উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন #পর্ব২৫ #আফিয়া_আফরোজ_আহি

0
24

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব২৫
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

ভোরের আলো চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নিকষ কালো আঁধার কাটিয়ে ধরিণীতে সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়ছে। গভীর ঘুমে বিভোর আমি। মাথায় কেউ উষ্ণ হাতের ছোঁয়া দিচ্ছে। কারো হাতের অস্তিত্ব মাথায় টের পেতেই চট করে উঠে গেলাম। আদ্র ভাইয়ের ঘুম কি তবে ভেঙ্গে গেল? উনি কি উঠে গেছেন? চোখ কচলে সামনে তাকাতেই নজরে এলো আদ্র ভাইয়ের মলিন চেহারাটা। মাথা শুভ্র ব্যান্ডেজে মোড়ানো। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। বুকের মাঝে ঢক করে উঠলো। আমার আদ্র ভাইয়ের এমন করুণ রূপ যে সহ্য সীমার বাহিরে চলে যাচ্ছে। সারা কেবিনে আদ্র ভাই আর আমি ছাড়া কেউ নেই। তাহলে কে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো? আদ্র ভাই? কিন্তু উনার হাতে তো ক্যানোলা পড়ানো। উনি কিভাবে মাথায় হাত বুলাবেন। খেয়াল করে দেখলাম আদ্র ভাইয়ের হাত উঁচু করে রাখা। তার মানে উনিই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। কাল রাতে উনার হাত ধরে কান্না করতে করতে কখন যে উনার হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি সে খেয়াল নেই। তবে ভালো লাগার বিষয়টা হচ্ছে মানুষটা এই অসুস্থ শরীর নিয়েও আমার খেয়াল রাখছেন। এতে মন কিছু টা ভালো হয়ে গেল। শুভ ভাই বলেছিলো আদ্র ভাইয়ের ঘুম ভাঙলে তাকে ডাকতে। আদ্র ভাইকে একবার ঠিক করে দেখে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

——

শুভ ভাই আদ্র ভাইয়ের চেকআপ করছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি। চেক আপ শেষে শুভ ভাই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সকে বলল,
“ওকে ফ্রেশ করিয়ে খাবার খাইয়ের ওষুধ গুলো ঠিক মতো দিয়ে দিবেন”

নার্স মাথা নেড়ে সায় জানালো। আমি চোখ ছোটো ছোটো করে শুভ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি থাকতে আমার আদ্র ভাইকে অন্য কেউ ফ্রেশ করিয়ে খাইয়ে দিবে সাহস কতো তার? শুভ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বুঝতে পারলো। নার্স কে বলল,
“থাক আপনার কিছু করা লাগবে না। আপনি শুধু ওকে পেসেন্ট এর ওষুধ গুলো বুঝিয়ে দেন তাহলেই হবে”

নার্স আমাকে আদ্র ভাইয়ের ওষুধের টাইম, কখন কোনটা খাওয়াতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। শুভ ভাই ও চলে গেলেন। তার রাউন্ডে যেতে হবে। আমি সাবধানে আদ্র ভাইকে ফ্রেশ করিয়ে তার জন্য সুপ নিয়ে এলাম। উনার মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে মুখের সামনে চামচে করে সুপ ধরলাম। তবে আদ্র ভাই মুখ খুলছেন না। কেমন অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
“কি সমস্যা হা করছেন না কেন? আপনার ওষুধ খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি মুখ খুলুন”

আদ্র ভাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। উনি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই তার মুখে চামচ পুড়ে দিলাম। আদ্র ভাই কিছু বলার চেষ্টা করছে আমি তাকে কোনো সুযোগই দিচ্ছি না। সুপ শেষ হলে ওষুধ খাইয়ে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিলাম। আদ্র ভাইকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলাম না।
——

ক্লান্ত শরীরে কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রেখে শরীর এলিয়ে দিলাম। পরপর চারটা ক্লাস করে অবস্থা খারাপ। ঘাড় ব্যথা করছে। ফুপ্পি পাশে এসে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“ক্লান্ত লাগছে? ক্লাস শেষ করে বাড়ি গেলেই তো পারতি। একেবারে খেয়ে দেয়ে রেস্ট নিয়ে আসতি”

“আমার কথা বাদ দাও তো। তোমার ছেলে খাবার খেয়েছো?”

“হ্যাঁ মাত্র খাওয়ালাম”

“ওষুধ দিয়েছো?”

