#অনপেখিত
শেষ পর্ব
লিখা Sidratul Muntaz
ফারদিন তড়িৎ গতিতে লিফটে উঠলো ছাদে যাওয়ার জন্য। আজকে লিফটটাও খুলতে লেইট হচ্ছে। লিফট খোলার পরেই ফারদিন দেখল ভেতরে সাত তলার প্রিয়ন্তী দাঁড়িয়ে আছে। ফারদিনের চেহারা আপনা-আপনি ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অস্বস্তিকর মুহুর্তে অস্বস্তিকর মানুষের সাথে যদি দেখা হয়, বিরক্তি তো আসবেই।
প্রিয়ন্তী হেসে বলল,” কেমন আছেন ফারদিন?”
” ভালো। তোমার কি অবস্থা?”
” জ্বী এইতো, ভালোই।”
এরপর আর কারো মুখে কোনো কথা নেই। প্রিয়ন্তী নিশ্চয়ই কথা বলার জন্য হাঁসফাঁস করছে। আর ফারদিন হাঁসফাঁস করছে কিভাবে দ্রুত এই জায়গা থেকে বের হওয়া যায়। এই মেয়ের সামনে যত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ততই অস্বস্তি।
প্রিয়ন্তী হঠাৎ বলল,” আপনার বউয়ের সাথে তো দেখা করালেন না। বিয়েতে দাওয়াত দেননি মানলাম৷ তাই বলে কি বউকেও লুকিয়ে রাখবেন?”
ফারদিন হেসে বলল,” আরে না, লুকিয়ে কোথায় রাখলাম? বিয়েতে আসলে কাউকেই দাওয়াত করার সুযোগ হয়নি। তুমি বাসায় এসো। দেখা করে যেও তোমার ভাবীর সাথে।”
” ও হ্যাঁ, আপনার বউ তো আমার ভাবীই হবে।”
লিফট থেমে গেছে। প্রিয়ন্তী বলল,” আসছি ফারদিন। আপনি কি ছাদে যাচ্ছেন?”
” হ্যাঁ। একটু কাজ ছিল।”
” ঠিকাছে। আল্লাহ হাফেজ। দেখা হবে।”
ছাদে উঠেও মেহেককে পেল না ফারদিন। তন্নতন্ন করে খুঁজলো সে। কোথাও নেই মেহেক। হতাশ হয়ে আবারও নিচে নামলো। এবার একদম নিচে চলে গেল।কারণ বাড়িতে মেহেক কোথাও নেই। তাদের গ্যারেজের পেছনে একটা ছোট্ট পার্কের মতো জায়গা আছে। সেখানে বাগানের মতো গাছপালা লাগানো আছে। একটা দোলনা আছে, স্লিপার’স আছে। বাচ্চারা বিকালে এখানে খেলতে আসে। ভালোই ভীড় হয়। এখন সকাল এগারোটা বাজে। তেমন কেউ নেই জায়গাটায়। ফারদিন মেহেককে পুরো রাস্তা খুঁজেও যখন পেল না তখন হতাশ হয়ে পার্কে এসে দোলনায় বসল। একটা সিগারেট ধরালো। টেনশন তার খুব বেশি বেড়ে গেলে সিগারেট লাগে। ফারদিন সিগারেটে টান দিতে দিতে চিন্তা করছিল মেহেক কোথায় থাকতে পারে।
একটু পরেই শুনতে পেল মেহেক চিৎকার করছে। ফারদিন উঠে দাঁড়ালো। অস্থির হয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগল। তার চোখ দু’টো পাগলের মতো সেই একটি চেহারা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কান আকুল হয়ে শুনতে চাইছে ওই বাচ্চাসুলভ মায়ামাখা কণ্ঠ! কোথায় মেয়েটি? মিষ্টি চেহারার ছোট্ট মেয়েটি যে ফারদিনের প্রাণ! কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই ফারদিন দেখল নারকেল গাছের নিচে কয়েকটা বাচ্চার সাথে দাঁড়িয়ে আছে মেহেক৷ তার চেহারায় চাঞ্চল্য হাসি। দুনিয়ার কোনো কিছুর হুশ নেই। একটা মানুষ যে তাকে খুঁজে না পেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে সেদিকেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দিব্যি নিজের মতো বাচ্চাদের নিয়ে লাফ-ঝাপ করছে, হাসছে,খেলছে, চেঁচাচ্ছে। তার চেহারা কি অদ্ভুত নিষ্পাপ!
