অনপেখিত পর্ব ৪ লিখা- Sidratul

0
100

#অনপেখিত
পর্ব ৪
লিখা- Sidratul Muntaz

ফারদিন আছাড় মেরে মেহেককে বিছানায় ফেলে দিল। মেহেক নিজের কোমড় খামচে ধরে বলল,” আহ, এটা কি হলো? আমাকে এভাবে ফেললেন কেন? ব্যথা পেলাম তো।”

ফারদিন উত্তরে কিছু বলল না। নাক-মুখ ফুলিয়ে সামনে তাকিয়ে রইল। তাকে সুন্দর বলায় কি সে এতো রেগে গেছে? আশ্চর্য, সুন্দরকে সুন্দরও বলা যাবে না? তাহলে কি বলবে মেহেক? ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, ” রাগ করেছেন?”

” খেতে যাও। ভাবী ডাইনিংটেবিলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

” তাহলে আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন? সরাসরি ডাইনিংটেবিলেই নিয়ে যেতেন।”

” ভাবীর সামনে? দাদুর সামনে আমি তোমাকে কোলে নিয়ে ডাইনিংটেবিলে যাবো? আর ইউ ইনসেন?”

” ও বাবা, আমি তো আপনার বউ। আমাকে কোলে নিলে কি আপনার মান-সম্মান চলে যাবে? আর লিয়ার সামনে যে সুজিকে কোলে নিয়েছিলেন। তখন মান-সম্মান যায়নি?”

” তুমি আর সুজি এক না।”

” কেন এক না?”

” জানি না। আর এতো প্রশ্ন করবে না সবসময়। আমার পারসোনাল লাইফ নিয়ে কথা বলার অধিকার আমি তোমাকে দেইনি।”

ধমক খেয়ে চুপসে গেল মেহেকের মুখ। কিছুটা অভিমানী স্বরে বলল,” আপনি কথায় কথায় এতো ধমকান কেন? আমার আব্বাও কখনও আমাকে এতো ধমকায়নি।”

” তাহলে বাবার কাছে চলে যাও। আমার কাছে থাকতে হলে ধমক খেয়েই থাকতে হবে।”

মেহেক মনে মনে বলল,” খুব চালাক তাই না? আমি আব্বার কাছে চলে গেলে তো আপনারই লাভ। যখন তখন ওই সুজির হালুয়াকে কোলে নিয়ে ঘুরতে পারবেন। আপনাকে আর কেউ কিছু বলতেও আসবে না। কিন্তু আমি এতো বোকা পাত্রী না। যদি আমি আব্বার বাড়ি যাইও আপনাকে নিয়েই যাবো। ”

” আমার আব্বা-আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে। চলুন কালকে আমাদের গ্রাম থেকে ঘুরে আসি।”

” ভাইয়াকে বলে দিবো। অফিসে যাওয়ার আগে তোমাকে তোমার গ্রামে ড্রপ করে দিবে।”

” আপনি যাবেন না?”

” না।”

” কেন?”

” আমার কাজ আছে।”

” কি কাজ?”

” তা দিয়ে তোমার দরকার কি?”

” বলেন না, এমন করেন কেন?”

” কাল আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি।”

” চট্টগ্রাম কেন?”

” আমাদের একটা বাগানবাড়ি আছে ওখানে। ওটা দেখতে।”

মেহেকের হঠাৎ করেই মনে হলো ফারদিন যদি ক সুজিকে নিয়ে চট্টগ্রাম যায়? এই কথা ভেবেই সে তড়িঘড়ি করে বলল,” আমিও যেতে চাই।”

” কোথায়?”

” বাগানবাড়ি দেখতে।”

ফারদিন তাচ্ছিল্যের হাসি দিল,” আমি তোমাকে নিবে কে?”

” নিবেন না?”

