অমানিশায়_সেই_তুমিই #লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা ২৭. (প্রথমাংশ)

0
97

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৭. (প্রথমাংশ)

রাতের শেষ প্রহর পেরিয়ে ভোর হতে চলল। খুব বেশি সময় বাকি নেই ফজরের আজান পড়তে। কোথাও কোথাও দূর মসজিদ থেকে ভেসেও আসছে আজানের ধ্বনি। রাত আধার কেটে আলোর ছটা তো প্রকাশ পাবে শীঘ্রই; সেই সাথে যেন ইরাজের ছটফটানি সম-হারে বাড়ছে। পাবলিক হাসপাতাল হওয়ায় লোক সমাগম তুলনামূলক কম। ইরাজ বারান্দায় একাধারে ছটফটে পায়ে পায়চারী করছে। পাশেই এক বেঞ্চে ভেঙে পড়া হেলাল সাহেবকে ধরে বিষণ্ন মুখে বসে রয়েছেন ইমতিয়াজ সাহেব। ইরাজ একা অস্থির নয়। আজ বড়ো আশ্চর্যজনক দৃশ্য হিসেবে চোখে পড়ার মতো ব্যপার হলো— আনতারা খানম যেন সমানতালে অস্থির ইরাজের সঙ্গে সঙ্গে। তার চোখ-মুখে স্পষ্ট উদ্বেগ। বারবার এগিয়ে যাচ্ছেন অবজারভেশন রুমের দ্বারের দিকে। আবার হতাশ হয়ে ফিরে আসছেন।

মেঘালয়া নাক-মুখে র ক্ত উঠে এসেছিল সঙ্গে অস্বাভাবিক পেটের ব্যথা। রাত সাড়ে তিনটার সময় নিয়ে আসা হয়েছে হাসপাতালে। তখনই মেঘালয়াকে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়েছে অবজারভেশন রুমে। তখন থেকে ইরাজের এই অশান্ত, এলোমেলো চলন চালু আছে। চোখ-মুখ র ক্ত শূন্য, উদ্দীপনাহীন লাগছে। চেহারাটা ভাঙা, বসে যাওয়া। শারমিন আরা আজ রাতে ডিউটিতে ছিলেন না। তাকে ইরাজ ফোন করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। তিনি এখনও এসে পৌঁছান নি। ইরাজের মাথা আরও গরম হয়ে উঠল।

ফজরের আজান শোনা যায়। ইরাজ একবার ভাবনা-পীড়িত দৃষ্টিতে তাকাল সেই কেবিনের দিকে– যেখানে মেঘালয়াকে অবজার্ভ করা হচ্ছে। অতঃপর ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল মসজিদের উদ্দেশ্যে। হাসপাতালের বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতেই নজরে এলো শারমিন আরা নামলেন নিজস্ব গাড়ি থেকে। ইরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে দাঁড়াল এক পুরুষ। ইরাজ এগিয়ে গিয়ে দাঁত খিঁচে বলল, “ম্যাম! আপনার বিবেক ঘুনপোকায় খেয়েছে? মেঘের কিছু হলে আপনাকে আমি..

শারমিন আরা ইরাজের বাহুতে হাত রেখে সজল চোখে তাকায় ইরাজের বিক্ষুব্ধ চোখের দিকে। ইরাজ নিভে গেল একটু, থামল। শারমিন আরা ডিভোর্সী-নারী। এই শেষ রাতে একজন নারীর পক্ষে পথ পেরিয়ে হাসপাতালে আসা সহজ তো মোটেই নয়। যে ছেলেটি তাকে নামিয়ে দিতে এসেছে, শারমিন আরার ছোটো ভাই শান্ত। সেও পরিচিত ইরাজের। শারমিন আরা বললেন, “কুল, রাজ!ʼʼ

ইরাজ চলে যায় নামাজের উদ্দেশ্যে। শারমিন আরা দ্রুত প্রবেশ করলেন ভেতরে।


সকাল সাড়ে ছয়টা বাজতে চলল। ইরাজ মন্থর পায়ে প্রাণহীনের ন্যায় দরজা খুলে প্রবেশ করল কেবিনে। চোখের কাতরতা আর বুকের ধুকপুকানিতে ইরাজ বিদ্ধস্ত যানবাহনের মতো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে যেন! গিয়ে বসতেই শারমিন আরা বলতে শুরু করলেন,
“রাজ! আমি তো তোমাকে প্রেগন্যান্সির সেই শুরুতেই বলেছিলাম, মেঘালয়ার প্রি-একলাম্পসিয়া দেখা দিতে পারে। কারন প্রথম থেকে ওর ব্লাড-প্রাশার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। আর যা ধারণা করেছিলাম, তা ঘটে গেছে। এখন..

কথা শেষ করতে দেয়না ইরাজ। বলে ওঠে, “এখন কী অবস্থা, ম্যাম!ʼʼ

শারমিন আরা ইতস্তত করলেন। এই ছেলের যা মেজাজ। না জানি কথাটা শুনে কিভাবে নেবে। তবুও বলতে শুরু করলেন, “মেঘালয়ার ব্লাড-প্রেশার অনিয়ন্ত্রণে। মাঝেমধ্যেই খিঁচুনি হচ্ছে। নাক-মুখে রক্ত আসছে। আর বাচ্চার গঠন সুষ্ঠুভাবে হয়নি।ʼʼ

কোনদিন কোন রোগীর কন্ডিশন জানাতে ডাক্তার হিসেবে এমন দ্বিধা কাজ করেনি তার, অথচ ইরাজের সামনে ব্যাপারটা খুলতে মুখে বাঁধছে যেন। থেমে থেমে বললেন কথাগুলো শারমিন আরা। ইরাজ শান্ত নজরে তাকিয়ে বলল, “ভনিতা না করে খুলে বলুন, এখন কী করা যায়। কী হয়েছে?ʼʼ

