#অনপেখিত
পর্ব ৯
লিখা Sidratul Muntaz
ফারদিন পূর্বিতার সাথে তাদের রুমে এলো। দেখলো সুজানা মাথায় ঘোমটা দিয়ে বিছানায় বসে আছে। ওর চেহারাটা থমথম করছে।
ফারদিন প্রথমেই বলল,” এইটার আবার কি হয়েছে? হুজুর আপা সাজলো কেন হঠাৎ?”
পূর্বিতা বলল,” বলছি।”
সুজানা আর পূর্বিতা একবার চোখাচোখি করল। তারপর পূর্বিতা সুজানার মাথা থেকে ঘোমটাটা টেনে সরাল। ফারদিন সুজানার ঘাড় পর্যন্ত চুল দেখে বিস্ময়ে তাক লেগে গেল। চট করে বলে উঠলো,” হোয়াট দ্যা ফা*ক!”
পূর্বিতা ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলল,” ফা*ক? এইটা গিয়ে তোর বউকে বল।”
” মানে? আমার বউ আবার তোদের কি করল?”
” তোর বউয়ের জন্যই ওর এই অবস্থা।”
” হোয়াট? মেহেকের জন্য? ”
” তাছাড়া আর কে? তোর কয়টা বউ আছে?”
” মানে? মেহেক কি করেছে?”
পূর্বিতা বলতে নিলে সুজানা ওকে থামিয়ে বলল,” আমি বলছি।”
সুজানা এইবার ফারদিনের দিকে ঘুরে তাকালো। শান্ত কণ্ঠে বলল,” তুই আগে মেহেককে ডাক। কোথায় মেহেক?”
” না, মেহেককে পরে ডাকছি। আগে আমাকে বল মেহেক কি করেছে?”
সুজানা চুপ করে রইল। রাগে মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। পূর্বিতাই বলল,” ম্যায়োনিসের মধ্যে আঠা মিশিয়ে উর্মিকে দিয়ে সেই আঠা মাখানো ম্যায়োবিস সুজির চুলে ঢেলেছে তোর বউ। এরপর সেই আঠা আর চুল থেকে ছাড়ানো যায়নি। পার্লারে নিয়ে যাওয়ার পর পার্লারের আপু বলেছে চুল কাটতে হবে। ”
ফারদিন কোনোকিছু না বুঝার মতো সুজানার দিকে তাকালো। সুজানার চোখ দু’টো রাগে লাল হয়ে আছে৷ ফারদিন অবিশ্বাস্য গলায় বলল,” মেহেক এই কাজ করবে না। কি বলছিস তোরা?”
সুজানা ক্রোধিত স্বরে বলল,” ওহ রিয়েলি? তুই কি ওকে নাদান বাচ্চা মনে করিস? ও আসলে খুব শেয়ানা একটা মেয়ে। আস্তো শয়তান। ”
ফারদিনের মেজাজও খারাপ হয়ে গেল এবার। ধমক দেওয়ার মতো বলল,” সুজি, বেশি হয়ে যাচ্ছে।”
” আমাকে ধমকাচ্ছিস কেন? এই ধমকটা তোর বউকে গিয়ে দে। আমি তার কি ক্ষতি করেছিলাম বল? আমার চুলের উপর ওর কুনজর পড়লো কেন? কিসের এতো ক্ষোভ ওর আমার প্রতি?”
” তুই কাউকে জেলাস করিস মানে এই না যে তার নামে যা ইচ্ছা বানিয়ে বলবি আর আমি বিশ্বাস করবো।”
সুজানা হতভম্ব হয়ে বলল,” আমি বানিয়ে বলছি?”
” অফ কোর্স বানিয়ে বলছিস। মেহেক সারাদিন আমার সাথে ছিল। তাহলে ও এইসব কখন করল?”
