প্রিয়তোষ #পর্ব_১৬ লিখা: Sidratul muntaz

0
67

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_১৬
লিখা: Sidratul muntaz

নোরা চলন্ত গাড়ির জানালায় এক হাত বের করে হাতের উপর মাথা ঠেঁকিয়ে আনমনে বলল,” জানেন,আজকে অন্তরা আর আলভীর বাসররাত।”

অনিক ড্রাইভ করতে করতে বলল,” জানি।”তারপর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” আমাদেরটা যে কবে হবে!”

নোরা অনিকের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,” বিয়ে হওয়ারই কোনো চান্স নেই আর উনি এলেন বাসর নিয়ে। স্বপ্ন দেখারও লিমিট লাগে।”

” বিয়ে হওয়ার চান্স নেই মানে? কি বলছো?”

” আন্টি তো আমাকে পছন্দই করেন না। দেখলেন না, খাবার টেবিলে কিভাবে এড়িয়ে গেলেন!”

” আরে ধুর, তুমি ওইটা নিয়ে চিন্তা করছো? পাগল! মা হয়তো তোমাকে চিনতে পারেনি। চিনলে এমন করতো না।”

” আপনি যেভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, চিনতে না পারার তো কথা না। আমার মনে হয় উনি নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছেন।”

অনিক এ কথার জবাব দিতে পারল না। কি করে দেবে? তার কাছে তো জবাব নেই। নোরাও আর প্রশ্ন করল না এ বিষয়ে। অনিক নিজেও খুব ভালো করে জানে তার মা এই সম্পর্কে সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু সেটা নোরাকে বুঝতে দিতে চাইছে না সে। আর অনিক যেটা বুঝাতে চায়না, নোরা সেটা আগ বাড়িয়ে বুঝতেও চায়না। অনিক বলল,” ফুচকা খাবে নোরা?”

” এতোরাতে ফুচকা কোথায় পাবেন?”

” তুমি খাবে কিনা বলো।”

” হ্যাঁ খাবো।”

” ঠিকাছে তাহলে দশমিনিট ওয়েট করো।”

দশমিনিট পর অনিক গাড়ি থামিয়ে কোথায় জানি চলে গেল। নোরা একাই গাড়িতে বসে রইল। একটু পর নোরা দেখল অনিক সত্যি সত্যি ফুচকার গাড়ি নিয়ে আসছে। গাড়িটা সে নিজেই ঠেলছে। আর ফুচকাওয়ালা ওর পেছন পেছন আসছে। নোরা অবাক হয়ে গাড়ি থেকে নামল। অনিককে জিজ্ঞেস করল,” আপনি এতোরাতে উনাকে কোথায় পেলেন?”

অনিক হাসিমুখে বলল,” তোমাকে নিয়ে লংড্রাইভে আসব এই প্ল্যান অনেক আগে থেকেই ছিল। তখনি মামার সাথে এপোয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিলাম। কারণ আমি তো জানি, আমার বউয়ের ফুচকা হলে আর কিছু লাগেনা। আমাকেও লাগেনা। আজকে আলভী অন্তরার বাসররাত, আর আমাদের ফুচকারাত।”

একথা বলেই নোরার দিকে এক প্লেট ফুচকা এগিয়ে দিল অনিক। নোরা হেসে ফেলল। ফুচকার প্লেট নিতে নিতে বলল,” আপনি আসলেই একটা পাগল।”

অনিক ফুচকাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল,” মামা তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমি বানাও। জলদি জলদি বানাও। ও কিন্তু খাওয়াতে খুব ফাস্ট। তুমি একটা বানাতে বানাতে ওর দশটা খাওয়া হয়ে যাবে।”

নোরা ফুচকা মুখে পুরে বলল,” মামা কি আপনার পরিচিত?”

অনিক বলল,” পরিচিত মানে? আরে আমাদের এলাকার মামা! তোমার কাছে তো অনেকবার উনার গল্প করেছি ভুলে গেছো?”

