একটি_অপ্রেমের_গল্প #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪১।

0
105

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪১।

বাইরের আত্মীয়-স্বজন সবাই প্রায় চলে গিয়েছে। সেন্টার মোটামুটি খালি এখন। এমন সময় নতুন ব্যক্তির আচনক আগমনে সবাই বিস্তর অবাক। খালামনি আসিয়া বেগমের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কে উনি, আপা?’

আসিয়া বেগম কাঁধ উঁচিয়ে বললেন,

‘কী জানি, আমিও চিনি না। হয়তো মাহিরের কোনো আত্মীয় হবে।’

সুঠাম দেহী পুরুষ মানুষটার মুখে লেপ্টে আছে কাষ্ঠ হাসি। পা টেনে এগিয়ে এল সে। মাহিরের সমীপে দাঁড়িয়ে বলল,

‘বিয়েটা না হয় আমাকে ছাড়াই করলি। রিসেপশনে তো অন্তত দাওয়াতটা দিতে পারতি, তাই না?’

এইটুকু বলে সে ঘাড় কাত করে মাহিরের পেছনে বসে থাকা অন্বিতাকে দেখল। যার তপ্ত, ক্ষুরধার চাহনি দেখে হাসল সে। বলল,

‘আরে ভাবি, কেমন আছেন? ভুলে যাননি তো আমায়?’

চোয়াল দৃঢ় করল অন্বিতা। অতীতের সেই বিদঘুটে মুহুর্তগুলো সহসাই তাজা হয়ে উঠল যেন। রাগে শরীর রি রি করে উঠল তাতে। কুপিতস্বরে বলল,

‘মানুষকে ভোলা গেলেও অমানুষকে ভোলা যায় না। আমি আপনাকে ভুলিনি।’

হু হু করে হাসল সে। মাহিরের কাঁধ চেপে বলল,

‘ভাই, ভাবি তো বেশ মজা করে।’

কাঁধ থেকে হাতখানা এক ঝটকা’ই সরিয়ে দেয় মাহির। দাঁতে দাঁত চেপে সে জিজ্ঞেস করে,

‘কেন এসেছিস এখানে? আমি তো তোকে ইনভাইট করিনি?’

সে দু হাত পকেটে পুরে পিঠ টানটান করে দাঁড়িয়ে বলল,

‘তুই ইনভাইট না করলেও আমার একটা দায়িত্ব কর্তব্য বলে ব্যাপার আছে না? তুই তো জানিস, তোর ব্যাপারে আমি কত সিরিয়াস।’

বলেই ফের হাসল সে। মাহিরের রাগ সপ্ত আকাশ ছুঁয়েছে বোধ হয়। সেদিনের ঐ সি সি টিভি ফুটেজ সে দেখেছিল। হোটেলের ওয়েটার বলেছিল সমস্ত সত্যটা। নিজের চোখে দেখেছিল, কীভাবে অন্বিতার ড্রিংকস্-এ ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে তাকে হেনস্থা করা হয়েছে। তবে এইসব কিছু জেনেছিল বিদেশ যাওয়ার পর। সেখানে বসে তার আর কিছুই করার ছিল না। তবে এরপর থেকেই এই বন্ধু নামের কুৎসিত মানুষটার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে সে। কিন্তু আজ আচমকা এই মানুষটা তার বিয়ের খোঁজ পেল কীভাবে?

আভা ফিসফিসিয়ে বলল,

‘এটাই কি ঐ লোকটা, যার জন্য সব হয়েছিল?’

অন্বিতা ক্ষুব্ধ হয়ে উপর নিচ মাথা নাড়ায়। আভা হকচকিয়ে উঠে বলে,

‘কী সাংঘাতিক! এতকিছু ঘটিয়ে এখন কী নির্দ্বিধায় এখানে এসে কথা বলছে। সামান্য লজ্জাটুকুও নেই।’

মাহির নিজেকে ধাতস্ত করে নিল। অন্বিতার পরিবারের সামনে সে সবকিছু খোলাসা করতে চাইছে না। তাই শান্ত স্বরে বলল,

‘এসে ভালোই করেছিস। আমি নিজেও হয়তো কোনো একদিন ডাকতাম তোকে। খুব জরুরি একটা কাজ বাকি পড়ে আছে যে।’

