গল্পের_নাম #হটাৎ_এক_বৃষ্টির_দিনে #পর্বঃ২১ সমাপ্ত পর্ব #নবনী_নীলা

0
99

#গল্পের_নাম #হটাৎ_এক_বৃষ্টির_দিনে
#পর্বঃ২১ সমাপ্ত পর্ব
#নবনী_নীলা
আমাকে এতো পরিমাণে খাবার খাওয়ানো হচ্ছে যে নিজেকে আমার জলহস্তী মনে হচ্ছে। আমি খেতে পারছি না তবুও জোর করে খাওয়াচ্ছে। এই নিয়ে অভির সাথে ঝগড়া শুরু করেছি।

” না খাবো না। একটু আগে খেয়েছি তো।”, কাদো কাদো করে বললাম।

” একটু আগে মানে? দুইঘন্টা আগে খেয়েছো এখন এই গ্লাস দুধ তুমি শেষ করবে।”,রাগী গলায় বললো অভি।

” আমার খিদে নেই। উফফ এমন করবেন না।”, ভ্রু কুঁচকে বললাম।

” তোমার খিদে না থাকতে পারে কিন্তু আমার বাচ্চার তো খিদে পেয়েছে। তোমার জন্য কি সে না খেয়ে থাকবে?”,বলেই গ্লাস হাতে আমার পাশে বসে পড়লো।

” আপনার বাচ্চা মানে?”,রেগে বললাম

” তোমার বাচ্চা হলে তুমি চুপ চাপ খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে।”,বলে গ্লাস আমার দিকে এগিয়ে দিলো।

আমি বিরক্তি সহকারে গ্লাস হাতে নিয়ে বললাম,” ছেলেরা কেনো যে প্রেগনেন্ট হয় না! হলে আপনাকে আমি বুঝাতাম।”

” ছেলেদের মধ্যে মেয়েদের মতো এতো সহ্য ক্ষমতা নেই। মেয়েরা যা সহ্য করে একটা বাচ্চাকে পৃথিবীতে আনতে একটা ছেলের পক্ষে এতো পেইন সহ্য করা অসম্ভব। ছেলেরা শুধু শক্তিতে এগিয়ে।”

” হয়েছে হয়েছে, এতো ভালো সাজতে হবে না।”, বলে মুখ ভেংচি কেটে গ্লাসটা শেষ করলাম।

অভি আমার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে আমার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।

এভাবে আদর যত্নে দেখতে দেখতে এক মাস, দুইমাস, তিন মাস, ছয় মাস কিছুদিন হলো নয় মাসে পা দিয়েছি। নিজেকে দেখে আমি নিজেও অবাক আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছি। পেট কতটুকু বড় হয়েছে সেটা দেখছি, আচ্ছা বেবী কি করছে বসে আছে নাকি ঘুমিয়ে আছে?অভী পিছন থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

“আচ্ছা বেবির কি নাম দিব?”, আমি অভির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতেই অভি আমার বললো,” হুম আমি ভেবেছি কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না।” তারপর আমাকে এনে খাটে বসলো।

” আমিও অনেক নাম পড়েছি কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না।”, অভি আমার গাল হাত দিয়ে ধরে বললো,” আচ্ছা বেবী আসুক তারপর চিন্তা করবো, ঘুমাও এবার।”

” তাহলে আপনাকেও ঘুমাতে হবে।”, বললাম আমি। রাত সবে সাড়ে এগারোটা ঘুম কি এখন আসবে? শুধু শুধু শুয়ে থাকা। একদিন আমার মতন শুয়ে থাকুক তাহলে বুঝবে মজা। অভি না তো করলোই না উল্টো কোনো কথা না বললো,” আচ্ছা ঠিক আছে।”

উফফ জ্বালা! ভালো লাগে না শুয়ে থাকতে। অভি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। এখন ভাল্লাগছে। আচ্ছা বাচ্চা কার মতো হবে? আমার মতো নাকি অভির মত হবে, বাচ্চার নাম এইসব ভেবে আমাদের সময় যাচ্ছে।