” ভুলিনি, মনে আছে। মামা আপনি এতো তাড়াহুড়া করবেন না তো। আস্তে আস্তে বানান। আমি এতো বেশি খাবো না।”

ফুচকাওয়ালা হেসে বলল,” আরে খান আম্মাজান। বাপজান তো খালি আপনার লাইগাই আমারে বাসার থেকা উঠায় আনসে। আর বিল নিয়া চিন্তা কইরেন না। আপনাদের লাইগা আজকে ফ্রী অফার।”

নোরা অনিকের দিকে তাকিয়ে হাসল। অনিক ফুচকাওয়ালার কাঁধে হাত রেখে বলল,” আরে কি বলো মামা? কথায় কথায় এতো ফ্রী অফার দিলে চলবো? ব্যবসায় কি লালবাত্তি ধরাইবা নাকি?”

” বাপজান, আপনারে ফ্রী দিমু না তো কারে ফ্রী দিমু? আর আপনারে ফ্রী দিলে আমার ব্যবসায় লালবাত্তি জ্বলবো না। উলডা সবুজবাত্তি জ্বলবো।”

” দেখেছো নোরা। এই না হলে মামু। কিন্তু মামা, তুমি আমার মামা হয়ে ফ্রী ট্রিট দিতেই পারো। কিন্তু আমি ভাগ্নি হয়ে তোমারে কিছু দিমু না তাই কি হয়? তাই আজকের জন্য কিন্তু তোমার বাসার ডিনারের দায়িত্ব আমি নিলাম। এইডায় না করলে চলবো না।”

ফুচকাওয়ালা হাসতে হাসতে বলল,” আইচ্ছা আইচ্ছা।”

নোরা ফুচকা খাচ্ছে আর ওদের আলাপ শুনে হাসছে। ফুচকাওয়ালা নোরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,” বুঝলেন আম্মাজান, বাপজানের লাইগা তো দোকানে আমার বাড়তি লোকই রাখা লাগেনা। বাপজান সময় পাইলেই দোকানে আইসা কাস্টমারগো অর্ডার সাপ্লাই দেয়। উনার লাইগা আমার ব্যবসায় কেমনে লাল বাত্তি জ্বলবো কন দেহি? ”

নোরা চোখ বড় করে বলল,” ও, তাহলে এই কাহিনি? আপনি ফুচকার দোকানেও কাজ করেন? তাইতো বলি, ফুচকা সম্পর্কে আপনার এতো জ্ঞান কিভাবে হলো!”

অনিক মাথা চুলকে বলল,” আরে মামার দোকান থাকলে ভাগ্নিরা তো একটু আকটু শিখেই যায়। বাই দ্যা ওয়ে নোরা, তোমার আর আমার কিন্তু ফুচকা খাওয়ার একটা কম্পিটিশন হওয়ার কথা ছিল। কম্পিটিশনটা কি হবে?”

” একদম না। আমি অলরেডি তিনপ্লেট খেয়ে ফেলেছি। এখন কম্পিটিশন হলে আমি নিশ্চিত হারবো। আপনি আগে বলেন নি কেন? চালাকি না?”

অনিক হো হো করে হেসে দিল। নোরা অনিকের মুখে একটা ফুচকা তুলে দিয়ে বলল,” নিন, খান।”

অনিক বড় করে হা করল। নোরা পুরোটা ফুচকা অনিকের মুখে পুরে দিল। তারপর হাসতে লাগল। অনিক বুঝল না নোরা হাসছে কেন। তারপর টের পেল, ফুচকাটা এত্তো ঝাল! ঝালে ওর মুখ জ্বলে যাচ্ছে। অনিক প্রতিশোধী গলায় বলল,” দাঁড়াও। এখন আমিও রিভেঞ্জ নিবো। উইথ এক্সট্রা মাসালা।”

