প্রিয়তোষ পর্ব ১৫ লিখা Sidratul Muntaz

0
32

#প্রিয়তোষ
পর্ব ১৫
লিখা Sidratul Muntaz

অন্তরা আলভীদের বাসার দরজায় নক করেছে। দরজা খুললেন আলভীর মা আফিয়া খানম। অন্তরার চোখ-মুখে কান্নার ছাপ৷ চোখ-নাক ফুলে লাল হয়ে দেখাচ্ছে। হাতে লাগেজ ব্যাগ।ওরনা দিয়ে ক্রমাগত চোখ-মুখ মুছছে আর কাঁদছে মেয়েটা। বিধ্বস্ত অপরিচিত মেয়েটিকে দেখে আফিয়া খানিক ঘাবড়ালেন। হকচকিয়ে বললেন,” কে তুমি? কাকে চাও?”

অন্তরা ক্রন্দনরত অবস্থায় বলল,” আলভী বাসায় আছে?”

” না, আলভী তো বাসায় নাই। তুমি আলভীর কে হও?”

” আপনি কি আন্টি? মানে আলভীর মা?”

” হ্যাঁ।কিন্তু তুমি কে? আর কাঁদছো কেন এভাবে?”

অন্তরা শুরু করল চূড়ান্ত নাটক। কাঁদতে কাঁদতে দরজার সামনে বসে পড়ল। আফিয়া আরো অবাক হলেন। হুট করে একটা অচেনা মেয়ে এসে তার বাড়ির দরজার সামনে বসে এইভাবে কাঁদছে কেন? মনে তো হচ্ছে প্রেমঘটিত ব্যাপার। আফিয়া কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন। অন্তরাকে বসা থেকে উঠিয়ে বললেন,” আচ্ছা তুমি আগে ভেতরে এসো। তারপর শুনছি কি হয়েছে।”

অন্তরা এক কথায় ভেতরে ঢুকে গেল। মনে হচ্ছে ভেতরে আসতে বলায় মেয়েটা খুশিই হয়েছে। ভেতরে ঢুকে দেখল জুতা পড়েই চলে এসেছে। তাই আবার বাইরে গিয়ে জুতা গুলো খুলল। লাগেজটা নিয়ে ভেতরে ঢুকেই সোফায় বসে গেল। আফিয়া দরজা লাগিয়ে অন্তরার পাশে বসলেন। অবাক হয়ে তিনি দেখছে মেয়েটিকে।

অন্তরা নাক মুছতে মুছতে বলল,” আমি অন্তরা।”

” আচ্ছা অন্তরা। এবার বলো কি হয়েছে তোমার? আমার ছেলে কি তোমার সাথে কোনো অন্যায় করেছে?”

অন্তরা নিজেকে স্বাভাবিক করে দুঃখী দুঃখী কণ্ঠে বলতে লাগল,” আন্টি, ওর সাথে আমার পুরো তিনবছরের সম্পর্ক। মাঝে একবার ব্রেকআপও হয়েছিল। তাও কার জন্য জানেন? আপনার প্রবাসী বড় ছেলের গার্লফ্রেন্ডের জন্য। ”

” আমার বড় ছেলে? মানে আবির?”

” হ্যাঁ। ওই আবির ভাইয়ার একটা গার্লফ্রেন্ড ছিল। কি যেন নাম, আদ্রিতা না পাদ্রিতা জানি?”

” আদ্রিতা।”

” হ্যাঁ। ওই মেয়ে আমাকে এত্তো অপমান করেছে আন্টি আমি আপনাকে কি বলবো? আপনি আমার মায়ের মতো। মায়ের কাছে এসব কিভাবে বলি?”

” আচ্ছা আমি বুঝতে পেরেছি। ওই মেয়ের মুখ তো মুখ নয় পঁচা নর্দমা। চরিত্রও ভীষণ বাজে। ওর সাথে আবিরের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বিয়েটা ভেঙে গেছে। আমরাই ভেঙে দিয়েছিলাম৷ সে আরো দুইবছর আগের ঘটনা।”

” হ্যাঁ আমি তখনকার কথাই বলছি আন্টি। এর আগে আলভীর সাথে আমার রিলেশন ছিল। ওই আপুটার জন্য সেই রিলেশন ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। তারপর আবার আমাদের প্যাচআপ কিভাবে হয়েছিল জানেন? ছাব্বিশে অক্টোবর আলভীরা পাহাড় ট্রেকিং এ গেল না? সীতাকুন্ডে?”