ফারদিনের মন এতোক্ষণে শান্ত হলো। সে যা আশঙ্কা করেছিল সেরকম কিছুই হয়নি। মেহেক ভালো আছে, সুস্থ আছে, হাসছে, এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। ফারদিন এগিয়ে গেল মেহেকের কাছে। দশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার পর মেহেকের নজর পড়লো ফারদিনের উপর। তাকে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই মেহেক ঘাবড়ে গেল। বুঝে নিল তার কপালে এখন দুঃখ আছে। ফারদিন আবার বাচ্চাগুলোর সামনে ধমকিয়ে তার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দিবে না তো?
মেহেক অভিমান করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। রাস্তায় যেতে ভয় লাগছিল তাই গ্যারেজের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সেখানে বাচ্চারা লুকোচুরি খেলছিল। ওদের খেলা দেখতে দেখতে মেহেকের মন কেন জানি ভালো হয়ে গেল। বাচ্চারাও ওকে খেলতে ডাকছিল। মেহেক তখন ওদের সাথে খেলতে চলে এলো। এখন ফারদিনকে দেখে ভয়ে তার শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাত-পা জমে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো ফারদিনের কাছে।
অপরাধী কণ্ঠে ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো বলল,”স্যরি। আমি বাসা থেকে বের হতে চাইনি..”
মেহেক আর কিছু বলার আগেই ফারদিন হাত ধরে টেনে তাকে লিফটে নিয়ে গেল। লিফট বন্ধ হতেই সে কাছে এসে গভীরভাবে মেহেকের ঠোঁটে চুমু দিল। মেহেক থতমত খেয়ে গেল। বড় বড় চোখে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটি কখন কি করে বোঝা মুশকিল। ভেবেছিল ধমক দিবে অথচ দিচ্ছে চু’মু! লিফটের দরজা খুলে যেতেই ফারদিন তাকে ছেড়ে দিল। স্তব্ধ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে মেহেক। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। আশেপাশে তাকাতেও লজ্জা লাগছে।
“আচ্ছা প্রিয়ন্তী কে?”
মেহেক হাত ভাঁজ করে খুব আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নটা করল। ফারদিন কিছু সময়ের জন্য থেমে গেল। তার এক হাতে ছিল ছুড়ি অন্যহাতে মাংসের টুকরা। আজকে লাঞ্চে সবার জন্য স্টেক বানাবে ফারদিন। মেহেক কখনও স্টেক রান্না দেখেনি। কখনও খায়ওনি এই জিনিস। তবে নাম শুনেছে অনেকবার। তাই আগ্রহ নিয়ে রান্না দেখতে এসেছিল। তখনি হঠাৎ এমন প্রশ্ন করল।
ফারদিন না বুঝার ভান করে ভ্রু কুঁচকে বলল,” কে প্রিয়ন্তী?”
“এটা আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি। একই কথা আবার আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
ফারদিন কিছু একটা চিন্তা করে বলল,” ও আচ্ছা প্রিয়ন্তী? উপরে সাত তলায় থাকে। একটা মেয়ে।”
” আজ এসেছিল।”
” কখন এসেছিল?”
” যখন আপনি আর মা বাজারে গিয়েছিলেন তখন এসেছিল। আপনার সাথে দেখা করতে। আমি বললাম আপনি বাড়িতে নেই। তখন জিজ্ঞেস করল আমি কে?”
” তাই? তারপর তুমি কি বলেছো?”
” যা সত্যি তাই বলেছি। আমি আপনার বউ হই এটাই বলেছি!”
” তারপর?”
” তারপর আমরা অনেকক্ষণ বসে গল্প করেছি।”
” গল্প করেছো?”
” হুম। শুনে ভয় পেলেন নাকি?”
” না। ভয়ের কি আছে?”
” সেটাই তো ভয়ের কি আছে? আমি যখন প্রিয়ন্তীকে আমার পরিচয় জানালাম তখন মেয়েটা খুব এক্সাইটেড হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। গাল-টাল টিপে বলল, তুমি তো দেখি একদম পিচ্চি মেয়ে। আমি ভেবেছিলাম আমার চেয়ে বয়সে বড় হবে। এখন দেখি তুমি আমার চেয়েও ছোট! তারপর আরও কত কথা যে বলল!”
” কি কি বলল?”
” আপনাকে কেন বলবো? এগুলো আমাদের মধ্যকার সিকরেটস।”
” ওরে বাবা, সিকরেটস? ভালোই।”
” শুনলাম প্রিয়ন্তীর সাথে নাকি আপনার একসময় খুব ভালো সম্পর্ক ছিল?”
