ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড #সূচনা_পর্ব #সারিকা_হোসাইন®

0
42

নগ্ন পিঠে ধবধবে সাদা বিছানায় উপুড় হয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে শহরের নামকরা শিল্পপতি মির্জা সাদাফ শাহিরের একমাত্র পুত্র “আবইয়াজ শাহীর যুবরাজ ”
তার সমস্ত পিঠ জুড়ে অঙ্কিত রয়েছে বিশালাকার এক ঈগলের হিংস্র কালারফুল ট্যাটু ।সাথে গলা পেঁচিয়ে রাখা বীভৎস এক ড্রাগন স্নেকের ভয়ানক কালো ট্যাটু।দেখে মনে হচ্ছে ঈগলটি সাপটিকে শিকার এর জন্য হা করে আছে।

উন্মুক্ত লোম হীন ফর্সা পিঠটি কাটাকাটি আর নীলচে জখমের দাগে বীভৎস রূপ ধারণ করেছে।দৃশ্যমান কাটা দাগ গুলো কোনো কোনোটা পুরোনো আবার কোনোটা দগদগে,আবার কোনোটার ব্যান্ডেজ থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত গড়িয়ে গায়ের সাথে শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে।জিম করা পেটানো শরীরে দাগ গুলো খুবই বেমানান ঠেকছে।

যুবরাজের জন্ম বাংলাদেশে হলেও শৈশব কৈশোর দুই ই কেটেছে বিদেশের মাটিতে।সাদাফ শাহীরের স্ত্রী নবনীতা গত হয়েছেন যুবরাজের বয়স যখন মাত্র পাঁচের ঘরে তখন।
মাতৃহীন যুবরাজকে লালন পালন করতে বেশ হিমশিম খেতে হয় সাদাফ শাহীরকে।

এতো অল্প বয়সে মা হারিয়ে ছেলেটি সারাক্ষন মা মা করে কাঁদতে থাকতো।কাঁদতে কাঁদতে যখন দুর্বল হয়ে যেতো তখন ঘরের এক কোনে মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তো।বাসার হেল্পিং হ্যান্ড কোনো ভাবেই ছোট যুবরাজ কে হ্যান্ডেল করতে পারতো না।

একদিকে ভালোবাসার স্ত্রী বিয়োগ অন্যদিকে ছেলের অসহায় কান্নাকাটি।চোখের সামনে ছেলের এমন করুন অবস্থা দেখে নিরুপায় হয়ে হুহু করে চোখের জল ফেলতেন সাদাফ শাহীর।

ব্যাবসায় নাকি নিজের ছেলে ?
কোনটা রেখে কোনটা সামলাবেন দিশাই যেনো খুঁজে পাচ্ছিলেন না সাদাফ শাহীর।

শেষমেশ উপায় না পেয়ে লস এঞ্জেলস এ বসবাস রত নিজের ছোট বোন সামিনার কাছে রেখে মানুষ করেছেন একমাত্র ছেলেকে।

এদিকে সামিনা ছিলেন নিঃসন্তান।প্রভাব প্রতিপত্তি সব কিছু থাকলেও একটা সন্তানের অভাবে আল্লাহর দরবারে প্রতিনিয়ত জায়নামাজে মাথা ঠুকে কাঁদতেন সামিনা।কিন্তু বিধাতা মুখ তুলে সামিনাকে দেখেনি।

সাদাফ শাহীর যখন সামিনাকে নবনীতার মৃত্যুর খবর জানিয়ে যুবরাজের অসহায় করুন অবস্থা জানালেন ঠিক তখনই সামিনা এক বাক্যে রাজপুত্রের মতো দেখতে ভাইপোকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। কোনো প্রকার কষ্ট পৌঁছাতে না দিয়ে নিজের সবটুকু ঢেলে মাতৃ ভালোবাসায় বড় করেছেন যুবরাজকে।

এই আটাশ বছর বয়সে যুবরাজ কখনো খুঁজতে আসেনি কে তার আসল মা আর কে তার ফুপি?