ফুচকাওয়ালা ওদের খুনশুটি দেখে হাসছেন। অনিক ফুচকাওয়ালাকে বলল,” মামা তুমিও আমাদের সাথে খাও।”

ফুচকাওয়ালা বলল,” আরে আরে বাপজান আমি কেন খামু? আপনে আম্মাজানরে নিয়া খান, মজা করেন।”

অনিক বলল,” ধুর! আমরা একলাই খাবো আর তুমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখবে তা হয় নাকি? হা করো তো।”

অনিক ফুচকাওয়ালাকেও ফুচকা খাইয়ে দিল। নোরা অবাক হয়ে দেখছে। অনিকের এই রুপ তার অজানা ছিল। তার কেন জানি অসম্ভব ভালো লাগছে অনিককে দেখে। ছেলেটা এতো মিশুক, আগে তো জানতো না সে! কিছুদিন আগেও নোরা ভাবতো অনিক এক্সট্রা ভাবওয়ালা অহংকারী লোক। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, ওর মধ্যে অহংকারের লেশমাত্র নেই। ও একজন বিশুদ্ধ মনের মানুষ।

যাওয়ার সময় অনিক ফুচকাওয়ালার বাসার সবার জন্য কাচ্চি কিনে দিল। উনি সেগুলো নিয়ে চলে গেলেন উনার গন্তব্যে। আর অনিক-নোরা উঠে গেল ওদের গাড়িতে। গাড়ি চলছে, নোরা বলল,” আচ্ছা, এই গাড়ি আপনি আদনান স্যারের কাছ থেকে কি বলে এনেছেন?”

” যা সত্যি তাই বলে এনেছি।”

” আমার কথা বলেছেন?”

” হুম।”

” উনি কি তাহলে আমাদের সম্পর্কে খুশি?”

” উনার খুশি-অখুশিতে কি আসে যায়? আমরা তো খুশি।”

অনিক হাসল। নোরা বলল,” না মানে.. প্রথম প্রথম উনি আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে যেভাবে রিয়েক্ট করেছেন আমি তো ভয়ই পেয়েছিলাম৷ আচ্ছা উনি তখন এতো রাফ বিহেভ কেন করেছিলেন?”

” দ্যাখো নোরা, কোচিংটা তো আদনান ভাইয়ের ছিল। আর সেই কোচিং এ আমাদের সম্পর্ক ছিল টিচার আর স্টুডেন্টের। উনি ভয় পাচ্ছিলেন আমরা কোচিং এর নাম খারাপ করবো। তার উপর তন্নীকে তো চেনোই। সেও কিন্তু তোমার মতোই ছিল। অবশ্য তোমার মতো এতো পাগলামি করতো না, কিন্তু এমন অনেক কিছুই করতো যা আদনান ভাইয়ের চোখ এড়ায়নি। উনি তো তোমাদের ক্লাস থেকে আমাকে বাদ দেওয়ার ডিসিশন নিয়েছিলেন।”

” এইটা করলে আমি কোচিং এই পড়তাম না।”

” আর আমিও কি চাকরি করতাম? তোমার জন্যই তো কোচিং এ ঢোকা। তোমাদের ক্লাস নিতে না পারলে আমিও রিজাইন করে দিতাম।”

” সব হয়েছে ওই তন্নী শাকচুন্নিটার জন্য। আদনান স্যার হয়তো ভাবতেন আপনি ক্লাস নেওয়ার নাম করে স্টুডেন্টদের সাথে ফ্লার্ট করে বেড়ান তাইনা?”

” এক্সেক্টলি। কিন্তু একটা সত্যি কথা কি জানো? তন্নী যা করতো, সব কিন্তু তোমাকে জ্বালানোর জন্য। তুমি কি সেটা বুঝতে?”

” বুঝতাম না আবার! একশোভাগ বুঝতাম। কিন্তু আপনি তো ওকে পাত্তা দিতেন না। এতেই আমার শান্তি লাগতো। হিহি!”

