উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন #পর্ব৩১ #আফিয়া_আফরোজ_আহি

0
29

#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব৩১
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

নিশিথে ধরিত্রী জুড়ে তমিস্রা’র বিচরণ। দমকা হাওয়া বইছে। পুরো ব্যালকনি জুড়ে আলো আঁধারের খেলা। চারপাশ অন্ধকার থাকলেও ব্যালকনিতে থাকা ছোটো ছোটো লাইট গুলো জ্বলছে। গালে হাত দিয়ে ভাবনার শহরে বিচরণ করছি। সকাল থেকে বিকেলের মাঝের এই টুকু সময়ে জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন টা হয়ে গেল। এখন আমি কারো স্ত্রী, তাও আবার সেই ব্যক্তির যাকে আমি ভালোবাসি। বিষয়টা ভাবতেই পুরো শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে যায়। কিন্তু কথা হলো বাড়িতে যখন বিষয়টা জানবে তখন তাঁদের রিয়েকশন কেমন হবে? তারা কি মেনে নিবে? নাকি? আর কিছু ভাবতে পারলাম না। মনের মাঝে ধক করে উঠলো। পরোক্ষনে ভাবলাম আদ্র ভাই সবার প্রিয় ছেলে তাকে না মানার মতো কোনো কারণ নেই। এমনিতে আমাদের বাড়ির সবাই আদ্র ভাই বলতে অজ্ঞান। তাকে সবাই বড্ড আদর করে। একমাত্র বোনের একমাত্র পুত্র বলে কথা। তার ওপর তার ব্যক্তিত্ব। সব মিলিয়ে সবাই ওনাকে অনেক ভালোবাসে। সো নো টেনশন। এমন সময় রুমে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। দৌড়ে রুমে এসে দেখলাম মহাশয়ের ফোন। সেই সময় বিদায় দিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো কথা হয়নি আমাদের মাঝে। স্ক্রিনে উনার নাম দেখে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এই মানুষটা এখন আমার বর। ভাবতেই মনে মাঝে অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। দেখতে দেখতে কল কেটে গেল। আবার পুনরায় বেজে উঠলো। নিজেকে সামলে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠ,
“ছাদে আয়”

অবাক হয়ে গেলাম। এখন এই রাতে আমি ছাদে যেয়ে কি করবো? একা একা ভুতেদের সাথে গল্প করবো?
“ছাদে কেন?”

“আসতে বলছি আয়। ১ মিনিটও যেন দেরি না হয়”

কল কেটে গেল। মাথায় ভাবনা আসলেও সেটা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। সুন্দর করে গাঁয়ে ওড়না জড়িয়ে হাঁটা দিলাম ছাদের উদ্দেশ্যে।

পুরো ছাদ জুড়ে অন্ধকার। ছাদের দরজা খুলতেই কেউ একজন হাত ধরে টান দিলো। আচমকা আক্রমণে যেয়ে পড়লাম সামনের মানুষটার প্রশস্ত বুকে। সামনের মানুষটা কোমর চেপে তার সাথে মিশিয়ে নিলেন। কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। কে এই অজ্ঞাত ব্যক্তি। চিৎকার করতে নিবো এমন সময় ছাদের লাইট জ্বলে উঠলো। লাইটের আলোতে সামনের মানুষটাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমার সদ্য বিয়ে করা বর মানে আদ্র ভাই। কিছুটা রাগী সুরে বললাম,
“এভাবে কেউ আচমকা হাত ধরে টানে? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি”

“সামান্য হাত ধরে টান দেওয়ায় যদি ভয় পাস তাহলে ভবিষ্যতে কি হবে কে জানে?”

“মানে?”

“কিছু না”

“তুমি এখানে কি করছো? বাড়ি যাও নি”

“সদ্য বিয়ে করা বউ রেখে কি বাড়িতে মন টিকে? তাই চলে এসেছি”

“কখন এলে?”

“কিছুক্ষণ আগে। মেঝ মা সরি শাশুড়ি আম্মু কতো যত্ন করে খাওয়ালেন আমায়। তোর সেদিকে খেয়াল আছে? তোর যে একটা বেচারা বর জুটেছে সে খেয়াল আছে? নাকি সেটাও ভুলেছিস?”

