প্রিয়তোষ #পর্ব_৭ লিখা: Sidratul muntaz

0
32

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_৭
লিখা: Sidratul muntaz

স্কুটারে বসে নোরা কাঁপছে। কিছুক্ষণ আগের সেই সুখানুভূতির কথাটি মনে পড়তেই তার শরীর শিহরীত হয়ে উঠছে। অন্তরা নোরার শরীরের কম্পন টের পেতেই বলল,” এই নোরা, কি হয়েছে তোর? কাঁপছিস কেন এভাবে?”

নোরার মুখে আনন্দের হাসি। চোখ উজ্জল। মুখে লজ্জার ছাপ। সেই লজ্জায় তার গাল দুটো গোলাপী আভায় ভরে উঠেছে। অনিককে এতো কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য এর আগে কখনো হয়নি তার। অনিক যখন তাকে কোল থেকে নামাচ্ছিল, নোরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অনিকের ফরসা গালের খোচা খোচা দাড়িতে এক নেশা জাগানো সুভাষ। আর কিছুক্ষণ কোলে থাকলে নোরা হয়তো চুমু দিয়ে ফেলতো ওই গালে। ভেবেই সে একটা চিৎকার মে’রে স্কুটি থামিয়ে দিল। একটা ভ্যানের সাথে এখনি টক্কর খাচ্ছিল স্কুটিটা। একটুর জন্য এ’ক্সিডেবট হয়নি। নোরা বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাঁপাচ্ছে। আশেপাশের মানুষ বিরক্ত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভ্যানওয়ালা বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে চলে গেল।

অন্তরা বলল”এই নোরা, কি হয়েছে তোর? ঠিকাছিস? এখনি তো একটা দূর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল।”

অন্তরা কাঁধ ধরে ঝাকাতেই হুশ ফিরল নোরার। সে বলল,” হ্যাঁ?”

“কি ভাবছিস? তোর কি হয়েছে?”

নোরার মুখে আবার সেই হাসির ঝিলিক। খুশিতে ভাসতে ভাসতে অন্তরার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,” অন্তুরেএএএ, জানিস, আজ কি হয়েছে?”

” কি হয়েছে? না বললে জানবো কিভাবে?”

” আজকে অনিকস্যার আমাকে কোলে তুলেছেন।”

এ কথা বলেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল নোরা। অন্তরা অবাক হয়ে নোরার মুখের কাছে এসে চিৎকার করে বলল,
” কি? তুই সত্যি বলছিস?”

” হুম।”

” কখন? কোথায়? কিভাবে?”

” ছুটির পর ছাদে গিয়েছিলাম। ওখানে অনিকস্যারও ছিলেন। সিড়ির উপর একটা কালো ট্যাংক আছেনা? উনি ওখানে বসেছিলেন। আমিও উঠেছি। কিন্তু নামার সময় আর নামতে পারছিলাম না। তখন উনি আমাকে কোলে করে নামিয়েছে।”

” সো লাকি! তোর ভাগ্যটা খুব ভালো রে নারু! কিন্তু এখনও এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ সেজুতি বলেছিল অনিকস্যারেরর গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে।”

” এক্ষুনি তওবা কর। এসব অলুক্ষুণে কথা বলতে হয়না।”

” তুই কি সিউর উনি সিঙ্গেল? যদি গার্লফ্রেন্ড থাকে তাহলে কি করবি?”

” প্রশ্নই আসেনা। উনার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।”

” এত্তো সুদর্শন হ্যান্ডসাম একটা লোক। অথচ কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই? তাও আবার এই যুগে? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার!”

নোরা কঠিনগলায় বলল,” তুই কি বলতে চাইছিস?”

” আমি বলতে চাইছি, যদি উনার গার্লফ্রেন্ড না থাকে মানে যদি উনি সত্যিই সিঙ্গেল হয় তাহলে তো ভালোই। খুব ভালো। কিন্তু সেটার সম্ভাবনা টেন পারসেন্ট। আর গার্লফ্রেন্ড থাকার সম্ভাবনা কিন্তু প্রায় নাইনটি পারসেন্ট।”

” তুই পারসেন্টেজ কিভাবে বের করলি?”

” দৈবভাবে চিন্তা করলে পারসেন্টেজ এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।”

“তুই কি সম্ভাবনার অংক কষতে বসলি?”