” হ্যাঁ।”

” ওইখানে আমিও গিয়েছিলাম আমার ফ্রেন্ডদের সাথে। আপনার ছেলে খাদে পড়ে যাচ্ছিল। ওই খাদ থেকে আমি ওকে টেনে তুলেছি। কিন্তু ‘উপকারীকে বাঘে খায়’ একটা প্রবাদ আছে না? আপনার ছেলে হলো সেই বাঘ। আমি ওকে খাদ থেকে টেনে তুললাম, ওর জীবন বাচালাম, আর ও এখন আমাকেই ছেড়ে চলে যেতে চাইছে।”

অন্তরা আবার কাঁদতে শুরু করল। চোখে হাত দিয়ে কান্না। আফিয়া পড়ে গেলেন মহা মুশকিলে। এই মেয়ে কথা বলে কম, কাঁদে বেশি। একে কিভাবে সামলাবেন? উনি অন্তরার মাথায় হাত রেখে বললেন,” আহারে! কি করেছে কুলাঙ্গারটা তোমার সাথে?”

” প্রথমে আমার সাথে নাটক করেছে, বিয়ের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখন আমি.. আমি..”

অন্তরা আবার কাঁদতে লাগল। আফিয়া ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন,” মা তুমি নির্দ্বিধায় বলো। কি হয়েছে?”

” কিভাবে আপনাকে বলি কথাটা আন্টি? আপনি আমার মায়ের বয়সী।”

” আহা বলোই না। কি কথা?”

” আমি দুইমাসের প্র্যাগনেন্ট..”

তারপর আবার কান্না শুরু। আফিয়া মুখে হাত রেখে চোখ বড় করে বললেন,” কি বলো? হারামজাদা এতোবড় ঘটনা ঘটায় ফেলছে?”
অন্তরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ” শুধু তাই না আন্টি। এখন আমার সাথে ব্রেকআপ করতে চায় ও। আর.. দাঁড়ান.. দেখাই আপনাকে।”

অন্তরা হ্যান্ডব্যাগ থেকে একপাতা ট্যাবলেট বের করল। বলল,” এইযে দেখেন আন্টি, এগুলো আমাকে কিনে দিয়ে বলে কিনা অ্যাবর্শন করে ফেলতে।”

অন্তরা কাঁদছে। জোরে জোরে কাঁদছে। আফিয়া বিস্ফারিত চোখে অন্তরার হাত থেকে ট্যাবলেটের পাতাটা নিলেন। তার এসব দেখে মাথা ঘুরছে। চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে আসছে।

অন্তরা কান্না বজায় রেখে বলল,” আপনিই বলুন আন্টি, একটা বাচ্চা নষ্ট করা কতবড় অন্যায়! আমি ওকে জন্ম দিতে পারবো না, কিন্তু তাই বলে মেরে ফেলব? আমি কি এতোই পাষাণ! আপনিও তো মা। আপনিই বলেন কোনো মা কি পারে তার সন্তানকে মেরে ফেলতে?”

আফিয়া জবাব দিলেন না। তিনি রীতিমতো বাকরুদ্ধ। অন্তরা বলতে লাগল,” আমার বাসায় এ কথা জানলে এই বাচ্চার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলবে। এদিকে আপনার ছেলে আমার ফোনও ধরছে না। আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিলনা। তাই বাধ্য হয়ে আপনার কাছে এসেছি। এখন আপনি এর একটা বিহিত করুন আন্টি। আপনিই আমার শেষ ভরসা। নাহলে আমি ভারী কলসি গলায় বেঁধে পানিতে ডুবে মরব। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার কাছে।”

আফিয়া অনেকক্ষণ পর মৃদু স্বরে বললেন,” ছি, ছি, এসব কথা বলে না মা। ”

