#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব২৯
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
স্নিগ্ধ সকালে মিষ্টি রোদের ছোঁয়া। জানালা ভেদ করে সূর্যের আলো মুখে পড়তেই ঘুমটা হাল্কা হয়ে গেল। চোখ খুলে আরমোড়া দিয়ে উঠে বসলাম। ঘড়ির দিকে খেয়াল করতেই দেখলাম সবে ছয়টা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। এতো জলদি ঘুম ভাঙার কোনো দরকার ছিলো। চাদর মুড়ি দিয়ে আবারো ঘুমানোর চেষ্টা করলাম তবে ঘুম আসছে না। কিছুক্ষন বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে উঠে বসলাম। এখন যে ঘুম আসবে না এটা জানা কথা। ফ্রেশ হয়ে গরম ধোয়া ওঠা এক কাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। ব্যালকনি থেকে পুরো বাগান দেখা যাচ্ছে। সকাল সকাল স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। মুহূর্তেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। সকালের মিষ্টি পরিবেশ নিমিষেই মন ভালো করে দেয়। চা শেষ করে টেবিলে বসে পড়লাম। কিছু পড়া বাকি রয়ে গেছে সেগুলো শেষ করতে হবে।
মেডিকেলের জন্য রেডি হয়ে নিচে নেমে ইভার পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম। টেবিলে আমি, ইভা আর শুভ ভাই। আব্বু, বড় আব্বু আর অভ্র ভাই আরো আগে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়েছে। মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছি এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে কারো নেমে আসার শব্দে ওপরে তাকালাম। আদ্র ভাই অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নামছে। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট হাতে কোট সব মিলিয়ে ফর্মাল লুকে আদ্র ভাইকে পুরা নায়ক নায়ক লাগছে। উনাকে দেখে পুরো ফিদা হয়ে গেলাম। ক্যাবলাকান্তের মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছি। আদ্র ভাইয়ের পিছু পিছু ফুপ্পি কিছু বলতে বলতে আসছে। আদ্র ভাই কখন যে আমার পাশে এসে বসেছে আমার সে খেয়াল নেই। আমি তো তাকে দেখতে ব্যাস্ত। ফুপ্পি বলে উঠলো,
“রোদ বলতো এখনো ঠিক মতো সুস্থ হতে পারেনি ছেলে আমার অফিস যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আর কয়টা দিন রেস্ট নিলে কি হতো? রোদ ওকে যেতে না কর”
ফুপ্পির কথা শুনে ধ্যান ফিরলো। আদ্র ভাইকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিবো তার আগেই উনি বলে উঠলো,
“তুই অন্তত আম্মুর মতো বলিস না। অফিসে অনেক কাজ জমে গেছে আব্বু একা সামাল দিতে পারছে না। আমাকে যেতেই হবে। আর আম্মু একটু বোঝার চেষ্টা করো এখন তো আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছি। এখন কি সমস্যা?”
আদ্র ভাই শেষের কথা গুলো ফুপ্পিকে উদ্দেশ্য করে বলল। ফুপ্পি বলল,
“সুস্থ হয়েছিস তো কি হয়েছে আরো কয়েকটা দিন রেস্ট নিলে ভালো হতো না। একবার অফিসে যাওয়া শুরু করলে সারাদিন কাজ নিয়ে থাকিস। নিজের খেয়াল রাখিস? ছেলে হয়েছে একদম বাপের মতো কাজ পা*গল”
“কথা না বাড়িয়ে এখন খাবার দাও দেরি হয়ে যাচ্ছে”
ফুপ্পি বিরবির করতে করতে আদ্র ভাইয়ের জন্য খাবার আনতে চলে গেল। ওদের দেখা বাদ দিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। খাবার খাচ্ছি এমন সময় কানের কাছে ফিসফিস কণ্ঠে ভেসে এলো,
“এভাবে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকিস না প্রেমে পড়ে যাবি। আর প্রেম মানেই সর্বনাশ”
আদ্র ভাইয়ের কথা শুনে লজ্জায় মুড়িয়ে গেলাম। তার মানে উনি খেয়াল করেছেন আমি ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এখন নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা লাগছে। কি দরকার ছিলো অমন বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকার। না তখন ওভাবে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর না এখন এমন লজ্জা পেতে হতো। লজ্জা দূরে ঠেলে দিয়ে ওনার মতোই ফিসফিস করে বলে উঠলাম,
“আমার আদ্র ভাই আমি তাকিয়ে থাকবো তোমার কি? প্রেমে পড়লেও আমিই পড়বো অন্য কেউ না”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ”
আদ্র ভাই কথার বিপরীতে কিছু বলল না। খাওয়া শেষ আমি,ইভা আর শুভ ভাই একসাথে বেরিয়ে পড়লাম। বের হওয়ার আগে আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়েছিলাম উনিও সুযোগ বুঝে ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দিয়েছেন। ওনার হটাৎ এমন করায় অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিলাম। মুচকি একটা হাসি দিয়ে চলে এলাম।
ক্লাসে বসে আছি। একের পর এক ক্লাসে হচ্ছে কিন্তু আমার তাতে মনোযোগ নেই। হটাৎ করে মনের মাঝে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কেমন হাঁসফাঁস লাগছে। দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে। আচমকা এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ খুঁজে পেলাম না। আচ্ছা আদ্র ভাইয়ের কিছু হয়নি তো? উনি ঠিক আছে তো?মাথা থেকে উদ্ভট চিন্তা বাদ দিলাম। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছি। তবুও কিছুতেই যেন নিজেকে সালমাতে পারছি না। এই অশান্ত মন নিয়েই সব গুলো ক্লাসে শেষ করলাম। বেরিয়ে আদ্র ভাইয়ের নাম্বার ডায়াল করলাম। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই হুড়মুড়িয়ে বলে উঠলাম,
“আদ্র ভাই তুমি ঠিক আছো? তোমার কিছু হয়নি তো?”
