ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড #পর্ব_১৭

0
30

#ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড
#পর্ব_১৭
#সারিকা_হোসাইন

নিজের অসাড় হয়ে যাওয়া শরীরটাকে কোনোমতে টেনে হিচড়ে অপারেশন থিয়েটার থেকে বাইরের করিডোরে বেরিয়ে এলো যুবরাজ।রক্তে জবজবে ভেজা পেটানো শরীরটা তার কাছে ভর শূন্য ঠেকছে।মাথাটা ক্রমাগত ভো ভো শব্দে উদ্বেলিত করছে সবকিছু।চিন্তা ভাবনা সব কিছুই লোপ পেয়ে নিজেকে বড্ড ঘিলুহীন মানব ঠেকছে।কিছুক্ষন আগের বিভৎস ঘটনা বেমালুম ভুলে এলোমেলো পায়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ফাঁকা দৃষ্টিতে হেটে চলেছে যুবরাজ।পরিহিত ধবধবে সাদা রঙের ডক্টর এপ্রোন টা থেকে চুইয়ে চুইয়ে হালকা জমাট বাঁধা গাঢ় লাল রক্ত বিন্দু গুলো সারা করিডোর ময় ছড়িয়ে যাচ্ছে।সেদিকেও যুবরাজের কোনো হেলদোল নেই।

পুব আকাশের সোনালী সূর্য টা ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে অস্তমিত হচ্ছে।তার লালটকে আভা যেনো আলাদা একটা সৌন্দর্যের উপমা।গোধূলির এই লগ্নে সামান্য শিরশিরে হিম ধরানো বাতাস বয়ে যাচ্ছে মাউন্ট সিনাই হসপিটালের বৃহৎ করিডোর জুড়ে।
অপারেশন থিয়েটারের খোলা করিডোরে অস্থির চিত্তে চিন্তিত ভঙ্গিতে সমানে পায়চারি করছে জ্যাকব গ্যাব্রিয়েল এর একমাত্র কন্যা ম্যাগান।চিন্তায় তার নাকের ডগা পর্যন্ত রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।কালচে বাদামি রঙের চুলগুলো একটু বেশিই বাতাসে উড়াউড়ি করছে যেনো আজকে কিন্তু মেয়েটি নিজের ব্যাপারে একদম উদাসীন।এদিকে তাপমাত্রা ও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।গায়ের পাতলা উষ্ণ পোশাকটি শিরশিরে ঠান্ডা বাতাসকে প্রতিহত করতে ব্যার্থ হচ্ছে।নিজের ঠান্ডা হাত দুটো মুঠো করে একহাত আরেক হাতের আলিঙ্গন এ বদ্ধ করে মুখের গরম ভাপে নিজেকে নিজেই উষ্ণ রাখার বৃথা প্রয়াস চালালো ম্যাগান।

হঠাৎই টাইলসে ঘষে ঘষে হেটে চলার অদ্ভুত শব্দে স্থির হয়ে দাঁড়ালো ম্যাগান।নিজের অবনত দৃষ্টি সম্মুখে পেতে যুবরাজকে এমন ভয়ংকর অবস্থায় দেখে থরথর করে কেঁপে উঠলো সে।যুবরাজের চুল থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত রক্তে রঞ্জিত।সারা মুখে দলা দলা রক্ত জমে ভয়ংকর জম্বি মানব ঠেকছে তাকে।
নিজের ভয়কে কোনোমতে গিলে খেয়ে অসহায় ভঙ্গিতে যুবরাজের সামনে এসে দাড়ালো ম্যাগান।

“ডক্টর ইউভি আপনি ঠিক আছেন তো?আপনার শরীরে এতো রক্ত কিসের?পাপার কন্ডিশন কেমন এখন??

কাঁপা কাঁপা জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে ঝটপট প্রশ্ন গুলো করে যুবরাজের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো ম্যাগান।

ম্যাগানের এতোগুলো প্রশ্ন যুবরাজের কাছে ঠান্ডার স্ট্রম এর মত লাগলো।নিজের মস্তিষ্ক হাতড়ে ম্যাগানের আশানুরূপ কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না যুবরাজ।
অসহায় ম্যাগান যুবরাজের এপ্রোনের রক্তাক্ত দুই কলার শক্ত হাতে চেপে ধরে যুবরাজের চোখে চোখ রেখে কিছু অনুসন্ধান করার চেষ্টা চালালো।