অন্তরা কাঁদছে। আফিয়া বিস্ময় সামলে উঠতেই বললেন,” তুমি একদম ঠিক করেছো আমাকে এসব জানিয়ে। এবার শুধু দেখো আমি কি করি। তুমি ওঠো মা, অনেক কান্নাকাটি করেছো আর না। চোখ মোছো।”

” আন্টি বাসায় আমার বিয়ের কথা চলছে। কিন্তু আমি অন্যকাউকে কিভাবে বিয়ে করি বলেন? তাই ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে একেবারে চলে এসেছি। আপনি যদি আমাকে আশ্রয় না দেন তাহলে আমি আ’ত্মহ’ত্যা করবো।”

” আমার ছেলে তোমার সাথে যেটা করেছে তার মাশুল ওকে দিতেই হবে। ও খালি আজ বাসায় আসুক।”

অন্তরা মাথা তুলে বলল,” আন্টি, আমি কিন্তু একেবারে বাসা থেকে চলে এসেছি। এই মুখ নিয়ে বাড়ি ফেরা আমার পক্ষে আর সম্ভব না। যদি আপনারা এখান থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেন তাহলে আমি সোজা রেললাইনে গিয়ে মাথা দেবো।”

আফিয়া ভ’য়ে তটস্থ হয়ে বললেন,” আরে কি আবোল-তাবোল কথা! তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে কে? যাও আলভীর ঘরে গিয়ে বসো। হাত মুখ ধুঁয়ে ফ্রেশ হও। খেয়েছো কিছু?”

” না।” দুইপাশে মাথা নাড়ল অন্তরা।

আফিয়া বললেন,” আচ্ছা ঠিকাছে, আমি তোমাকে খাবার দিচ্ছি। যাও মা যাও, আর কান্নাকাটি করো না।”

অন্তরা কাঁদতে কাঁদতে আলভীর ঘরে গেল। আফিয়া মুখে হাত চেপে সোফায় বসে রইলেন। তার এখনও হাত-পা কাঁপছে। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। তার কুলাঙ্গার ছেলেটা তলে তলে এতো কাহিনি ঘটিয়ে ফেলল আর উনি কিচ্ছু টের পেলেন না?

আলভী বাসায় এসে দেখল অন্তরা তারই ঘরের তারই বিছানায় আরাম করে শুয়ে মোবাইল টিপছে। অন্তরাকে বাসায় দেখে আলভীর মাথায় বাজ পড়ল যেন। বিস্ময়ে ঘাবড়ে গিয়ে বলল,” তুমি? তুমি এখানে কি করছো?”

অন্তরা মুচকি হেসে বলল,” এইতো, তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম জান।”

” মানে? তুমি আমার বাসার এ্যাড্রেস কোথায় পেলে?” আলভী আ’তঙ্কে অস্থির। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ আছে নাকি। মা-বাবা জিজ্ঞেস করলে সে কি উত্তর দেবে?

অন্তরা উঠে বসতে বসতে চোখ টিপে বলল,” পেয়েছি! মন দিয়ে খুঁজলে সব পাওয়া যায়।”

” এখনি আমার বাসা থেকে বের হও।”

” সরি, সেটা সম্ভব না।”

” মানে?”

” ওইযে দেখো আমার লাগেজ, সব গুছিয়ে একেবারে চলে এসেছি। তোমার কাছে।”

আলভীর মাথা কাজ করছে না। অন্তরা এসব কি বলছে? সে তীব্র মেজাজ দেখিয়ে বলল,” তুমি কি ফাজলামো করছো আমার সাথে? দেখো এসব করে কোনো লাভ নেই। আমি একবার বলে দিয়েছি রিলেশন রাখবনা মানে রাখবোই না। নাউ গো টু হেল।”

” রিলেশন তোমাকে রাখতে হবে না। আর আমি কেন হেলে যাবো? হেলে তো এবার তোমাকে পাঠাবো বেবি।”

আলভী রাগে ফুসতে ফুসতে অন্তরার লাগেজটা তুলে ওর হাতে দিয়ে বলল,” এক্ষুনি বের হও।”