সামিনার স্বামী আদনান সাহিল বছর দশেক আগে গাড়ি এক্সিডেন্টে মর্মান্তিক ভাবে মৃত্যুবরণ করেন।আদনান সাহিল ছিলেন অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ ।অকাল স্বামী বিয়োগে সামিনা খুবই ভেঙে পড়েন।স্বামী হীন বিদেশ বাড়ি সামিনার কাছে প্রতি মুহূর্তে নরকের যন্ত্রণা দায়ক কুঠুরি মনে হতো।তাই তিনি যুবরাজ কে নিউইয়র্কে পাঠিয়ে দিয়ে দেশে ফিরে আসেন তার ভাইয়ের কাছে।
সাদাফ শাহীর আর সামিনা দুই ভাই বোন মিলে এখন একই বাড়িতেই থাকেন।

সাদাফ শাহীর কখনো চান নি মায়ের আদরের অভাবে তার ছেলে বখে যাক।
তিনি সবসময় চেয়ে এসেছেন ছেলে সৎ, পরোপকারী,ভালো চরিত্রের অধিকারী হবে।
কিন্তু ধীরে ধীরে তার মনে হচ্ছে বেলা শেষে তিনি হেরে গিয়েছেন।
নবনীতা কে দেয়া কথা তিনি বোধ হয় রাখতে পারেন নি।

_______

নিজ কক্ষে বিছানার উপর এলোমেলো হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে যুবরাজ।
বিশাল বড় কক্ষ জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান।

কক্ষটির একটা সাইড কিছু ইনডোর প্লান্ট আর ক্যাকটাস দিয়ে সজ্জিত।আসবাবপত্র বলতে একটা কিং সাইজ বেড,একটা বেড সাইড টেবিল ,একটি ড্রেসিং টেবিল আর একটা ওয়ারড্রোব ।
ঘরের আরেকটা কোনে একটা ঝুড়িতে হকি স্টিক,ব্যাট,ক্রিকেট স্ট্যাম্প আর কিছু লাঠি সোঠা দিয়ে ঠাসানো।

বিশালাকার জানালার ভারী পর্দা গুলো এমন ভাবে টানা হয়েছে যাতে কোনো প্রকার ফাঁক ফোকর গলিয়ে সামান্যতম আলো ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে না পারে।
বাগান বাড়ির মতো দেখতে বৃহতাকার অট্রলিকাটি শহরের এমন জায়গায় গড়েছেন সাদাফ শাহীর যেখানে যানবাহনের শব্দ তো দূরে থাক মানুষের কোলাহল পর্যন্ত পৌঁছায় না।
যার কারনে কক্ষে আলো না থাকলে রাত কি দিন কিছুই অনুমান করা যায় না।
বেড সাইড টেবিলের উপর থাকা মোবাইল নামক যন্ত্রটি হঠাৎই সকল নীরবতা বিলীন করে ভো ভো শব্দ তুলে কাঁপতে থাকলো।

অসময়ে নিজের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় চোখ মুখ কুঁচকে দুই পাশ থেকে দুটো বালিশ নিয়ে কানে আর মাথায় চেপে ধরলো যুবরাজ।

কিন্তু অনুভূতি হীন যন্ত্র টি কি এতকিছু বুঝে?

শব্দ থেমে যেতেই যুবরাজ ফিচেল হেসে আবার ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাতে চাইলো।
কিন্তু ফোনটি দ্বিতীয় দফায় আবার শব্দ তুলে কেঁপে উঠলো।

ঘুমের রেশ কেটে মুহূর্তেই যুবরাজের শিরা উপশিরায় তেজের দমক বয়ে গেলো।
অসময়ে যেই ব্যাক্তি ফোন করেছে তার উপর খু*ন চেপে গেলো।

কোমড় পর্যন্ত জড়ানো কাথাটিকে সজোড়ে লাথি মেরে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে রক্ত বর্ন চক্ষু নিয়ে উঠে বসলো।

ততক্ষনে আবারো ফোনের লাইন কেটে গিয়েছে।
মুখে বিশ্রী গালাগাল উচ্চারণ করে চোখ কচলাতে কচলাতে ফোন হাতে নিয়ে আননোন নম্বর দেখে মেজাজের পারদ আরো দুই ধাপ চটে গেলো ।

