#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
৯.
ইরাজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা হেঁটে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। মেঘালয়া চুপচাপ চেয়ে দেখল কেবল। বেশ অনেকটা সময় কেঁটে যাওয়ার পরও ইরাজ রুমে এলো না। মেঘালয়া ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে, ফুসকার প্যাকেটটি টি-টেবিলের ওপর রেখে সোফার কুশন মাথার তলে রেখে আড়াআড়ি ভাবে— গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়।
প্রায় ঘন্টা-দুয়েক কেঁটে যাওয়ার পর ইরাজ রুমে এলো। একবার আড়চোখে দেখল। অতঃপর বিছানার দিকে অগ্রসর হয়। সেই মুহূর্তেই মেঘালয়া তড়াক করে উঠে বসল। তড়িঘড়ি ডেকে উঠল, “ইরাজ ভাই!ʼʼ
ইরাজ তাৎক্ষনিক ফিরে তাকায় না। একটু রয়েসয়ে বিরক্ত চোখে তাকাল। মেঘালয়া খানিক ইতস্ততঃ করে বলে, “একটু সময় হবে?ʼʼ
ইরাজ কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল, “কোন মহাকাজে সময় লাগবে তোর?ʼʼ
মেঘালয়ার অনুযোগের স্বর, “আমায় যেকোন কিছুতে আপনার টেমপারেচার হাই হয়ে যায়? একটু ভালো করে কথা বললেও তো পারেন।ʼʼ
ইরাজ ভাবলেশহীন জবাব দিল, “কখনও বলেছি?ʼʼ
“বদলাবেন না আপনি?ʼʼ
“আজীবনেও না।ʼʼ
মেঘালয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আস্তে করে বলল, “বসুন। কিছু পরামর্শ নেওয়ার আছে।ʼʼ
ইরাজ কঠিন কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। বিরক্তিতে বুদ হয়ে অতিষ্ট ভঙ্গিতে মেঘালয়ার সামনের সোফায় এসে বসল। মেঘালয়া মাথা নত করে হাতের নখ খুঁটছে। ইরাজ কপাল জড়িয়ে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মেঘালয়া বলে ওঠে, “কিছু জটিলতায় ভুগছি।ʼʼ
ভ্রু উঁচিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে ইরাজ, “কাব্যিক হয়ে উঠছিস নাকি?ʼʼ
মেঘালয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, “কাব্যিক? নাহ.. মানে! আমি নিজের ভেতরে অবস্থা বুঝতে পারছি না। মিশ্র অনুভূতি আর চিন্তারা জ্বালাতন করছে। অনেক কৌতৃহল আর প্রশ্ন জমেছে।ʼʼ
ইরাজ নির্লিপ্ত নজরে নিচের দিকে চেয়ে, সামনের চুলগুলো মুচরে ধরে পেছনে ঠেলে আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, “বয়স কত তোর?ʼʼ
মেঘালয়া নাক কুঁচকাল। তবে জবাব দিল, “হুম? আঠারো পার হয়েছে। বোধহয় ঊনিশ! না, হ্যাঁ! মানে আব্বু জানে। আসলে আমিও জানি, ঊনিশ।ʼʼ
ইরাজ শীতল দৃষ্টিতে সামান্য সময়ের জন্য মেঘালয়ার অতি চঞ্চল চোখে দৃষটিপাত করল। নজর নামিয়ে বলল, “এ বয়সে এমন অস্থিরতা কাজ করা অস্বাভাবিক নয়। এমন হয়।ʼʼ
“কী হয়?ʼʼ সরল প্রশ্ন মেঘালয়ার।