” হুম। ছিল তো।”
” কতটা ভালো? ”
” এইভাবে জিজ্ঞেস করছো কেন?”
” না, আমি জানতে চাই। ঠিক কতটা ভালো সম্পর্ক হলে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা একে অন্যের সাথে রাত জেগে ফোনে কথা বলতে পারে।”
ফারদিন কেশে ফেলল। মেহেক বলল,” পানি খাবেন নাকি?”
” না, লাগবে না।”
” আমার সাথে কিন্তু কখনও আপনি রাত জেগে ফোনে কথা বলেননি।”
” ঠিকাছে। এখন থেকে তাহলে তুমি আমি এক বিছানায় শুয়ে সারারাত ফোনে কথা বলবো। খুশি?”
” আমার সাথে ফাজলামি করবেন না।”
ফারদিন হাসছিল। মেহেক তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” এরকম আর কয়টা প্রিয়ন্তী, সুজির সাথে আমার দেখা হবে শুনি?”
” দেখো, প্রিয়ন্তীর সাথে সুজির তুলনা করা একদম বেমানান। প্রিয়ন্তী আমাকে পছন্দ করতো। কিন্তু আমি কখনও রেসপন্স করিনি।”
” তাহলে রাত জেগে কথা বলতেন কেন?”
” ও ফোন দিতো। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতো। আমি শুধু উত্তর দিতাম।”
” আর এভাবেই বুঝি রাত পার হয়ে যেতো?”
” মেহেক, আমাকে সন্দেহ করো না। আমি তোমাকে মিথ্যে বলবো না।”
” আমার আপনার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনার চোখেমুখে আমি মিথ্যার উপস্থিতি টের পাচ্ছি।”
এই কথা বলে মেহেক রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ফারদিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই সন্দেহকাতর মেয়েকে নিয়ে তার কপালে বিরাট দুঃখ আছে মনে হচ্ছে।
ফারদিন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মেহেক তার হাত ধরে অনবরত ঝাঁকাচ্ছে। চোখমুখ কুঁচকে জেগে উঠল ফারদিন। ঘুমো ঘুমো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে?”
” বাইরে বৃষ্টি!”
” তো? জানালা আটকে দাও।”
” না। আমি বাইরে যাবো।”
ফারদিন বিস্ময় নিয়ে তাকাল,” মানে?”
” আমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। ছাদে চলুন।”
মাঝরাতে বউয়ের মুখে এমন কথা শুনে ফারদিন হতভম্ব। কতক্ষণ হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,” রাত দুইটা বাজে তুমি বৃষ্টিতে ভিজতে ছাদে যাবে? মাথা ঠিকাছে মেহেক?”
” দুইটা না, আড়াইটা বাজে। তো কি হয়েছে? আমার খুব ইচ্ছে করছে। প্লিজ চলুন।”
মেঝেতে নখ খুটতে খুটতে বলল মেহেক। ” অসম্ভব” বলে বালিশে মাথা রেখে আবারও ঘুমাতে উদ্যত হলো ফারদিন।
মেহেক সর্বশক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কাতে লাগল,” উঠুন না, বৃষ্টি থেমে যাবে তো। ”
” থেমে যাক।” ফারদিনের দায়সারা জবাব।
” আমি শান্তিতে ঘুমাতেই দিবো না আপনাকে।”
ফারদিন শক্ত করে চেপে ধরল মেহেকের হাত। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” ঘুমাতে না দিলে তোমারই বিপদ। আমি কি করব জানো নিশ্চয়ই?”
মেহেক ভ্যাবাচেকা খেল। নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে বলল,”বিয়ের পর এই প্রথম একটা আবদার করেছি। আপনি এইটুকু রাখতে পারছেন না?”
” তোমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে নিয়ে গেলে আমি কি পাবো? আমার ঘুম মাটি করার পানিশমেন্ট কি হবে? আগে বলো!”
মেহেক বাইরে তাকাল। বৃষ্টি থেমে গেলে মহাবিপদ। তাড়াহুড়ো করে বলল,” আচ্ছা আপনি যা চান তাই হবে।”
” চিন্তা করে বলো। সত্যি তো?” ফারদিনের ঠোঁটে শয়তানি হাসি।
মেহেক মাথা নাড়ল,” সত্যি।”
” ঠিকাছে চলো।”
তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসল ফারদিন। মাঝরাতে দরজা খুলে দু’জনেই ছাদে চলে গেল। ফারদিন ছাদের এক কোণায় দাঁড়াল। মেহেক এই মাথা থেকে ওই মাথা দৌড়াতে শুরু করেছে। উচ্ছ্বাসে তার পুরো শরীর কাঁপছে। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। আনমনে গান গেয়ে নাচতে শুরু করল সে। পা দিয়ে ছিটাতে লাগল পানির ঝাপটা।
” এই আপনিও আসুন না!”
