একটি_অপ্রেমের_গল্প #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪২।

0
113

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪২।

পর্দায় নিগূঢ় ভাবে ফুটে উঠল কিছু মুখোশধারী মানুষের মুখোশের আঁড়ালের কুৎসিত চিত্রগুলো। উপস্থিত মানুষগুলো হতভম্ব, হতবাক। রা নেই কারোর মুখে। মাহিরের নিষ্পলক, নিস্তেজ চাহনি। অন্বিতার চোখে মুখে হতাশা, মাহিরের জন্য বড্ড খারাপ লাগছে তার। পনেরো মিনিটের ভিডিয়োতে সমস্ত ঘটনার আদ্যোপান্ত শোনা গেল, দেখা গেল। ঘৃণায় শরীর রি রি করছে আসিয়া বেগমের। নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের সাথে এত বড়ো অন্যায় তারা কী করে করতে পারে। ভিডিয়োটা বন্ধ করে রিয়াল দাদুর সমীপে দাঁড়াল। নিরুত্তাপ সুরে শুধাল,

‘আপনার কি আর কিছু বলার আছে, দাদু?’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দাদু। বয়স হয়েছে উনার। এই বয়সে এসে মেয়ে আর নাতনির এহেন রূপ দেখে পীড়িত হয়েছেন তিনি। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। জিনিয়া বেগমের সামনে গেলেন। মাথা তুলে তাকানোর মতো বিন্দুমাত্র সাহস আর অবশিষ্ট নেই মা আর মেয়ের। জিনিয়া বেগম ভীত, নির্জীব। দাদু মেঘমন্দ্র সুরে বলে উঠলেন,

‘এই শিক্ষা’ই আমি দিয়েছি তোমায়? এই দিন দেখার জন্যই কি আমি বেঁচে আছি?’

শশী চোখ তুলে আকুতি করতে চাইল। বলল,

‘নানুভাই, আমরা আসলে..’

‘থামো।’

চেঁচিয়ে উঠলেন দাদু। তিনি কাঁপছেন। আদর্শবান মানুষ তিনি। গ্রামের মানুষ ফেরেশতার চোখে তাঁকে দেখে। আর আজ তার’ই মেয়ে আর নাতনির এই অধঃপতন তিনি মেনে নিতে পারছেন না। অন্বিতা মাহিরের কাছে এল। উদ্বেগ নিয়ে বলল,

‘দাদুকে সামলাও, মাহির। নয়তো উনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’

মাহির ছুটে গেল দাদুর কাছে। বৃদ্ধকে একহাতে আগলে ধরে বলল,

‘শান্ত হও, দাদু। এখানে এসে বসো।’

তাঁকে চেয়ারে বসায় মাহির। ইশারায় তাইভিদকে পানি আনতে বলে। তাইভিদ পানি এনে দেয়। মাহির দাদুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কোমল স্বরে বলে,

‘পানি’টা খাও, দাদু।’

দাদু এক ঢোক গিললেন বোধ হয়। চোখ মুখ দৃঢ় উনার। লাঠি ধরে রাখা হাতটা ঠকঠক করে কাঁপছে। মাহির সেই হাতে হাত বুলিয়ে বলল,

‘অস্থির হয়ো না, অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।’

দাদু শ্বাস টানলেন খানিক জোরে। সন্তপ্ত সুরে বললেন,

‘তোমরা কী করে এসব করতে পারলে? এভাবে একটা মেয়েকে অসম্মান করার সাহস হলো কী করে? বিবেক বুদ্ধি কিছু নেই? এত জঘন্য তোমরা? এসব করার আগে একবার নিজের ভাতিজার কথাও কি স্মরণে আসেনি, জিনিয়া? ও তোমাকে নিজের মায়ের জায়গা দিয়েছিল, আর তুমি? ছি:’

বাবার কথা শুনে কেঁপে উঠলেন জিনিয়া বেগম। জীবদ্দশায় কখনও বাবার এমন তোপের মুখে তিনি পড়েননি। চোখ ভিজে উঠে উনার। তিনি ছুটে এসে বাবার পায়ের কাছে পড়েন। হাত জোড় করে আকুতি জানিয়ে বলেন,

‘আমায় ক্ষমা করো, বাবা। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।’

মাহির উঠে দাঁড়াল। দাদু মুখ ঘুরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। রূঢ় সুরে বললেন,

‘কারোর বাবা বলে আমি অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করব না। চোখের সামনে থেকে চলে যাও, আর কখনও আমি তোমাদের মুখ অবধি দেখতে চাই না।’

জিনিয়া বেগম আঁতকে উঠলেন। বাবার পাযুগল জড়িয়ে ধরলেন সঙ্গে সঙ্গে। ক্রন্দনরত স্বরে বললেন,

‘এভাবে বলো না, বাবা। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? এভাবে আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। মাহির বাবা, ক্ষমা করে দে ফুপিকে।’

মাহির দাঁতে দাঁত চেপে অন্যদিকে চাইল। এই মানুষ দুজনকে সে ক্ষমা করতে পারবে না। এত বড়ো হৃদয় তার নয়। ছোট্ট বক্ষে এত আঘাত লুকিয়ে মানুষগুলোকে ক্ষমা করা অসম্ভব।

দাদু শক্ত গলায় বললেন,

‘মাহির, ওদের চলে যেতে বলো।’

জিনিয়া বেগম ব্যাকুল হয়ে উঠেন। বাবার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলেন,

‘এমন করো না, বাবা। ক্ষমা করো আমাদের। আমরা আর কখনও এমন করব না। প্রয়োজন পড়লে আমরা অন্বিতার পা ধরে ক্ষমা চাইব।’

‘তা তো অবশ্যই চাইবে। এখনই চাইবে। তুমি আর তোমার মেয়ে অন্বিতাসহ তার পুরো পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়ে এখান থেকে বিদায় হবে।’

শশী ক্ষুব্ধ চোখে তাকাল। সে সবার কাছে ক্ষমা চাইতে পারবে না। তার অহমিকায় আঘাত করবে এমন কিছুই সে করবে না। জিনিয়া বেগম উঠে দাঁড়ালেন। অন্বিতার দিকে এগিয়ে গেলেন তারপর। আচমকা তার পায়ের কাছে বসে যেতেই ঘাবড়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায় অন্বিতা। কম্পিত স্বরে বলে উঠে,

‘এসব কী করছেন? উঠুন।’

জিনিয়া বেগম মাথা তুলে চেয়ে বলেন,

‘আমাকে ক্ষমা করে দাও, অন্বিতা। আমার অনেক বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে।’

অন্বিতা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মাহিরের দিকে তাকায় একবার। মাহিরের অভিব্যক্তির কোনো বদল না দেখে ইতস্তত সুরে বলে,

‘ক্ষমা চাইতে হবে না। উঠুন আপনি।’

‘না না, তুমি ক্ষমা না করলে বাবাও যে আমায় ক্ষমা করবেন না।’

অন্বিতা নীরব দাঁড়িয়ে থাকে। মাহির এগিয়ে আসে তখন। আমর্ষ স্বরে বলে,

‘তোমরা ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য। আজ থেকে তোমাদের সাথে আমার আর আমার স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই, চলে যাও এখান থেকে।’

জিনিয়া বেগম অনেক ভাবে আকুতি জানালেন। সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু ক্ষমা করল না কেউ। নিজের বাবাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তাঁর কাছ থেকে। ভগ্ন আর ব্যথিত হৃদয়ে মেয়েকে নিয়ে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর চোখে মুখে কিঞ্চিৎ অনুশোচনার দেখা মিললেও তাঁর মেয়ের চোখ মুখ ছিল দৃঢ়। আমিত্বের বেড়া জালে আটকে যাওয়া ব্যক্তিত্ব ছাপিয়ে পরিতাপের কোনো দেখা মিলল না তার মাঝে।

বাতাবরণে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসা দাদু, মেয়ের অন্যায়ের ভারী বোঝায় শৃঙ্খলিত। মাহির এগিয়ে গিয়ে রিয়ালের নিকটে দাঁড়ায়। রিয়াল ঠোঁট খুলে বলতে নেয় কিছু। থামিয়ে দেয় মাহির। যথাসাধ্য ঠান্ডা গলায় বলে,

‘তোর অপরাধও কোনো অংশে কম নয়। আমার বিশ্বাসে আঘাত করেছিস তোরা প্রতিটা মানুষ। আর তুই আঘাত করেছিস আমার ভালোবাসাতেও। এত আঘাতের পর তোকে আর ক্ষমা করা সম্ভব না। সামান্য কয়টা টাকার লোভে বন্ধুর বুক চিরতে যার হাত কাঁপেনি সে বন্ধু নামের কলঙ্ক। তোকে আঘাত করতে হাত নিশপিশ করছে আমার। নিজেকে সামলে রাখতে পারছি না। চলে যা এখান থেকে, আর কখনও আমার সামনে আসবি না।’

রিয়াল তেজ দেখিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। মাহির তাইভিদকে বলল,

‘দাদুকে নিয়ে আপনি বাসায় যান, তাইভিদ। আমরা আসছি।’

তাইভিদ মাথা হেলিয়ে দাদুকে ধরে উঠাল। লাঠি সমেত দাদু এগিয়ে গেলেন অন্বিতার মায়ের কাছে। তিনি অনুনয়ের স্বরে বললেন,

‘আমাদের ক্ষমা করবেন। এমন কিছু হয়েছে আমি জানতাম’ই না। জানলে আরো আগেই এই অন্যায়ের বিচার করতাম।’

আসিয়া বেগম ইতস্তত সুরে বললেন,

‘না না, আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে না। আমার মেয়ের বাকি জীবন যেন সসম্মানে কাটে শুধু সেইটুকু দেখলেই হবে।’

‘চিন্তা করবেন না। আমার নাতি আর নাতবউকে আমি আগলে রাখব।’

আসিয়া বেগম মলিন হেসে কৃতজ্ঞতা জানালেন। দাদু অন্বিতার দিকে চাইলেন। বললেন,

‘বুবু, এই বুড়ো দাদুকে তুমি ক্ষমা করতে পারবে তো?’

অন্বিতা দাদুর সামনে এল। নরম গলায় বলল,

‘আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন, দাদু? এখানে তো আপনার কোনো দোষ নেই। আর যা হয়েছে আমি সব ভুলে গিয়েছি, আপনিও আর এসব ভেবে কষ্ট পাবেন না।’

দাদু অন্বিতার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন,

‘দোয়া করি, জীবনে অনেক সুখী হও।’

তাইভিদ দাদুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বিষন্নতার ভীড়ে তলিয়ে যাওয়া মাহির চোখ তুলে তাকাল আসিয়া বেগমের দিকে। বলল,

‘মা, আমি নিজেও এতকিছু জানতাম না। ঐ মানুষগুলোর জন্য আমিও অন্বিতাকে কম ভুল বুঝেনি। অন্যায় তো আমিও করেছি। তার জন্য অন্বিতা আমাকে ক্ষমা করে দিলেও আমি নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না। আপনার কাছেও আজ ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই আমার।’

বিধ্বস্ত হয়ে একটা চেয়ারে বসল মাহির। আসিয়া বেগম এগিয়ে এসে মাহিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘মা ডেকেছ না, তাহলে মায়ের কাছে এত জড়তা দেখাচ্ছ কেন? তুমি ভুল কিছু করোনি, ঐ মানুষগুলো চোখ বেঁধে দিয়েছিল তোমার। চোখে পট্টি থাকলে মানুষ ডান বাম দেখবে না সেটাই স্বাভাবিক। যা হয়েছে এখন সব ভুলে যাও, বাবা। আমার মেয়েটাকে নিয়ে সুখী হও, এই দোয়াই করি।’

নিষ্প্রভ হাসল মাহির। বলল,

‘দোয়া করবেন, মা। আমি যেন অন্বিতাকে এক অন্তরীক্ষ সুখ দিতে পারি।’

‘পারবে তুমি। আমার বিশ্বাস আছে।’

চলবে….

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৩।

রিসেপশনের পর অন্বিতার বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দাদুকে একা ফেলে যেতে মাহিরের মন সায় দেয় না। অন্বিতাও ঠাহর করতে পারে সেটা। তাই মাহিরকে আশ্বস্ত করে বলে, তারা না হয় কাল যাবে, আজ থাক।

মা, খালামনি আর আভাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসল অন্বিতা। বেশ রাত হয়েছে। শহরের রাস্তায় ব্যস্ততা কমে এসেছে। মাহিরও এসে বসল অপর পাশের সিটে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল।

সিটে হেলান দিয়ে বসে চোখ মুদে নিল মাহির। জানলা নামানো। সাঁ সাঁ বাতাস ঢুকছে ভেতরে। বাইরের হরিদ্রাভে মাঝে মাঝেই গাড়ির ভেতরটা আলোকিত হচ্ছে, আবার মিইয়ে যাচ্ছে খানিক বাদেই। অন্বিতা বাইরে থেকে চোখ সরাল।
তাকাল মাহিরের ব্যথিত মুখপানে। সাঁঝ বেলাতেও চোখে মুখে যে দীপ্ততা ছিল তা আর এখন নেই। কেমন শুকনো মুখ যেন। অন্বিতা তার হাতের উপর হাত রাখল। নরম উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে হাতখানা জড়িয়ে ধরল মাহির। বিমর্ষ স্বরে বলে উঠল,

‘এমনটা তো না হলেও পারত, অন্বি। আমি যে ঐ মানুষগুলোকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না’

মাহিরের বাহুতে মাথা এলিয়ে দিল অন্বিতা। অন্যহাতে তার হাত জড়িয়ে ধরল। নরম গলায় বলল,

‘সব ভুলে যাও না, মাহির। এভাবে কষ্ট পেলে যে আমারও খারাপ লাগবে।’

মাহির অন্বিতার হাতটা উপরে তুলে হাতের পিঠে চুমু খেল। তারপর হাতখানা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,

‘ভুলে যাওয়ার মতো কঠিন কাজ বোধ হয় দুটো হয় না। তাও চেষ্টা করব আমি। তোমার সাথে অন্যায় করা মানুষগুলোকে আমি আমার স্মৃতি থেকে মুছে দিব একেবারে, তাতে যদি নিজের অনুতাপের দহন থেকে একটু বাঁচতে পারি।’

অন্বিতা চোখ তুলে মাহিরের দিকে তাকাল। আবিষ্ট সুরে বলল,

‘এভাবে বলো না। কোনো কিছু নিয়ে তোমাকে অনুতপ্ত হতে হবে না। সব আমি ভুলে গিয়েছি। তোমার ভালোবাসা সব ভুলিয়ে দিয়েছে। আর এসব নিয়ে ভাববে না একদম।’

মাহির চোখ মেলে তাকিয়ে অন্বিতার পরিশ্রান্ত বদন দেখে মৃদু হাসল। মেয়েটা কী নিঁখুত করে তাকে ভালোবাসে, আগলে রাখে। আর সে কি-না এই মেয়েটাকেই একদিন ভুল বুঝেছিল। ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলে অন্বিতার ললাটে এক গাঢ় চুম্বন এঁকে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল সে। পরম আবেশে, উষ্ণ বক্ষের মাঝে নিজেকে গুঁটিয়ে নেয় অন্বিতা। চোখ বুজে চুপটি করে থাকে। মাহিরও চোখের পাতা নিমীলিত করে। প্রেয়সীকে বুকে পেয়ে চিত্তের অস্থিরতা প্রশমিত হচ্ছে তার। ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে সব বিষন্নতা। এভাবেই যদি এক যুগ পার করা যেত, তবে মন্দ হতো না।

দাদুকে একবার দেখে রুমে আসে মাহির। অন্বিতা ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,

‘দাদু শুয়েছেন?’

মাহির হাত থেকে ঘড়ি খুলতে খুলতে জবাব দেয়,

‘হ্যাঁ।’

ঝাড়া শেষ করে বিছানার ঝাড়ুটা সাইডে রেখে বসল অন্বিতা। জিজ্ঞেস করল,

‘তাইভিদ কি দাদুর রুমেই শুয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, আমিই বলেছি আজ ঐ রুমে শোয়ার জন্য। দাদুকে দেখে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, ভীষণ ভেঙে পড়েছেন।’

মাহির এসে অন্বিতার পাশে বসল। অন্বিতা বলল,

‘দাদুর সামনে তুমি আর নরম হয়ো না, তাতে দাদুর কষ্ট বাড়বে। বরঞ্চ এমন ব্যবহার করবে যেন কিছুই হয়নি, এসবে তোমার কিছু যায় আসে না।’

মাহির মাথা নুইয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘ঠিক আছে, শুয়ে পড়ো এবার। রাত কম হয়নি।’

চিন্তিত সুরে অন্বিতা বলল,

‘মা আমাকে খাইয়ে দিলেও তুমি তো একেবারে কিছুই মুখে নাওনি, এখন কিছু খেয়ে নাও।’

মাহির মলিন হেসে বলল,

‘খিদে নেই এখন। ভীষণ ক্লান্ত, একটু ঘুমোলে বোধ হয় ভালো লাগবে।’

এই বলে মাহির শোয়ার আয়োজন করল। অন্বিতা শুধাল,

‘একেবারে না খেয়ে শুবে?’

ততক্ষণে বালিশ টেনে শুয়ে পড়েছে মাহির। বলল,

‘হ্যাঁ। চিন্তা করো না, আমার অভ্যাস আছে। বাতি নিভিয়ে তুমিও শুয়ে পড়ো।’

মাহিরের ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মনের কথা বুঝতে পেরে অন্বিতা আর তাকে ঘাটাল না। চুপচাপ বাতি নিভিয়ে এসে পাশে শুয়ে পড়ল। অনেক ক্লান্ত বিধায় শোয়ার সাথে সাথেই চোখ লেগে গিয়েছিল তার। তবে কাঁচা ঘুমটা ছুটে গেল মাহিরের আচমকা টানে। অতি নিবিড়, নিগূঢ় ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে সে অন্বিতাকে বুকে জড়িয়ে নিল। যেন ছেড়ে দিলেই সে পালাবে। বুকের সাথে মিশে শ্বাস টানল অন্বিতা। মাহিরের শরীরের পুরুষালী ভারী ঘ্রাণ শরীরে শিহরণ জাগায় যেন। উন্মত্ত চিত্তকে দমিয়ে রেখে অন্বিতাও হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। বিড়বিড় করে কী যেন একটা বলল, যেটা মাহিরের বোধগম্য হলো না ঠিক।

নব্য প্রত্যুষ। বাইরে বিভাবসুর দাপটে খা খা করছে বাতাবরণ। অতীতের আবলুস ভেদ করে বর্তমানের জৌলস বোধহয়। অন্বিতা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। বড়ো করে হাই তুলে দেখল পাশে মাহির নেই। উঠে পড়ল সে। ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।

রুম এখনও ফাঁকা। মুখ মুছে অন্বিতা রুম থেকে বের হলো। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই দেখল সবাইকে। মাহির, দাদু আর তাইভিদ বসার ঘরের সোফায় বসে কথা বলছে। অন্বিতা দাদুকে সালাম দিল। সালামের উত্তর দিলেন দাদু। অন্বিতা প্রসন্ন গলায় শুধাল,

‘খেয়েছেন, দাদু?’

‘হ্যাঁ দাদুমনি, খেয়েছি। তুমি মাহিরকে নিয়ে খেয়ে নাও। ও তোমার অপেক্ষায় ছিল। আর তারপর মাহিরকে নিয়ে তৈরি হয়ে তোমার বাসায় চলে যেও, যদিও কাল’ই যাওয়া উচিত ছিল তোমাদের।’

অন্বিতা চিন্তিত সুরে বলল,

‘দাদু, এখানে কি আপনি একা থাকবেন? আমরা না হয় কয়দিন পর যাব।’

‘চিন্তা করো না, তাইভিদ আছে এখানে। আর আমি একা থাকতে পারতাম, গ্রামে তো প্রায়’ই থাকি। কিন্তু তোমার বর তো নাছোড়বান্দা, তাইভিদকে এখানেই রেখে দিয়েছে।’

‘এটা ভালো হয়েছে, দাদু। তাইভিদ থাকলে আমরাও নিশ্চিন্ত থাকব।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া তো আমার আর উপায় নেই। বেশ, মেনে নিলাম। যাও, এবার খেতে বসো।’

অন্বিতা মৃদু হেসে ডাইনিং এর কাছে গেল। মাহিরও উঠে এল সেখানে।

__________

দাদুর হাতের মোবাইল’টা বাজছে ক্রমাগত। তিনি মোবাইল হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। হাতে ঔষধ নিয়ে সেই রুমে এল তাইভিদ। দাদুর কাছে আসতেই বেজে যাওয়া ফোনটা দেখে বলল,

‘দাদু, কেউ বোধ হয় কল দিচ্ছেন।’

দাদু তাইভিদের দিকে তাকালেন। মোবাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘তোমরা যে কী একটা করো না, যেটা করলে নাম্বার থেকে আর ফোন মেসেজ আসতে পারে না, ঐটা করে দাও তো।’

তাইভিদ প্রথমে বুঝল না। ফোনটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কী করার কথা বলছেন, দাদু?’

দাদু খানিক বিরক্ত নিয়ে বললেন,

‘আরে ছেলে, কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে না করলে তার নাম্বারটা কী জানি একটা করো, নামটা তো মনে পড়ছে না আমার…’

দাদু ভাবছেন। তাইভিদের টনক নড়ে। বলে উঠে,

‘ব্লক করার কথা বলছেন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই। এই নাম্বারটা ব্লক করো।’

এতক্ষণে স্ক্রিনের দিকে তাকাল সে। জিনিয়া নামটা দেখে ফ্যালফ্যাল করে চাইল দাদুর দিকে।

‘আমার দিকে চেয়ে আছো কেন? ব্লক করো।’

তাইভিদ ইতস্তত বোধ করে। তাও দাদুর আদেশ পালনে পিছপা হয় না সে। ব্লক করে ফোনটা দাদুর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বলে,

‘আপনার ঔষধ নিয়ে এসেছিলাম।’

____________

মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের জন্য এলাহি আয়োজন করেছেন আসিয়া বেগম। খালামনি চলে যেতে চাইলেও তিনি তাঁকে জোর করে রেখে দিয়েছেন। পাক্কা দুই দিন দুই রাত পর নিজের ঘর, নিজের কামরায় ফিরে মনটা প্রশান্তিতে যেন ভরে উঠল অন্বিতার। নিজের রুমের বিছানায় হাত মেলে শুয়ে পড়ল। তার পাশে এসে বসল মাহির। এর আগে আসলেও ওভাবে মনোযোগ দিয়ে রুমের কিছু দেখেনি সে। আজ দেখছে। দেয়ালে একটা ছবি দেখিয়ে বলল,

‘উনি তোমার বাবা?’

অন্বিতা সেদিকে চাইল। বলল,

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি পুরো তোমার বাবার মতো হয়েছ।’

সপ্রতিভ হয়ে অন্বিতা বলল,

‘হ্যাঁ, সবাই তাই বলে।’

আশেপাশে চোখ বুলিয়ে উঠে বারান্দায় গেল মাহির। তার পেছন পেছন গেল অন্বিতাও। স্বভাবতই পাশের বারান্দায় চোখ গেল তার। মাহির জিজ্ঞেস করল,

‘অমিত আর অয়ন ঐ ফ্ল্যাটেই থাকে?’

‘হু।’

‘অয়ন তোমাকে একটা উপহার দিয়েছিল, সেটা তো খুলে দেখলে না।’

এই উপহারের কথা বেমালুম ভুলে বসেছে অন্বিতা। মনে পড়তেই বলল,

‘মনে ছিল না, বাসায় ফিরে গিয়ে খুলব।’

মাহির নয়নতারা গাছের দিকে তাকাল। গোধূলির কমলা রঙা আলোয় তাকে কমলা সুন্দরী লাগছে। ফুলের ভারে বেচারি নুইয়ে পড়েছে বোধ হয়। মাহির এগিয়ে গিয়ে সেখান থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে। তারপর নির্মল হেসে অন্বিতার সমীপে দাঁড়িয়ে যত্ন করে সেই ফুল গুঁজে দেয় তার কানে। মুচকি হাসে অন্বিতা। অস্তগামী ভানুর সমস্ত রঙে মেয়েটার সফেদ গায়ের রং চকচক করছে যেন। মাহিরের লোভ হলো বড্ড। নরম পাপড়ির ন্যায় কপোলে ঠোঁট বসিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো সে। হকচকিয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল অন্বিতা। গালে হাত দিয়ে আশেপাশে চেয়ে দেখল কেউ দেখছে কি-না। অন্বিতার ভীত দৃষ্টি দেখে মাহির রগড় হেসে বলল,

‘দেখেনি কেউ।’

অন্বিতা গাল ঘঁষে বিড়বিড় করে বলল,

‘অসভ্য।’

পরক্ষণেই আবার আরেক গাল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘আরেক গালেও দাও, নয়তো বিয়ে হবে না।’

মাহির ক্ষুরধার চাহনি বর্তিয়ে তীক্ষ্ণ সুরে বলল,

‘তুমি আরো বিয়ের কথা ভাবছো?’

অন্বিতা দায়সারা ভাবে বলল,

‘ভাবতেই পারি।’

মাহির কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

‘তবে ঐ গালে জীবনেও চুমু দিব না। আজীবন এক গালেই চুমু দিয়ে যাব।’

চলবে…..

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here