“হ্যাঁ আমি ঠিক আছি। কিছু হয়নি আমার। তোর কণ্ঠ এমন লাগছে কেন? কোনো সমস্যা? কিছু কি হয়েছে?”
“না তেমন কিছু না। তোমাকে নিয়ে টেনশন হচ্ছিলো তাই”
“বোকা মেয়ে আমি ঠিক আছি। আমায় নিয়ে তোকে আর টেনশন করতে হবে না”
“হ্যাঁ তাই তো। তোমায় নিয়ে টেনশন করার মানুষের তো অভাব নেই। আমি টেনশন করলেই কি আর না করলেই বা কি?”
“আরে রাগ করেছিস কেন? টেনশন করলে তোরই ক্ষতি তাই বলছিলাম। আচ্ছা যা আমি সরি বলছি। তাও রাগ করিস না”
“এখন ঠিক আছে”
আদ্র ভাই হেসে দিলেন। ফোনের মধ্যে থেকেও তার প্রাণবন্ত হাসি আমি অনুভব করতে পারছি। ওনার হাসি শুনে মনটা কিছুটা হাল্কা হলো। আরো কিছু সময় আদ্র ভাইয়ের সাথে কথা বলে রেখে দিলাম। ইভাকে বললাম,
“চল বাড়ি যাবো”
ইভা আমতা আমতা করে বলল,
“বনু তুই একা বাড়ি চলে যা। আমি আর পিয়াস মিলে একটু ঘুরতে যাবো। তুই প্লিজ বাড়িতে ম্যানেজ করে নিস”
“ঠিক আছে”
ইভাকে বিদায় দিয়ে মেডিকেল এর বাইরে চলে এলাম। আজকে শুভ ভাইয়ের অপারেশন আছে তাই ভাইয়াও পরে যাবে। বাহিরে রোদের সেকি তেজ। আজকের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে সূর্য মামা মামীর সাথে ঝগড়া করে সকল তেজ আমাদের মতো বেচারিদের ওপর ঢেলে দিচ্ছে। বাইরে আসতেই চোখ পড়লো গাড়ির দিকে। উঠে বসে ড্রাইভার আঙ্কেল কে বললাম,
“আঙ্কেল তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে চলুন”
ড্রাইভার আঙ্কেল আমার দিকে টিসু এগিয়ে দিলেন। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি।
“আঙ্কেল টিসু কেন?”
“আপনাকে ক্লান্ত লাগছে মুখটা মুছে নিন”
টিসু নিয়ে মুখ ভালো করে মুছে নিলাম। হটাৎ করে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। মাথা কেমন ঘুরছে। শরীরে শক্তি পাচ্ছি না। চোখ ধীরে ধীরে ঝাঁপসা হয়ে আসছে। চেয়েও চোখ খুলে রাখতে পারছি না। একসময় ঢোলে পড়ে গোলাম।
——-
পিটপিট করে চোখ খুলে নিজেকে অপরিচিত একটা রুমে আবিষ্কার করলাম। রুমটার দেওয়াল গুলো কেমন পুরোনো। দেওয়ালে শ্যাওলা পড়ে রয়েছে। চারপাশে দেওয়াল ওপরে টিনের চাল। দেখে মনে হচ্ছে অনেক পুরোনো। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি কোথায় আমি। মাথাটা এখনো কেমন ঝিম ধরে আছে। চেষ্টা করেও কোথায় আছি বুঝতে পারছি না। এমন সময় দরজা খুলে রুমে কেউ প্রবেশ করলো। সামনের মানুষটাকে দেখে মুহূর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মানুষটা কাছে এসে আমার পাশে বসলো। গালে হাত রাখতে গেলে সিটকে সরে গেলাম।
“কি হলো সরে গেলি যে? ঠিক আছিস তুই?”
“এটা কোথায়? আমি এখানে কিভাবে এলাম? আমি তো গাড়িতে ছিলাম এখানে কিভাবে এলাম?”