এমন সময় আফিয়া ঘরে ঢুকলেন। পাথর কঠিন মুখে বললেন,” ও কোথাও যাবেনা। ওকে আমি থাকতে দিয়েছি, ও এখানেই থাকবে।”

আলভী অবাক হয়ে বলল,” ও। এবার বুঝতে পেরেছি। মেয়েটা তোমার ব্রেইনওয়াশ করে এই বাসায় ঢুকেছে তাইনা মা? এই বাসায় ওকে আমি এক মিনিটও টিকতে দিবো না। এই বের হও।”

আফিয়া ঠাস করে আলভীর গালে চড় মা’রলেন। মায়ের আক্রোশী আচরণে ভ্যাবাচেকা খেল। আফিয়া ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন,” এতোবড় একটা কান্ড করার পরেও লজ্জা করে না তোর? তুই আবার ওকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলছিস? বাসা থেকে তো তুই নিজে বের হবি। আজকে তোর বাবা আসুক! তারপর তোর বিচার হবে। অন্তরা তুমি চলে এসো, আমার ঘরে থাকবে।”

আফিয়া অন্তরাকে নিয়ে চলে গেল। আলভী বোকার মতো তাকিয়ে রইল। ক্রমশ তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। নিজের চুল নিজ হাতে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। অকারণেই টেবিলে কয়েক বার লাথি দিল সে। দেয়ালে কয়েকবার ঘুঁষি মারল৷ তবুও রাগ কমছে না।

আলভীর বাবা আহসানুল্লাহ বাসায় এসে সব শুনলেন। তবে তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। কেবল বিরাট একটা লাঠি নিয়ে আলভীকে বেরধক পেটানো শুরু করলেন। আফিয়া ঘাবড়ে গেলেন এ অবস্থা দেখে। পেটাতে পেটাতে ছেলেকে না মেরেই ফেলেন। উনি কাঁপা হাতে অনিকের মা ইলোরাকে ফোন করলেন। অনিকরা ওদের এলাকাতেই থাকে। যে কোনো সমস্যায় সাহায্যকারী প্রতিবেশীর মতো ছুটে আসেন ইলোরা।

আফিয়া ইলোরাকে ফোন করে বাড়ির পরিস্থিতি জানালানে। অনুরোধ করলেন অনিককে যেন এখানে পাঠানো হয়। ইলোরা শুনে হা হুতাশ করতে লাগলেন। আলভী ছেলেটাকে কত ভালো ভেবেছিলেন তিনি! অথচ সে এসব কি করল?

অনিক এসে আলভীদের বাড়ির পরিবেশ ঠান্ডা করল। আহসানুল্লাহ আর আফিয়াকে নিয়ে বৈঠকে বসল। অনিক মাঝখানে, দুইপাশে আহসানুল্লাহ আর আফিয়া। সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আলভী। মার খেয়ে ওর চেহারাই বদলে গেছে। আহসানুল্লাহ এখনও শান্ত হোন নি। একটু পর পরই মেজাজ গরম করে ছেলেকে মা’রতে যাচ্ছেন। অন্তরা আফিয়ার ঘরে চুপচাপ বসে আছে। বসার ঘরে কি আলোচনা হচ্ছে সেটাও কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে।

অনিক অন্তরা আর নোরার প্ল্যানের ব্যাপারে সব জানতো। সে আহসানুল্লাহকে ঠান্ডা করার উদ্দেশ্যে বলল,” আঙ্কেল, এভাবে রাগারাগি করে লাভ নেই। ঘটনা যেহেতু ঘটেই গেছে, আমাদের এখন উচিৎ একটা সমাধানে আসা।।”

আহসানুল্লাহ রাগান্বিত গলায় বললেন,” সমাধান পরে। আগে এই কুলাঙ্গারকে আমি পুলিশে দিবো। কত্তবড় জানোয়ার একটা মেয়ের গোটা জীবন নষ্ট করে দিল। এমন আরো কত জায়গায় কত কাহিনি করছে ও জানে আর ওর আল্লাহ জানে। ওই কু*ত্তা**রবাচ্চা, ওই হারামজাদা। তুই এখনি বের হো। আমার বাসা থেকা বের হো তুই।”