” নেওয়ার প্রশ্নই আসছে না।”

কাঠখোট্টা স্বরে জবাবটা দিয়ে বারান্দায় চলে গেল ফারদিন। একটা সিগারেট ধরালো। অন্ধকার বারান্দায় মেহেক শুধু দূর থেকে দেখলো একটু টুকরো অগ্নিখন্ডের নড়াচড়া। আর অবাধ ধোঁয়া। সত্যি বলতে, ইদানীং সিগারেটের গন্ধটাও প্রিয় হয়ে উঠেছে মেহেকের। তার বাবাও তো সিগারেট খান। কিন্তু তখন এতো ভালো লাগতো না এই গন্ধ। এখন যতটা লাগে!

ভোরে মেহেক খুব দ্রুত উঠে গেল। বলতে গেলে রাতে তার দুশ্চিন্তায় ঘুমই হয়নি। কখন যেন ফারদিন উঠে চলে যায় সেই ভয় কাজ করেছে। এমন কি শেষরাতে মেহেক একটা স্বপ্নও দেখেছিল। সুজি আর ফারদিন গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। ভোরের স্বপ্ন তো সত্যি হয়। তার মানে আসলেই সুজি যাচ্ছে তার বরের সাথে। কিন্তু মেহেক বেঁচে থাকতে এটা কিছুতেই হতে দিবে না। সে সকাল সকাল উঠে দাদুর জন্য কফি বানালো। কিভাবে পারফেক্ট কফি বানাতে হয়, আর দাদু কিভাবে খেতে পছন্দ করে সব তিশার থেকে জেনে নিয়েছে সে। দাদুর আরেকটা অতি পছন্দের খাবার হচ্ছে মালাই চমচম। মেহেক সকালে উঠে তিশার সাহায্যে এটাও তৈরী করে ফেলল। দাদুকে ইমপ্রেস করতেই হবে।

তিশা একবার জিজ্ঞেস করেছিল,” তোমার মতলবটা কি মেহেক? আজকে সকাল সকাল সব দাদুর পছন্দের জিনিস রান্না করছো?”

মেহেক শুধু হেসেছে। কোনো উত্তর দেয়নি। সে নিজে কতটা প্যারায় আছে সেটা তিশা ভাবীকে বোঝানো সম্ভব না। ট্রেতে সবকিছু সুন্দর করে সাজিয়ে মেহেক আরশাদ সাহেবের ঘরে গেল। সকাল সকাল মেহেককে দেখে তিনি বেশ খুশিই হলেন।

মেহেক বলল,” গুড মর্ণিং দাদু। আপনার জন্য কফি এনেছি।”

” বাহ, কতদিন পর সকাল সকাল একদম বিছানায় বসে কফি পেলাম। থ্যাঙ্কিউ মেহেক। এইটা কি?”

” আপনার প্রিয় মালাই চমচম। তিশা ভাবীর কাছ থেকে শিখে আমি বানিয়েছি।”

” তাই নাকি? দেখি তো খেয়ে কেমন হলো?”

আরশাদ সাহেব কফির আগে মালাই চমচমের বাটিটাই তুলে নিলেন। মেহেক একটু ভয়ে ছিল। জীবনের প্রথম রান্না কেমন না কেমন হয়েছে। দাদুর পছন্দ হবে তো? কিন্তু তিনি খুব পছন্দ করলেন। মেহেকের এবার একটু ভরসা হলো। সে যেই কাজের জন্য এসেছে সেই কাজটা হয়তো হয়েই যাবে। তাকে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরশাদ সাহেব প্রশ্ন করলেন,” আমাদের এখানে তোমার কেমন লাগছে মেহেক?”

মেহেক নিরস মুখে উত্তর দিল,” জ্বী দাদু। ভালোই।”

আরশাদ সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন,” মনখারাপ নাকি?”

মেহেক মাথা নিচু করে ডানপাশের চুলগুলো কানে গুঁজল। তার চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। আরশাদ সাহেব এইবার ব্যাপারটা নিয়ে একটু সিরিয়াস হলেন। খাওয়া- দাওয়া রেখে মেহেককে কাছে ডেকে প্রশ্ন করলেন,” কি হয়েছে বলো তো মেহেক?বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে? গ্রামে যেতে চাও?”

মেহেক খুব দুঃখী দুঃখী কণ্ঠে বলল,” না দাদু। আব্বা-আম্মার সাথে তো রোজই কথা হয়। কিন্তু..”

” কিন্তু কি? নির্দ্বিধায় বলো।”

” উনি কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। ”

” কে?”

” আপনার ছোটনাতি।”

” তাই নাকি? আমি তো জানি না।”

” আমিও কালরাতেই জানতে পেরেছি। আজ সকালেই চলে যাচ্ছেন উনি।”

আরশাদ সাহেব উচ্চকণ্ঠে ডাকলেন,” তিশা, এই তিশা।”

তিশা ছুটে এলো,” জ্বী দাদাজান?”

” ফারদিন নাকি আজকে চট্টগ্রাম যাচ্ছে? তুমি জানো এই ব্যাপারে কিছু?”

” হ্যাঁ। ও আমাকে বলেছিল কিছুদিনের জন্য ঘুরতে যাবে। কিন্তু আজকেই যাবে কি-না সেটা বলেনি।”

” মেহেককে নাকি বলেছে আজকেই যাচ্ছে।”

” তাই? তাহলে হতে পারে দাদাজান। ওর তো কোনোকিছুর ঠিক নেই। যখন যা মনে চায় তাই করে। আপনি তো চেনেন ওকে।”

” তাই বলে এখনও যা মন চায় তাই করবে নাকি? ওর বিয়ে হয়েছে না? নতুন বউকে রেখে একা একা ঘুরতে চলে যাবে এইটা কোনো কথা হলো? মেহেকের তো মনখারাপ হয়ে আছে এজন্য।”

তিশা তাকালো মেহেকের দিকে। এতোক্ষণে বুঝতে পারল সকালে এতো আয়োজনের কারণ। আরশাদ সাহেব হুংকার ছাড়লেন,” ডাকো ফারদিনকে।”

” জ্বী ডাকছি দাদাজান।”

তিশা দ্রুত চলে গেল। একটু পরেই ফারদিন এসে উপস্থিত হলো।

” দাদু ডেকেছো?”

” তুই নাকি আজ চট্টগ্রাম যাচ্ছিস?”

” হ্যাঁ। ওই বাগানবাড়িটা দেখতে যাচ্ছি। আগেই তো যাওয়ার কথা ছিল দাদু।”

” মেহেককেও সাথে নিয়ে যা।”

” মানে? ও আমার সাথে গিয়ে কি করবে?”

” তুই যা করবি মেহেকও সেটাই করবে। বাগানবাড়ি ঘুরে দেখবে!

” কিন্তু দাদু, আমি তো যাচ্ছি আমার কাজে। ”

” বললাম তো মেহেকও যাবে। হয় মেহেককে নিয়ে যাবি নয়তো তুইও যেতে পারবি না। কথা শেষ।”

ফারদিন হতবিহ্বল দৃষ্টিতে মেহেকের দিকে তাকালো। মেহেক ঠোঁট টিপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করল। তার এতো ভালো কেন লাগছে? ইশশ, দাদুটা কত্ত ভালো!

নীরবে গাড়ি ড্রাইভ করছে ফারদিন। পাশে বসে আছে মেহেক। কারো মুখে কথা নেই। মেহেক নিজেও কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। কারণ ফারদিনের ভাব-গতিক দেখে মনে হচ্ছে সে ভয়ানক রাগান্বিত। তাই এখন ওর সাথে কথা বলতে গেলে আগুনে ঘি ঢালার মতো ব্যাপার হবে। সেজন্য চুপ থাকাই শ্রেয়। মেহেক মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল। যদিও এভাবে বসে থাকতে তার দমবন্ধ লাগছে। বাচাল প্রকৃতির মেয়েদের এই এক জ্বালা। পৃথিবীর সব কঠিন কাজ তারা করতে পারবে। কিন্তু চুপ করে থাকা? ইম্পসিবল! একটু পরে একটা বিশাল এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি থামানো হলো। ফারদিন জানালার কাঁচ নামিয়ে হাত বের করে কাউকে ‘হাই’ বলল। মেহেক দেখল সুজানা নামের মেয়েটা হাতে লাগেজ ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠছে। অর্থাৎ মেহেক যা ভেবেছিল তাই হলো।

সুজানা মেহেকের দিকে ইশারা করে ফারদিনকে বলল,” ও এইখানে কি করছে?”