“আরে কুল। এটা আমার বন্ধুর বাড়ি”
“আমি এখানে কি করছি? আমাকে এখানে এনেছেন কেন?”
“আর এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? আমি তোর কোনো ক্ষতি করবো না। তুই এতটা হাইপার হোস না”
“আমি বাড়ি যাবো। আমাকে বাড়ি দিয়েছি আসুন”
“বাড়ি তো আমরা যাবো কিন্তু বিয়ের পর”
“বিয়ের পর মানে? কার বিয়ে? কিসের বিয়ে? আমি বাড়ি যাবো”
“তোর আর আমার বিয়ে”
মাথায় যেন বাজ পড়লো। কি বলছে ইভান ভাই? ওনার মাথা ঠিক আছে?
“আপনার মাথা ঠিক আছে? কিসের আপনার আর আমার বিয়ে? আপনাকে আমি বলেছি না আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি? কথা কানে যায় না আপনার? আপনি সরুন আমি এখনই বাড়ি যাবো”
বিছানা থেকে উঠতে নিলে ইভান ভাই হাত ধরে নিলেন। টান দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো।
“ভালোবাসিস তো কি হয়েছে? আমার কোনো প্রবলেম নেই। বিয়ের পর ভালোবাসা অটোমেটিকলি হয়ে যাবে”
“আপনি আমায় যেতে দিন নাহয় খু*ন করে ফেলবো আপনাকে”
“খু*ন করিস তবে বিয়ের পর”
ইভান ভাই আমার দিকে এটা ডালা বাড়িয়ে দিলেন। আমি ধরলাম না। উনি ডালা টা পাশে রেখে বললেন,
“এখানে শাড়ি, চুরি, গহনা সব আছে পরে লাল টুকটুকে বউ সেজে ফেল। ইভানের লাল টুকটুকে বউ। একটু পর কাজী আসবে এরপর তুই আমার, শুধুই আমার। তোকে বলেছি না, তোকে আমার চাই মানে চাই”
“আপনার জন্য লাল শাড়ি তো দূর কিছুই করবো না আমি”
কান্না পাচ্ছে আমার। চোখের সামনে আদ্র ভাইয়ের মুখটা ভেসে উঠলো। তার সেই সুন্দর মন ভালোনা হাসি। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। চোখে গড়িয়ে পানি পড়লো। কন্দনরত স্বরে ইভান ভাইকে বললাম,
“ইভাম ভাই কেন এমন করছেন? আমায় যেতে দিন প্লিজ। আমি বাড়ি যাবো”
“বাড়ি তো আমরা যাবো সোনা। আগে বিয়ে টা হয়ে যাক তারপর। তুই রেডি হো আমি দেখে আসি ওদিকের কি খবর”
ইভান ভাই দরজা আটকে দিয়ে চলে গেলেন। দরজায় আঘাত করছি কিন্তু খুলছে না। অনেক ক্ষণ টানাটানি করেও খুলতে পেরছি না। নিজেকে অসহায় লাগছে। হটাৎ মাথায় এলো ফোনের কথা। আমাকে আদ্র ভাইকে ফোন করে জানাতে হবে। আশেপাশে খুঁজেও ফোন বা আমার ব্যাগের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। বিছানায় রাখা ডালাটা ছুড়ে ফেলে দিলাম। ওই ইভান নামক শ*য়তানটার জন্য আর যাইহোক আমি বউ সাজবো না। আশেপাশে তাকিয়ে পালানোর রাস্তা খুঁজছি কিন্তু আমি ব্যর্থ। পুরো রুমে একটাও জানালা নেই। পালানোর মতো কোনো অপশনও নেই। তবে কি আমি এখন থেক বের হতে পারবো না? ইভান নামক নি*কৃষ্ট মানুষটাকে আমায় বিয়ে করতে হবে? আমার ভালোবাসা আমার আদ্র ভাইকে হারিয়ে ফেলবো আমি? কানের কাছে আদ্র ভাইয়ের কথা গুলো ভেসে উঠলো,
“সারাজীবন আমার হয়েই থাকিস রৌদ্রময়ী”
উনার সেই করুণ কণ্ঠস্বর। বুকের মাঝে ধক করে উঠলো। নিজেকে পা*গল পা*গল লাগছে। মাথা কাজ করছে না। এর চেয়ে অসহায় পরিস্থিতি বোধ হয় আর নেই। হাঁটু মুড়ে বিছানায় বসে পড়লাম। মুখ হাঁটুতে গুঁজে দিয়ে কেঁদে উঠলাম।
“আদ্র ভাই তুমি কোথায়? আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না আদ্র ভাই। কোথায় তুমি? আদ্র ভাই তুমি এসে তোমার রৌদ্রময়ী কে নিয়ে যাও। ও আদ্র ভাই কোথায় তুমি?”
#চলবে?
(পর্ব টা পড়ে কেউ গা লি দিয়েন না ভাই। আমি কিছু করি নাই যা করছে ইভান করছে। তবে আপনাদের জন্য সারপ্রাইজ আছে। ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। পর্বটা কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ)