একটি_অপ্রেমের_গল্প #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪০।

0
111

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪০।

নিজের আর মাহিরের জন্য টেবিলে খাবার বাড়ছে অন্বিতা। ডাইনিং বরাবর ড্রয়িং রুম তাদের। সেখানে বসে টিভি দেখছে জিনিয়া বেগম আর শশী। অন্বিতা আসার পর থেকে শশীর নজর অবশ্য টিভির চেয়ে অন্বিতার দিকেই বেশি। অন্বিতার ভেজা চুল গায়ে জ্বালা দিচ্ছে তার। রোষপূর্ণ চোখে তাকে আপাদমস্তক দেখে কী যেন বিড়বিড় করছে। জিনিয়া বেগমও ক্ষান্ত নন। আড়চোখে অন্বিতাকে খেয়াল করলেন অনেকক্ষণ। তারপর বিদ্রুপের সুরে বললেন,

‘জমিদারের বউ কি-না, তাই সকাল এগারোটায় এসেছে নাস্তা করতে।’

আস্তে বললেও কথাটা ঠিক অন্বিতার কান অবধি গেল। তবে কিছু বলল না সে। টি শার্ট ঠিক করতে করতে নিচে নেমে এল মাহির। চেয়ার টেনে বসল। অন্বিতার দিকে চেয়ে বলল,

‘তুমিও বসে পড়ো।’

শশী নাক মুখ কুঁচকে চেয়ে আছে। জিনিয়া বেগমও তাই। নিজের সুপ্ত ক্রোধ আর ক্ষোভকে প্রশমিত করতে পারছেন না কিছুতেই। তাই তো বলে বসলেন,

‘বাবা আজ খেতে বসে অনেক কথা বলেছেন। বাড়ির বউ এত বেলা অবধি ঘুমায় না।’

‘চিন্তা করো না, ফুপি। আমি দাদুকে বুঝিয়ে বলব।’

মাহিরের এত শান্ত জবাব পেয়েও জিনিয়া বেগম ঠান্ডা হতে পারছেন না। মাহিরের পাশে অন্বিতাকে সহ্য হচ্ছে না তাঁর। উঠে চলে গেলেন তিনি। শশী একা বসে। অন্বিতা মাহিরকে বেড়ে বেড়ে খাওয়াচ্ছে। গা জ্বালা বাড়ছে তার। উঠে গেল সেও। বসার ঘরের ডানে লাগোয়া অলিন্দে গিয়ে দাঁড়াল। হাতে ফোন। অনেক খুঁজে একটা নাম্বার বের করতে সফল হলো অবশেষে।

সচরাচর বিয়ের অনুষ্ঠান সব দিনের আলোতে হলেও অন্বিতা আর মাহিরের রিসেপশনের আয়োজন হলো রাতে। উদ্ভাসিত অম্বরতল তখন পতনোন্মুখ। দিনের ম্লান অংশু ইতমধ্যেই নিরুদ্দেশ। পথে তাই জ্বলে উঠেছে হরিদ্রাভ। অন্বিতার সাজ শেষ হয়েছে মাত্রই। পার্লারের মেয়ে দুজন বেরিয়ে যেতেই ঘরে প্রবেশ করল মাহির। সৌম্যদর্শন যুবকের দিকে একপলক চেয়ে চোখ নামাল অন্বিতা। মাহির এগিয়ে এল শ্লতগতিতে। অন্বিতার অভিমুখে দাঁড়াল। সাদা রঙের জর্জেট শাড়ি গায়ে তার। মুখে প্রসাধনীর নিখুঁত ছোঁয়া। ড্রেসিং টেবিল বরাবর হেলান দিয়েছে মাহির। অন্বিতার চোখ মুখ পূর্ণ মেদুর চোখে দেখছে। সব ঠিক। তবে হঠাৎ মাথা কাত করে সে বলল,

‘অন্বি, তোমার নাক ফোড়ানো না, তাই না?’

অবাক হয়ে অন্বিতা তাকাল। বলল,

‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’

মাহির প্রসন্ন গলায় বলল,

‘নাকে ছোট্ট একটা পাথর থাকলে বেশ মানাতো।’

আয়নার দিকে তাকাল অন্বিতা। একটুক্ষণ নিজেকে দেখে নিয়ে তার টিপের পাতা থেকে একটা সাদা পাথরের টিপ তুলে নাকের বাম পাশে লাগাল। তারপর মাহিরের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বলল,

‘এবার ঠিক আছে?’