মিনিট দুই ব্যায় করার পর যুবরাজের নিচু চাহনি দেখে কিছুই বুঝতে বাকি রইলো না ম্যাগানের।সহসাই তার বড় বড় দুই নেত্র বেয়ে সমানে অঝোর ধারায় উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।গলা দিয়ে সামান্যতম আওয়াজ করার ক্ষমতা টুকুও যেনো সে হারিয়ে ফেলেছে আজ।নিজের বাবার সাথে কাটানো এতোগুলো বছরের সমস্ত স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠতেই ভুবন কাঁপানো চিৎকার করতে চাইলো ম্যাগান।
বুকের খাঁচার ভেতর সেই চিৎকার টাকে কে যেনো গলা টিপে রোধ করে ফেললো।হাজার চেষ্টা করেও ম্যাগান তার ভেতরের কষ্ট গুলো কে উজাড় করতে পারলো না।

“আই কিলড ইউর ফাদার মিস ম্যাগান,হি ডায়েড বিকজ অফ মাই ফল্ট,আম এ মার্ডারার।কল দ্যা পুলিশ ফর এরেস্ট মি! প্লিজ”

অনুভূতি হীন সোজা সাপ্টা অকপট স্বীকারোক্তিতে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো ম্যাগান।অবুঝ সিক্ত চাহনীতে যুবরাজের ঘোলাটে চোখের দিকে তাকিয়ে কথার সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ সে।কিন্তু কথাগুলো বলে যুবরাজ অপরিবর্তিত শক্ত মুখে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো।

ম্যাগান কিছু বলার আগেই লাইটস ক্যামেরা আর মানুষের চিৎকার চেঁচামেচিতে নিজেদের ধ্যান ছেড়ে সামনে তাকালো দুজনে।হঠাৎই চারপাশে এতো মানুষের সমাগম দেখে আতঙ্কে যুবরাজের রক্তে ভেজা হাত খামচে ধরলো ম্যাগান।
অপ্রস্তুত যুবরাজকে আরো বেকায়দায় ফেলতে রিপোর্টার্সরা নানান ধরনের বিকৃত মস্তিষ্কের প্রশ্ন সমূহ ছুড়তে লাগলো।

“শুনেছি আপনি হসপিটালের সকল ডক্টরস দের কথার অবাধ্য হয়ে এই অপারেশনের জন্য সাইন করেছেন?

“অপনি কি ডাক্তার নাকি নর পিচাষ?

“জ্যাকব গ্যাব্রিয়েল এর সাথে আপনার কি পুরোনো কোনো শত্রুতা ছিলো যার জের ধরে আপনি তার জীবন প্রদীপ এভাবে নিভিয়ে দিলেন?

নিউইয়র্ক শহরের টিভি চ্যানেলের প্রত্যেকটি রিপোর্টার্স এর কাছ থেকে এমন ভয়াবহ ইংরেজি প্রশ্নবানে যুবরাজ যেনো পায়ের নিচের মাটি হারিয়ে ফেললো।নিজের কাছে নিজেকেই তার বদ্ধ উন্মাদ মনে হচ্ছে।সকল প্রশ্নের সুন্দর বিস্তৃত ব্যাখ্যা জনিত উত্তর গলার কাছে তালগোল পাকিয়ে আটকে রইলো।বোকা অবুঝ জরাজীর্ণ মানুষের মতো ফ্যালফ্যাল করে রিপোর্টার গুলোর দিকে শুধু নীরবে তাকিয়ে রইলো যুবরাজ।

শুনশান নীরব হাসপাতাল নিমিষের ব্যাবধানে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠলো।আশেপাশের কেবিনের পেশেন্ট থেকে শুরু করে অন্যান্য ডাক্তার এবং বাইরের মানুষে ভরে গেলো হসপিটাল করিডোর।
নিজেদের ক্ষোভ ধরে রাখতে না পেরে যুবরাজকে উদ্দেশ্য করে কেউ নিজের স্যন্ডেল ছুড়ে মারলো কেউ বা গরম কফি ছুঁড়লো।কেউ কেউ ভিড় ঠেলে যুবরাজকে আঘাত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো।কেউ কেউ বিশ্রী গালাগাল দিতেও ভুল করলো না।
নিজের ডাক্তারি পেশার তিন বছরের ক্যারিয়ারের সকল সম্মান যেনো নিমিষেই খুইয়ে ফেললো যুবরাজ।যেই মানুষ গুলো সম্মানের শ্রেষ্ঠ সিংহাসনে তাকে বসিয়েছিলো এতোদিন আজ তারাই তাকে টেনে হিচড়ে পদদলিত করছে।আজকের এই দুঃস্বপ্ন ময় অভিজ্ঞতায় যুবরাজ যেনো অনুভূতি হীন অদ্ভুত জন্তু হয়ে সকলের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে রইলো।
চারপাশের বিক্ষুব্ধ জনতা যখন যুবরাজের থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘৃণা প্রদর্শন করতে লাগলো ঠিক সেই সময়ে যুবরাজের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো ম্যাগান।নিজের বুক চিরে ঠেলে বেরিয়ে আসা কান্নাকে বহু কষ্টে রোধ করে সকলের উদ্দ্যেশে মিহি কন্ঠে চিৎকার করে উঠলো
“প্লিজ স্টপ ডিজ ননসেন্স”!