নম্বরটি কার এটা জানার জন্য মাথায় নিয়ন্ত্রণ হীন রাগ কিলবিল করে উঠলো।
বাজ পাখির ন্যায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে নম্বরটি দেখে কিছুক্ষন গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগলো।
পরিচিত কারো নম্বর মনে হলো না।।
রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নম্বরটি ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে সুমধুর কন্ঠে উত্তর এলো

“আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে।

যুবরাজ লাইন কেটে দিয়ে মেঝের দিকে কিছুক্ষণ দৃষ্টি দিয়ে নীরবে বসে রইলো।
রাগে তার পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
সারা রাত তার এক মিনিটের জন্যও ঘুম হয়নি।
ভোর রাত্রের দিকে কেবলই চোখটা একটু লেগে এসেছে।এখন সকাল ছয়টা বাজতে আরো দু মিনিট বাকি।

“এই মুহূর্তে কার এতোবড় দুঃসাহস জাগলো এই যুবরাজের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর?”

যুবরাজ যতক্ষন না তার কলিজা খুবলে বের করে আনতে পারবে ততক্ষণ সে কিছুতেই শান্তি নিদ্রায় যেতে পারবে না।

মেঝে থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তুলে ফোনের উপর নিবদ্ধ করলো।
কন্টাক্ট লিস্ট থেকে নিজের পারসোনাল হ্যাকার রায়াফ রেদোয়ান এর নম্বর ডায়াল করে কানে তুললো।

প্রথমবারের রিং রায়াফ তুললো না।
এতে যুবরাজের রাগ আকাশচুম্বী হলো।মুখে অদ্ভুত এক গালি উচ্চারণ করে দ্বিতীয় বার কল লাগালো।
লাইন কেটে যাবে এরকম শেষ মুহূর্তে রায়াফ কিছুটা বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করতেই গমগমে ভরাট কন্ঠে যুবরাজ বলে উঠলো

‘”একটা নম্বর দিচ্ছি এক্ষুনি এর ছবি সহ সকল ইনফরমেশন চাই।

রায়াফ ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো
“ঘুমুচ্ছি ব্রো।”

“ঘুম থেকে উঠে দেই?”..

“চোখ খুলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।”

যুবরাজ হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো

“তোর চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে আর আমার ঘুমুতে কষ্ট হচ্ছে।”

“এখন বল কোনটা আগে?”

“তোর চোখ খোলা নাকি আমার চোখ বন্ধ করা?

ঘটনা বেগতিক বুঝতে পারলো রায়াফ।ধড়ফড় করে ঘুম ফেলে নিজের ল্যাপটপ টেনে বাবু হয়ে বিছানায় বসলো।

হাই তুলতে তুলতে ল্যাপটপ অন করে কাজ করতে করতে রায়াফ বলে উঠলো―

“নম্বর দে আর আমাকে ফাইভ মিনিটস টাইম দে”

যুবরাজ খট করে লাইন কেটে দিয়ে রায়াফের নম্বরে এসএমএস পাঠিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে মাথার পেছনে দুই হাত রেখে পায়ের উপর পা তুলে সমানে নাচাতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো

“যে আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে এই সাত সকালে তার শাস্তি কিভাবে দেবো আমি?

কুপিয়ে পিস পিস করে লবন ভরে নাকি এক মাস বিভিন্ন টর্চারের উপর রেখে তাকে না ঘুমুতে দিয়ে?

যুবরাজের চিন্তায় ভাটা পড়লো মেসেজের টুং শব্দে।

ধূর্ত শিয়াল যেভাবে শিকার আক্রমন করে ঠিক সেই ভাবে ছো মেরে নিজের ফোন হাতে তুলে লক ছাড়িয়ে রায়াফের মেসেজ ওপেন করলো যুবরাজ।