অন্বিতার উপস্থিত বুদ্ধি দেখে মাহির হা করে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। পরক্ষণেই আবার হেসে বলল,

‘আমার বউয়ের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। চমৎকার লাগছে।’

লজ্জা পেল অন্বিতা। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘এবার যাওয়া যাক, সবাই বোধ হয় সেন্টারে চলে গিয়েছে।’

অন্বিতা পার্সটা হাতে নিল। মাহির সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভাঁজ করা বাহুটা এগিয়ে দিল অন্বিতার দিকে। তা দেখে মৃদু হাসল অন্বিতা। মাহিরের বাহুর ভাঁজে নিজের হাত প্রবেশ করিয়ে হাঁটা ধরল দুজন।

বিয়েতে তেমন আড়ম্বরতা না থাকলেও রিসেপশনে বিরাট আয়োজন। আত্মীয়-স্বজন কেউ বাকি নেই হয়তো। মাহিরের গ্রাম আর তার নার্সিংহোম থেকে অনেক মানুষ এসেছে। অন্বিতার পরিবার থেকে এসেছে কেবল তার মা, খালা আর তাঁর ছেলে, আর এসেছে আভা। মা’কে দেখে জড়িয়ে ধরল অন্বিতা। কেবল এক রাতের ব্যবধানে মনে হচ্ছে যেন কত কাল বাদে এই দেখা। আসিয়া বেগম মেয়েকে আদর করে দিলেন। খালামনিও ভালোবাসা জানালেন। তার ছোট্ট খালাতো ভাই এবার ক্লাস থ্রি তে পড়ে। তাকে গাল টেনে আদর করল মাহির। আভা ছুটে এল বান্ধবীর কাছে। তার গলা জড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘দোস্ত, আমার আর তর সইছে না।’

‘কীসের জন্য?’

আভা ছাড়ল তাকে। লজ্জা পাওয়ার ভান করে বলল,

‘তোর বাসর রাতের গল্প শোনার জন্য।’

অন্বিতা তার হাতে আস্তে করে চড় বসিয়ে বলল,

‘খুব ফাজিল হয়েছিস। আজকেও আংকেলকে আনিসনি?’

‘বলেছিলাম তো, কিন্তু বাবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত বলে আসেননি।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এইদিকে আয়, কয়েকটা ছবি তুলি।’

সবাই ছবি তুলল অনেকক্ষণ। তারপর মাহির তাইভিদকে ডেকে তাদের খেতে পাঠাল। মাহিরের পক্ষ থেকে তাইভিদ সব সামলাচ্ছে। আত্মীয়-স্বজন থেকে ধরে প্রত্যেকটা মানুষকে সে আপ্যায়ন করছে সরস মুখে। হাতে একটা সফট ড্রিংকস্ এর ট্রে নিয়ে তাইভিদ ব্যস্ত পায়ে আগাচ্ছিল। অন্বিতার পরিবারের জন্য নিয়েছে এগুলো। তন্মধ্যে পেছন থেকে কেউ বলে উঠে,

‘হেই ওয়েটার, একটা ড্রিংকস্ আমাকে দিয়ে যান।’

পা থামল তাইভিদের। পেছন ফিরে তাকাল। দেখল শশী তার দিকে বক্র হেসে চেয়ে আছে। শশী নিজে থেকেই এগিয়ে এসে ট্রে থেকে ড্রিংকস্ নিতে চাইলে ট্রে’টা সরিয়ে নেয় তাইভিদ। বলে,

‘এগুলো অন্বিতা ম্যাডামের পরিবারের জন্য। আপনার প্রয়োজন হলে ড্রিংকস সেকশন থেকে নিজে নিয়ে খান।’

তাইভিদের কথায় ক্রোধ বাড়লেও শশী হাসল। বলল,

‘ঠিক আছে, উনাদের দিয়ে আমার জন্য নিয়ে আসবেন।’

‘দুঃখিত ম্যাডাম, আমি আপনার অর্ডার শোনার জন্য এখানে আসিনি।’

এই বলে ফের পা বাড়ায় সে। শশী রুষ্ট হলো ভীষণ। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালাল। এই ছেলেটার একটা ব্যবস্থা না করা অবধি মনে শান্তি পাবে না বোধ হয়।

বিভিন্ন রকমের পোস দিতে দিতে মহাবিরক্ত মাহির। তার কুঁচকানো মুখ দেখে ঠোঁট চেপে হাসল অন্বিতা। ক্ষীণ সুরে বলল,

‘কী ব্যাপার ডাক্তার সাহেব, এত অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠলেন যে?’