মেহেক হাত ইশারা করে ডাকল। ফারদিন ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,” আসব না আমি। তুমি ভেজো।”
মেহেক ইচ্ছেমতো লাফালাফি করছে। বৃষ্টিতে ভিজতে পেরে তাকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মেয়ে মনে হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকে উঠল হঠাৎ। ফারদিন আচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে রইল। এই বৃষ্টিবিলাসী মেয়েটিকে সে আকাশের মতো ভালোবাসে! ধীরপায়ে মেহেকের দিকে এগিয়ে গেল সে।
মেহেক পেছনে ঘুরে ফারদিনকে দেখে চটপট করে বলল,” কি ব্যাপার? আসবেন না বলেও এলেন যে? আর থাকতে পারছিলেন না তাই না? আপনারও ভিজতে ইচ্ছে করছে তাই না বলুন?”
মেহেক হেসে উঠল খিলখিল করে। ফারদিন মেহেকের গালে চু’মু দিল। কপালে চু’মু দিল। তারপর ব্যাকুল কণ্ঠে বলল,” এবার ঘরে চলো। ”
ফারদিন কেন ঘরে যেতে চাইছে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না মেহেকের। সে লজ্জা মাখা কণ্ঠে বলল,” না।আমার আরও ভিজতে ইচ্ছে করছে।”
মেহেক একছুটে ছাদের কার্ণিশে গিয়ে দাঁড়াল। বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। অস্থির লাগছে তার। অজানা শীহরণে বুক কাঁপছে। ফারদিন একহাতে কপালের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিল। পুনরায় ডাকল,” ঘরে চলো মেহেক। এতো ভিজলে তোমার শরীর খারাপ করবে।”
” হোক শরীর খারাপ। আমি ঘরে যাবো না!” চেঁচিয়ে বলল মেহেক। সঙ্গে সঙ্গে বিকট বজ্রপাত হলো। ভ*য়ে আৎকে উঠল মেহেকের আত্মা। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল সে ফারদিনের গলা। তার ভ*য় পাওয়া দেখে হেসে ফেলল ফারদিন। প্রশ্ন করল,” যাবে এখন?”
মেহেক কিছু বলার আগেই পুনরায় আকাশ কাঁপিয়ে বজ্রপাত হলো আরেকটা। মেহেক দুইহাতে খামচে ধরল ফারদিনের টি-শার্ট। ঝটপট মাথা নাড়ল। সে ঘরে যেতে রাজি। ফারদিন হেসে মেহেককে কোলে তুলে নিল। দুইহাতে ফারদিনের গলা জড়িয়ে ধরে তার বুকের মধ্যে মুখ গুজে পড়ে রইল মেহেক। বেশ ভ*য় পেয়েছে মেয়েটা। তারা লিভিংরুমে প্রবেশ করতেই আ’চমকা বাতি জ্বলে উঠল। সেন্টার টেবিলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন ফয়জুন্নিসা।
মাকে দেখে ফারদিন চ’মকালো। মেহেক দ্রুত কোল থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ফয়জুন্নিসা অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন মেঝের দিকে।তাদের গায়ের পানিতে কার্পেট অনেকটাই ভিজে গেছে। মেহেক শাশুড়ির সামনে চরম লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতেও পারছিল না। কোনমতে দৌড়ে পালিয়ে গেল নিজের ঘরে। ফারদিন কি করবে বুঝতে পারছিল না। সেও কি ঘরের দিকে দৌড়াবে?
ফয়জুন্নিসা জিজ্ঞেস করলেন,” এতো রাতে তোরা কোথা থেকে ফিরলি?”