” আচ্ছা আমাকে বলতো, অনিকস্যার কি তোকে নিজের মুখে কোনোদিন বলেছে যে উনার গার্লফ্রেন্ড নেই বা উনি সিঙ্গেল?”

” না সেটা বলেনি। আমি অনেক কায়দা করে জিজ্ঞেসও করেছি। কিন্তু উনি চালাকী করে বিষয়টা এড়িয়ে গেছেন।”

” তারমানে গার্লফ্রেন্ড আছে। কিন্তু তোকে বলতে চায়না।”

” বলতে চাইবে না কেন?”

” কারণ উনি ব্যাক্তিগত বিষয় স্টুডেন্টদের সাথে শেয়ার করা পছন করেন না। সবাই তো আর আফজাল স্যারের মতো না। গড়গড় করে খালি গার্লফ্রেন্ডের গল্প বলবে আর চাপাবাজী করবে। ”

নোরা হেসে ফেলল। তারপর বলল,” নিশ্চিত হয়েই বলছি। উনার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।”

” নিশ্চিত কিভাবে হলি?”

” গার্লফ্রেন্ড থাকলে উনি আমাকে এতো লাই দিতেন না। আমি তো আকার-ইঙিতে বুঝিয়েছি যে আমি উনাকে পছন্দ করি। আর উনিও অবশ্যই সেটা বুঝেছেন। গার্লফ্রেন্ড থাকলে নিশ্চয়ই আমাকে ইগনোর করতেন।”

” উনি তোকে লাই দিচ্ছেন এটাই বা কিভাবে বুঝলি?”

” কাল আমাদের চ্যাটিং দেখালাম না তোকে? আর আজকে ছাদে যাওয়ার ঘটনাটাই ভাব।”

” সব ভেবেই বলছি। তুই আগে ভালোমতো নিশ্চিত হয়ে নে। উনার মতো ছেলেদের আমার কেন জানি বিশ্বাস হয়না। তোর আলভীর কথা মনে নেই?”

” তুই আলভীর সাথে উনার তুলনা করছিস? আলভী তো একটা ফ্রড।”

” হ্যাঁ আমি জানি অনিকস্যার আলভীর থেকে শতগুণে ভালো। কিন্তু তবুও ভয় হয়। সুন্দর ছেলে তো! ওদের প্যাশনই হচ্ছে দুই-তিনটা করে গার্লফ্রেন্ড পালা। আর আলভীর সাথে উনার চেহারার কোথায় একটা মিলও আছে। আমি চাইনা তুইও আমার মতো ছ্যাকা খেয়ে বাঁকা হয়ে বসে থাকিস।”

” কোনো চান্সই নেই। আর আমি তোর মতো অন্ধ না। আলভীকে দেখলেই বোঝা যেত ও যে একটা ফ্রডমার্কা। সবাই বুঝতো খালি তুই বুঝতিনা। প্রেমে অন্ধ হয়েছিলি।”

” এমন অন্ধ তুইও হয়ে যাস না।”

” হবো না ইনশাআল্লাহ। ”

নোরা ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় বারবার নিজেকে দেখছে। আর একাই একাই হেসে উঠছে। এখনো অনিকের ছোয়া ভুলতে পারছে না সে। মনে হচ্ছে অনিক এখনো তাকে ছুয়ে আছে। এতো ভালোলাগা নিয়ে কিভাবে থাকবে সে?নোরা ঠিক করেছে পরনের জামাটা সে যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখবে। কক্ষনো ধোঁবেনা। তাহলে অনিকের ছোয়াটা মুছে যাবে। এই ছোয়া কক্ষনো সে মুছতে দিবেনা।

রাতে অনিক অনলাইনে আসেনি। তবুও নোরা ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছিল। সেই রিপ্লাই এখনও আসেনি। নোরার ঘুম আসছে। কিন্তু সে কষ্ট করে জেগে আছে। অনিকের সাথে কথা না বলে সে ঘুমাতে যাবেনা।নোরার ইচ্ছে পূরণ হলনা। অনিক সারারাত একবারের জন্যেও অনলাইনে আসেনি।

নোরা অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে আবার মেসেজ চেক করল। অনিক তখনও অনলাইনে নেই। বারো ঘণ্টা আগে একটিভ ছিল। নোরার হালকা চিন্তা হল। সারাদিন ছটফট করতে থাকল কখন কোচিং এ যাওয়ার সময় হবে। তাহলে অনন্ত একবার অনিকের সঙ্গে দেখা হবে। এর আগে সে শ্বাসও নিতে পারবেনা। অবশেষে ঘড়ির কাটা চারটায় পৌছাল। নোরা চারটার আগেই বেরিয়ে পড়েছিল।

কোচিং ঢোকার সময় ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েদের কথাবার্তা নোরার কানে আসল। একটা মেয়ে বলছে,” এই শুনছিস, অনিকস্যারের নাকি পা ভেঙেছে।”

আরেকজন বলল,” এজন্যই কি স্যার আজকে আসেনি? তুই কিভাবে জানলি?”