_________

দিনটা ছিলো রবিবার। সেদিন খুব বৃষ্টি ছিলো হটাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। শুনেছি বৃষ্টি সাথে করে নাকি আনন্দ নিয়ে আসে। আনন্দ কিনা নওরীন জানে না কারণ তখন তার লেবার পেইন উঠেছে । রাত তখন বারোটা। এই বৃষ্টিতে অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হচ্ছে দেখে অভি হুড়োহুড়ি করে গাড়ি বের করলো।

ব্যাথায় নওরীন হাটতে পর্যন্ত পারছেনা। নওরীনকে কোলে করে নিচে নিয়ে আসলো। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় জ্যাম, রাস্তা পানিতে ডুব ডুব অবস্থা। কিছুক্ষণ পর পর নওরীন ব্যাথায় চিৎকার করছে। অভি কিছুক্ষণ জ্যাম ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করলো। নওরীনের হাত ধরে তাকে ভরসা দিতে থাকলো কিন্তু জ্যাম কমছে না। অভি নওরীনকে রেখে বেরিয়ে গিয়ে যে ট্রাফিক পুলিশের সাথে কথা বলে কিছু ব্যাবস্থা করবে অভি সেটাও পারছে না। এই সময় নওরীনকে একা রেখে যাওয়া সম্ভব নয়।অভির নিজেকে অসহায় লাগছে। নওরীনের এমন সময় সে কিছুই করতে পারছে না। হাসপাতলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত তখন দুইটা বাজে।নওরীনের শরীর নিস্তেজ হয়ে গেছে তবুও ক্ষণিক পরে পরে সে চিৎকার করে উঠছে। ঘুমে আচ্ছন্ন হাসপাতাল জেগে উঠলো নওরীনের চিৎকারের শব্দে ।হাসপাতলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই নওরীনকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো।

বাড়িতে ফোন করা হয়েছে অভির বোন, দুলাভাই আর নওরীনের বাবা মা আসছে। অভি অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে বসে আছে। অভির ভয় হচ্ছে, কিসের ভয় অভি জানে না। বৃষ্টি আরো জোরে শুরু হয়েছে। বৃষ্টির শব্দে এখণ অভির ভয়টা আরো বাড়ছে। সময় যেনো কিছুতেই যেতে চাইছে না। অভি উঠে পায়চারি শুরু করেছে। অপারেশন থিয়েটার থেকে অনেক্ষন পর ডক্টর বেরিয়ে এসে বললেন,” আপনি কি অভি আহমেদ? পেশেন্ট এর হাসবেন্ড?”

অভি ভয়াথ চেহারায় হা সূচক মাথা নাড়ল।
“congratulations আপনাদের একটা সুন্দর মেয়ে হয়েছে।” অভির বুক থেকে যেনো একটা পাথর নেমে গেছে।

কিন্তু পরক্ষনেই ডক্টর বললো,” তবে আপনার ওয়াইফের অনেক ব্লিডিং হয়েছে। আমাদের এ বি নেগেটিভ রক্তের খুব দরকার। যত তারাতারি সম্ভব রক্তের জোগাড় করুন নয়তো আমাদের কিছুই করার থাকবে না।”, বলে অভির কাধে হাত রাখলেন। অভির বুকটা কেঁপে উঠলো। অভির জানা মতে ফ্যামিলির কারোর সাথেই নওরীনের ব্লাড গ্রুপ মিলে না।এতো রাতে কোথায় সে রক্ত খুঁজবে।অভি ছুটতে লাগলো পাগলের মতন,নিজের মেয়েকেও দেখলো না।

হটাৎ ড্রাইভার জোড়ে ব্রেক কষতেই অভির ঘুম ভাঙলো। সেই ভয়ানক দিনটি সে কখনই ভুলতে পারে। মাঝে দুঃস্বপ্ন হয়ে তার কাছে ধরা দেয়। অভি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নামলো।

রাত এখন একটা বাজে অভি চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে আসলো। আজকাল কি নিঝুম লাগে যখন সে বাড়ীতে ফিরে। অভির প্রতিদিন এমন দেরি হচ্ছে। অভি অফিসের ব্যাগ সোফার পাশে গিয়ে রেখে নিজের রুমে এলো। অরিন কি ঘুমিয়ে আছে? দেখার জন্য রুমে এলো। অরিন নামটা নওরীনের রাখা। অভি যখন বলেছিলো এতো নাম থাকতে অরিন কেনো রাখবে?

নামটা রাখার পিছনে নওরীনের যুক্তি ছিল সে অভির অ আর নওরীনের রিন নিয়ে অরিন রেখেছে। অরিনের বয়স এক বছর হলো।প্রতিদিন দেরি করে আসায় দেখা যায় অরিন ঘুমিয়ে গেছে। আজ বিপরীত হয়েছে অরিন জেগে আছে নিজের মনে খেলা করছে নিজের হাত দিয়ে। বাবাকে সে ভালো করেই চিনে, বাবাকে দেখে সে এক গাল হাসলো। অভি কাছে গিয়ে দেখলো নওরীন ঘুমিয়ে আছে।

সেদিন রাতের পর থেকে অভি ইমন নামের ছেলেটার কাছে ঋণী হয়ে আছে। হাসপাতলে যখন রক্তের জন্যে ছুটাছুটি করেও রক্ত পায়নি তখন ইমনের সাথে দেখা, ইমনের সাথে অভি কোনো কথা বলে নি। সে রক্তের খোঁজে ব্যাস্ত। কিন্তু এতো রাতে কোথাও এ বি নেগেটিভ রক্তের সন্ধান পায় নি।যখন শেষমেশ রক্ত জোগাড় করে অভি ফিরে আসে ততক্ষনে দেরি হয়ে যায়। অভি যখন ব্যার্থ হয়ে চোখের পানি আটকে রাখতে পরছিলো না তখন নার্স বলে ইমন নামে এক ছেলে নওরীনকে রক্ত দিয়েছিলো। তাই এখন আর রক্তের কোনো প্রয়োজন নেই।

ইমনের মায়ের অপারেশনের কারণেই সেদিন সে হাসপাতালেই ছিলো। অভিকে অস্থির হয়ে ছুটো ছুটি করতে দেখে সে নার্সকে প্রশ্ন করতেই সব জানতে পারলো। ইমন আর নওরীনের প্রায় মজা করে বলতো আমি মোরে গেলে তুই আমাকে রক্ত দিয়ে বাঁচাবি আর তুই মরে গেলে আমি তোকে রক্ত দিয়ে বাঁচাবো বুঝলি। কারণ তাদের দুজনেরই ব্লাড গ্রুপ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ইমন নিজের দেওয়া কথা ঠিক রেখেছে। নওরীনকে সে বাঁচিয়েছে।

অভি সেদিনের পর ইমনকে নানা জায়গায় খুঁজেছে কিন্তু কোথাও ছেলেটি সন্ধান পায় নি। সেই বৃষ্টির রাতে ফেরেস্তার মতন এসে সে অভির জীবনের আলোটুকু নিভতে দেয়নি। এই আলোটা হয়তো সে নিজের জন্যই জ্বালিয়েছে নিজের ভালোবাসার জন্য কিন্তু তাও অভি ঋণী রয়ে গেল।

অভি কাছে গিয়ে অরিনের খেলা দেখছে, মেয়েটা খুব শান্ত নওরীন তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে কিন্তু সে মায়ের ঘুম না ভাগিয়ে নিজের মনে খেলছে।অভিকে দেখে বাবা বলে উঠলো অরিন। বাবার সাথে তার দেখা হয় খুব কম। অফিসের কাজে ফিরতে রাত হয় আবার সকালে তাড়াতাড়ি যেতে হয়। অভি নওরীনের গায়ে কাথা তুলে দিয়ে ইশারায় অরিনকে চুপ করতে বললো। তারপর নওরীনের ঘুম না ভাঙিয়ে অরিনকে কোলে তুলে নিলো। বাবা মেয়ে অনেক্ষন খেললো। অরিন চোখ বন্ধ করে আবার খুলে অভিকে দেখে হাসতে থাকে তারপর আবার চোখ বন্ধ করে।

অভি মুগ্ধ হয়ে অরিনের খেলা দেখছে। খেলতে খেলতে অভির কোলে অরিন ঘুমিয়ে পড়েছে। অভি অরিনকে নওরীনের পাশে শুইয়ে দিলো। অভি মুগ্ধ হয়ে মা আর মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