বিড়বিড় করে বলে উঠলাম,
“নিজের সত্ত্বা কে ভুলে গেলেও তাকে কি ভোলা যায়?”

“বিরবির করে কি বলছিস?”

“কিছু না। তুমি বলো এখানে এসেছো কেন?”

“বাসর করতে?”

আদ্র ভাইয়ের কথা শুনে ঘাবড়ে গেলাম। তোতলানো কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“মানে? কি বলছো?”

“দেখ আজকে আমাদের বিয়ে হয়েছে আর বিয়ের রাত মানে বাসর রাত। তো বাসর রাতে বর বউয়ের কাছে কেন আসে বলতো?”

উনার কথা শুনে ঢোক গিললাম। না বুঝার ভান ধরে বললাম,
“আমি জানি না। এই তুমি আমাকে ছাড়ো তো। আমি এখানে থাকবো না নিচে যাবো। ছাড়ো”

আদ্র ভাইয়ের বুকে ধাক্কা দিয়ে উনার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি তবে পারছি আর কই। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করে থেমে গেলাম। এতক্ষন ধাক্কা দিয়েও আদ্র ভাইকে নিজের থেকে এক চুল পরিমান সরাতে পারিনি। তাই শান্ত হয়ে গেলাম। আদ্র ভাই আমার কাজে শব্দ করে হেসে দিলেন।
“তুই কি ভেবেছিস এমন মশা মার্কা শরীর নিয়ে তুই আমাকে সরাতে পারবি? ভাবনা ভুল। মজা করছিলাম এতক্ষন। এমনি তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই চলে এসেছি। ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। আমি সবার আগে তোর বন্ধু, যাকে নির্দ্বিধায় সব কিছু বলা যায়। যার সাথে মুহূর্তেই মিশে যাওয়া যায়, যার কাছে তোর কোনো সংকোচ নেই। তারপর যেয়ে তোর বর। তাই বর ভেবে দূরে সরে যাস না যেন”

আমি চুপ করে আছি। কিছু বলছি না। সামনে দাঁড়ানো মানুষটার কথা মুগ্ধ হয়ে শুনছি।
“চল দোলনায় যেয়ে বসি”

আদ্র ভাই হাত ধরে দোলনায় নিয়ে বসিয়ে দিলেন। নিজে বসলেন আমার পাশে। আকাশে মস্ত বড় থালার ন্যায় চাঁদ। পুরো আকাশে জুড়ে আছে। আমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি চাঁদের দিকে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম পাশে বসা আদ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি উল্টোদিক ঘুরে চাঁদ দেখছি। হটাৎ আদ্র ভাই আমাকে নিজের কাছে টেনে নিলেন। আমার পিঠ যেয়ে ঠেকলো আদ্র ভাইয়ের বুকে। আদ্র ভাই আবেশে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন আমায় । আমি লজ্জায় রাঙা হয়ে যাচ্ছি। লজ্জায় গাল গুলো গরম হয়ে উঠছে। দুজনের মাঝে নীরবতা। কেউ কিছু বলছি না। নীরবে নিভৃতে অনুভব করছি একে অপরকে। এমনি সময় উনার সাথে গল্প জুড়ে দিলেও আজ লজ্জা লাগছে। উনার সাথে কথা বলতে গেলেও লজ্জারা কেমন ঘিরে ধরে আমায়।
“কি হলো আজকে এতো চুপচাপ যে?”

“চুপচাপ কোথায়?”

“এইযে প্রতিদিনের মতো গল্পের সমাহার নিয়ে বলছিস না। সারাদিন কি কি করলি তা নিয়েও বক বক করছিস না। কারণ কি?”

“কারণ কিছুই না। এমনি”

আমায় কথা বলতে না দেখে আদ্র ভাই নিজে থেকেই গল্প জুড়ে দিলেন। আমিও তার সাথে সায় দিচ্ছি। আবার আগের মতো উনার সাথে ফ্রি হয়ে গিয়েছি। অস্বস্থিরা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। আচমকা মনে প্ৰশ্ন এলো আদ্র ভাই কিভাবে আমার খোঁজ পেলেন? এটা তো জানাই হলো না। তাই ফট করে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
“আচ্ছা আদ্র ভাই তুমি আমায় খুঁজে পেলে কিভাবে? আর জানলেই বা কি করে যে আমায় ইভান ভাই তুলে নিয়ে গেছে?”