মাহিরের বন্ধুমহলের একমাত্র প্রিয় বন্ধু রিয়াল। নিজের সুখ দুঃখ সমস্তটাই এই বন্ধুর কাছে খোলা বইয়ের ন্যায়। তবে এই বন্ধু’ই যে কখনও তার সাথে এত বড়ো বেইমানি করবে তা কল্পনাও করেনি। সে কেন এমন করেছে সেটা এখনও অজানা। মাহির সেই সত্যিটা জানতেও চায় না। বন্ধুর প্রতি এক অন্তরীক্ষ ক্ষোভ থাকা স্বত্ত্বেও তাকে আঘাত করতে চায় না সে। তাই নিজেকে যথাসাধ্য আত্মস্থ করে ফের বলল,

‘অন্যায় করেছিলি, আজ সুযোগ পেয়েছিস ক্ষমা চেয়ে নে।’

রিয়াল কপাল কুঁচকাল। মাহির কোন অন্যায়ের কথা বলছে বোধগম্য হলো না তার। পরক্ষণেই আবার ভাবল, মাহির কি সব জেনে গিয়েছে তবে। রিয়াল একপলক শশীর দিকে চাইল। চোখের পাতা ঝাপ্টে শশী আশ্বস্ত করল তাকে। রিয়াল হেসে জানতে চাইল,

‘ক্ষুমা চাইব? কীসের জন্য?’

মাহির ঘুরে একবার অন্বিতার বিক্ষিপ্ত মুখটা দেখে নিয়ে বলল,

‘সেদিনের পুরো ঘটনা জানি আমি। অযথা কথা বাড়াস না, অন্বিতার কাছে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে যা এখান থেকে।’

গোলমাল হয়ে গেল বোধ হয়। শশী, জিনিয়া বেগমও আঁতকে উঠলেন। মাহির জানে সব? কই কখনও তো তাদের কিছু বলেনি। রিয়াল চোয়াল শক্ত করে শশীর দিকে চাইল। শশীর জবুথবু অবস্থা। রিয়াল গুমোট স্বরে বলল,

‘সেদিন যা হয়েছিল সবই জানিস, তারপরেও ক্ষমা চাওয়ার কথা বলছিস কোন আক্কেলে?’

‘সব জানি বলেই ক্ষমা চাইতে বলছি।’

অন্বিতার মা খালা এসব ব্যাপারে অবগত নন, দাদু বা তাইভিদও না। যারা বিষয়টা জানেন না তারা হতভম্ব হয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন। রিয়াল শক্ত গলায় বলল,

‘আমি এখানে ক্ষমা চাইতে আসিনি।’

‘কেন এসেছিস তবে? নিজের কুৎসিত ফন্দি এঁটে আবার অন্বিতাকে হেনস্থা করার জন্য?’

চেঁচিয়ে উঠল মাহির। রিয়াল হাসল। বলল,

‘শুধু আমি’ই সব করেছি না-কি? আশ্চর্য! তুই শুধু আমার দিকেই আঙ্গুল তুলছিস কেন?’

মাহির রেগে বলল,

‘তোর মতো জঘন্য চিন্তা ভাবনা আর কারোর নেই। নিজের দোষ অন্যের উপর চাপাবি না।’

শব্দ করে হাসল রিয়াল। বলল,

‘মানলাম, আমার চিন্তা না হয় জঘন্য। কিন্তু তোর পরিবারের মানুষ, তাদের চিন্তা তো আমার থেকেও জঘন্য। তারা যদি এমন জঘন্য চিন্তা ভাবনা নিয়ে দিব্যি নেচে কুদে বেড়াতে পারে, তবে আমার বেলায়’ই কেন এত কঠোরতা?’

মাহির ভ্রু কুঁচকাল। ঢোক গিললেন জিনিয়া বেগম আর শশী। ইশারায় থামতে বললেন রিয়ালকে। মাহির জিজ্ঞেস করল,

‘আমার পরিবার মানে? কাদের কথা বলছিস তুই?’

বার কয়েকবার চোখের পাতা ঝাপ্টে রিয়াল বলল,

‘সেকি! তুই না বললি, সব জানিস? আর এইদিকে ঘটনার পেছনে মূল হোতা কে সেটাই জানিস না?’

কপালে ভাঁজ পড়ল লম্বালম্বি ভাবে। সিসি টিভি ফুটেজে তো সে কেবল রিয়ালকেই দেখেছিল। তাহলে এর পেছনে তার পরিবারের লোক যুক্ত হলো কী করে? উদ্বিগ্ন সুরে মাহির শুধাল,

‘খোলাখুলি বল। কাদের কথা বলছিস তুই?’

শশী মায়ের হাতটা চেপে ধরল। ধরা পড়ার ভয়ে মুখটা নিভে গেল তার। জিনিয়া বেগম থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। বাকি জনতা চেয়ে আছে উৎসুক চোখে। খালামনি আসিয়া বেগমকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এসব কী হচ্ছে বলো তো, আপা?’

আসিয়া বেগম চিন্তিত সুরে জবাব দিলেন,

‘আমিও তো বুঝতে পারছি না কিছু।’

রিয়াল একবার শশী আর জিনিয়া বেগমকে দেখে নিল। এই স্বল্প সময়ের দৃষ্টি বিনিময়ের মাঝেও তারা দুজন চোখের ইশারায় আকুতি জানাল, যেন সে মাহিরকে সত্যিটা না জানায়। কিন্তু শয়তান কি আর একা বিপদে ফাঁসতে চায়, বিপদে পড়লে সে নিজের সঙ্গীদের সাথে নিয়েই পড়ে। রিয়ালও দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,

‘তোর ফুপি আর উনার মেয়ে শশী, এই পুরো ঘটনার মূল কারসাজি উনারাই করেছেন। উনাদের কথাতেই আমি সব করেছি। তার বিনিময়ে পেয়েছি মোটা অঙ্কের টাকা।’

মাহির থমকে গেল। চারদিক হয়ে পড়ল নিস্তব্ধ। সেদিন অন্বিতার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলাতে পরবর্তীতে তাদের প্রতি মাহিরের ক্ষোভ থাকলেও সে এটা জানত না যে এই পুরো ঘটনা তাদের ইশারাতেই ঘটেছে। কী আশ্চর্য! তার কাছের মানুষগুলো এভাবে কষ্ট দিল তাকে। ঢোক গিলল মাহির। অন্বিতার প্রথমেই এমনটা মনে হয়েছিল, প্রমাণ ছিল না বলে কখনও এই কথা আর গলা দিয়ে বের করেনি।

জিনিয়া বেগমের দিকে তাকাল মাহির। জিনিয়া বেগমের নতজানু। চোখ তুলে তাকানোর উদ্যম নেই। পাশে শশীও শঙ্কিত বদনে দাঁড়ান। মাহির জড়ানো স্বরে বলল,

‘মায়ের পর আমি সবথেকে বেশি তোমাকেই সম্মান করতাম, ফুপি। তুমি কী করে এমনটা করতে পারলে?’

জিনিয়া বেগম শুকনো মুখে চাইলেন। কম্পিত স্বরে বললেন,

‘বিশ্বাস কর বাবা..’

বাকি কথা শেষ করার আগেই হাত উঠিয়ে তাঁকে থামিয়ে দেয় মাহির। ধরা গলায় বলে,

‘আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। ভুল আমার’ই।’

সমস্ত বিষয়টা অবলোকন করে এই পর্যায়ে দাদু লাঠি ভর করে উঠে এলেন মাহিরের সমীপে। মাহিরের কাঁধ চেপে জিজ্ঞেস করলেন,

‘দাদুভাই, কী হয়েছে? পুরো ঘটনা আমাকে বলো তো।’

মাহির বিধ্বস্ত চোখে দাদুর দিকে চাইল। এই বিদঘুটে সত্যিটা মনে ভারী আঘাত করেছে তার। অন্বিতা ফ্যালফ্যাল চোখে মাহিরকে দেখছে। তার চোখ মুখের অসহায়ত্ব তাকে পীড়া দিচ্ছে বড্ড। না চাইতেও ক্লান্ত স্বরে দাদুকে সব খুলে বলল মাহির। পুরো ঘটনা শুনে হতভম্ব, হতবাক অন্বিতার মা, খালামনি আর তাইভিদ। আসিয়া বেগম এসবের কিছুই জানতেন না। মাহিরের সাথে সম্পর্কের কথাটাও জানতেন হালকা পাতলা ভাবে। অত গভীরে কখনও হাতিয়ে দেখেননি তিনি। তাইভিদ নাক মুখ কুঁচকে শশীর দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে আওড়াল,

‘একটা মানুষ এত জঘন্য হয় কী করে?’

সব শুনে দাদু বললেন,

‘সবকিছু যে জিনিয়া আর শশীর কথাতেই হয়েছে তার কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে, রিয়াল?’

রিয়াল রূঢ় সুরে বলল,

‘আপনার প্রমাণ লাগবে, দাদু?’

‘হ্যাঁ। এতকিছুর পর তোমাকে আমার আর বিশ্বাস হচ্ছে না।’

জিনিয়া বেগম আর শশীর মুখে কিঞ্চিৎ আশার আলো। রিয়ালের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। আর তার মুখের কথার উপর ভিত্তি করে দাদু কিছু করবেন না, এই বিশ্বাসটুকু অন্তত আছে তাদের।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here