” আদনান স্যারের কাছে শুনেছি। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছেন।”

নোরা এসব কথা শুনে অস্থির ভাব শুরু করল। ক্লাসে ঢোকার সময় দরজার বাহিরে সেজুতি আর অন্তরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,” এই তোরা জানিস? অনিকস্যারের নাকি পা ভেঙে গেছে।”

সেজুতি বলল,” হ্যা শুনেছি। আর আমরা তো উনাকে দেখতে যাওয়ারই প্ল্যান করছিলাম।”

নোরা বলল,” আমিও যাবো।”

অন্তরা বলল,” তুই এতো জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিস কেন? আর ঘামছিস কেন এভাবে? রিল্যাক্স! পা ভেঙেছে। মরে তো যায়নি।”

নোরা ধমকে উঠল,” তোর সবসময় আজে-বাজে কথা তাইনা? মরবে কেন?”

সেজুতি হেসে ফেলল। নোরা কঠিনচোখে তাকিয়ে বলল,” তুই হাসছিস? এইরকম একটা পরিস্থিতিতে হাসছিস?”

“তুই যেমন করছিস হাসি পেয়ে গেল। সরি দোস্ত।”

” যাইহোক।শোন আমি অনিকস্যারের বাসায় যাচ্ছি। তোরা কে কে যাবি আয়।”

অন্তরা সেজুতি একসাথে বলল,” আমি যাব।”

নোরা বলল,” ঠিকাছে তাহলে চল।”

সেজুতি বলল,” আরে এক মিনিট। এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? তুই কি উনার বাসা চিনিস?”

“হ্যা চিনি। একবার গিয়েছিলাম।”

সেজুতি বলল,” আচ্ছা এখুনি কেন যেতে হবে? ছুটির পর যাই?”

” অসম্ভব। আমি ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবোনা। আর ক্লাসেও আমার মন বসবে না। ”

অন্তরা বলল,” কিন্তু ক্লাস ছেড়ে গেলে যদি বাসায় ফোন যায়?”

সেজুতি বলল,” একজেক্টলি। আমিও সেটাই বলছি।”

নোরা বলল,” তাহলে একটা কাজ করি, আমরা আদনান স্যারের কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে নেই। উনাকে একটু কনভেন্স করতে হবে। কে পারবি?”

সেজুতি বলল,” আমি ট্রাই করবো।”

” ঠিকাছে তাহলে চল।”

আদনান স্যারের পারমিশন পাওয়া গেল। নোরা,সেজুতি আর অন্তরা স্কুটারে করে বিশমিনিটের মধ্যে অনিকের বাসায় পৌঁছাল। গিয়ে তারা দেখল তন্নী,জবা, রেশমি, সাদিয়া সবাই এখানে আছে। অনিকস্যারের মা তাদের যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন। নোরার মনখারাপ হল। সে আরেকটু আগে আসতে পারল না?

নোরাদের ড্রয়িংরুমে বসতে দেওয়া হল। তন্নীরাও সেখানেই বসেছে। নোরা শুধু আশেপাশে অনিককে খুঁজছে। তার ছটফটানিটা কেউ ধরতে পারছে না। কিন্তু একজন বুঝে ফেলল। খুব সুন্দর দেখতে একটা আপু নোরাকে বলল,” তোমার কি বসতে অসুবিধা হচ্ছে?”

নোরা হাসার চেষ্টা করে বলল,” না আমি ঠিকাছি।”

সেজুতি বলল,” আসলে ও স্যারকে নিয়ে খুব টেনশনে আছে।”

অন্তরা মুখ টিপে হাসল। নোরা কঠিনচোখে তাকাল। আপুটা হেসে বলল,” তোমাদের স্যার সুস্থ আছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। এখন ঘুমাচ্ছে তো, ঘুম থেকে উঠলেই তোমাদের সাথে দেখা করবে।”

সেজুতি বলল,” আপনি কি স্যারের বোন?”