চরম অসভ্যের মতো শোনাল ইরাজের কথা। শারমিন আরা একটা শ্বাস নিয়ে বললেন, “তোমার বাচ্চা বাঁচার সম্ভাবনা টেন-পার্সেন্ট। আর যেহেতু প্রি একলাম্পসিয়া শুরু হয়েছে, প্রসবের সময় খিঁচুনি উঠবে প্রায় নিশ্চিত। আর তখন বাচ্চা ও মা দুজনের লাইফ-রিস্ক রয়েছে। যদি কোনভাবে কেউ একজন বেঁচেও যায়, সে মেঘালয়া হলে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়বে। আর বাচ্চা প্রতিবন্ধী হতে পারে। কারণ, বাচ্চার বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়নি। মেঘালয়া গর্ভধারণের শুরু থেকে শারীরিকভাবে ফিট ছিল না। আর… মেঘালয়ার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ। আ’ম সিওর তোমারটা পজেটিভ। বাচ্চার বর্ধণ ও শারীরিট পরিপক্কতায় বাঁধা হয়েছে ব্যাপারটি, সঙ্গে মেঘালয়ার শারীরিক কন্ডিশনকে আরও বিগড়েছে।ʼʼ

ইরাজের বুকটা কেঁপে উঠল বোধহয়! মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠল, তবুও অটল চাহনিতে জিজ্ঞেস করল, “কেন এসব হচ্ছে?ʼʼ

“হতে পারে পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে এমন। বংশগতি বোঝো তো! হার্ট ফেইলিওর বা উচ্চ রক্তচাপ রোগ গুলো বংশগতির ধারায় প্রবাহিত হওয়ার মতো ম র ন ঘা তি রোগ।ʼʼ

এই কথাটুকুর পরিপেক্ষিতে ইরাজের মাথায় হুট করে এলো, মেঘালয়ার আম্মুও মেঘালয়ার ছোটো ভাইয়ের প্রসবের সময় খিঁচুনিতে মা-ছেলে দুজনেই মারা গিয়েছিল। এ-কথা এতদিন মাথায়ই আসে নি ইরাজের। শারমিন আরা বলতে লাগলেন,

“প্রথম গর্ভধারণে প্রেশারটা অনিয়ন্ত্রিত হতে বেশির ভাগ নারীরই দেখা যায়। মেঘালয়া পঁচিশ বছরের কম সময়ে গর্ভাধারণ করেছে, এখানেও এ অবস্থা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যায়। আর তাছাড়া তুমি খোঁজ নিয়ে দেখো, পরিবারে আর কারও হাইপারটেনশন আছে কিনা!ʼʼ

মেঘালয়ার গোটা পরিবারটাই হাইপারটেনশনের রোগী। হেলাল সাহেবের হাই-প্রেশার আছে, মেঘালয়ার মা তো জীবনটাই দিয়ে গেলেন। এ-কথা মাথায় আসতেই ইরাজ উদ্ভ্রান্তের মতো বলে ওঠে, “আমার বাচ্চা লাগবে না। আপনি মেঘালয়াকে ঠিক করুন। বাচ্চা দরকার নেই তো, ম্যাম! আমার জন্যই হয়েছে সব। আমিই করেছি এসব। মেঘের গর্ভধারণে আমি শালা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম। বুঝেই উঠতে পারিনি আমার এক খুশির জন্য আমার জীবনের বেঁচে থাকার অবলম্বনকে কোরবানী করতে হবে। শালা, বোকা ইরাজ! জীবনে তোর হারানোর শেষ নেই। আর তার কারণগুলো তুই নিজেই।ʼʼ

পাগলের মতো ছটফট করতে করতে এসব প্রলাপ বকতে শুরু করল ইরাজ। উঠে দাঁড়াল, কেবিন থেকে বেরিয়ে একদৌঁড়ে গেল মেঘালয়ার কেবিনের দিকে। ওয়ার্ডবয় ওর উত্তেজনা দেখে বাঁধা দিতে আসলে এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। মেঘালয়া প্রায় অচেতন পড়ে আছে বেডে। ইরাজ গিয়ে দাঁড়াল মেঘালয়ার বেডের পাশে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল মেঘালয়ার অচঞ্চল, অর্ধবোজা চোখের দিকে। মেঘালয়ার হাতটা মৃদূ নড়ে ওঠে। ইরাজ তা চেপে ধরে বসে পড়ল চেয়ারে। মেঘালয়ার মুখে কাতর হাসি। মলিন চোখদুটো চেয়ে আছে ইরাজের দিকে, মুখে হাসি লেপ্টে আছে তার। ইরাজের বুকের ভেতর সূঁচাল ব্যথা অনূভূত হয়। হৃদযন্ত্রটা লাফিয়ে উঠল ধকধক করে। চোখ লাল হয়ে উঠল। নির্নিমেষ চেয়ে রইল মেঘালয়ার তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটের দিকে। কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা বুঝে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষারত রয় ইরাজ।

চলবে..

[ এ পর্বের বর্ধিতাংশ আসবে কাল সকালে বা আশেপাশের কোন সময়ে ইনশা-আল্লাহ! বেশ অনিয়মিত হয়ে পড়েছি তাই-না! আসলে দৈনন্দিন ব্যস্ততার পর অলসতা ঘিরে ধরে খুব। আপনারা একটু মানিয়ে নিন। চেষ্টা করব নিয়মিত হবার!🙃❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here