আদ্র ভাই আমার প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। দম নিয়ে বলা শুরু করলো,
“সকাল বেলা তোরা বেরিয়ে পড়তেই মন টা কেমন হাঁসফাঁস করছিলো। অফিসে গিয়ে কাজের মাঝেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। কেমন জানো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি আমার খুব কাছের কিছু হারিয়ে ফেলছি। দুপুর নাগাদ মেঝ মামীর কল। হটাৎ মামীর কল পেয়ে ভ্রু কুঁচকে এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকেই মামী কান্না করতে করতে বলে উঠলো,
“বাবা আদ্র রোদ এখনো বাসায় আসেনি, ফোন করছি তাও রিসিভ করছে না । তুই জানিস ও কোথায়?”

“ইভা বাড়িতে এসেছে? ওকে কল দিয়েছিলে?”

“হ্যাঁ। ইভা বলল ও বন্ধুদের সাথে আছে। রোদ নাকি অনেক আগেই বাড়ির উদ্যেশে বেরিয়েছে কিন্তু এখনো বাড়ি আসেনি। দেখতো বাবা ও কোথায়?”

“ঠিক আছে মামি তুমি চিন্তা করো না আমি দেখছি”

কল কেটে ইভা কে কল করলাম। ইভা জানালো তুই বেরিয়ে গেছিস আরো আগে। ওর থেকেও কোনো ইনফরমেশন পেলাম না। মাথা কাজ করছিলো না। ফোন দিলাম শুভ ভাইকে, ভাইয়া ব্যাস্ত ছিলো। কোনো রকমে কথা বলে রেখে দিলো। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ফোন দিলাম মামীকে।
“মামী আজকে বাড়ি থেকে কে গিয়েছিল ওদের আনতে?”

“জলিল ভাই গিয়েছিল”

“ঠিক আছে”

জলিল কাকার নাম্বার আমার কাছে আগেই ছিলো। ডায়াল করলাম তার নাম্বারে। উনাকে জিজ্ঞেস করতেই উনি বলল ইভান নাকি কাকাকে বাজারে পাঠিয়েছে আর ও গেছে তোদের আনতে। তখনই বুঝেছিলাম সব ইভানের চাল। মামীকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম উনি যেন চিন্তা না করে, তুই আমার সাথে আছিস। শুভ ভাইকে আবার ফোন দিলাম। সোজা গাড়ি নিয়ে মেডিকেলের সামনে চলে গেলাম। শুভ ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম,
“শুভ ভাই ইভান রোদকে কোথাও নিয়ে গেছে। রোদ এখনো বাড়ি ফিরেনি। শুভ ভাই আমি আমার রোদ কে কোথায় খুঁজবো বলো? ইভান ওকে নিয়ে কোথায় গেছে? ও রোদের সাথে কিছু করবে না তো? আমার ভয় হচ্ছে”

শুভ ভাই আমায় শান্তনা দিলো। মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে বসলাম কিভাবে তোকে খুঁজে বের করা যায়? তখন মাথায় এলো লোকেশন ট্র্যাকের কথা। অতঃপর তোর ফোন ট্র্যাক করলাম। লোকেশন দেখাচ্ছিল শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা গ্রামের। লোকেশন ট্রেস করতে করতে চলে গেলাম। বাড়ির বাইরে কয়েকজন ছিলো। তাঁদের তোর ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতেই ওরা কেমন ঘাবড়ে গেল। আমার সন্দেহ হলো। ওদের জেরা করতেই ওরা বলে দিলো। তারপরের ঘটনা তো তুই জানিস”