“না। দিতে যাচ্ছিলাম তুই চলে এলি”

“ঠিক আছে। তুমি বসো আমি দিয়ে দিচ্ছি”

আদ্র ভাই হসপিটালে আছে দুই দিন হয়ে গেল। এখন উনার অবস্থা আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। বিগত দুই দিনে আদ্র ভাইয়ের কাছেই ছিলাম আমি আর শুভ ভাই। ক্লাস শেষ করে সোজা এখানে চলে আসতাম। তাই রুদ্র ভাই এসে আমার আর শুভ ভাইয়ের খাবার দিয়ে যেত। সারাদিন এখানেই আমার কেটে যেত। হাইপাওয়ারের ওষুধে দেওয়ায় আদ্র ভাই খাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমের দেশে হারিয়ে যেত। আর আমি এক ধ্যানে মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এই মানুষটার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো? ভাবলেই বুকে হাহাকার নামে আসে। দম আটকে যায়। কি জঘন্য সেই অনুভূতি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদ্র ভাইকে ওষুধ খাইয়ে দিলাম। তিনি করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাতে আমার কি? কথা বলবো না উনার সাথে। রাগ করেছি। রাগের চেয়েও অভিমানে মাত্রা বেশি। বিগত দুই দিন ধরে আদ্র ভাই আমার সাথে কথা বলতে চাইলেও আমি তার সাথে কথা বলিনি। কেন বলবো উনার সাথে কথা? আদ্র ভাইকে ওষুধ খাইয়ে দিতেই কিছুক্ষনের মাঝে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। শরীর ক্লান্ত থাকায় ধপ করে সোফায় ফুপ্পির পাশে বসে পড়লাম। ফুপ্পির ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রেখেছি। ফুপ্পি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“রোদ সোনা আমার কথাটা শোন। তুই বাসায় যা। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে রেস্ট নিয়ে আয়। আদ্রর কাছে আমি আছি। আর এমনিতেও ও তো ঘুমাচ্ছে”

“আমার কথা বাদ দাও। আমি ঠিক আছি”

“তুই যাবি নাকি না? আমি কিন্তু এখন তোর ওপর রাগ করবো। যা রেস্ট নেওয়া লাগবে না। তুই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আয়। ভাবি তোর জন্য চিন্তা করছে”

ফুপ্পি অনেক করে রিকোয়েস্ট করছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বাসায় যাবো। যাওয়ার আগে ফুপ্পিকে বললাম,
“তোমার ছেলেকে দেখে রেখো। আমি আধা ঘন্টার মধ্যে আসছি”

ফুপ্পি হাসতে হাসতে বলল,
“তুই যা পা*গলী মেয়ে। আমি আছি”

বাসায় ঢুকতেই সামনে পড়লো রোশনি। আমায় দেখে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে চেঁ*চিয়ে উঠলো।
“আম্মু, বড় আম্মু, মেঝ আম্মু দেখে যাও কে এসেছে”

আমি এসেছি এতে সবাইকে ডাকার কি দরকার? আম্মুরা ছুটে এলো রান্না ঘর থেকে। বড় আম্মু গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“অবশেষে এলি তুই?”

“হ্যাঁ। এখন রুমে যেতে দাও। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে হসপিটালে যেতে হবে”

ওদের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমে চলে এলাম। এক সেট কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। টেবিলে বসতে বসতে হাক ছাড়লাম,
“আম্মু তাড়াতাড়ি খাবার দাও আমায় হসপিটালে যেতে হবে”

আম্মু খাবার বেড়ে দিলো। ঝটপট খেয়ে রুমে আসে বিছানায় বসলাম। শরীর ক্লান্ত লাগছে। বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলাম।
——

গোধূলি লগ্ন স্বল্প হিলেম হাওয়া বইছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে পশ্চিমে। আকাশে স্বল্প মেঘেদের আনাগোনা। আদ্র ভাইয়ের পাশে বসে রয়েছি। বসে রয়েছি বললে ভুল হবে উনি আমায় বসিয়ে রেখেছে। আমার হাত ধরে আটকে দিয়েছে। উঠতেও পারছি না। বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিতেই কখন যে চোখ লেগে এসেছে জানি না। ঘুম ভাঙলো বিকেল নাগাদ। উঠে কোনো রকম ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আম্মুকে বললাম,
“আমি ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। তোমরা আমায় ডেকে দাওনি কেন?”

“আমি ডাকতে বারণ করেছি তাই”

সোফায় বসে শুভ ভাই উত্তর দিলেন। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কেন?”

“তোর রেস্ট দরকার আছে। বিগত দুই দিনে যেভাবে আদ্রর সেবা করছিস দেখা যাবে কখন তুই নিজে অসুস্থ হয়ে যাস। তাই আমি মেঝ আম্মুকে ডাকতে বারণ করেছি”

শুভ ভাই উঠে পকেটে ফোন রাখতে রাখতে বলল,
“আমি তোর জন্য বসেছিলাম। এখন চল দুই ভাইবোন মিলে একসাথে যাই”

দুজন একসাথে আদ্র ভাইয়ের কেবিনে ঢুকলাম। আদ্র ভাই আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। ফুপ্পি আদ্র ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন । উনিও বসে বসে মায়ের আদর খাচ্ছেন। শুভ ভাই আদ্র ভাইয়ের চেকাপ করে চলে গেলেন। ফুপ্পি উঠতে উঠতে বলল,
“তুই ওর কাছে থাক আমি একটু বাসায় যাই”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। ফুপ্পি চলে গেল। আমি আদ্র ভাইয়ের বেডের পাশে রাখা প্রেসক্রিপশন নিতে হাত বাড়াতেই আদ্র ভাই খপ করে হাত ধরে ফেলল। আমি উনার দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো। চোখ নামিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। তবে পারছি না। বাধ্য হয়ে মুখ খুললাম,
“হাত ধরেছেন কেন? হাত ছাড়ুন”

“কি সমস্যা তোর? কথা বলছিস না কেন আমার সাথে? আর আপনি আপনিই বা করছিস কেন?”

আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কথা বলবো না ওনার সাথে। আদ্র ভাই থুতনি ধরে আমায় তার দিকে ফিরালেন।
“কি হলো কথা বল”

“কথা বলবো না তোমার সাথে”

“কেন? আমি কি করেছি?”

“তুমি নিষ্ঠুর মানুষ। তোমার সাথে কথা নেই। তুমি একবার ভেবেছো তোমার কিছু হলে আমার কি হতো? পা*গল হয়ে যেতাম আমি। যখন শুনলাম তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছে তখন আমার মাঝে কি ঝড় বইছিলো জানো তুমি? তোমার নিস্প্রাণ চেহারা দেখে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। হাহাকার কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো আমায়। তোমার এই অবস্থা দেখে পা*গল প্রায় হয়ে দিয়েছিলাম। আমি যেন নিজের মাঝে ছিলাম না। তুমি আমার কথা একটুও ভাবো না আদ্র ভাই, একটুও না”

কথা গুলো বলতে বলতে কান্না করে দিলাম। চোখের পানি বাঁধ মানছে না। অবলীলায় গড়িয়ে পড়ছে। কান্না করতে করতে এক সময় হামলে পড়লাম আদ্র ভাইয়ের বুকে। আদ্র ভাই আমায় আগলে নিলেন তার বুকের সাথে। আমি কেঁদেই চলেছি। থামাথামির নাম নেই। আদ্র ভাই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আবেশে।
“বিশ্বাস কর রৌদ্রময়ী সেদিন কি থেকে কিছু হয়ে গেল আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। রাতে তোর সাথে কথা হওয়ার পর মনে শান্তি পাচ্ছিলাম। তোকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। সারারাত চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারিনি। সকালে অফিসে গিয়েও শান্তি মিলেনি। ভেবেছিলাম হয়তো আমিই বেশি বেশি ভাবছি। তাই আমার এমন মনে হচ্ছে।কাজের মাঝে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু আমি পারিনি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তোর সাথে দেখা করবো। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তোর টেনশনে অমনোযোগী থাকায় কখন যে সামনে এক খাম্বা এসে পড়েছে আমি নিজেও খেয়াল করিনি। চোখ বন্ধ হওয়ার আগ মুহূর্তে তোর আর আম্মুর মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। মনের মাঝে একটাই প্রশ্ন জাগছিলো ‘তবে কি আমি ম*রে যাচ্ছি’। একটু একটু করে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। হাত বাড়িয়েও কোনো কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না”

আদ্র ভাইয়ের মুখে হাত রেখে বললাম,
“ভুলেও ম*রার কথা মুখে আনবে না। নাহলে আমি নিজে তোমায় খু*ন করে ফেলবো”

“রৌদ্রময়ীর হাতে খু*ন হতে পারলে যে আমি ধন্য হয়ে যাবো”

আমি চোখ রাঙিয়ে আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। আদ্র ভাই মুখে আঙ্গুল দিয়ে বললেন,
“রাগ করছিস কেন? এমনি বলছিলাম আরকি”

কিছু বললাম না। নিঃশব্দে মিশে রইলাম তার বুকের সাথে। এতদিনে বোধ হয় একটু শান্তি খুঁজে পেলাম। এই গোটা মানুষটাই তো আমার মানসিক শান্তির জায়গা। আমার ‘ভালোবাসা’। হ্যাঁ, আদ্র ভাই আমার ভালোবাসা। এই কয়েকদিনে আমি এটা বুঝে ফেলেছি আদ্র নামক মানুষটাকে ভালোবাসে ফেলেছি। তাকে ছাড়া আমার চলা সম্ভব না। আমার তাকে চাই, সব সময়ের জন্য চাই। আমার ভালো থাকার জন্য হলেও উনাকে আমার চাই। আদ্র ভাই ফিসফিস করে বলে উঠলেন,
“ভালোবাসি রৌদ্রময়ী”

#চলবে?

(অনেকেই বলেন পর্ব ছোটো হয়েছে, আবার প্রতিদিন গল্প চান। প্রতিদিন গল্প দিলে এর চেয়ে বড় করে লিখা কষ্টকর আমার জন্য। আপনাদের পর্বটা পড়তে ৫মিনিট লাগলেও আমার লিখতে ২-৩ ঘন্টা লাগে। তাই এরচেয়ে বড় করে লিখা সম্ভব না। দুঃখিত। আমার কথায় কেউ কষ্ট পেলে ক্ষমা করে দিবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পর্ব টা কেমন হয়েছছে জানাবেন। ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here