? কান্না থামাও প্লিজ।”
” থামিয়েছি। আর কাঁদবো না।”
কয়েক সেকেন্ড পর ফারদিন আবার বলল,” তখন ওই কথাগুলো বলার মানে কি? আমি কি তোমাকে কোনোভাবে কষ্ট দিয়েছি?”
” কোনো কষ্ট দেননি তো। আপনি আমাকে কষ্ট দিতেই পারেন না।”
” তাহলে আমি কি জানতে পারি তুমি সারাদিন কেন না খেয়ে ছিলে?”
” বলেছি তো। ক্ষিদে পায়নি।”
” তাহলে এখন খেতে চলো।”
” আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি যান।”
” ভালো করে বলছি। আমার কথাটা শোনো। খেতে চলো।”
” বললাম তো, আমার ইচ্ছে করছে না। আপনি যান!”
” মেহেক তুমি চলবে কি-না?”
” না।”
ফারদিন আর কোনো কথা না বলে তেড়ে আসলো মেহেকের দিকে। মেহেক কিছু বুঝে উঠার আগেই ফারদিন ওকে পাঁজাকোলায় নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। ডাইনিংরুমে তখন সবাই খেতে বসেছে। ফারদিন সবার সামনে দিয়েই ওকে নিয়ে রুমে চলে এলো। মেহেক ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছিল। কিন্তু যখন দেখল সুজি তাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তখন মনের অজান্তেই মেহেকের একটা পৈশাচিক আনন্দময় অনুভূতি হলো। কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে যদি নিজের মনে আনন্দের সঞ্চার হয় তবে তাকেই পৈশাচিক আনন্দ বলে। মেহেক সেই আনন্দেই উচ্ছ্বসিত। সাথে একটা নাম না জানা তৃষ্ণাও পেয়ে বসলো তাকে।
ফারদিন মেহেককে বিছানায় বসিয়ে আদেশ দেওয়ার মতো বলল,” চুপ করে বসে থাকো এখানে। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
ফারদিন চলে যেতে নিলেই মেহেক ওর শার্টের কলার খামচে ধরল। ফারদিন একটু চমকালো। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,” কি ব্যাপার?”
মেহেক মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তার নজর ফারদিনের কালচে ঠোঁটের দিকে। ফারদিন সেটা বুঝতে পেরে হালকা অপ্রস্তুত হলো। না চাইতেও তার দৃষ্টি চলে গেল মেহেকের কোমল,পাতলা গোলাপী ঠোঁটে। সেই অপূর্ব ঠোঁটজোড়া দেখেও ফারদিন কোনো অনুভূতি পেল না। তার কাছে মনে হলো, এ যেন পাঁচ বছর বয়সী কোনো বাচ্চা মেয়ের ঠোঁট। এই ঠোঁটে স্পর্শ করাও অন্যায়! মেহেক তখন সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন।
ফারদিনের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় মরিয়া। ফারদিন ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,”হোয়াট রাবিশ! হোয়াট’স রং উইথ ইউ মেহেক?”
মেহেক ভয়ে কেঁপে উঠলো। ফারদিন জোর করে নিজের কলার থেকে মেহেকের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁডাল। রাগান্বিত স্বরে বলল,” কি করছিলে তুমি এটা?”
মেহেক টলমল চোখে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ চেয়ে রইল। একটু পর কান্নার ঢোঁক আটকে বলল,” সবসময় আমার সাথেই কেন এমন করেন আপনি? আমি যে আপনাকে ভালোবাসি সেটা কি আপনি বুঝেন না?”
ফারদিন স্তব্ধ,বাকরুদ্ধ এবং অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল। হাজারবার নিজের মনকে বুঝানোর চেষ্টা করেও সে মেহেককে মেনে নিতে পারছে না। তার অবাধ্য মন কিছুতেই মানতে চাইছে না যে সামনে বসে থাকা পিচ্চি মেয়েটি তার বউ হয়! হ্যাঁ মেহেককে তার ভালো লাগে। মেহেক কিউট সুন্দর, মিষ্টি একটা মেয়ে। কিন্তু ফারদিন তাকে বউ হিসেবে ভালোবাসতে পারছে না। ওই কথা ভাবতে গেলেও তার দম বন্ধ হয়ে আসে। কিভাবে বুঝাবে সে মেয়েটিকে?বুঝানো বড় কঠিন। তাও ফারদিন চেষ্টা করল,” দেখো মেহেক, তুমি এখনও খুব ছোট। তোমার এখন যেটাকে ভালোবাসা মনে হচ্ছে সেটা কিন্তু আসলে ভালোবাসা না। এটা একটা আকর্ষণ। তুমি আরেকটু বড় হলে নিজেই বুঝতে পারবে কেন আমি তোমাকে বাঁধা দিয়েছি।”
মেহেক এই কথা শুনে ভস করে জ্বলে উঠল ম্যাচের কাঠির মতো। বলল,” বড় হওয়ার দরকার নেই। আমি এখনি সব বুঝতে পারছি। আপনি সুজিকে ভালোবাসেন। এজন্যই আমাকে আপনার সহ্য হয় না।”