অনিক হেসে বলল,” আমার মনে হয় এর পেছনেও তিথির হাত আছে।”

” মানে? এখানে তিথিআপুর হাত কোথ থেকে এলো?”

” বাহ, হঠাৎ তিথিআপু বলছো যে? আগে তো শুধু তিথি বলতে।”

” না, আজকে বিয়ের অনুষ্ঠাবে উনাকে দেখে মন হল উনি আমার অনেক বড়। বয়সেও বড় আর হাইটেও বড়। তাই ভাবলাম উনাকে আমার আপুই ডাকা উচিৎ। ”

” নোরা, তিথির বিশাল হাইট দেখে কি তোমার মনখারাপ হয়েছে?”

নোরা মাথা নিচু করে বলল,” হুম। আমি যদি তিথি আপুর মতো হতাম তাহলে খুব ভালো হতো। আপনার সাথে দাড়ালে আমাকে একদমই মানায় না। মনে হয় বিশাল তালগাছের সাথে ছোট্ট বোনসাই।”

অনিক হো হো করে হেসে দিল। বলল,” বোনসাইয়ের দাম সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে? সেদিক থেকে চিন্তা করলে তুমি সবচেয়ে দামী। আর তুমি জানো তোমাকে আমার কত কিউট লাগে? ”

” হয়েছে বাদ দিন। এবার বলুন তন্নীর ওসব কারসাজির পেছনে তিথিআপুর কিভাবে হাত আছে?”

” তিথি তন্নীর কাজিন না? হাত থাকতেই পারে। আর তিথি তো তোমার ব্যাপারে সব জানে। হয়তো ইচ্ছে করেই তন্নীকে দিয়ে এসব করাতো। তোমার উপর হিংসা থেকে!”

” কি? তন্নী তিথিআপুর কাজিন?”

” কেন তুমি আগে জানতে না?”

” কিভাবে জানবো? আমি কি তন্নীর সাথে এতো ক্লোজ নাকি? যদিও ওকে আমি চারবছর ধরে চিনি। কিন্তু কখনো এইটা জানিনি যে ওর কাজিনের নাম তিথি।”

” ওহ। হয়তো ইচ্ছে করেই জানায়নি। তিথিই হয়তো নিষেধ করেছে। কারণ চারবছর ধরেই কিন্তু আমি তোমাকে পছন্দ করি।”

” আর এজন্যই সেদিন রেশমি আমাকে ইচ্ছে করে আপনার বার্থডে তে সিগারেট গিফট করার আইডিয়া দিয়েছিল! রেশমি তো তন্নীর ক্লোজ ফ্রেন্ড। এইটা হয়তো ওদের প্ল্যানেরই অংশ ছিল যেন আপনি আমার উপর রেগে যান।”

” তুমি একথা আমাকে আগে বলোনি কেন?”

” সরি।”

” বোকা নোরা, তুমি খুব বোকা।”

নোরা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,” আসলে রেশমির কথা শুনে ইন্সপায়ারড হয়ে না, আমি ইচ্ছে করেই আপনাকে সিগারেট গিফট করেছিলাম। আমি জানতাম আপনি রেগে যাবেন, তবুও।”

অনিক অবাক হয়ে বলল, ” কেন?”

” কারণ আমি বুঝতে চেয়েছিলাম, আমার উপর আপনার ইন্টারেস্ট আছে কি নেই। সেটা আপনার রাগের মাত্রা দেখেই বোঝা যেতো।”

” তাহলে যখন ধমকাচ্ছিলাম তখন ফ্যাচফ্যাচ করে ওভাবে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলে কেন?”