মাহির ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখে অন্বিতা ঠোঁট চেপে হাসছে। সে বিরক্ত হয়ে বলে,

‘এত ছবি তুলার কী আছে?’

‘ক্যামেরাম্যান তুমিই আনিয়েছ, আমি তো আর বলিনি।’

‘শুধুমাত্র স্মৃতি রাখব বলে কয়েকটা ছবি তুলতে চেয়েছিলাম, এখন আমার জন্মের মতো ছবি তোলার সাধ মিটে গিয়েছে।’

শব্দ করে হাসল অন্বিতা। তাকে হঠাৎ এভাবে হাসতে দেখে ক্যামেরাম্যান আর ভিডিয়োগ্রাফার অবাক। ক্যামেরাম্যান সেই সুযোগে অন্বিতার হাসির কয়েকটা অকপট ছবি তুলে নিল। দূর থেকে মেয়েকে এমন প্রাণবন্ত দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আসিয়া বেগম। খালামনি পাশ থেকে বললেন,

‘দোয়া করি, মেয়েটা আজীবন এভাবেই হাসি খুশি থাকুক।’

আসিয়া বেগম চোখের পাতা ঝাপটে বললেন,

‘আমিন।’

ফোন হাতে নিয়ে ব্যগ্র শশী। পায়চারি করছে অযথা। এক কোণে দাঁড়িয়ে দই খাচ্ছে আর শশীর শশব্যস্ত অভিব্যক্তির কারণ ঠাহর করার চেষ্টা চালাচ্ছে তাইভিদ। শশীর চঞ্চল বদনখানা দেখে মনে হচ্ছে, সে কারোর জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো। তন্মধ্যে দ্রুত হাঁটার দরুন শশীর ওড়না গিয়ে পাশের টেবিলের কোণায় আটকে যায়। ওড়নায় টান পড়তেই মেজাজ খারাপ হয় তার। এগিয়ে এসে সেটা খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু তার দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল মন সহজ কাজটাও করতে দিচ্ছে না তাকে। ওড়ানাটা টানও দিতে পারছে না ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়ে। এক ওড়না নিয়ে যুদ্ধ করতে দেখে দইয়ের গ্লাস রেখে এগিয়ে আসে তাইভিদ। নিজ উদ্যোগে টেবিলের কোণে লোহায় আটকে যাওয়া ওড়নাটা যত্ন সমেত খুলে আনে। শশীর হাতে তুলে দিয়ে বলে,

‘নতুন উপায় পেয়ে গেলেন। এবার স্যারকে সহসাই বলতে পারবেন, আমি আপনার ওড়না ধরে আপনার সাথে অসভ্যতামো করেছি।’

শশী ভ্রু কুঁচকাল। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘আপনার সাহায্যের প্রয়োজন আমার ছিল না, আমি নিজেই পারতাম।’

‘তা তো দেখছিলাম’ই। সামান্য ওড়নার সাথে না পেরে মুখ লাল করে ফেলেছিলেন।’

শশী সন্তপ্ত গলায় বলে,

‘আমাকে দেখতে কে বলেছে আপনাকে? ফলো করছেন আমায়?’

তাইভিদ ভ্রু উঁচিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

‘আমার এতটাও খারাপ সময় আসেনি যে আমি আপনাকে ফলো করব।’

শশীর রোষানলে দগ্ধ হওয়ার আগেই কেটে পড়ে তাইভিদ। রাগ হলেও সেদিকে আর নজর দিল না সে। গেইটের দিকে চেয়ে দেখল, কেউ আসছে কি-না।

ছবি তুলার পর্ব সবেই শেষ হয়েছে। ক্লান্ত হয়ে সজ্জিত সোফাটায় বসল অন্বিতা আর মাহির। তাইভিদকে ডাকল মাহির। তাকে জিজ্ঞেস করল মেহমানরা সবাই ঠিকঠাক মতো খেয়েছে কি-না। অন্বিতা কথা বলছে আভার সাথে। অয়নের নাম্বার নেওয়ার কথা শুনে অন্বিতার চোখ কপালে। এই মেয়ে তো চিতার চেয়েও দ্রুত দৌড়ায়। এত ব্যস্ততার মাঝেও সেখানে আচানক ভেসে এল পুরুষালী এক ভরাট স্বর। সেই স্বর অনুসরণ করে সামনে তাকাল সবাই। হতভম্ব, ক্ষুব্ধ হলো দুই জোড়া চোখ। বাতাবরণ তপ্ত হয়ে উঠল নিমিষেই। মাহির উঠে দাঁড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,

‘তুই এখানে?’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here