একই সময় মেহেকও প্রশ্ন করল,” উনি এইখানে কেন?”

ফারদিন উত্তর দেওয়ার আগেই সুজানা বলল,” এইটা আমার সিট। তুমি পেছনে যাও।”

” মানে?” মেহেক আশ্চর্য হয়ে গেল এই মেয়ের স্পর্ধা দেখে। তার বরের পাশ থেকে তাকেই উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে? খুব সাংঘাতিক মেয়ে তো! মেহেক অসহায়ের দৃষ্টিতে ফারদিনের দিকে তাকালো।

ফারদিন বলল,” তুমি পেছনে গিয়ে বসো সুজি। ওকে উঠানোর কি দরকার?”

ফারদিনের উত্তরে মেহেকের চেহারায় একটা আশ্চর্য অহংবোধ জন্ম নিল। ভেতরে আত্মবিশ্বাস তৈরী হলো। সেই আত্মবিশ্বাসী চকচকে দৃষ্টি নিয়ে সুজানার দিকে তাকালো সে। সুজানা ঈর্ষান্বিত নজরে মেহেককে কয়েক মুহূর্ত দেখে নিয়ে শেষমেষ পেছনে গিয়েই বসলো।

গাড়ি পুনরায় চলতে শুরু করল। ফারদিনের এই মুহুর্তের আচরণে মেহেকের মন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেও সেই আনন্দটুকু বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ যখন মনে পড়লো, সে না এলে ফারদিন শুধু সুজানাকে নিয়েই চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছিল তখনই মনটা বিষাক্ত এক অনুভূতিতে তিক্ত হয়ে এলো। নিজের প্রতি জন্ম নিল বিতৃষ্ণা। সে সুজানার চেয়ে সুন্দর হতে পারলো না বলেই কি তার প্রতি এমন অবিচার? আয়নায় তাকিয়ে পেছনে বসে থাকা সুজানাকে একবার দেখলো মেহেক। মেয়েটা সুন্দর। শুধু সুন্দর বললে ভুল হবে অনেক বেশিই সুন্দর। বাদামী চোখের মণি, লালচে চুল, সোনালী ফরসা গায়ের রঙ, ঠোঁটের আকৃতি মোহনীয়, চেহারায় নায়িকা-নায়িকা ভাব, বেশ ভালোই লম্বা। আর ও পোশাক-আশাকেও কত স্মার্ট! দেখলেই বোঝা যায় সে খুব এলিগেন্ট। মেহেক কি কখনও পারবে তার মতো হতে?

একটু পরেই গাড়ি থামলো চার রাস্তার এক মোড়ে। সেখানে অপেক্ষারত দুইজন ছেলে আর একজন মেয়ে ছিল। প্রথম ছেলেটির গাঁয়ে খয়েরী টি-শার্ট। অন্যজন পরে আছে নেভি ব্লু জ্যাকেট। আর মেয়েটার গাঁয়ে কাঁচা কলাপাতা রঙের সেলোয়ার-কামিজ। তবে কামিজের হাতা নেই। ফরসা বাহু দৃশ্যমান হয়ে আছে। ফারদিন গাড়ি থামিয়ে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করল। সুজানাও হাত নাড়িয়ে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করল। ওরা ইংরেজি আর বাংলার সংমিশ্রণে কথা বলছে। এ ধরণের কথা শুনলে মেহেকের কেমন একটু লজ্জা লাগে। ছেলে দু’জনের দৃষ্টি আটকে গেল মেহেকের দিকে। নেভী ব্লু জ্যাকেটওয়ালা প্রশ্ন করল,” এই কিউটি টা কে?”