মেয়েটা বলল,” বোন না বড়আপু।”

অন্তরা বলল,” ও আচ্ছা, আপু আপনার নাম কি?”

” আনিকা।”

আনিকা ওদের সাথে অনেকক্ষণ গল্প করল। গল্পের মাঝখানে অন্তরা নোরাকে কানে কানে বলল,” দোস্ত ওয়াশরুমে যাব।”

” তো যা না।”

” তুই আমার সাথে যাবি?”

” এটা কি কোচিং এর ওয়াশরুম যে আমাকে যেতে হবে? তুই যা তো।”

অন্তরা উঠে চলে গেল। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও অন্তরা আসছেনা। তাই নোরা উঠে গেল অন্তরাকে খুঁজতে। অন্তরা বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল। নোরা তাই দেখে এগিয়ে গেল,” অন্তু কি হয়েছে তোর? এভাবে কাঁদছিস কেন?”

অন্তরা কান্নার জন্য কথাও বলতে পারছেনা। শুধু কেঁদেই চলেছে। অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর অবশেষে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,” নোরা, দোস্ত আমি এখানে আলভীকে দেখেছি।”

” কি? আলভী এখানে কোথ থেকে আসবে?”

” জানিনা। আমি ওকে দেখেছি।”

” ও তোকে দেখেছে?”

” না ও দেখেনি। আমি ওকে দেখেই অন্যদিকে ঘুরে গিয়েছিলাম। তারপর ওখান থেকে চলে এসেছি। তাই দেখতে পায়নি। কিন্তু আমি এবার কি করবো? আমার তো আবার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।”

” অন্তু তুই মনে হয় ভুল দেখেছিস। আলভী এখানে কিভাবে আসবে?”

অন্তরা শব্দ করে বলল,” আমি ঠিকই দেখেছি। ওইটা আলভীই ছিল।”

কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলে উঠেছে অন্তরার। নোরা ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শুধু। অন্তরা আবার বলল,” আলভী নিশ্চয়ই অনিকস্যারের কেউ হয়। হয়তো অনিকস্যারের আপন ভাই? অনিকস্যারের কি কোনো ভাই আছে?”

” আমি তো জানিনা। শুধু শুনেছিলাম বড়বোন আছে। আর তাকে তো দেখলিই। আনিকা আপু।”

অন্তরা নোরার দুইহাত ধরে বলল,” নোরা তুই বলেছিলি না প্রতিশোধ নিবি? এখন প্রতিশোধ নেওয়ার সময়,সুযোগ দুটোই এসেছে। তুই প্রতিশোধ নে।”

” মানে? কিভাবে প্রতিশোধ নেব?”

অন্তরার চোখেমুখে হঠাৎই হিংস্রতা ভর করল। সে নিষ্ঠুরগলায় বলল,” আলভী তো অনিকস্যারের ভাই। তুই অনিকস্যারকে ফাসাবি। তারপর ছ্যাকা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিবি। আমার যেমন অবস্থা হয়েছিল উনারাও তেমন অবস্থা হবে। তাহলেই আলভী বুঝবে।”

নোরা এ কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। ঢোক গিলে বলল,” অন্তরা তুই পাগল হয়ে গেছিস। আমি এটা কোনোদিন করতে পারবনা। আলভী যদি উনার ভাই হয়েও থাকে তাহলে তার অপরাধের শাস্তি উনি কেন পাবেন?”

অন্তরা নোরার হাতটা নিজের মাথায় ছুয়িয়ে বলল,” আমার কসম বল। তুই প্রতিশোধ নিবি। তুই না আমার বেস্টফ্রেন্ড? প্রুভ ইট।”

নোরা অন্তরার মাথা থেকে হাত সরিয়ে বলল,” ছি। এভাবে কসম কাটতে হয়না। গুণাহ হয়।”

” এসব বলে তুই আমাকে ভোলাতে পারবিনা। তোকে কথা দিতেই হবে। আচ্ছা নোরা, তুই কি সব ভুলে গেছিস? ছয়টা মাস কতটা কষ্টে কাটিয়েছিলাম আমি! পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম।আমার পাশে কিন্তু কেউ ছিলনা। শুধু তুই ছিলি। ছায়ার মতো আমার পাশে ছিলি। তুই না থাকলে হয়তো আমি সুইসাইডই করে ফেলতাম। আর এখন পাশে থাকবি না? দুইদিনের অনিকস্যারের জন্য আমার এতো দিনের কষ্টগুলো ভুলে যাবি? আলভীকে মাফ করে দিবি?”