ইরাজ এবার শান্ত দৃষ্টি ঠিক মেঘালয়ার দৃষ্টিতে ফেলল। তাতেই যেন আরও অশান্ত হয়ে ওঠে মেঘালয়া। শীতল স্বরে বলল ইরাজ, “তোর কী হচ্ছে?ʼʼ
মেঘালয়া মাথা দুদিকে দুলায়, “উহু। আমার সকল জটিল কৌতূহল আপনাকে ঘিরে। সবারই তো বয়স ঊনিশ হয়। তাদের কাছে তো আর আপনি থাকেন না! তো সবার কি হয় তাহলে? মানে— কি নিয়ে এমন অসস্তিতে ভোগে তারা?ʼʼ
ইরাজ সে-সবের জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কৌতূহল গুলো বল।ʼʼ
মেঘালয়া থমকে যায় এবার। কিছুটা সময় নিলো। অতঃপর ধীর-স্থির কম্পমান কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “তাবির, তাবিরের সঙ্গে আপনার যে ঝামেলা হয়েছিল, তা আপনি আমাদের কলেজে যাওয়ার কারনেই হয়েছিল! আপনি কেন যেতেন আমাদের কলেজে?ʼʼ
বলেই ইরাজের দিকে তাকায়। ইরাজ ঠাণ্ডা নজরে তাকিয়ে আছে। মেঘালয়া ব্যস্ত হয়ে ওঠে, বুঝানোর মতো করে বলে ওঠে, “না মানে, আমি জানি, ওটা আপনারও কলেজ। আপনি সেখানকার প্রাক্তন ছাত্র। কিন্ত শুধু কি এ কারনেই যেতেন রোজ আমাদের কলেজে?ʼʼ
ইরাজ কিছুক্ষন চুপচাপ চেয়ে রইল মেঘালয়ার চোখের দিকে। মেঘালয়া চেয়েও দৃষ্টি সরাতে পারে না ইরাজের দৃষ্টি থেকে। আচমকা উঠে দাঁড়াল ইরাজ। অদ্ভুত স্বরে বলল,
“দামী জিনিস চোখে চোখে রাখতে হয়, জানিস তো! ওই কলেজে আমার এক মূল্যবান সম্পদ ছিল। তাতে নজর রাখতে যেতাম। এখন ঘুমা।ʼʼ
মেঘালয়া ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকাল ইরাজের দিকে। কি বুঝল কে জানে! কিঞ্চিত হাসির ফুটে উঠল যেন ঠোঁটের কোনে। ইরাজ হাঁটতে অগ্রসর হলে পেছন থেকে চঞ্চল কণ্ঠে বলল, “আমার প্রশ্ন শেষ হয় নি।ʼʼ
ইরাজের কণ্ঠস্বর যেন গম্ভীর শোনায় এবার, “আমার উত্তর শেষ।ʼʼ
“আচ্ছা, আর প্রশ্ন করছি না। বসুন এবার।ʼʼ
ইরাজ কপাল জড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল।
“তোর সঙ্গে এই প্যানপ্যানানি প্যাঁচাল পারব রাতভর?ʼʼ
“উহু!ʼʼ মনঃক্ষুন্ন হয়ে ধীরে জবাব দেয় মেঘালয়া। মাথাটা নত করে বসে রইল। চমকে উঠল সেকেন্ড কয়েক পর— ইরাজ ধপ করে বসে পড়ে আবার সোফাটির ওপর। তবে মেঘালয়া তাকিয়ে দেখল না। ইরাজ ধমকে ওঠে, “ন্যাকামি চরম অপছন্দের আমার। কেন বসতে বললি?ʼʼ
মেঘালয়া কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, “এ বাড়িতে এমনিতেও তো স্থায়ী নই আমি, তাই-না! খুব বেশি সময় জায়গা হবে না এখানে আমার।ʼʼ
আরও কিছু বলবে, তার পূর্বেই ইরাজ রসিকতা করে বলে ওঠে, “এত মোটা হয়ে যাবি তুই? আমার বাপের এত বড়ো বাড়িতে আঁটবে না তোর শরীর?ʼʼ
মেঘালয়া ধাক্কা খেল, এমন এক সময় এরকম একটা কথা শুনে। হাঁ হয়ে গেল মুখটা। ভেতরে নিঃশব্দে প্রশ্ন করে ওঠে, ‘অ্যাঁহ!’