” তুই এতো কথা না বলে মেহেককে ডাক। তাহলেই তো সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
” মেহেককে আমি ডাকবো না। আগে তুই প্রমাণ কর তুই যা বলছিস সব সত্যি। ”
” আমার কথা বিশ্বাস করতে তোর এখন প্রমাণ লাগবে? বাহ!”
সুজানা অবাক! তার এতোবছরের পুরনো বন্ধুকে যেন সে চিনতেই পারছে না। বিয়ের পর বুঝি মানুষ এতো বদলে যায়? পূর্বিতা বলল,” প্রমাণ আছে। মেহেক উজানের থেকে আঠা নিয়ে এই কাজ করেছিল। পরে উজানই আমাদের কাছে সব স্বীকার করেছে। তুই চাইলে উজানকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারিস।”,
ফারদিন সুজানার দিকে চেয়ে কঠিন মুখে বলল,” ডাক উজানকে।”
সুজানা আহত কণ্ঠে বলল,” এর মানে তুই আসলেই আমার কথা বিশ্বাস করিসনি?”
” না করিনি।”
পূর্বিতা উজানকে ডাকার জন্য রুম থেকে বের হচ্ছিল। সুজানা ওর হাত ধরে বলল,” দাঁড়া পূর্বি। যাবি না তুই। আগে ওকে বলতে হবে ও আমার মুখের কথা কেন বিশ্বাস করবে না? আমার থেকে দুইদিনের বউ এখন ওর কাছে বেশি বড় হয়ে গেল?”
” বড়-ছোট’র বিষয় না এটা। আমি লজিক খোঁজার চেষ্টা করছি। কিন্তু তোর কথায় আমি কোনো লজিক পাচ্ছি না। হ্যাঁ মেহেক দুষ্টমি করে মানলাম। কিন্তু এইরকম অফেন্সিভ কাজ ও জীবনেও করবে না। ওর মন এতো ছোট না।”
” তাহলে কি আমার মন ছোট? আমার পেটে হিংসা? হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস। আমিই হিংসুটে, আমিই নোংরা মনের অধিকারী। তাইতো তোকে সেক্রিফাইস করেছি ওর জন্য।”
” সেক্রিফাইস কি তুই শুধু একাই করেছিস? আমি করিনি? সবচেয়ে বড় সেক্রিফাইস তো আমাকেই করতে হচ্ছে।”
” তাহলে তুই ভাবলি কি করে আমি এতোবড় মিথ্যে বলবো? তুই যা বলেছিস সবকিছু আমি মেনে নিয়েছি না? তুই বলেছিস আমাদের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক হবে না। আগের মতো শুধু বন্ধুত্বই থাকবে। সেটা মেনে নিয়েছি না আমি?যদি মেহেককে আসলেই আমি জেলাস করতাম তাহলে কি এতো সহজে সব মানতাম? তুই-ই বল!”
ফারদিন চুপ করে আছে। সুজি গলা উঁচিয়ে বলল,” আমারই ভুল হয়েছে। তোকে চিনতে ভুল করেছি আমি। তুই আসলে আমার যোগ্যই ছিলি না।”
” এইখানে যোগ্যতার প্রসঙ্গ আসছে কেন?”
পূর্বিতা ওদের থামানোর চেষ্টা করে বলল,” আচ্ছা তোরা কি এখন ঝগড়া শুরু করবি?”
ফারদিন বলল,” না, না ওয়েট, লেট মি ক্লিয়ার। এইখানে যোগ্যতার কথা কিভাবে আসলো আমাকে বল।”
সুজানা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,” যোগ্যতার কথা এজন্যই এসেছে কারণ এতোদিন তোকে আমি আত্মসম্মানী পুরুষ ভাবতাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম তুই আসলে বউয়ের গোলাম।”
ফারদিন আর রাগ চেপে রাখতে পারল না। সুজির দিকে তেড়ে গিয়ে বলল,” হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বউয়ের গোলাম?”
পূর্বিতা ফারদিনকে দুইহাতে থামাল,” দোস্ত প্লিজ, সিন ক্রিয়েট করিস না। এইখানে আমরা ছাড়াও অন্য মানুষ আছে। দু’টো বাচ্চা আছে। ওরা কি ভাববে?”