” আমি তো মাফ করার কথা বলিনি। আমি শুধু বলছি, যে অপরাধ আলভীর সেটার শাস্তি অন্যকেউ কেন পাবে? অনিকস্যারকে কষ্ট দিলে সেটা হবে বিনা দোষে শাস্তি। এতোবড় অন্যায় আমি কখনোই করতে পারবোনা। আর অনিকস্যারের সাথে তো জীবনেও না।”

” তুই আমার থেকেও অনিকস্যারকে ভালোবাসিস?”

” তুই আর উনি সম্পুর্ণ আলাদা। তুই তো আমার বোনের মতো। তোর কষ্ট যেমন আমি সহ্য করতে পারিনা, তেমনি উনার কষ্টও পারবো নারে। কিন্তু আলভীর শাস্তি হবে। অবশ্যই হবে৷”

” কিভাবে শাস্তি হবে?”

” অনিকস্যারের সাথে না। ধোঁকাবাজী যদি করতে হয় তাহলে আলভীর সাথে করবো৷ ও তোর সাথে যা যা অন্যায় করেছে সব আমি ওকে ফিরিয়ে দিব দেখিস!”

“কিন্তু আলভী তো তোকে চেনে। তুই কিভাবে ওকে ফাসাবি? পারবি না তো।”

“সেজুতি তো আছে। সেজুতিকে দিয়ে করাবো।”

” সেজুতিও পারবে না। আলভী তো সুন্দরের পূজারী। সেজুতিকে দেখে ও পটবেনা। তোর উপর ইজিলি পটে যেতো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ও তোকে চেনে।”

” তাহলে ফেসবুকে ওকে ফাসাবো। ”

” ফেসবুকে কিভাবে?”

“ফেইক আইডি খুলে নিজের পরিচয় গোপন করবো। সিম্পল!”

” এতো সহজ না। আলভী খুব চালাক। কথায় কথায় ভিডিও কলে আসতে চাইবে, ফোন করতে চাইবে, দেখা করার কথা বলবে। আর এসব না করলে তোকে পাত্তা দিবেনা। বশেও আসবেনা। ওকে আমি ভালো করে চিনি।”

” তাহলে আর কি উপায়?”

অন্তরা আবার কাঁদো কাঁদোমুখে একই কথা বলা শুরু করল,
” নোরা আমি যেটা বলছি সেটা কর। অনিকস্যারকে ফাসা। উনি তো অলরেডি তোর উপর ফিদা। আর ছেলেরা দুই নম্বর মেয়েদের প্রেমেই বেশি পড়ে বুঝেছিস? তুই যদি মন-প্রাণ উজার করে পাগলের মতো ভালোবাসিস, জান-প্রাণ সব দিয়ে দিস, ওরা তোর ভালোবাসা বুঝবেনা। তোকে ঠকাবে, কষ্ট দিবে, ইগনোর করবে। কিন্তু তুই যদি ভালোবাসার নামে নাটক করিস তাহলে দেখবি তোর পেছনেই পড়ে থাকবে। তোর সবকথায় উঠবে আর বসবে। তোকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝবেনা। তুই লাথি মারলেও তুই-ই ভালো।”

নোরা করুণচোখে অন্তরার দিকে তাকিয়ে আছে। কথাগুলো যে সে খুব কষ্ট থেকে বলছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু অন্তরার প্রস্তাবে রাজি হওয়াও তার পক্ষে সম্ভব না। অন্তরা বলল,” কিরে! পারবি না আমার জন্য?”

” প্রতিশোধ আমি অবশ্যই নিবো অন্তু। কিন্তু অনিকস্যারের উপর না৷ তুই যদি আমাকে তোর জন্য জীবন দিতে বলিস সেটাও আমি পারবো। কিন্তু অনিকস্যারকে কষ্ট দিতে জীবনেও পারবো না। সরি।”

ওদের কথার মাঝখানেই আনিকার ডাক শোনা গেল,” নোরা, তোমরা এখানে কি করছো? তোমাদের স্যার তো ঘুম থেকে উঠে গেছে৷ দেখা করতে যাবে না?”