” হোয়াট? না মেহেক এরকম কিছুই না। শোনো…”
ফারদিন কথা শেষ করার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠলো। দু’জনেই তাকালো বিছানার কোনায় বাজতে থাকা মোবাইলটির দিকে। ‘সুজানা” নামটি স্পষ্ট ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। মেহেকে ক্রোধে, আক্রোশে ভেতরে থেকে ফেটে যাচ্ছিল৷ ফারদিন মোবাইলটি নেওয়ার আগেই সে নিয়ে আছাড় মারল। ফারদিন হতবাক হয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে ফোনটা মেঝে থেকে তুলে দেখল স্ক্রিন ফেটে গেছে। ফোনটাও সুইচড অফ হয়ে গেছে। ফারদিন ক্ষীপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মেহেকের উপর। আর মেহেক এতে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না। মাথা নিচু করে এমনভাবে চোখের জল মুছতে লাগল যেন কিছুই হয়নি।
ফারদিন হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। রাতে কেউ কারো সাথে কথা বলল না। হোসনেয়ারা চাচীর অনুরোধে মেহেক ভাত খেয়ে নিল। রুমে এসে দেখল ফারদিন ঘুম। মেহেক ওকে বিরক্ত না করে সাবধানে বিছানার একপ্রান্তে শুয়ে পড়ল। রাতটা কেটে গেল।
সকালে বন্ধুরা আবার প্ল্যান করল ঘুরতে বের হবে। চট্টগ্রামে তারা ঘোরার জন্যই এসেছে। মাত্র তিনদিনের ট্রিপেই তাদের চট্টগ্রাম শহরের সব সুন্দর জায়গা ভ্রমণ করতে হবে। আজকে অবশ্য পূর্বিতা,আনজীর, ওয়াসীম প্রত্যেকেই মেহেককে অনুরোধ করল তাদের সাথে যাওয়ার জন্য। গতকাল মেহেক যায়নি বলে তারা অনেক মনখারাপ করেছে। কিন্তু মেহেক কি কম ঘাড়ত্যাড়া? যতই মানুষ তাকে অনুরোধ করুক যতক্ষণ না ফারদিন নিজে এসে বলবে ততক্ষণ মেহেক রাজি হবে না। সে পূর্বিতাদের বলে দিল তার মাথাব্যথা। যেতে পারবে না। এই কথা বলে ঘরে এসে ঘাপটি মেরে বসে রইল। একটু পর ফারদিন এসে বলল,” তুমি তাহলে যাচ্ছো না?”
” কোথায় যাবো?”
” আমরা ওয়ার সিমেট্রি যাচ্ছি। তুমি যাবে আমাদের সাথে?”
ইশশ, এই জায়গাগুলোতে ঘোরার কত শখ ছিল মেহেকের। কিন্তু আব্বা কখনও তাকে ঘরের বাহিরে যেতেই দেয়নি। ঘুরতে যাওয়া তো তার কাছে স্বপ্ন। ঘুরাঘুরির এতো সূবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে মন চায় না। কিন্তু এক কথায় রাজি হয়ে নিজের দাম তো কমানো যাবে না। তাই মেহেক বলল,” না।”
” কেন যাবে না? সুজি যাচ্ছে তাই?”
মেহেক একটু হকচকিয়ে বলল,” না, তা কেন হবে? আমি এমনিই যাবো না।”
ফারদিন মেহেকের পাশে বসে সুন্দর করে বলল,” আচ্ছা থাক, সুজিকে নিবো না। শুধু তুমি আর আমি যাবো। এইবার চলো।”
মেহেক বিস্মিত হয়ে বলল,” সত্যি বলছেন?”
” হুম।”
” শুধু আপনি আর আমি?”
” হুম!”
” তাহলে বাকিরা? সবাই তো যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেছে।”
” হোক রেডি। ওরা অন্য গাড়িতে যাবে। আমরা আমাদের গাড়িতে যাবো!”
” শুধু গাড়িই আলাদা হবে? নাকি জায়গাও আলাদা?”
” তুমি চাইলে জায়গাও আলাদা হবে।”
মেহেকের এই মুহুর্তে আসলেই খুশি লাগছে। সে খুশিটা চেপে রাখতে না পেরে বলে ফেলল,” আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরি?”
ফারদিন কঠিন মুখে বলল,” না।”
মেহেক তোয়াক্কা না করে আচমকা ফারদিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,” আমরা আজকে অনেক ঘুরবো! অনেক মজা করবো! শুধু আমি আর আপনি। অন্যকেউ না কিন্তু!”
” ঠিকাছে। তুমি তাহলে রেডি হও? আমি বাহিরে ওয়েট করছি।”
” আরে দাঁড়ান।”
” কি?”
মেহেক লাজুক মুখে বলল,” আপনি তো আমার বর। আমি রেডি হলে আপনাকে বাহিরে ওয়েট করতে হবে কেন? ভেতরেই থাকুন। কিছু হবে না।”
ফারদিনের চেহারায় অস্বস্তি ফুটে উঠলো। মেহেকের হাতটা আস্তে করে ছাড়িয়ে বলল,” গেলাম আমি।”
ফারদিন বেরিয়ে যেতেই মেহেক বিরবির করে বলল,” আমি মেয়েমানুষ হয়ে লজ্জা পাই না। আর উনি পুরুষ হয়েও লজ্জায় মরে যায়। কি আজব!”
চলবে