“আমার বাবা আগে থেকেই অনেক অসুস্থ ছিলো।অপারেশন জটিলতায় উনি মারা যাবে এটা আমরা আগে থেকেই জানতাম,সব কিছু জেনে বুঝেই আমরা বন্ড সাইন করেছি।কারন পাপা শেষ চেষ্টা করতে চেয়েছিলেন।এখানে ডক্টর ইউভির কোনো দোষ নেই।তাই আমি আপনাদের করজোড়ে অনুরোধ করবো আপনারা প্লিজ উনাকে ব্লেইম করা বন্ধ করবেন।আজকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আমরা দুজনেই ভেঙে পড়েছি।প্লিজ আমাদের একটু স্পেস দিন।”

কান্না ভেজা উঁচু কন্ঠে এক বাক্যে কথা গুলো শেষ করে যুবরাজের থাবার ন্যায় হাত ধরে টেনে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গেলো ম্যাগান।জ্ঞান শূন্য যুবরাজ অন্ধের জষ্ঠীর মতো ম্যাগানকে অনুসরণ করে চলতে লাগলো।

এই দৃশ্য দেখে দূর থেকে শেরহাম দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে উঠলো।যুবরাজের অপদস্থ হবার দৃশ্য খুব কঠিন ভাবে তাকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু মেয়েটির সাংঘাতিক স্পর্ধায় নিজের আনন্দের ব্যাঘাত ঘটতেই মুখের হাসি মিলিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।
নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে হাতে থাকা জুসের ক্যান হাত থেকে ফ্লোরে ফেলে পায়ের সহিত পিষে কচলে গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো

“যুবরাজের প্রতি ভালোবাসা দেখানোর জন্য তোকে চূড়ান্ত দাম চুকাতে হবে ব্লাডি হুয়াইট বিচ।এমন আযাব দেবো তোকে রূহ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে।তোকে আমি খুব করে আমার আসল চেহারা চিনিয়ে ছাড়বো।

*************
যুবরাজের মুখ থেকে এই টুকুন ঘটনার বর্ণনা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন সামিনা।যেই ছেলেকে নিজের সব টুকু দিয়ে আদর ভালোবাসায় বড় করেছেন সেই ছেলের জীবন মুহূর্তেই এমন বিষাদের কালো মেঘে ঢেকে গেছে মা হয়েও এটা তিনি বুঝতেই পারেননি?
এতো বড় ব্যার্থতা নিয়ে কিভাবে বেঁচে আছেন তিনি?

নিজের সকল ব্যার্থতা ঘুচাতে শক্ত হাতে যুবরাজকে বুকে টেনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন সামিনা।

“বাবারে ও বাবা।আমার সোনা বাবা।মাম্মা তোর কষ্ট বুঝতে পারিনি রে বাবা।না বুঝে সব সময় তোর উপর অনেক কিছু চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি আমি।আমাকে মাফ করে দে আব্বা”!

সামিনার কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হলো।সামিনার পিঠ জড়িয়ে কাঁধে থুতনি রেখে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো যুবরাজ।

“ও আমার ভালোবাসার মানুষ গুলোকে আমার থেকে কেড়ে নিবে মাম্মা।আমাকে বরবাদ করতে এটাকেই সে শক্ত হাতিয়ার হিসেবে বারবার ব্যাবহার করতে চাইছে”

কথাগুলো বলে দ্রুত দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো যুবরাজ।

নিজের চোখের ঝরে যাওয়া অশ্রু দানা নরম হাতের করপুটে মুছে যুবরাজের উদ্দেশ্যে সামিনা শুধালো

“তুই কি কাউকে ভালবেসেছিস কখনো?

সামিনার প্রশ্ন শুনে বাইরের খোলা জানালায় শূন্য দৃষ্টি মেললো যুবরাজ।এরপর লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধরে আসা গলায় বললো―
“ডক্টর রেহানের বোনকে বিগত আট বছর ধরে আমি ভালোবাসি মাম্মা”

#চলবে

[পর্ব টা ছোট করে দেবার জন্য দুঃখিত।আপনারা অনেকেই জানেন আমার মা অসুস্থ।কয়েক দিন ধরে আমি খুবই ব্যাস্ত সময় পার করছি।কিন্তু আমি রেগুলার হবার চেষ্টা করছি।আপনারা আমার এবং আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।আর গল্পটি পড়ার পর সকলকে বিশেষ অনুরোধ করবো আমার পেইজ টিকে ফলো দিতে।ধন্যবাদ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here