অনিক আহসানুল্লাহর হাত ধরে বলল,” আঙ্কেল থামেন। মাথা ঠান্ডা করে ভাবেন, ওকে পুলিশে দিলে মান-সম্মান আপনারই যাবে। আর মেয়েটারও বাসায় জানাজানি হবে। বদনাম ছড়াবে। তার চেয়ে ভালো আমি একটা কথা বলি, অন্তরাদের বাসায় আপনারা বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। বিয়ে ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

আহসানুল্লাহ আরও চটে গেলেন। উচ্চগলায় বললেন,” কোন মেয়ের বাবা মা রাজি হবে এই অধমের কাছে মেয়ে দিতে? ও তো এলাকার ভাদাইম্মা। না আছে কোনো চাকরি না আছে কোনো যোগ্যতা। এই গাধাকে আমি কেমনে বিয়া করাই? কিসের ভরসায়?”

” আঙ্কেল এতো কথা চিন্তা করার সময় এখন না। এতোবড় দুর্ঘটনা যেহেতু ঘটে গেছে, বিয়ে ছাড়া আমি আর কোনো উপায় দেখছি না। তাছাড়া বিয়ে না দিলে মেয়েটা যদি উল্টা-পাল্টা কিছু করে তখন কিন্তু দোষ আবার আপনাদের ঘাড়েই এসে পড়বে। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে যাবে। এমনিতে তো হ্যারসমেন্টের কেইস হতো, পরে কিন্তু হয়ে যাবে মার্ডার কেইস।”

আফিয়া মাথা নেড়ে বললেন,” হ্যাঁ বাবা ঠিক বলেছো। আমিও সেটা ভেবেই মেয়েটাকে ঘরে রেখেছি।”

আহসানুল্লাহ খানিকটা আতঙ্ক নিয়ে বললেন,” এখন কি হবে বাবা? কিছু একটা করো তুমি।”

অনিক বলল,” শোনেন আঙ্কেল, আমি যেটা বলছি সেটা একবার ভেবে দেখেন। আপনি অন্তরাদের বাসায় প্রস্তাবটা দেন।”

” বাবা তুমি যতটা সহজ ভাবছো বিষয়টা কিন্তু অত সহজ না। ওরা কেমনে রাজি হবে? আর এই গাধার বাচ্চার কাছে তো অন্ধ-খোড়া মেয়েও বিয়ে দিবে না কেউ।”

” আঙ্কেল অন্তরা আমার স্টুডেন্ট। আমি না হয় টিচার হিসেবে ওর মা-বাবার সাথে কথা বলবো। ওদেরকে রাজি করানোর চেষ্টা করবো। আপনি খালি প্রস্তাব দেন। বাকিটা ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার।”

আহসানুল্লাহ মাথা নেড়ে বললেন,” ঠিকাছে, দেখি।”

ওমনি আলভী চেচিয়ে উঠল,” না আব্বু। আমি বিয়ে করবো না।”

আহসানুল্লাহ বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন,” হারামজাদা! তুই আবার কথাও কস?”

বলতে বলতে পায়ের জুতা খুলে ছুড়ে মারলেন আলভীর গায়ে। আলভী ক্যাচ ধরে ফেলল। নিয়মিত ক্রিকেট খেলার এই এক সুবিধা। কেউ কিছু ছুড়ে মারলে সহজেই ক্যাচ ধরে ফেলা যায়।

অনিকের কথা অনুযায়ী আলভীর বাবা-মা অন্তরাদের বাসায় গেলেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। নোরা ওইদিকে অন্তরার বাবা-মাকে বুঝিয়ে রেখেছিল। অন্তরা দুইবছর ধরে যে ছেলের জন্য ডিপ্রেশনে ছিল, ওই ছেলেটাই আলভী। অন্তরা ছেলেটাকে খুব ভালোবাসে। তাছাড়া পারিবারিক অবস্থাও খারাপ না আলভীদের। বড়ভাই বিদেশ থাকে। যে-কোনো সময় আলভীও চলে যাবে। এসব জেনে অন্তরার মা-বাবাও রাজি হলেন। অন্তরা-আলভীর বিয়ে ঠিক করা হলো।