অন্তরা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে স্বাভাবিক হয়ে নিল। নোরা হাসার চেষ্টা করে বলল,”জ্বী, আসছি।”
“এসো।”

আনিকার পেছন পেছন নোরা আর অন্তরা হাঁটতে লাগল। নোরা ইশারা করে অন্তরাকে চুপ থাকতে বলল। ফিসফিস করে বলল,” এ বিষয়ে আর কোনো কথা না। আলভীকে দেখলেও স্বাভাবিক থাকবি।”

অন্তরা বলল,” আমি ওর সামনেই যাবনা।”

রুমে ঢুকতেই অনিক নোরাকে দেখে হেসে বলল,” কেমন আছো নোরা?”

নোরা অনিকের দিকে তাকাল। অনিকের মাথায়ও ব্যান্ডেজ, বামপায়েও ব্যান্ডেজ। ঘুম থেকে উঠায় চোখগুলো ফুলে আছে। দেখতে কি সুন্দর লাগছে! এলোমেলো চুলগুলো সাদা ব্যান্ডেজে আটকানো। এই মুহুর্তে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য নোরার কাছে আর কিচ্ছু হতেই পারেনা। প্যান্টের বামসাইড হাঁটু পর্যন্ত ওঠানো। ধবধবে সাদা পায়ে সাদা রঙের ব্যান্ডেজ। তার উপর কালো লোম দেখা যাচ্ছে। নোরাকে এমন ড্যাবড্যাব করে অনিক স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেজুতি ধাক্কা দিল। নোরা নড়েচড়ে দাঁড়াল। সেজুতি মিনমিন করে বলল,” কন্ট্রোল দোস্ত কন্ট্রোল!”

নোরা লজ্জা পেয়ে সেজুতির কাঁধে একটা থাপ্পড় দিল।আনিকা এসব দেখে হেসে বলল,” তোমরা মারামারি করছ কেন?”

সেজুতি বলল,” ও-ই আমাকে মারে আপু। ডাকাতনি একটা।”

আনিকা হেসে ফেলল। নোরা আঁড়চোখে অন্তরার দিকে তাকিয়ে দেখল সে গম্ভীরমুখে দাড়িয়ে আছে। তন্নী তার এক্সট্রা কেয়ার শুরু করে দিয়েছে। টিফিনবক্সে অনিকস্যারের জন্য পায়েস আর কি কি যেন খাবার এনেছে। ওসব এখন স্যারকে খাওয়ানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। কিন্তু স্যার মিষ্টিখাবার খায়না।

রেশমি জিজ্ঞেস করল,” ডায়াবেটিস নাকি?”

অনিক বলল,” ডায়াবেটিস না, আমার মিষ্টি জিনিসটাই পছন্দ না।”

নোরার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। সে সেজুতিকে বলল,
” সেজু, এই তন্নী কি বাচ্চি এতো জিনিস আনলো কেমনে? ও কি আগে থেকে স্যারের অ্যাক্সিডেন্টের খবর জানতো?”

“জানতো মনে হয়। ওর তো সব টিচারদের সাথে এড আছে। হয়তো আপডেট পেয়েছে।”

সেজুতি অন্তরার দিকে তাকিয়ে নোরাকে বলল,” ওইডার কি হইসে? ভুতে ধরছে কেন?”

নোরা বলল,” অনেক কাহিনি। পরে বলবো।”

এতোক্ষণে আলভী ভেতরে আসল। আলভীকে দেখে অন্তরার মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যেতে লাগল। বুকের মধ্যে তুমুলমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হল। অবিলম্বে নোরার পেছনে গিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা শুরু করল অন্তরা। কিন্তু আড়াল হতে পারছে না। নোরা তো খুব খাটো আর অন্তরা তুলনামূলক অনেক লম্বা। তাই নোরার পেছনে দাঁড়ালেও তার মাথা দেখা যাচ্ছে। সে ওরনা দিয়ে অর্ধেক মুখ ঢেকে ফেলল।

আলভী এখনো এদিকে তাকায়নি। অন্তরার ছটফটানি দেখে নোরা বলল,” অন্তু প্লিজ, স্বাভাবিক থাক। তুই এমন করলে আলভী বুঝে ফেলবে যে তুই এখনো ওর প্রতি দুর্বল। তুই কি এটা ওকে বুঝাতে চাস?”