মুহূর্তের ব্যাবধানে রাগের পারদ জিরো হয়ে গেলো।চোখের ঘুম কোথায় গিয়ে পালালো তার হদিস ই পাওয়া গেলো না।টনটনে মাথা ব্যাথাটা নিমিষেই গায়েব হয়ে শরীর মন দুটোই প্রশান্তিতে ভরে গেলো।
বার দুয়েক ফাঁকা ঢুক গিলে শুষ্ক গলাটা ভেজানোর চেষ্টা করলো যুবরাজ।
কিন্তু গলাটা ভেজার পরিবর্তে চৈত্র মাসের খরায় ফেটে যাওয়া চৌচির ভূমির ন্যায় দ্বিগুন শুষ্ক হয়ে উঠলো।
মুহূর্তেই পুরো শরীর মন অস্থির হয়ে উঠলো যুবরাজের।
হাতের ফোন বিছানায় ফেলে দ্রুত জানালার পর্দা সরিয়ে রুম আলোকিত করে দিলো যুবরাজ।
তবুও তার অস্থিরতা কোনো ভাবেই কমছে না।
এসির পাওয়ার উনিশ।সাধারণত এই টেম্পারেচারে শীত অনুভূত হবার কথা।
কিন্তু যুবরাজের সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে জপজপে অবস্থা।
নিজের অস্থিরতা কমাতে দ্রুত বেলকনির দরজা খুলে দৌড়ে বৃহতাকার খোলা বেলকনিতে এসে দাড়ালো যুবরাজ।
এরপর রেলিংয়ে হাত দিয়ে সামান্য ঝুকে বুক ভরে শ্বাস টেনে মনে মনে বলে উঠলো―

“হম্ম এবার একটু ভালো লাগছে!

এতো ভোর বেলায় উঠে যুবরাজ কখনো প্রকৃতির এমন শান্ত স্নিগ্ধ রূপ দেখেনি।দেখেনি বললে ভুল হবে,বিভিন্ন ব্যাস্ততায় তার সময় হয়ে উঠেনি।
ফুরফুরে ঠান্ডা উত্তীরিয় সমীরণ সাথে পুব আকাশে লাল টকটকে সূর্যের আভা ছড়ানো দৃশ্য সব কিছুই যেনো যুবরাজকে দ্বিতীয় দফায় মুগ্ধ করলো।
ভোরের নির্মল মিষ্টি বাতাস যুবরাজের ঘাড় সমান এলোমেলো চকলেট রঙা চুল গুলো এলোপাতাড়ি উড়িয়ে দৃষ্টি সীমানা অবরোধ করতে চাইছে।
যুবরাজ দুই হাতের সাহায্যে ব্যাকব্রাশ এর মতো করে চুল গুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে পুনরায় প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগে মগ্ন হলো।

কিন্তু বেশিক্ষণ সেই সৌন্দর্য দৃষ্টি উপভোগ করতে চাইলো না।
যুবরাজের মনে হলো কিছুক্ষণ আগে সে যেই সৌন্দর্য উপভোগ করছে সেই সৌন্দর্য পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় সৃষ্টিই হয়নি।
বেহায়া মন দ্বিতীয় বার সেই সৌন্দর্যের দর্শন চাইলো।
নিজের মনের উপর নিজেরই নিয়ন্ত্রণ খাটছে না যেনো।
নিজেকে শাসিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজের কক্ষে চলে এলো যুবরাজ।লাজুক হেসে ফোন হাতে তুলে রায়াফের পাঠানো মেসেজ ওপেন করে মুচকি হাসলো।
ফোনের স্ক্রিনে কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো

“যুবরাজ সব সময় দুটো জিনিসের লোভ এড়িয়ে গিয়েছে।
“এক হচ্ছে টাকা দ্বিতীয় হচ্ছে নারী।

“টাকা আর নারী দুটোই এই মির্জা আবইয়াজ শাহীর যুবরাজ কে ধরা দিয়েছে স্বেচ্ছায়।

” যুবরাজ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে কখনো এই দুটো জিনিস হাসিল করেনি।

“কিন্তু তোমাকে যেকোনো মূল্যে এই যুবরাজ হাসিল করবে।

“নিজে থেকে ধরা দিয়ে বড় বিপদে পড়ে গেলে “সুইটহার্ট”

“এবার সামলাও আমাকে।

#চলবে?

#ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড
#সূচনা_পর্ব
#সারিকা_হোসাইন®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here