ওই প্রশ্নে সুজানার হাসি হাসি চেহারাটা কালোবর্ণ ধারণ করল। সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,” ফারদিনকেই জিজ্ঞেস কর।”

ফারদিন উত্তর দিল,” ওর নাম মেহেক। আমার ওয়াইফ।”

তিনজনের চেহারায় এখন খেলা করছে বিস্ময়। যেনো মাত্র শোনা কথাটা তারা হজম করে উঠতে পারলো না। ফারদিন বিয়ে করেছে এটা সুজানার থেকে আগেই শুনেছিল তারা। কিন্তু আজকের ট্রিপে যে সে বউ সাথে নিয়ে আসবে এটা কেউ ভাবতে পারেনি।

গাড়িতে উঠে বসার পর মেয়েটাই প্রথমে মেহেকের সাথে কথা বলল,” হাই, আমি পূর্বিতা। ফারদিনের কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড।”

পূর্বিতার দেখা-দেখি খয়েরী টি-শার্টওয়ালাও বলল, ” হ্যালো, আমি ওয়াসিম। ফারদিনের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড।”

মেহেক কিছুটা অপ্রস্তুতবোধ করছিল ওদের সামনে।
সে কথা শুরু করল সালাম দিয়ে,” আসসালামু আলাইকুম, আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। আমি মেহেক ইমরোজ।”

পূর্বিতা বলল,” বাহ, খুব সুন্দর নাম তো।”

ওয়াসিম হাসি দিয়ে বলল,” আপনি তাহলে আমাদের সবার ভাবী, তাই না?”

নীল জ্যাকেটওয়ালা ওয়াসিমের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,” আরে বেটা, আপনি আপনি করছিস কেন? দেখছিস না কত ছোট মেয়ে! ওকে আপনি বললে মানায়?”

পূর্বিতা বলল,” হ্যাঁ তাইতো। আমরা ওকে তুমি করেই বলতে পারি। যেহেতু আমাদের পুচকী ভাবী। তাই না?”

মেহেক আন্তরিকভাবে হেসে বলল,” জ্বী।”

নীল জ্যাকেট পরা ছেলেটির নাম আনজির। সে ফারদিনের উদ্দেশ্যে বলল,” এই শালা, তোর প্রবলেম কি? বিয়েতে দাওয়াত দিলি না কেন?”

ফারদিন আক্ষেপের সুরে বলল,” আরে ভাই, বিয়ে এতো তাড়াহুড়ার মধ্যে হয়েছে যে নিজের বাপ-মা’র জন্যেও অপেক্ষা করতে পারিনি। বাবা-মা আসলে রিসিপশন হবে। তখন ভেবেছিলাম তোদের সবাইকে একসাথে জানাবো।”

পূর্বিতা বলল,” তাহলে আজকেরটা কি সারপ্রাইজ ছিল?”

বন্ধুরা সমস্বরে হেসে উঠলো। ফারদিনও ওদের হাসিতে যোগ দিয়ে বলল,” ধরে নে তাই।”

আনজির সুজানার দিকে তাকিয়ে বলল,” সত্যি, খুব বিরাট একটা সারপ্রাইজ ছিল!”

মেহেকের কিছুটা অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। ঠিক এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে জেদ করে ফারদিনের সাথে ঘুরতে আসা মোটেও উচিৎ হয়নি। যতই সবাই মেহেকের সাথে হেসে হেসে কথা বলুক না কেন, মনে মনে প্রত্যেকের মধ্যেই একটা জড়তা কাজ করছে। এই জড়তার কারণ হতে পারে সুজানা আর ফারদিনের মধ্যকার সম্পর্ক। আচ্ছা,তাদের মধ্যে কি প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপার ছিল?

গল্প-গুজব করতে করতে সময়গুলো যেন কিভাবে কেটে যাচ্ছিল। কুমিল্লার একটি রেস্টুরেন্টে গাড়ি থামানো হলো লাঞ্চের জন্য। সবাই নেমে হাত-মুখ ধুঁয়ে টেবিলে খেতে বসলো। তখন আনজির আর ওয়াসিম ফারদিনকে নিয়ে কোথায় যেনো উধাও হয়ে গেল। আর আসার নাম নেই। পূর্বিতা আর সুজানা বসেছিল মেহেকের সাথে। একটু পর ওরাও উঠে চলে গেল। পূর্বিতা যাওয়ার আগে মেহেককে বলল,” পুচকী ভাবী, তুমি একটু বসো। আমরা ওয়াশরুম থেকে আসছি।”

ওরা চলে যাওয়ার পর মিনিট পাঁচেক একা একাই বসে রইল মেহেক। হঠাৎ কোথ থেকে যেন অদ্ভুত শব্দ ভেসে এলো। সেই শব্দের উৎস বরাবর মেহেক এগিয়ে যেতেই আবিষ্কার করল ফারদিন ও তার বন্ধুরা একটা খালি জায়গায় জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আনজির ফারদিনের কলার ধরে রাগান্বিত স্বরে বলছে,” তুই শালা এটা কিভাবে করলি সুজির সাথে? এতো বেঈমান তুই?”