সুজির চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,” কথায় আছে আল্লাহ যা করে মঙ্গলের জন্য করে। আজকে বুঝলাম কথাটা একদম সত্যি। তোর সাথে প্রেম না হওয়ায় আমার মঙ্গলই হয়েছে। তুই আসলে আমাকে ডিজার্ভই করিস না। তোর জন্য মেহেকের মতো মিচকা শয়তানই ঠিকাছে।”
” আর তুই নিজে খুব ডিজার্ভ করিস তাই না আমাকে? তোর মনের মধ্যে নোংরা এজন্যই তুই আমাকে পাসনি। ”
” তোকে পাওয়ার জন্য আমি মরে যাচ্ছিলাম না। কোথাকার কোন রাজপুত্র তুই যে পেতেই হবে? যা ভাগ!”
” তুই ভাগ। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হো।”
” তুই দূর হো।”
” দারুণ। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকেই দূর করা হচ্ছে। এইটা আমার বাড়ি সো তুই দূর হবি।”
পূর্বিতা আশ্চর্য হয়ে বলল,” টিনেজার হয়ে গেছিস নাকি তোরা? আমার বাড়ি, তোমার বাড়ি এইসব কি? এমন চাইল্ডিশ বিহেভিয়ার তোদের এই বয়সে মানায় না। বি ম্যাচিউর!”
সুজানা যেন পূর্বির কথাটা শুনতেই পেল না। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,” ওহ রাইট! তোর বাড়ি। এই বাড়িটা তো তোর তাই না? তাহলে আমি এইখানে কি করছি? আমার তো এইখান থেকে এখনি চলে যাওয়া উচিৎ।”
” অভিয়াসলি। প্লিজ গেট লস্ট।”
ফারদিন হাত দিয়ে চলে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিল। পূর্বিতা মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে। এখন এই কাহিনী কোথায় গিয়ে থামবে কে জানে? সুজানা রেগে-মেগে ব্যাগপত্র গোছানো শুরু করল৷ আর ফারদিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পূর্বিতা সুজানাকে থামানোর চেষ্টা করে বলল,” দোস্ত আমার কথা শোন।”
সুজানার সোজা জবাব, ” পূর্বিতা তুই আমাকে আর একটা কথাও বলবি না। আমি এক মিনিটও এইখানে থাকতে চাই না। ফারদিনকে আমার চেনা হয়ে গেছে। আই জাস্ট হেইট হিম।”
” প্লিজ, এমন করিস না সুজানা। বাহিরে বৃষ্টি তার উপর রাত। তুই এইসময় কোথায় যাবি?”
” যেখানে খুশি সেখানে যাবো৷ কিন্তু এই বাড়িতে থাকবো না।”
” আল্লাহ!”