অভি শাওয়ার শেষ করে বেরিয়ে দেখে নওরীনের ঘুম ভেঙেছে সে খাবার টেবিলে বসে অভির জন্যে অপেক্ষা করছে। নওরীনের মাঝে ম্যাচুরিটি এসেছে সে এখন আর নিজেকে বিপদে ফেলে না কারন সে জানে তার বিপদ মানে অভি আর অরিনের বিপদ। তবে নওরীনের বাচ্চামিগুলো অভি মিস করে। খাওয়া শেষ করে অভি রুমে গিয়ে বসে নওরীনের দিকে তাকিয়ে আছে।

নওরীন বললো,” আপনি ঘুমাবেন না?”
অভি না সূচক মাথা নাড়ল। নওরীন চিন্তিত হয়ে বললো,” কেনো? মাথা ব্যাথা করছে?”

অভি ইশারায় নওরীনকে নিজের কাছে ডাকলো। নওরীন এসে পাশে বসতে নিলো অভি নওরীনের হাত ধরে টেনে নিজের কোলে বসালো।

” আরে আপনি কি করছেন? অরিন ঘুমিয়ে আছে না। উঠে পড়লে?”, নওরীন বিস্ময় নিয়ে বললো।

অভি নওরীনের বাধা চুল খুলে দিয়ে বললো,” উঠবে না, কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়েছে। এটা না তোমার জায়গা ছিলো এখন বুঝি আর আমার কোলে বসতে ইচ্ছে করে না?”

নওরীন হেসে বললো,” আপনার তো এখন কোলে খেলার মতন মেয়ে আছে। আর জনাব আপনার কাছে সময় আছে আমার জন্য?”

” ঠিক আছে মানছি আমি ব্যাস্ত থাকি কিন্তু সময় না দিলে সময় আদায় করে নিতে পারো না?”

” হয়েছে কি আপনার আজকে?”নওরীন অবাক হয় বললো অভির কথায় সে হতবাক।

অভি নওরীনের প্রশ্ন উপেক্ষা করে বললো,” তুমি অনেক বদলে গেছো। কেমন বুঝদার মেয়ে হয়ে গেছো। আমি আমার আগের নওরীনকে মিস করি।”

নওরীন কিছুক্ষণ হতভম্বের মতন তাকিয়ে থেকে মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বললো,” আরেহ আপনি দেখি ভালোই অভিযোগ করা শিখেছেন। নওরীনের জামাই! নওরীনের জামাই লাগছে আপনাকে। এখন আবার এই নামে ডাকলে তো সমস্যা পরে অরিনও বাবা না ডেকে বলবে নওরীনের জামাই। কেমন হবে ভাবুন তো।”

” আমি মোটেও মজা করছি না।”, অভির কথায় নওরীন হাসি থামলো তারপর নওরীন অভির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো,” আচ্ছা, ঠিক আছে। নওরীনের জামাই এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। কালকে অফিসে আছে না।”

অভি নওরীনকে কোলে তুলে নিতেই নওরীন অবাক হয় বললো,” কি করছেন?”অভি বললো,” কাল আমি অফিসে যাবো না।”

” কেনো? আপনি অফিস যাবেন না কেনো?”, বলে শেষ না করতে অভি নওরীনকে চুপ করতে বললো না হলে অরিনের ঘুম ভেঙে যাবে। নওরীন চুপ করে অভির কোলে থেকে অভির কান্ড দেখছে। অভি নওরীনকে নিয়ে অন্য রুমে এসে নওরীনকে শুইয়ে দিলো। অভি কি করতে চাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে নওরীন লাফ মেরে উঠে বসলো।

” কি করেছেন? মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?অরিন একা ওই রুমে।”,বলতেই অভি নওরীনের কাছে আসতে লাগলো।তারপর বললো,” অরিন ঘুমচ্ছে। আমার মেয়ে যথেষ্ট ভদ্র সে তার বাবা মায়ের রোমান্সে বাধা দিবে না।”

[ সমাপ্ত ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here