ফারদিন ইতস্তত করে বলল,” ছাদে গিয়েছিলাম।”
” বৃষ্টির মধ্যে ছাদে কেন? ”
” মেহেককে নিয়ে চাঁদ দেখতে গেছিলাম।”
” বৃষ্টির মধ্যে চাঁদ? ” ফয়জুন্নিসা হতবাক।
ফারদিন হেসে বলল,” হ্যাঁ। বৃষ্টির মধ্যেই তো চাঁদ দেখতে বেশি মজা আম্মু।”
ভেজা চুল ঝারতে ঝারতে হাসিমুখে কথাটা বলেই ঘরের দিকে চলে গেল সে। ফয়জুন্নিসা বোকার মতো তাকিয়ে রইলেন ছেলের যাওয়ার পথে।
মেহেক সকালে উঠে লিয়ার মা’র থেকে জানতে পারলো যে ফারদিন বাসায় নেই। মায়ের সাথে শপিং-এ বের হয়েছে। তিশা মেহেককে ব্রেকফাস্ট করতে দিয়ে ফাহিমের সাথে বেরিয়ে পড়ল। ফাহিম অফিসে যাওয়ার পথে তিশাকে পার্লারে নামিয়ে দিয়ে যাবে। তিশার সাজগোজের প্রতি খুব ঝোঁক। নিজের যত্ন নিতে সে ভালোবাসে। তাই সপ্তাহে একদিন তাকে পার্লারে যেতেই হয়। ফাহিম আর তিশাকে একসাথে দেখতে মেহেকের অনেক ভালো লাগে। তারা দু’জন খুব হাসি-খুশি। আর সমবয়সী হওয়ায় প্রায় সময়ই দু’জন খুব ঝগড়া করে। তাদের ঝগড়া, খুঁনশুটি দেখতেও মেহেকের ভালো লাগে।
আজকে ব্রেকফাস্ট করার সময় তিশা ফাহিমকে বলছিল,” তুমি অফিসে কখন যাবে?”
” প্রতিদিন যখন যাই, সাড়ে নয়টায়।”
” তাহলে আমাকে একটু পার্লারে ড্রপ করে দিও।”
ফাহিম দীর্ঘসশ্বাস ছেড়ে বলল,” পার্লার! ঘন ঘন এতো পার্লারে গিয়ে লাভ কি? চেহারার তো কোনো পরিবর্তন হয় না। দুইবছর ধরে সেই একই চেহারা দেখে আসছি। শুধু শুধু টাকা নষ্ট।”
” হোয়াট ডু ইউ মিন? আমার চেহারা দেখতে তোমার ভালো লাগে না?”
তিশার দৃষ্টি কটমট। ফাহিম বলল,” আমি তো সেটা বলিনি। মানে জানতে চাইছি পার্লারে রেগুলার গিয়েও যদি কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে গিয়ে লাভটা কি?”
” মানুষ চেহারা পরিবর্তন করতে পার্লারে যায় না। নিজের যত্ন নেওয়া মানেই চেহারা পরিবর্তন করে ফেলা না। সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করা।”
” ও তাই বলো। আমি অবশ্য উন্নতি দেখলাম না।”
” দেখবেও না৷ কারণ আমার দিকে তো তোমার তাকাতে ভালো লাগে না। আমার পেছনে খরচ করলে তোমার টাকা শেষ হয়ে যাবে। আমি যেটাই করি সেটাই তোমার কাছে অপচয়..”
শুরু হয়ে যাচ্ছিল তর্ক-বিতর্ক। মেহেক ঝগড়া আটকানোর জন্য জিজ্ঞেস করল,” উনারা কখন আসবে?”
মেহেকের প্রশ্নেও কিন্তু তাদের তর্ক কমলো না। তিশা এক কথায় উত্তর দিল,” ঠিক নেই।” তারপর আবার ফাহিমের সাথে তর্ক শুরু। ফাহিম অবশ্য তিশাকে রাগানোর জন্য ইচ্ছে করেই এসব বলে। কিন্তু তিশা বুঝে না। কিংবা হয়তো বুঝে। বুঝেই ঝগড়া করে।
মেহেক নিজের ঘরে গিয়ে বসতেই একটা হারমোনিয়াম দেখতে পেল। হারমোনিয়ামটা একদম নতুন। এইটা কে এনেছে, কি জন্য এনেছে তা মেহেক জানে না। তবে তার খুব ইচ্ছে করছে হারমোনিয়ামটা একটু বাজিয়ে দেখতে। মেহেক আবার খুব সুন্দর হারমোনিয়াম বাজাতে পারে। তার খুব মিষ্টি একটা গানের কণ্ঠও আছে। কিন্তু তার এই গোপন প্রতিভার কথা কেউ জানে না।
ছোটচাচীর কাছে মেহেক হারমোনিয়াম বাজানো শিখেছিল৷ তার ছোটচাচী দরজা, জানালা বন্ধ করে লুকিয়ে গান গাইতেন। কারণ তাঁর গানের প্রতি খুব ঝোঁক ছিল এই কথা মেহেক ছাড়া অন্যকেউ জানতো না।
একদিন মেহেকের আব্বা জেনে গেলেন। মেহেক ছোটচাচীর থেকে গান শিখেছে এইটা জানার পর তিনি মেহেককে থাপ্পড় দিলেন। বাবার কাছে ওই প্রথমবার তার মার খাওয়া। এরপর আর কখনও মেহেক গানের কথা উচ্চারণ করেনি। মেহেকের ছোটচাচা তার চাচীর হারমোনিয়ামটা ভেঙে ফেলেছিলেন। তাতে ছোটচাচী যতটুকু কষ্ট পেয়েছিল তার চেয়েও হাজার গুণ কষ্ট মেহেক পেয়েছিল।
ফারদিন রুমে প্রবেশ করতেই মেহেক জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা, এই হারমোনিয়ামটা কার?”