পূর্বিতা আর কোনো উপায় না পেয়ে ওয়াসীম আর আনজীরের ঘরে গেল। তাদেরকে ঘটনা খুলে বলল।
ফারদিন নিজের রুমে এসে বিছানায় বসল। খুব রেগে গেলে তার হাতের রগ কাঁপতে শুরু করে। মুখ ক্রমশ লাল হতে থাকে। এখনও হচ্ছে। উর্মি ভয়ে ভয়ে ফারদিনের কাছে এসে বলল,” ভাইয়া, আপনার জন্য শরবত।”
ফারদিন চোখ তুলে উর্মির দিকে তাকালো। উর্মির মুখটা ভয়ের চোটে ছোট্ট হয়ে গেছে। হাত কাঁপছে। ফারদিন আচমকা উর্মির হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ছুড়ে মারল। উর্মি এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার প্রাণ অর্ধেকটাই নাই হয়ে গেছে। এতো ভয় বাপের জন্মেও সে পায়নি।
মেহেক রান্নাঘরের দরজার চিপায় লুকিয়ে ছিল। উর্মি মেহেকের কাছে এসে মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলল। মেহেক বলল,” দেখেছিস বলেছিলাম না? অনেক রাগ উনার। শরীরের প্রতি শিরায় শিরায় কমপক্ষে তিন-চার কেজি করে রাগ। তোকে দেখে তো তাও গ্লাস আছাড় মেরেছে। আমাকে সামনে পেলে মনে হয় তুলে আমাকেই আছাড় মারতো।”
” আপনি তাইলে সামনে যাইয়েন না আপা। পরিস্থিতি মোটেও সুবিধার না। আমার তো ভয় করতাছে। আপনি লুকায় থাকেন, লুকায় থাকেন।”
উর্মি দরজার সামনে ভালোমতো পর্দা টেনে মেহেককে আড়াল করে রাখলো।
পূর্বিতার কাছে পুরো ঘটনা শোনার পর ওয়াসীম ফারদিনকে বুঝানোর জন্য তার ঘরে গেল। আর আনজীর গেল সুজানার কাছে৷ সুজানা তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। আনজীর ওর হাত চেপে ধরে বলল,” দাঁড়া, কথা শুনে যা।”
সুজানার কঠিন গলা,” সামনে থেকে সর আনজু।”
” তুই ফারদিনের উপর রাগ দেখিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিস? মানে সিরিয়াসলি? ও তো একটা ডিজাস্টার। কখন কি মর্জি হয় কোনো ঠিক নেই। রাগের মাথায় ও মানুষ খু*ন করলেও অবাক হবো না। আর তুই ওর কথা ধরছিস? তুই ওকে চিনিস না?”
” এতোদিন চিনতাম না। আজকে চিনতে পেরেছি। সেজন্যই তো চলে যাচ্ছি।”
সুজানা আর কথা বাড়ালো না। হাতের ব্যাগ চেপে ধরে হাঁটতে লাগল। আনজীর পকেটে দুইহাত গুঁজে সুজানার পেছন পেছন চলল। উঠান পেরিয়ে ওরা যখন সরু রাস্তাটি ধরে হাঁটছিল তখন সুজানা হঠাৎ বলল,” তোর প্রবলেম কি? আমার পেছন পেছন আসবি না। যা এখান থেকে। ”
” তুইও চল।”
সুজানা ক্রুর দৃষ্টিতে তাকাল,” দ্যাখ, মাথাগরম করবি না। লাথি খাবি।”
” লাথি মেরে দেখা।”
সুজানা রাগের মাথায় নিচ থেকে একটা পাথর তুলে আনজীরের গাঁয়ে ছুঁড়ে মারল। আনজীর নিচু হয়ে সরে গেল। পাথর তার গাঁয়ে লাগল না। সুজানা আরও একটা পাথর কুড়িয়ে ঢিল মারল। আনজীর এইবারও সরে গেল। পরপর দুইবার সুজানাকে হারিয়ে আনজীরের মুখে বিজয়ের হাসি৷ হাত তালি দিয়ে বলল,” আরও একবার ট্রাই করবি নাকি?”
সুজানা ক্রোধে কাঁদতে শুরু করল। আনজীর হতবাক। মশকরা বাদ দিয়ে সিরিয়াস হলো এবার। সুজানার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল,” সুজি, এই বোকা। কাঁদছিস কেন? বল আমাকে কি হয়েছে?”
সুজানা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে আনজীরের দিকে তাকালো। ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল,” ফারদিন আমাকে এই কথা কিভাবে বলতে পারলো দোস্ত? আমি মেহেককে জেলাস করে ওর নামে মিথ্যে বলেছি? আমার মনে নোংরা? ও আমাকে এতোটা জঘন্য ভাবে?”