কথাটা বুঝতেই কেন জানি অদ্ভুত ভঙ্গিতে মুচকি হেসে ওঠে। মাথাটা নামিয়ে নিলো হাসিমুখে। ইরাজ কেমন করে যেন চেয়ে রয় মেঘালয়ার বাঁকা চাঁদের ন্যায় হাস্যজ্জল ঠোঁটের দিকে। চোখ সরল না। ঠোঁটের দুকোন বেঁকে আছে মেঘালয়ার। মাথা নিঁচু করে থাকায়, সামান্য দেখতে পাওয়া যায় আকস্মিক হেসে ওঠা ঠোঁট। কোন এক আবেশে চেয়ে রইল ইরাজ। বুকে অদ্ভুত জ্বালা অনুভব করে। কোথাও তিরতির করে উঠছে, নিভু-নিভু আগুন যেন দমকা বাতাস পেয়েছে। আবার খড়ের গাদায় দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠতে চাইছে।
মেঘালয়া হাসিমুখেই তাকাল ইরাজের দিকে। ইরাজের এই অদ্ভুত দৃষ্টিপাত সম্পূর্ন নতুন। মেঘালয়ার ভেতর থমকে যায়। হাসিটুকু মিশে যায়, বাঁকানো ঠোঁট জায়গায় ফিরে মিলিত হলো। ইরাজ তাৎক্ষণিক দৃষ্টি সরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকাল। চোখ বুঁজে শ্বাস নিলো। অর্ধভেজা এক ঢোক গিলল। তাতে তার গলায় দৃশ্যমান স্বরযন্ত্রের উঁচুস্থানটি নড়ে উঠে ব্যাপক আন্দোলনে। নজর এড়ায় না মেঘালয়ার বিষয়টি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গলা অবধি নেমেছে হালকা করে। তার ওপর সেই পুরুষের বিশেষত্ব— উঁচু হয়ে থাকা দৃশ্যমান স্বরযন্ত্রের কম্পন দৃশ্যে মেঘালয়া কি বিমোহিত হলো!
মেঘালয়া দৃষ্টি সরে আসে ইরাজের কঠিন স্বরের বলা নিষেধাজ্ঞায়, “হাসবি না তুই, মেঘ!ʼʼ
মেঘালয়া কি বুঝল কে জানে! আবার লাজুক হেসে ওঠে। ইরাজ এবার কোনভাবেই তাকাল না। মাঝে কিছুক্ষণ নিরবতায় কেঁটে যায়। দুজনের দৃষ্টি নিবদ্ধ মেঝেতে। নিরবতা ভঙ্গ করে মেঘালয়া।
“আপনি জটিল।ʼʼ
“কতটা?ʼʼ
“না পড়া বইয়ের মতো।ʼʼ
“তাতে কী?ʼʼ
“পড়ে দেখতে ইচ্ছুক আমি। শুরু করেছি পড়তে।ʼʼ
সামান্য চমকেই যেন তাকাল ইরাজ। হাসল সামান্য। মেঘালয়া আবার থেমে যায়। দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়। সাহস হয় না ওই পোড়া ঠোঁটের রহস্য হাসিতে দৃষ্টি ধরে রাখার। ইরাজ হাসিটা গিলে নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে, মেঘালয়াকে যেন তুচ্ছজ্ঞান করে বসল। ভাব নিয়ে বলল,
“জটিল কেন আমি?ʼʼ
মেঘালয়া সে প্রশ্নের উত্তর দেয় না। বরঞ্চ নিজে প্রশ্ন করল,
“তখন ফুসকা খেতে চেয়েছিলাম, যে খিস্তি ঝাড়লেন— পরে আবার তা কিনে এনেছেন কেন?ʼʼ
ইরাজ চুপচাপ নিচের দিকে চেয়ে রয়। খানিক সময় পর মুখ তুলে, দুষ্টু হাসল। সেই বদ-হাসি ঠোঁটে রেখেই জবাব দেয়,
“মানুষের হউত-মউতের কথা বলা যায় না। অত করে চাইলি, না খেয়ে যদি এর মাঝেইʼ— বলেই হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে ওপরের ইশারা করে বলল, “টপকে যাস, তারপর পেত্নী হয়ে ভয় দেখাবি, আল্লাহর কাছে দায়ী থাকব এমনকি সবচেয়ে বড়ো ভয়, যদি দ্বিতীয় বউ নিয়ে সুখে সংসার করতে না দিস? ভয়ে এনেছি।ʼʼ বলেই মাথা দুলায়।