অন্তরা তাকিয়ে আছে আলভীর দিকে। কতদিন পর ছেলেটাকে দেখছে সে। একটুও বদলায়নি। একদম প্রথমদিনের মতোই লাগছে। আবার সেই পূরনো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অন্তরার ইচ্ছে করছে ফ্লোরে বসে কেঁদে ফেলতে। এই দুই বছরেও কি একটুও বদলায়নি আলভী? আচ্ছা আলভী কি এখন ওকে দেখলে চিনতে পারবে? হয়তো পারবে। হয়তো না। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে থাকাকালীন অক্টোবর মাসের শেষদিকে আলভীর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল অন্তরার। সেটাই ছিল শেষ দেখা। মানে তাদের জীবনে একবার দেখা হয়েছে। এখন দ্বিতীয়বার দেখা। অন্তরা নিজেকে সামলাতে পারছেনা।

পেছন থেকে অন্তরার কান্নার আওয়াজ শুনে নোরা আতঙ্কিত গলায় বলল,” অন্তু প্লিজ কাঁদিস না। দোহাই লাগে তোর।”

সবাই অনিককে নিয়ে ব্যস্ত তাই এদিকে কেউ তাকাচ্ছেনা। ওদের কথাও কেউ শুনছেনা। আলভী ওদেরকে পিঠ দেখিয়ে অনিকের সামনে বসে গেল। অন্তরা এখন আর আলভীর মুখটা দেখতে পারছেনা। আলভী অনিকের কাঁধে হাত রেখে বলল,” কি অবস্থা ভাই? এখন ঠিকাছো?”

অনিক বলল,” তেমন কিছু হয়নাই। মাথার একসাইডে একটু কেটে গেছে আর বামপাটা মচকে গেছে। সাতদিন বেডরেস্টে থাকতে হবে।”

আলভী বলল,” তাহলে কি সাতদিন ম্যাচ অফ? ”

” আরে না পাগল? সাতদিন কে বেডরেস্টে থাকে? আমার আরো কত কাজ আছে। আমি তিনদিনেই ঠিক হয়ে যাব।”

আনিকা বলল,” একদম না। তোকে সাতদিন বেডরেস্টে থাকতে বলা হয়েছে৷ এর আগে বিছানা ছেড়ে উঠল আমি তোর ডানপা-ও মচকে দিবো।”

এই কথায় সবাই হেসে ফেলল। হাসল না শুধু অন্তরা। সে তো আলভীকে দেখায় ব্যস্ত। কতটা স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে ছেলেটা।

আলভী বলল,” ভাই তুমি রান নিতে গিয়া পড়লা কেমনে?”

অনিক চিন্তিত গলায় বলল,” আমার মনে হচ্ছে আমারে কেউ ল্যাং মারছে। তবুও ব্যালেন্স ঠিক ছিল তাই আস্তে পড়ছি। নাইলে এতোক্ষণে উপর থাকতে হইতো।”

আলভী কপাল কুঁচকে বলল,” কি বলো? বিষয়টা তো খুব ডেঞ্জারাস। এভাবে চললে তো খেলা হইবো না ভাই। কয়দিন পর পর খালি অঘটন ঘটতাছে। আচ্ছা তুমি ট্র্যাকিং এ যাইবা?”

” কোনটায়?”

“সীতাকুন্ড, পাহাড় ট্র্যাকিং। ছাব্বিশ তারিখ যে যাইতাসি আমরা? ”

” দেখি, অবস্থা বুঝে নেই আগে।”

” আইচ্ছা ভাই।জানাইয়ো।”

“আচ্ছা।”

” থাকো তাইলে। আনিকা আপু খেয়াল রাইখো ভাইয়ের।”

অনিককে একবার জড়িয়ে ধরে আলভী বিদায় নিল। অন্তরার হৃৎস্পন্দন এতোক্ষণে শান্ত হল। নোরাকে ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াল সে। আলভী তাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু যদি দেখতে পেতো তাহলে কি করতো? ওর রিয়েকশন কেমন হতো? জানতে খুব ইচ্ছে করছে অন্তরার।

সেজুতি আর নোরা স্কুটারের পেছনে বসে আছে। সেজুতি সবচেয়ে পেছনে, মাঝখানে নোরা। সামনে অন্তরা স্কুটার চালাচ্ছে। এতোক্ষণে সেজুতিকে সবঘটনা বলে ফেলেছে নোরা। অন্তরা চুপ করে ছিল। হঠাৎ বলল,” নোরা একটা কথা বলি?”

” কি কথা বল?”