আনজীর ওর চোখের পানি মুছে ভরসা দেওয়ার মতো বলল,” কিছু হবে না। ফারদিন ওর ভুল বুঝতে পারলে ঠিকই তোর কাছে এসে ক্ষমা চাইবে দেখিস। সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে কষ্ট নিস না। আরেকটা কথা, লম্বা চুলের থেকে ছোট চুলেই কিন্তু তোকে বেশি ভালো লাগে। একেবারে কেটি পেরির মতো।”
” কার মতো?”
আনজীর হেসে বলল,” কেটি পেরি।”
এইবার সুজিও হেসে ফেলল। আনজীর সুজির হাত ধরে বলল,” ভেতর চল দোস্ত। আবার বৃষ্টি নামতে পারে।”
” সম্ভব নারে। ফারদিনের ওই কথা আমি যতক্ষণ ভুলতে না পারবো ততক্ষণ আমি এই বাড়িতে ঢুকতে পারবো না।”
” প্লিজ ভুলে যাতো। ও একটা ইডিয়েট। নাহলে বাগানবাড়ি কেনার জন্য কেউ বিয়ে করে?”
” ইডিয়েট হোক আর যাই হোক। ও আমাকে বলেছে আমি নাকি ওকে ডিজার্ভই করি না। আমার পেটে হিংসা। এসব কথা ও কিভাবে বলতে পারলো? যদি সত্যি আমার এতো হিংসা থাকতো তাহলে ওকে ওর বউয়ের সঙ্গে আমি এতো সহজে মেনে নিতাম? আমার জায়গায় অন্যকোনো মেয়ে হলে কি এসব সহ্য করতো? প্রথমদিনই ওকে জুতার বারি লাগানো উচিৎ ছিল আমার।”
” সুজানা শোন, আজকে তোকে আমি একটা কথা বলে রাখছি। এই কথা আগেও একবার বলেছিলাম। আবারও রিপিট করছি, ফারদিন তোকে জীবনেও ভালোবাসেনি। এজ আ বিউটিফুল গার্ল, হি লাইকস ইউ। কিন্তু ভালোবাসা অসম্ভব। যদি ও সত্যিই তোকে ভালোবাসতো তাহলে প্রপোজ করার জন্য এতো সময় নিতো না। ও তোর ব্যাপারে কনফিউজড ছিল। ভালোবাসা এতো কনফিউশন নিয়ে হয় না। লভ ইজ অলওয়েজ পিউর। ভালোবাসি মানে শুধুই ভালোবাসি। এর মধ্যে কোনো কিন্তু থাকতে পারে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, যদি ও তোকেই ভালোবাসতো তাহলে বিয়েটা কোনোদিন করতে পারতো না।”
” একজাক্টলি। আমিও এটাই ভেবেছি জানিস? ও কিভাবে এই বিয়েটা করতে পারল? আমি হলে কি পারতাম? বিয়ের সময় ওর কি একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?”
সুজির চোখ থেকে অশ্রুধারা নামলো। আনজীর বলল,” আবার কান্না শুরু! আচ্ছা তোরা মেয়েরা কি কান্না ছাড়া অন্যকিছু বুঝিস না?”
আনজীর পকেট থেকে রুমাল বের করে সুজির চোখ মুছে দিতে লাগল যত্নের সাথে। সুজি নিষ্পলক তাকিয়ে রইল আনজীরের দিকে। ওই গভীর চোখ দু’টির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সুজি হারিয়ে গেল আজ থেকে প্রায় দেড়বছর আগের সময়ে। সেদিন ছিল শ্রাবণ মাস। এমনই বৃষ্টি-বাদলার দিনে ম্যাপল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আনজীর তাকে প্রপোজ করেছিল৷ সেই দিনটি খুবই অস্বস্তিপূর্ণ আর অবিস্মরণীয় ছিল সুজির জন্য।
আনজীরের সাথে তখন তার আড়াই বছরের ফ্রেন্ডশীপ। যাকে সবসময় ভাইয়ের মতো দেখে এসেছে তার কাছ থেকে হঠাৎ প্রপোজ্যাল পাওয়া যে কত অস্বস্তিকর ঘটনা, যার সাথে হয়েছে সেই কেবল বুঝবে। সুজি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিল আনজীরকে, সে কখনও তাকে বয়ফ্রেন্ড বানাতে পারবে না। সে ফারদিনকে পছন্দ করে। রিজেকশনের পর আনজীর এই ব্যাপারে সুজিকে আর কোনোদিন বিরক্ত করেনি। কিন্তু সবসময় সুজিকে আগলে রেখেছে। প্রকৃত বন্ধুর মতো সুজির বিপদে সবার আগে ছুটে এসেছে। ভালোবাসার দাবী রাখেনি। কিন্তু ভালোবেসে দায়িত্ব ঠিকই পালন করেছে। তাদের এই ব্যাপারটা বন্ধুমহলের কাছে গোপন। কেউ আজও কিছু জানে না।
সুজি হঠাৎ বলল,” একটা কথা বলবো আনজু?”