ফারদিন হেসে বলল,” তোমার।”
” আমার জন্য মানে?”
ফারদিন বারান্দার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে অতি স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,”তোমার আম্মার কাছে শুনলাম তুমি নাকি গান গাইতে খুব পছন্দ করো৷ তাই হারমোনিয়াম কিনে এনেছি। এখন থেকে গান শিখবে। তোমাকে একদিন বড়সড় সিংগার হতে হবে! যেন মানুষ আমাকে দেখলেই বলে, কণ্ঠশিল্পী মেহেক ইমরোজের হাসব্যান্ড।”
মেহেক কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এই এতো সুন্দর হারমোনিয়ামটা তার জন্য কিনে আনা হয়েছে? সে গান শিখতে পারবে? সিংগার হতে পারবে? তার মতো মেয়ের জন্য তো এটা আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নের মতো। ফারদিন কি জানে সে মেহেককে আজ কত বড় উপহার দিয়েছে?
মেহেকের শরীর জুড়ে আনন্দের শিহরণ প্রবাহিত হচ্ছে। আর ফারদিন কি নির্বিকার!এতোবড় একটা কান্ড ঘটিয়েও তার মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। সে দিব্যি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কিছুই হয়নি! অথচ তার ওই অল্প কিছু কথায় মেহেকের পুরো পৃথিবী বদলে গেছে। রঙিন স্বপ্নেরা ডানা মেলে প্রজাপতির মতো মনের বাগানে উড়ে বেড়াচ্ছে। মেহেক ফারদিনের কাছে গিয়ে উৎফুল্ল গলায় বলল,” এই শুনুন।”
ফারদিন ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে মেহেকের দিকে তাকাতেই কিঞ্চিৎ অবাক হলো। মেহেকের দুই চোখে অশ্রু। ফারদিন কিছু বলার আগেই মেহেক দুইহাত তুলে বলল,” আমাকে উঠান।”
” মানে?”
” মানে উপরে তুলুন।”
ফারদিন মেহেকের কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে উপরে তুলতেই মেহেক টুপ করে ফারদিনের কপালে একটা চুমু দিয়ে ফেলল। তারপর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল,” আজকে আমার কত খুশি লাগছে সেটা আপনাকে কোনোদিন বুঝাতে পারবো না।”
ফারদিন হতচকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ একটু পর হেসে বলল,” কিন্তু একটা শর্ত আছে। তোমাকে স্কুলে ভর্তি হতে হবে। লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে হবে। নাহলে কিন্তু হারমোনিয়াম বেচে দিবো। ”
মেহেকও হেসে ফেলল।
” ঠিকাছে। আপনি যা বলবেন তাই হবে।”
ফারদিন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,” আই লভ ইউ পিচ্চি।”
মেহেকের অপরিসীম আনন্দ লাগছে। তার মতো একটি মেয়ের ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া এলোমেলো পৃথিবীতে এমন একটি জীবন তো একদম অনপেখিত ছিল। সে তার অনপেখিত এই জীবন পেয়ে ধন্য! ফারদিন বুক ভরে মেহেকের চুলের ঘ্রাণ নিল। এই মিষ্টি সুভাষ, উষ্ণ শরীরের উত্তাপ,কোমল স্পর্শ, হৃদয়জুড়ানো হাসি, মধুর কণ্ঠস্বর, এককথায় মেহেকের সবকিছু খুব ভালোবাসে ফারদিন। এই মেয়েটিকে অনপেখিত ভাবে জীবনে পেয়ে গিয়ে সে ধন্য!
সমাপ্ত