” তুই জানিস অনিকস্যারের এই অবস্থার জন্য কে দায়ী? ”

” কোন অবস্থা?”

” খেলতে গিয়ে দুর্ঘটনা। পা মচকে যাওয়া।”

” ওহ। কে দায়ী? ”

” আলভী।”

“আলভী কেন? তুই কিভাবে বুঝলি?”

” আমি বুঝেছি। আলভীই অনিকস্যারকে ল্যাং মেরে ফেলেছে। ও আমাকে সবসময় ওদের টিমের এক বড়ভাইয়ের গল্প শোনাতো। উনাকে আলভী খুব জেলাস করে।”

” জেলাস করে কেন?”

” ভালো খেলে তাই। প্রতিবার ম্যাচে হিরো হয় সবাই উনাকে কাঁধে তুলে নাচে। এসব ওর পছন্দ হতোনা। সবসময় সেই বড়ভাইয়ের নামে দুঃখ প্রকাশ করতো আমার কাছে। উনাকে কিভাবে ফাঁসানো যায় আমার কাছ থেকে আইডিয়া নিতো। আমি হেল্প করতামও।আমার সেটা অন্যায় মনে হলেও কখনো কিছু বলতাম না। প্রেমে অন্ধ ছিলাম তো তাই। ওকে খুশি করাই তখন আমার মুল লক্ষ্য। এতোকিছু ভাবতাম না। এখন আমি বুঝতে পেরেছি সেই বড়ভাই-ই হচ্ছে অনিকস্যার। সামনে ওরা ট্র্যাকিং এ যাচ্ছে না? সেখানে যেন অনিকস্যার যেতে না পারে সেজন্যই আলভী এতো কাহিনি করেছে। আমি নিশ্চিত।

“ও বাবা! আগে তো জানতাম মেয়েরাই হিংসুটে ভুতনি হয়। এখন দেখছি ছেলেরাও হয়। কিন্তু অনিকস্যার ট্র্যাকিং এ গেলে ওর কি সমস্যা? ”

” বুঝিস না? হিংসা।”

” আর তুই এই আলভীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমাকে বলছিলি অনিকস্যারের লেকফুল করতে? তাহলে তো আলভী কোনো শাস্তিই পেতো না। আরো খুশি হতো। ”

“তখন তো বুঝিনি। ভেবেছিলাম উনি আলভীর আপনভাই।”

” আচ্ছা অন্তু, কেমন হয় যদি অনিকস্যারদের মতো আমরাও ট্র্যাকিং এ যাই?”

” মানে?”

” মানে আমরা সবাই মিলে উনারা যে জায়গায় যাচ্ছে সে জায়গায় গেলাম। তাহলে তোরও আলভীর সাথে দেখা হবে আর আমারও অনিকস্যারের সাথে সময় কাটানো হবে। যদি এর আগে অনিকস্যার সুস্থ হয়ে যায় আর কি।”

“তুই পাহাড় ট্র্যাকিং এর মানে বুঝিস? জীবনে ট্র্যাকিং করেছিস তুই? এটা সোজা রাস্তায় স্কুটি চালানোর মতো না।”

” আচ্ছা গেলেই কি ট্র্যাকিং করতে হবে? আমরা ঈদের ছুটিতে ঘুরতে যাবো,ওরা ট্র্যাকিং করবে আমরা দেখবো।”

“ট্র্যাকিং না করলে গিয়ে লাভ কি? আর থাকবো কোথায়?”

” থাকার জায়গা নিয়ে ভাবতে হবে না। সীতাকুন্ডে আমার খালামণির বিশাল বাংলো আছে। ওখানে আমরা তিনজন আরামে থাকতে পারবো। এই সেজুতি যাবি?”

” তোরা যাচ্ছিস তোদের মতলবে। সেখানে আমি গিয়ে কি করবো?”

” তুইও তোর মতলবেই যাবি।”

” আমার কি মতলব?”

নোরা হেসে বলল,” ঘুরাঘুরি! ”

অন্তরা আর সেজুতি হেসে উঠল। নোরা বলল,” তাহলে ডান। আমরা তিনজন যাচ্ছি ওকে? আর তোদের বাসায় ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার।”

অন্তরা আর সেজুতি একসাথে বলল, “ওকে।”

তারপর তিনজন হাত মিলাল। নোরা শব্দ করে বলল,” মিশন সীতাকুন্ড।”

তারপর হাত উঠিয়ে তিনজন একসাথে চিৎকার করল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here