” হুম বল।”
” দেড়বছর আগে তুই আমাকে প্রপোজ করেছিলি। মনে আছে?”
আনজীরের চোখেমুখে এক মুহূর্তের জন্য অপ্রস্তুত ভাব ফুটে উঠলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,” মনে থাকবে না কেন?”
” তোর সেই অনুভূতি কি এখনও আগের মতো আছে নাকি ভুলে গেছিস?”
আনজীর চোখ ছোট করে খুব বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব নিয়ে বলল,” ভুলে যাওয়া এতো সহজ না। কিন্তু মানিয়ে নিয়েছি।”
” আচ্ছা ধর আমি তোর প্রপোজ এক্সেপ্ট করে ফেললাম। তাহলে কি করবি?”
আনজীর দাঁত বের করে কয়েক সেকেন্ড হাসলো। বোকা বোকা হাসি। সুজি বলল,” কি হলো বল?”
” জানি না কি করবো।”
” চল, আমরা বিয়ে করে ফেলি।”
” আর ইউ লস্টেড সুজানা? মাথাখারাপ হয়ে গেল নাকি?”
” সত্যি বলছি। আজকে যদি তুই আমাকে বিয়ে না করিস তাহলে আর কখনও আমাকে পাবি না। তোর জন্য জ্যাকপট চান্স। ভেবে দ্যাখ কি করবি।”
আনজীর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। সুজি তাগাদা দিল,” তোর কাছে সময় দশ সেকেন্ড। দ্রুত সিদ্ধান্ত নে। খবরদার কনফিউজড হবি না। কারণ তুই নিজেই বলেছিস, ভালোবাসায় কনফিউশন চলে না। লভ ইজ অলওয়েজ পিউর। ভালোবাসি মানে শুধুই ভালোবাসি। বলেছিস না?”
” হ্যাঁ.. কিন্তু..”
” এর মধ্যে কোনো কিন্তু থাকতে পারে না।”
” কিন্তু সুজানা, তুই ফারদিনের উপর রাগ করে ঝোঁকের মাথায় এই ডিসিশনটা নিচ্ছিস না তো? ভেবে দ্যাখ, আমি যদি তোর এই হাত একবার ধরি তাহলে সেটা সারাজীবনের জন্য ধরবো। কোনোদিন ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয়।”
সুজানা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ” ধর না প্লিজ। শর্ত হলো কোনোদিন ছাড়তে পারবি না।”
আনজীর হাতটা শক্ত করে ধরল,” তুইও প্রমিস কর!”
” প্রমিস করছি। কোনোদিন ছাড়বো না।”
ওয়াসীমের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলার পর ফারদিনের মেজাজ কিছুটা ঠান্ডা হয়েছিল। সুজির সাথে ওইরকম বিহেভ করা আসলেই ঠিক হয়নি এটা বুঝতে পেরেই ফারদিন ক্ষমা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সে সুজির খোঁজ করতে পূর্বিদের ঘরে গিয়ে দেখল সুজি নেই। পূর্বি একাই বসে আছে। ফারদিন জিজ্ঞেস করল,” পূর্বি, সুজি কোথায় রে?”