বাড়ির পাশেই একটা খোলা মাঠে স্টেজ সাজানো হয়েছে। আজ অন্তরা আর আলভীর বিয়ে।প্যান্ডেল টানিয়ে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুব বেশি আয়োজন না, ছোটখাটো অনুষ্ঠান। এলাকার কয়েকজন, অন্তরা-আলভীদের নিজস্ব আত্মীয় আর বন্ধু-বান্ধবদের নিয়েই বিয়ের অনুষ্ঠান। আর অনিক-নোরা তো আছেই।

সেজুতি,তন্নী, রেশমি, জবা, এক কথায় কোচিং-এর সব বন্ধুরা এসেছে। এই অনুষ্ঠানে নোরা তিথি মেয়েটিকে সরাসরি দেখল। মেয়েটি অসম্ভব সুন্দর। আর বেশ লম্বাও। নোরার থেকে তো কমপক্ষে একহাত লম্বা। অনিকের পাশে দাঁড়ালে একদম পারফেক্ট লাগে। মনে হয় যেন মেইড ফর ইচ আদার জুটি। তিথিকে দেখে নোরার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এজন্যই কি অনিকের মা তিথিকে এতো পছন্দ করেন?

অনিক ম্যানেজমেন্টের কাজে ব্যস্ত। টেবিলে খাবার দেওয়া, আনা-নেওয়া,সবাইকে বেড়ে খাওয়ানো, সবকিছু অনিক আর ওর গ্রুপ মেম্বাররা করছে। অনিক আজকে লেমন কালার শেরয়ানি পরেছে। ওকে যে কি সুন্দর লাগছে! নোরার বারবার চোখ আটকে যাচ্ছে। এদিকে অনিকেরও একই অবস্থা। নোরা পিঠ অবধি লালচে চুলগুলো দুলিয়ে তার চোখের সামনে এপাশ-ওপাশ ছুটোছুটি করছে। অনিক যতবার তাকাচ্ছে ততবার ছোটখাটো ধাক্কা খাচ্ছে। তার উপর নোরা পড়েছে রাণী গোলাপী রঙের লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গার উপর সোনালী সুতোর কাজ। মুখে হালকা-পাতলা মেকাপও করেছে।

আজকে একদম অন্যরকম লাগছে নোরাকে। ওর চুলের রঙ আর গায়ের রঙের সাথে লেহেঙ্গার রংটা ভালোভাবে ফুটে আছে। যেন বিধাতার এক অনন্য সৃষ্টি! অনিক মুগ্ধচোখে নোরাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। অন্তরাকেও আজ ভীষণ মিষ্টি লাগছে। ওর বিয়ের শাড়িটাও মিষ্টি কালার। সেই শাড়িতে অন্তরাকে অপরুপ লাগছে। বধুবেশে কি সব মেয়েকেই এতো মানায়?

আলভীটা মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। আলভীর মুখ দেখে নোরার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। এই বিয়েতে তার মত নেই, সেটা কি সবাইকে বোঝাতেই হবে? ওকে দেখে মনে হচ্ছে চেয়ারে স্কচটেপ লাগিয়ে ওকে জোর করে বেধে রাখা হয়েছে। উঠতে পারছে না বলে বাধ্য হয়ে বসে আছে। এই বিয়ে ভাঙার জন্য কত কান্ড যে সে করেছে! শেষমেষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

পরে আহসানুল্লাহ হু*মকি দিলেন অন্তরাকে বিয়ে না করলে ওকে ত্যায্য পুত্র করবেন। বাবার সম্পত্তির কানা-কড়িও সে পাবেনা। সেই ভয়েই বেচারা বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। আলভীর অসহায় মুখ দেখে নোরা মনে মনে পৈশাচিক আনন্দও পাচ্ছে।