” সেটাও আপনাকে পরীক্ষা করার জন্যই। আমার খারাপ লাগায় আপনার কতটা খারাপ লাগে সেটা দেখতে চেয়েছিলাম।”

” নোরা! তোমাকে আমি সহজ-সরল ভেবেছিলাম। এখন তো দেখছি তুমি শয়তানের হাড্ডি।”

নোরা খিলখিল করে হেসে উঠল। অনিক কিছুক্ষণ দেখল সেই মাদকমাখা হাসিমুখ। তারপর হঠাৎ শান্তগলায় বলল, ” নোরা, তুমি নেশা হও আমার।”

নোরা হাসি থামিয়ে অবাক চোখে তাকাল। অনিক গাড়ির ব্রেক কষল। তারপর আচমকাই নোরাকে একটানে কাছে এনে বলল, ” এসো বোঝাচ্ছি।”

আহসানুল্লাহ আলভীকে এক চড় দিলেন। আলভী মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ওর মধ্যে অবশিষ্ট নেই। আফিয়া কাদতে কাদতে আহসানুল্লাহকে বললেন, ” কি করছো? এই দিনে নতুন বউয়ের সামনে তুমি ছেলেটার গায়ে হাত তুলছো?”

আহসানুল্লাহ রাগী গলায় বললেন,” আর তোমার হারামজাদা কি করসে সেইডা দেখো না? আজকের মতো একটা রাইতে ছাইপাশ গিল্লা হেলতে-দুলতে ঘরে ঢুকে! হের কত্তবড় সাহস! আমার বাড়িতে এমন বেলেল্লাপনা আমি সহ্য করমু না। ওই বাইর হো তুই ঘরথেকা। এখনি বাইর হো।”

আহসানুল্লাহ আলভীকে কলার ধরে টেনে তুললেন। শিপন আর আরিফ সাথেই দাঁড়িয়ে ছিল। শিপন বলল,” আঙ্কেল ছাইড়া দেন।ওর ভুল হয়ে গেসে।”

আহসানুল্লাহ বিস্ফারিত চোখে বললেন,” তোমরা চুপ থাকো। এই তোমাদের সাথে চলতে চলতে ওর আরো এই অবস্থা। ওই, হারামজাদা এমনে ঝিমায় ক্যান? কয় পেগ গিলসে অয়? সত্যি কইরা বলো কয় পেগ গিলসে?”

আরিফ মাথা নিচু করে বলল,” বারো পেগ।”

আহসানুল্লাহ আবার আলভির গালে চড় দিলেন। আলভী পিছিয়ে গেল। আহসানুল্লাহ ছেলের পশ্চাৎদেশ বরাবর লাথি মেরে ঘর থেকে বের করলেন। তারপর ফটাস করে দরজা আটকে দিলেন। তারপর আফিয়ার দিকে ঘুরে বললেন,” আজকে থেকা ওর বাসায় ঢোকা বন্ধ।”

বলেই নিজের রুমে চলে গেলেন। অন্তরা সোফায় বসে কান্না আরম্ভ করল। আফিয়াও অন্তরার সাথে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। এদিকে শিপন আর আরিফ সমানে দরজা ধাক্কাচ্ছে। আলভী ওদের ডেকে বলল,” ওই থাম তোরা। ল যাই। এই বাসায় আমিও আর থাকতে চাইনা। একদিক দিয়া ভালোই হইসে। ওই মাইয়ার চেহারা দেখতে হইবো না। এর চেয়ে রাস্তায় থাকা ভালো।”

আলভী একথা বলে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগল। শিপন আর আরিফও বাধ্য হয়ে ওকে অনুসরণ করা শুরু করল।

অন্ধকার রাত। শীতল পরিবেশ। চারদিকে নিস্তব্ধতা। অনিক নোরার কোমল ঠোঁট আর্দ্র স্পর্শে ভরিয়ে দিচ্ছে। গলায় মুখ ডুবিয়ে অজস্র চুম্বন ক্রমাগত ঢেলে যাচ্ছে। নোরার সম্পুর্ণ শরীর প্রতি মুহুর্তে কেপে উঠছে। অজানা এক ভালোলাগায় শিহরীত হচ্ছে নোরা। যেন সুখের স্রোতে ভাসছে। শ্বাস আটকে আটকে আসছে।