আদ্র ভাই বলা শেষ করে লম্বা শ্বাস ছাড়লেন। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে নিঃশাসের সাথে সাথে সকল কষ্ট উড়িয়ে দিচ্ছেন। মানুষটা আমার জন্য এতটা করছে ভেবে মনে মনে শান্তি পেলাম। আদ্র ভাই কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“আজকে যদি আমি তোকে হারিয়ে ফেলতাম তবে আমি নিঃস্ব হয়ে যেতাম। আমি যে তোকে ছাড়া এক মুহুর্তও কল্পনা করতে পারিনা রৌদ্রময়ী। তুই আমার, শুধু আমার। আমায় ছেড়ে যাস না কখনো। তোকে ছাড়া আমি পা*গল হয়ে যাবো, পুরো উন্মাদ যাকে বলে”

“কথা দিচ্ছি আমি সজ্ঞানে তোমায় ছেড়ে যাবো না। সারাজীবন তোমার বুকে মাথা রেখে তোমার হয়েই রয়ে যাবো”

দুজনের মাঝে নীরবতা। একে অপরকে আলিঙ্গনে অনুভব করছি। এ অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো নয়। কোনো কিছু প্রাপ্তির অনুভূতি।
“আচ্ছা আদ্র ভাই বাড়িতে আমাদের বিয়ের বিষয়ে বললে না কেন?”

“এমনি বড় মামু ইভানের ওপর রেগে আছে। এখন যদি ওর এই কর্মকান্ড মামুর সামনে প্রকাশ হয় তবে মামু নিঃঘাত ওকে তেজ্য করবে। তুই তো মামুর রাগ সম্পর্কে জানিস। ইভান ওর কর্মের ফল কিছুটা হলেও পেয়েছে । তাই আমি চাইনা ও পরিবার থেকে আলাদা হোক”

“পড়ে যদি আমাদের বিয়ে নিয়ে সমস্যা হয় বা আব্বু আমায় অন্য কোথাও বিয়ে দিতে চায়, তখন?

“আমি আছি কি করতে? তোর ছোটো মাথায় এতো টেনশন নিতে হবে না। তোর ইয়ার ফাইনালের পর আব্বু-আম্মু কে পাঠাবো মামুর কাছে। তারপর একদম লাল টুকটুকে বউ রূপে তোকে আমার বাড়ি নিয়ে যাবো”

আদ্র ভাইয়ের মুখে ‘বউ’ ডাকটা শুনলেই শরীর বেয়ে শিহরণ বয়ে যায়। কি মধুর সেই ডাক। ইচ্ছে হয় উনার মুখ থেকে সারাদিন বউ ডাক শুনতে। আদ্র ভাই আমাকে নিজের বাহুডোরে থেকে ছাড়িয়ে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। পকেট হাতড়ে একটা ডায়মন্ড এর রিং সামনে ধরে বলল,
“আমার সারাজীবনের সঙ্গী হবি রৌদ্রময়ী? যতনে আগলে রাখবো তোকে বহুডোরে। আমার আকাশে ঘুড়ি হবি? পুরো আকাশ জুড়ে যার বসবাস থাকবে। আমার আকাশের চাঁদ হবি? আলো ছড়িয়ে দিবি আমার আঁধারে ঢাকা পুরো শহর জুড়ে। আমায় তোর চন্দ্রবিলাসের সঙ্গী বানাবি? অল্প স্বল্প গল্প সাথে ধোয়া ওঠা গরম কফির সাথে কেটে যাবে রাত্রি। আমায় তোর বৃষ্টিবিলাসের সঙ্গী বানাবি? তুই আবেশে বৃষ্টিকে গাঁয়ে মাখবি আমি দূর থেকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখবো। সব শেষে বলবো আমার ঘরের রানী হবি? পুরো ঘর এবং আমি জুড়ে যার বিচরণ থাকবে”

আদ্র ভাই থামলেন। আমি একটু একটু করে কাঁপতে থাকা আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম। আদ্র ভাই রিং পড়িয়ে হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেলেন। শিউরে উঠলাম। উঠে দাঁড়িয়ে গালে হাত রেখে কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলেন। এই ছোঁয়ায় নেই অপবিত্রতা, আছে একগুচ্ছ ভালোবাসার অনুভূতি। আবেশে চোখে বুজে নিলাম। নীরবে নিভৃতে কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। অতঃপর দুজনে পুনরায় মেতে উঠলাম গল্পে।

#চলবে?

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন। ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here