মেঘালয়া চোয়াল শক্ত করে চেয়ে রইল। ইরাজ মেঘালয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে এবার শব্দ করে হেসে উঠল। তা দেখে কি হলো কে জানে— মেঘালয়া নিজেও ফিক করে হেসে ওঠে।
অতঃপর বলল, “যতবার ফুসকা খেয়েছি— আব্বু আর নয়ত বান্ধবীরা সাথে থেকেছে। এ রুমে তো আর তাদের কেউ উপস্থিত নেই।ʼʼ
ইরাজ কথা কেড়ে নেয়, “তুই যদি মনে করে থাকিস, তাদের জায়গায় প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ার মাধ্যমে আমায় বসাবি, তাহলে খুব শীঘ্রই তোর কানটা গরম হতে যাচ্ছে।ʼʼ
মেঘালয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “একবার টেস্ট করে তো দেখুন। যত্ন করে নিজ হাতে বানিয়ে দেব।ʼʼ
ইরাজ তড়িঘড়ি উঠে দাড়ায়, “চটাং করে মারব এক চড়! তুই খা বেশি করে, আমার পোষাবে না ওসব আজুবাজু জিনিস।ʼʼ
মেঘালয়া ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল। নির্বিকার চিত্তে ভাবলেশহীন জবাব দিল, “আমারও।ʼʼ
ইরাজ ঘুরে তাকাল। বসল সোফায় আরাম করে। মেঘালয়া খুশি হয়। দ্রুত প্যাকেট ছিঁড়ে ফুসকা বের করতে উদ্যেত হয়। ইরাজ আস্তে করে প্যাকেটটি মেঘালয়ার হাত থেকে নিলো। দারুন খোশ-মেজাজে বলল, “তুই তো আর আমায় ছাড়া খাবি না। এতে ডাস্টবিনের হক আছে, বুঝলাম। দে।ʼʼ
বলেই প্যাকেট নিয়ে হাঁটা ধরে। মেঘালয়া কয়েক সেকেন্ড অবুঝের মতো বসে থেকে, যখন বুঝল ব্যাপারটা— ইরাজের পেছনে দৌড় লাগায়, “দিন, বলছি। খেতে হবে না আপনার। ইরাজ ভাই, আমার ফুসকা।ʼʼ
বলতে বলতেই রুম ছেড়ে বেরিয়ে সিঁড়ির প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে এলো দুজনে। পেছন থেকে মেঘালয়া তাড়া করতে করতে ডেকে ওঠে, “ইরাজ ভাই! আমার ফুসকা!ʼʼ
ইরাজও ওই একই সুরে বলল, “হ বইন, তোর ফুসকা। তা খুব শীঘ্রই ডাসটবিনে যাবে।ʼʼ
নিঁচে নেমে আসে দুজনে ধরাধরি করতে করতে। এক পর্যায়ে, ইরাজ নির্লিপ্ত আর মেঘালয়া থমকে দাঁড়িয়ে যায়। সম্মুখে থমথমে মুখে দাড়িয়ে আছেন আনতারা খানম। ইরাজ ফুসকার প্যাকেটটি মেঘালয়ার হাতে ধরিয়ে দেয় আস্তে করে। ভাবলেশহীন হেলেদুলে হেঁটে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। মেঘালয়া মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল কেবল।
রাত প্রায় দু’টোর কাছাকাছি!
চলবে..
[ আমি ভাবিনি আমার এই অনভিজ্ঞ হাতের অগোছালো, আবোল-তাবোল লেখার অপেক্ষা করার মতো পাঠক পাব। শুকরিয়া আর ভালোবাসা অশেষ! একটু মানসিক সমস্যায় ছিলাম এ ক’দিন। গত পরশু রাত থেকে জ্বর। কাল রাতে তা ১০৪°। অনিয়ম হয়েছে, হয়ত কিছুদিন হবেও, আর চরম অস্থিরতা নিয়ে অল্প সময়ে লিখেছি। ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে অনেক। একটু মানিয়ে নেবেন আপনারা!🩶🙃]