অনিকের মাথার চুলগুলো হাতের মুষ্টিতে নিয়ে ক্রমাগত ছটফট করছে সে। এ যন্ত্রণা ভয়ংকর, তীব্র এক অসহনীয় অনুভূতি। যা ক্রমান্বয়ে মাতাল করে তুলছে তাকে। তাদের এই সুখকালীন পর্যায়ে চিড় ধরল ফোনের তীক্ষ্ণ শব্দে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় নোরার বুক ধুকপুক করে উঠল। মনে হচ্ছে এতোক্ষণ সে স্বপ্ন সায়রে ডুবে ছিল। মাত্র জাগ্রত হয়েছে। অনিক বিরক্তগলায় বলল,” ফোনটা কি সাইলেন্ট রাখা যায়না?”

নোরা স্বাভাবিক হয়ে হাসার চেষ্টা করল,” সাইলেন্ট কিভাবে রাখবো? কত জরুরী ফোন আসতে পারে।”

নোরা ফোন হাতে নিয়ে দেখল বাবার ফোন। বাবা ছোটখাটো কারণে কখনও ফোন করেন না। নিশ্চয়ই জরুরী কোনো দরকার। নোরা ফোনের স্ক্রিনে দেখল রাত দেড়টা বাজে। অথচ এখনো সে বাইরে। এজন্যই তো বাবা ফোন করছেন! নোরা ফোন রিসিভ করলল,” হ্যালো আব্বু।”

” মা! কোথায় তুমি? বাসায় আসবে কখন?”

” এইতো আব্বু রিকশায় আছি। আসলে এতোক্ষণ সেজুতি, তন্নীদের সাথে গল্প করছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেছে। তুমি টেনশন করো আমি চলে আসবো।”

” চলে এসো মা, খুব রাত হয়েছে। গেইটের সামনে এসে আমাকে মিসডকল দিও। আমি চাবি নিয়ে নিচে নামবো।”

” আচ্ছা আব্বু।”

ফোন রেখে নোরা বলল,” দেখলেন কত দেরি হয়ে গেছে? বাসায় যেতে হবে। চলুন তো আমাকে গলির মোড়ে নামিয়ে দিবেন।”

” গলির মোড়ে কেন? সরাসরি গেইটের সামনেই নামিয়ে দিবো!”

” পাগল? আব্বু বারান্দা থেকে দেখে ফেললে? আমি তো বলেছি আমি রিকশায়।”

” ও আচ্ছা। কিন্তু এতোরাতে একা হেঁটে যেতে পারবে?”

” কতদূর আর? পাঁচমিনিটেরই তো রাস্তা। কিচ্ছু হবে না আপনি চলুন।”

” ওকে।”

অনিক নোরাকে গলির মোড়ে একটা চায়ের দোকানের পাশে নামিয়ে দিল। নোরা গাড়ি থেকে নেমে অনিককে হাসিমুখে বাই দিল। অনিকও বলল,” বাই।”

নোরাকে যতক্ষণ দেখা গেল, অনিক ততক্ষণ তাকিয়ে রইল। মেয়েটা আস্তে আস্তে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। অনিকের বুক হঠাৎ করেই কেঁপে উঠল। তার ইচ্ছে করল গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে নোরাকে ধরতে।

খালি রাস্তায় একা একা হাঁটার সময় নোরার ফোন বেজে উঠল। অন্তরার নম্বর। হালকা চিন্তিত হল নোরা। আলভী আবার কোনো কাহিনি ঘটায়নি তো? দ্রুত ফোন রিসিভ করল সে,” হ্যালো।”

” দোস্ত, তুই কি বাসায় চলে গেছিস?”