পূর্বিতা বলল,” আমার নামেও একটা চড় লাগা। ওকে ফ্রেন্ড বলতেও আমার লজ্জা লাগছে।”

ওয়াসিম বলল,” আচ্ছা বিয়ে করেছিস ভালো কথা৷ তাই বলে এইরকম একটা মেয়েকে? এইটা তো পিচ্চি মেয়ে! আমার ওর সমান একটা ভাগনী আছে। ”

ফারদিন বলল,” আচ্ছা তোরা আমার কন্ডিশনটা কি একটু বুঝবি না? আমি কেন বিয়ে করেছি সেটা আগে শোন!”

আনজির বলল,” যে কারণেই বিয়ে করিস। মূলকথা হলো তুই সুজিকে ঠকিয়েছিস।”

ফারদিন তেতে উঠলো এবার,” আরে বাল, কিভাবে ওকে ঠকালাম আমি? আমি কি জীবনে বলছি যে আমি ওকে ভালোবাসি?”

পূর্বিতা হতবাক, ” এইটা মুখে বলতে হবে কেন? তুই না বললেও এটা আমরা সবাই জানতাম। ওপেন সিকরেটের মতো ছিল ব্যাপারটা। ইনফ্যাক্ট আমরা তো ভেবেছিলাম তুই সুজিকে প্রপোজ করার জন্যই চট্টগ্রাম নিয়ে যাচ্ছিস। ওকে সারপ্রাইজ দিবি। কিন্তু বেচারী এতোবড় সারপ্রাইজ পেল যে এখন কোনো কথাই বলতে পারছে না। একবার মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখ।”

ফারদিন অপরাধী গলায় বলল,” সুজি, আই এম স্যরি।”

সুজানা হাত ভাঁজ করে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। ফারদিনের কথাটা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল তার উপর। রাগে ফুঁসে উঠে সুজি বলল,” তুমি আবার কথা বলছো কোন সাহসে? এতো ইজিলি আমি তোমাকে জীবনেও মাফ করবো না ফারদিন। আমি তো এখানে আসতেই চাইনি। শুধু বন্ধুদের অনুরোধে এসেছি। নাহলে তোমার কিংবা তোমার ওয়াইফের চেহারা দেখার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। আর আমি তো ভাবতেই পারছি না, তুমি আমাদের ট্রিপে ওই মেয়েটাকে পর্যন্ত নিয়ে এসেছো। কেন? আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য? এতোবড় কষ্ট দিয়েও আঁশ মিটেনি তোমার?”

সুজি অনেক বেশি এগ্রেসিভ হয়ে যাচ্ছিল। পূর্বিতা ওকে দুই হাত দিয়ে ধরে থামালো,” আচ্ছা কাম ডাউন মাই ডিয়ার। মেয়েটা আশেপাশেই আছে। শুনতে পেলে প্রবলেম হয়ে যাবে। বেচারার সংসারে আগুন লাগবে পরে।”

সুজি বেপরোয়া ভাবে বলল,” লাগুক আগুন। আমার জীবনটা ছাড়খাড় করে দিয়ে ও এখন খুব সুখে থাকবে তাই না? আমি বের করছি ওর সুখে থাকা।”

সুজানার চোখ দিয়ে স্রোতের ন্যায় অশ্রু গড়াচ্ছিল।ফারদিন আচমকা কাছে এসে সুজানাকে জড়িয়ে ধরে কোমল কণ্ঠে বলল,” আই এম স্যরি সুজি। এক্সট্রিমলি স্যরি!”

মেহেক এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না। মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলো ফুপিয়ে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here