নোরা খেতে বসার সময় সময় ইচ্ছে করেই অনিকের মা ইলোরার পাশে বসল। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যদি হবু শাশুড়ীকে একটু পটানো যায় সেই আশায়! কিন্তু লাভ হলো কই? ইলোরা একটিবারের জন্য নোরার সাথে কথাও বললেন না। এমনকি নোরার দিকে তাকালেন পর্যন্ত না। নোরা বামসাইডে বসেছিল। ডানসাইডে ইলোরা তিথির জন্য জায়গা রেখেছিলেন। তিথি এসে ওখানে বসল।অনিক টেবিলে খাবার দিতে আসার সময় হাসিমুখে একবার বলেছিল,” মা, ও নোরা। আমার স্টুডেন্ট।”

তখন উনি নোরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছেন। সেই হাসিতেও কপটতা, কৃপণতা। নোরার মনটা একেবারে খারাপ হয়ে গেল। তবে অনিকের বাবা ইসহাক সাহেব নোরার সাথে হাসিমুখে গল্প করছিলেন। ইসহাক পান খেতে খুব ভালোবাসেন। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর অনিক নোরার হাতে একটা পান দিয়ে বলল বাবার কাছে নিয়ে যেতে। নোরা ইসহাককে পান দিতে গেল। সেই উসিলাতেই হল গল্প।

অনিক ইসহাককে নোরার পরিচয় বলল। পরিচয় বলতে শুধু নাম। ইসহাক বাকিটা নিজে থেকেই বুঝে নিলেন। হবু শশুরমশাইকে নোরার বেশ পছন্দই হল। হাসি-খুশি ধরণের মানুষ। অথচ অনিকের মাকে দেখলে মনে হয় মুখের মধ্যে সারাক্ষণ ভারী কিছু পুরে রেখেছেন। হাসতে যেন ভীষণ কষ্ট হয় উনার। আর গালগুলো সারাক্ষণ ফুলে থাকে। যেন খুব রাগী মানুষ!

অনুষ্ঠান যখন প্রায় শেষের দিকে, কনে বিদায় হচ্ছে, অন্তরা মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে, সেই মুহুর্তে অনিক নোরাকে টেনে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে এলো। নোরা হাঁটতে হাঁটতে বলল,” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

” লং ড্রাইভে।”

” মানে?”

অনিক যখন দেখল আশেপাশে কেউ নেই, তখন নোরাকে কোলে তুলে নিল। নোরার ভালো লাগলেও সে বিরক্তির ভাণ করে বলল,” ধুর! কি করছেন? কেউ দেখে ফেললে?”

অনিক জবাব দিল না। নোরাকে গাড়ির ভেতরে এনে বসাল। তারপর নিজে বসল ড্রাইভিং সিটে৷ নোরা বলল,” আমরা এখানে কেন আসলাম? কার গাড়ি এটা?”

” আদনান ভাইয়ের। একঘণ্টার জন্য ম্যানেজ করেছি। তোমাকে নিয়ে লংড্রাইভে যাবো।”

” এতোরাতে হঠাৎ লংড্রাইভে কেন?”

” তুমি এতো সুন্দর করে সেজেছো কেন? এ অবস্থায় একটু আদর করতে না পারলে তো আফসোসে মরেই যেতাম।”

অনিক নোরার কোমর ধরে ওকে নিজের কোলের উপর বসাল। নোরা লজ্জায় লুটিয়ে পড়ছে। বলল,” আপনার উদ্দেশ্যটা কি বলুন তো? এভাবে আমাকে অনুষ্ঠানের মাঝখান থেকে তুলে নিয়ে আসলেন? সবাই তো পরে আমাদের খুঁজবে।”

” খুঁজুক। সবাইকে খুঁজতে দাও। আজরাতের জন্য নিখোঁজ হবো আমরা।”