” না। যাচ্ছি৷ কি হয়েছে তোর কাঁদছিস নাকি?”

অন্তরা পাঁচ সেকেন্ডে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,” আলভীকে আঙ্কেল মেরে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন।”

” ওমা কেন?”

” ছাদে বসে বন্ধুদের সাথে মতো মদ খাচ্ছিল। আঙ্কেল সেটা জানতে পেরে প্রচুর রেগে গেছেন। তারপর ওকে পিটিয়ে বের করে দিয়েছেন। ও কোনোদিনও শোধরাবে নারে। এখন মনে হচ্ছে ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটাই ভুল ছিল। কুকুরের লেজ হাজার টেনেও সোজা করা যায়না। ও হলো সেই কুকুর।”

অন্তরা এসব বলতে বলতে কেঁদেই চলেছে। নোরা বলল,” আচ্ছা তুই কান্না থামা। এতো কাঁদিস না। কেঁদেই বা কি হবে? আর ও যে শোধরাবে না সেটা আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝলাম না আন্টি-আঙ্কেলের মতো এতো ভালো মা-বাবা পেয়েও আলভী এমন কি করে হল? আঙ্কেল যেই মানুষ, ওকে তো পিটিয়েই সোজা বানিয়ে ফেলার কথা। ”

” পেটালেও কিছু হয়না রে। গন্ডারের চামড়া।”

” তুই চিন্তা করিস না। আমি কাল সকালে অনিককে তোদের বাসায় পাঠাবো। অনিক আঙ্কেলকে বুঝিয়ে বললে আঙ্কেল আবার আলভীকে বাসায় ফিরিয়ে আনবে।”

” সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না। আঙ্কেল আলভীকে বাসায় আনতে চাইলেও সে নিজে আসবে তো? ও তো আমার মুখও দেখতে চায়না।”

” তুই এজন্য কষ্ট পাচ্ছিস? কাঁদিস না। আসলে খুব ঝামেলার মধ্যে বিয়েটা হয়েছে তো, ওর এখন মাথাটা গরম। কয়েকদিন যাক, দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। টেনশন নিস না..”

নোরা কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল। সে বাসার সামনে চলে এসেছে। আর এসেই একটা অদ্ভুত জিনিস দেখল। আলভী আর তার সাথে দুইজন ছেলে নোরাদের বাসার গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে। নোরার বারান্দা বরাবর আলভী ইট,পাটকেল ছুড়ে মারছে। আর অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করছে। নোরার গা ভ’য়ে শিউরে উঠল। আলভীকে দেখে মনে হচ্ছে পুরোপুরি আউট অফ মাইন্ড। বারবার খালি বলছে,” নোরা দ্যা বিচ! সাহস থাকে তো সামনে আয়। একবার খালি বাসা থেকে বের হো। তারপর তোরে আমি বুঝামু। আমার সাথে পাঙ্গা নেওয়া?তোর খুব চুলকানি উঠসে নারে? তোর চুলকানির মলম আমার কাছে আছে। আজকে তোরে আমি মলম লাগামু তুই বের হো খালি।”

নোরা পিছিয়ে গেল। এ অবস্থায় কিছুতেই আলভীর সামনে যাওয়া যাবেনা। ওর বুক দুরুদুরু করছে। ওরা তিনজন আর ও একজন। কি করে পারবে? ওইদিকে অন্তরা ননস্টপ হ্যালো হ্যালো করছে। নোরা ভীত গলায় বলল,” অন্তু রে! অসভ্যটা এখন আমার বাসার সামনে।”

” কি বলিস? ও তোর বাসার এ্যাড্রেস পেল কই?”

” সেটাই তো বুঝতে পারছিনা। আর ও একা না। দু’টো ছেলেও আছে ওর সাথে।”

” তুই বাসায় ঢুকতে পেরেছিস?”

” না, কি করে ঢুকবো? ওরা তো গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”

” তোর সাথে আর কেউ নেই?”