” সুজি আর আনজীর কোথায় যেন বেরিয়েছে।”
” এতোরাতে কোথায় গিয়েছে ওরা? ”
” আমি জানি না। ফোন দিয়েছিল। শুধু বলল, আমরা কেউ যাতে ডিনার না করি। ওরা নাকি ডিনার কিনে আনবে। সবাইকে ট্রিট দিবে। আর একটা সারপ্রাইজ আছে।”
ফারদিন ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ আবার সারপ্রাইজ কিসের?
আনজীর আর সুজি কাজী অফিস থেকে বিয়ের কাজ সেরে হাজির হলো রাত বারোটায়। বিয়ের চিহ্ন হিসেবে দুজনের গলাতেই রজনীগন্ধার মালা। ওদের এই অবস্থায় দেখে ওয়াসীম আর পূর্বিতা বিস্ময়ে তাক লেগে রইল। কারো এখনও ঘটনা বিশ্বাস হচ্ছে না। উর্মি বার্তাবাহকের মতো দ্রুত গিয়ে মেহেককে সব কাহিনী জানালো। মেহেক এইসব শুনে খুশিতে নাচতে নাচতে পাগল হওয়ার অবস্থা। এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ দুনিয়ায় আর কিছু হতে পারে না। সে রুমে গিয়ে বিছানায় উঠে ধুম ধারাক্কা নৃত্য শুরু করল।
বারান্দায় তখন ফারদিন দাঁড়িয়ে ছিল। মেহেক সেটা জানতো না। ফারদিনের হাতে তখন মোবাইল ফোন। সুজির নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়ে সে দেখল বন্ধুদের নাম্বার থেকে অনেকগুলো মিসডকল এসেছে। আর তার সব বন্ধুদের নাম্বার ব্ল্যাকলিস্ট করা৷ এজন্য কেউ ফোন করলেও সে টের পাচ্ছে না। কিন্তু সে তো কারো নাম্বার ব্ল্যাকলিস্ট করেনি! তাছাড়া আজকে সারাদিন তার ফোন মেহেকের কাছে ছিল। তার মানে এইটা মেহেকেরই কাজ। এখন তো সুজির কথাগুলোই সত্যি মনে হচ্ছে। সুজির চুলে আঠাও কি মেহেক লাগিয়েছিল? নাহলে সে কেন সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে ফারদিনকে কথা বলতে দেয়নি?
ফারদিনের কাছে ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। রাগে কান দিয়ে উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হচ্ছিল যেন। মেহেককে পিষে ফেলতে মন চাইল। এমন সময় পূর্বিতা ম্যাসেঞ্জারে ফারদিনকে ম্যাসেজ করল,” দোস্ত কই তুই? জলদি ড্রয়িংরুমে আয়! মারাত্মক একটা ঘটনা ঘটছে। সুজি আর আনজু বিয়ে করে ফেলছে। তুই চিন্তা করতে পারতেছিস? দুইটা কতবড় শয়তান? পুরা গভীর জলের মাছ!”
ফারদিনের মস্তিষ্ক যেন ফাঁকা হয়ে গেল। কি হচ্ছে এসব? রাগে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে সে যখন বারান্দা থেকে বের হলো, দেখলো মেহেক বিছানায় উঠে ধেই ধেই করে নাচছে আর গান গাইছে,” চুল কাটা সুজি, বিয়ে করল বুঝি!” এমনিতেও মেজাজটা একশো ডিগ্রি হাই। তার উপর এইরকম উদ্ভট দৃশ্য দেখে ফারদিনের রাগ প্রায় অগ্নিবলয়ের রূপ নিল। বিকট শব্দে গর্জন করে উঠলো,” স্টপ ইট মেহেক!”
ফারদিনের হঠাৎ ধমক শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে মেহেক ধপাশ করে বিছানা থেকে নিচে পড়ে গেল।
চলবে