নোরা আর কিছু বলার আগেই অনিক ওকে গ্রাস করে নিল।

আলভী ছাদের রেইলিং এর উপর বসে সিগারেট টানছে। ওর দুইপাশে শিপন আর আরিফ। আলভীর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওর সকল কুকর্মের সঙ্গী। তিনজনের হাতেই মদের বোতল। আলভী মদও খাচ্ছে। আর বেহুশের মতো খালি টলছে। শিপন আলভীকে উদ্দেশ্য করে বলল,” কিরে মামা! আর কত খাবি? আজকা না তোর বাসররাত! আজকা এতো খাইস না। অসুবিধা আছে।”

আলভী চেচিয়ে উঠল,” রাখ তোর বাসররাত! এইডা বালের রাত। এই বিয়াই আমি মানি না আবার বাসর! ওই মাইয়ার লগে বাসর অনেক আগেই হইয়া গেসে। অয় এহন আমার কাছে মাল। ওইডাও মাল, এইডাও মাল। ওই মালের থেকা এই মালই ভালা। এইডাই খাই।”

আলভী মদের গ্লাসে চুমুক দিল। আরিফ বলল,” তুই বিয়াডা করলি ক্যা তাইলে?”

আলভী তাচ্ছিল্যের হাসি দিল,” চাপ মামা চাপ! চাপে পইড়া করসি। ওই মাইয়ারে বিয়া না করলে আমার বাপে আমারে ত্যায্য করতো। কপাল কইরা একটা বাপও পাইসি বটে। শালার জীবনডাই ত্যানা বানায় দিল।”

আলভী হাতের গ্লাসটা জোরে ছুড়ে মারল। ঝনঝন শব্দে গ্লাসটা ভেঙে পড়ল।শিপন বলল,” আরে কি শুরু করলি?”

আরিফ বলল,” ওর মাথা ঠিক নাই। নেশা হইয়া গেসে মনে হয়। ধর ওরে, নিচে নিয়া যাই।”

আলভী বলল,” ওই থাম! আমি কোনোখানে যামু না। ওই মাইয়ার কাছে তো জিন্দেগীতেও না। ওরে আমি মানি না, মানমু না। সব হইসে ওই কালনাগিনী নোরার লাইগা। মাইয়াটা মিচকা শয়তান বুঝলি? ওই মাইয়ারে যতদিন শিক্ষা দিতে না পারমু, আমার শান্তি নাই। আমার জীবনডা দোযখ বানায় ছাড়সে অয়। ওরে আমি ছাড়মু না।”

আরিফ রসিকতাপূর্ণ হাসি দিয়ে বলল,” কি করবি? অয় তো শুনলাম অনিক ভাইয়ের জানের জান। ওরে কিছু করার সাধ্য কি তোর আছে? মুখেই খালি তোমার ফটরফটর মিয়া!”

শিপন আরিফের কথায় হাসল।আলভী আগুন গরমচোখে তাকাল। আচমকা আরিফের গালে চড় বসিয়ে দিল সে। আরিফ হকচকিয়ে গেল। আলভী কাপা কাপা কণ্ঠে বলল,” তুই এই কথা কইয়া আমার রাগ আরো একশো গুণ বাড়ায় দিসোস। বুকের মধ্যে দাউদাউ কইরা আগুন জ্বলতাসে আমার। এই আগুন এতো সহজে নিভবো না। ওই মাইয়ারে তো আমি দেইখা লমুই। তোরেও দেইখা লমু।”

শিপন বলল,” কি করবি দোস্ত? মুখে এসিড মারবি?”

আলভী বাঁকা হেসে বলল,” অয় যা করসে, ওইডার লাইগা এই শাস্তিও খুব কম হইয়া যায়। আমার পুরা জীবনডা নষ্ট করসে ওই মাইয়া। ওর জীবনও আমি তেজপাতা বানামু। ওরে এমন শিক্ষা দিমু, যেন সারাজীবন মনে রাখে। আমার নাম বুকের মধ্যে গাইথা রাখে। চাইলেও যেন কোনোদিন ভুলতে না পারে।”

আলভী শয়তানি হাসিতে মত্ত হল। ওর চোখেমুখে তীব্র ক্রোধ উপচে পড়ছে। শিপন আর আরিফও সেই হাসি দেখে ভয়ে শিউরে উঠল। এই হাসি যেন হাসি নয়, সর্বনাশের ইঙ্গিত!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here