” না। অনিক তো আমাকে মোড়ে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে৷ রাস্তা পুরা খালি একটা মানুষও নেই। আমার ভীষণ ভয় করছে দোস্ত..”

হঠাৎ নোরার ফোন কেটে গেল। অন্তরা হ্যালো হ্যালো করছে কিন্তু ওইপাশ থেকে কোনো আওয়াজ নেই। অন্তরার বুক ধক করে উঠল। সে বুদ্ধি করে অনিককে ফোন লাগাল।

এদিকে আলভী,শিপন,আরিফ নোরাকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। নোরা ওদের হঠাৎ সামনে দেখে এতো ভয় পেল যে ওর হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। আলভী হিংস্র নেকড়ের মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওই চোখে এতো হিংস্রতা,এতো ক্রোধ যে ওই চোখে তাকাতেই নোরার হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। শিপন আলভীকে বলল,” কি করবি?”

আরিফ বলল,” উঠায় নিমু?”

এ কথা শুনে নোরা পিছিয়ে গেল। ওর নিঃশ্বাস থেমে গেছে। পেছনে কয়েক ইঞ্চি দূরেই দেয়াল। আলভী কোনো কথা না বলেই হুট করে নোরাকে একটা রামচড় দিল। সেই চড়ের ধাক্কা এতো বেশি ছিল যে নোরা সামলাতে না পেরে উল্টোদিকে ঘুরে দেয়ালের সাথে জোরেসোরে একটা বারি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

তার চোখ-মুখ ঝাপসা হয়ে আসছে। নোরার প্রতি যে ক্ষোভ,ক্রোধ তা যেন এক চড়েই ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে আলভী। নোরা চোখে কিছু দেখছে না, শুধু কানে শুনল,” এই তোরা তোল ওরে, জলদি তোল। আজকে ওর জীবনের শেষদিন হইবো।”

নোরা মাথায় হাত দিয়ে বহুকষ্টে উঠে দাঁড়াল। সবকিছু আবছা অন্ধকার লাগছে। মাথা থেকে গড়গড় রক্ত পড়ছে। ঠোঁটের একপাশ কেটে গেছে। তবুও এই অবস্থাতে শিপন আর আরিফ ওকে ধরতে এলে নোরা দুজনকেই ধাক্কা মেরে উল্টা পথে দৌড়ানো শুরু করল। আলভী, শিপন, আরিফও ওর পেছনে ছুটছে।

নোরা দৌড়ানোর বল পাচ্ছেনা, হাঁপিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু থামারও উপায় নেই। হঠাৎ সামনে তাকিয়েই দেখল অনিক পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এদিকেই আসছে। নোরা অনিককে দেখে থেমে গেল এবং মাটিতে বসে পড়ল। অনিক নোরাকে এই অবস্থায় দেখে আৎকে উঠল। নোরার সাথে সেও মাটিতে হাটু গেঁড়ে বসে পড়ল। নোরার রক্তাক্ত মুখ স্পর্শ করে কাঁপা কণ্ঠে বলল,” কি হয়েছে নোরা? ওরা কি করেছে বলো! সবকয়টাকে কবর দিয়ে ফেলবো।”

নোরা কিছু বলার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। অনিক নোরাকে কোলে তুলে সামনে এগিয়ে আসতে নিলে আলভীরা উল্টোপথে হাটা ধরল। কিন্তু উল্টোপথে পুলিশ। আর একপাশে নোরার বাবা আনিস দাঁড়িয়ে আছেন। আলভীরা যখন নোরার বারান্দায় ইট,পাটকেল ছুড়ছিল তখনি আনিস পুলিশকে ফোন করেছিলেন। পুলিশ আলভীদের এ্যারেস্ট করে নিল, আর আনিস তাকিয়ে রইল অনিকের দিকে। যে তার অজ্ঞান হওয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় দাড়িয়ে আছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here