একটি_অপ্রেমের_গল্প #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪৩।

0
99

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৩।

রিসেপশনের পর অন্বিতার বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দাদুকে একা ফেলে যেতে মাহিরের মন সায় দেয় না। অন্বিতাও ঠাহর করতে পারে সেটা। তাই মাহিরকে আশ্বস্ত করে বলে, তারা না হয় কাল যাবে, আজ থাক।

মা, খালামনি আর আভাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসল অন্বিতা। বেশ রাত হয়েছে। শহরের রাস্তায় ব্যস্ততা কমে এসেছে। মাহিরও এসে বসল অপর পাশের সিটে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল।

সিটে হেলান দিয়ে বসে চোখ মুদে নিল মাহির। জানলা নামানো। সাঁ সাঁ বাতাস ঢুকছে ভেতরে। বাইরের হরিদ্রাভে মাঝে মাঝেই গাড়ির ভেতরটা আলোকিত হচ্ছে, আবার মিইয়ে যাচ্ছে খানিক বাদেই। অন্বিতা বাইরে থেকে চোখ সরাল।
তাকাল মাহিরের ব্যথিত মুখপানে। সাঁঝ বেলাতেও চোখে মুখে যে দীপ্ততা ছিল তা আর এখন নেই। কেমন শুকনো মুখ যেন। অন্বিতা তার হাতের উপর হাত রাখল। নরম উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে হাতখানা জড়িয়ে ধরল মাহির। বিমর্ষ স্বরে বলে উঠল,

‘এমনটা তো না হলেও পারত, অন্বি। আমি যে ঐ মানুষগুলোকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না’

মাহিরের বাহুতে মাথা এলিয়ে দিল অন্বিতা। অন্যহাতে তার হাত জড়িয়ে ধরল। নরম গলায় বলল,

‘সব ভুলে যাও না, মাহির। এভাবে কষ্ট পেলে যে আমারও খারাপ লাগবে।’

মাহির অন্বিতার হাতটা উপরে তুলে হাতের পিঠে চুমু খেল। তারপর হাতখানা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,

‘ভুলে যাওয়ার মতো কঠিন কাজ বোধ হয় দুটো হয় না। তাও চেষ্টা করব আমি। তোমার সাথে অন্যায় করা মানুষগুলোকে আমি আমার স্মৃতি থেকে মুছে দিব একেবারে, তাতে যদি নিজের অনুতাপের দহন থেকে একটু বাঁচতে পারি।’

অন্বিতা চোখ তুলে মাহিরের দিকে তাকাল। আবিষ্ট সুরে বলল,

‘এভাবে বলো না। কোনো কিছু নিয়ে তোমাকে অনুতপ্ত হতে হবে না। সব আমি ভুলে গিয়েছি। তোমার ভালোবাসা সব ভুলিয়ে দিয়েছে। আর এসব নিয়ে ভাববে না একদম।’

মাহির চোখ মেলে তাকিয়ে অন্বিতার পরিশ্রান্ত বদন দেখে মৃদু হাসল। মেয়েটা কী নিঁখুত করে তাকে ভালোবাসে, আগলে রাখে। আর সে কি-না এই মেয়েটাকেই একদিন ভুল বুঝেছিল। ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলে অন্বিতার ললাটে এক গাঢ় চুম্বন এঁকে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল সে। পরম আবেশে, উষ্ণ বক্ষের মাঝে নিজেকে গুঁটিয়ে নেয় অন্বিতা। চোখ বুজে চুপটি করে থাকে। মাহিরও চোখের পাতা নিমীলিত করে। প্রেয়সীকে বুকে পেয়ে চিত্তের অস্থিরতা প্রশমিত হচ্ছে তার। ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে সব বিষন্নতা। এভাবেই যদি এক যুগ পার করা যেত, তবে মন্দ হতো না।

দাদুকে একবার দেখে রুমে আসে মাহির। অন্বিতা ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,

‘দাদু শুয়েছেন?’

মাহির হাত থেকে ঘড়ি খুলতে খুলতে জবাব দেয়,

‘হ্যাঁ।’

ঝাড়া শেষ করে বিছানার ঝাড়ুটা সাইডে রেখে বসল অন্বিতা। জিজ্ঞেস করল,

‘তাইভিদ কি দাদুর রুমেই শুয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, আমিই বলেছি আজ ঐ রুমে শোয়ার জন্য। দাদুকে দেখে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, ভীষণ ভেঙে পড়েছেন।’

মাহির এসে অন্বিতার পাশে বসল। অন্বিতা বলল,

‘দাদুর সামনে তুমি আর নরম হয়ো না, তাতে দাদুর কষ্ট বাড়বে। বরঞ্চ এমন ব্যবহার করবে যেন কিছুই হয়নি, এসবে তোমার কিছু যায় আসে না।’

মাহির মাথা নুইয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘ঠিক আছে, শুয়ে পড়ো এবার। রাত কম হয়নি।’

চিন্তিত সুরে অন্বিতা বলল,

‘মা আমাকে খাইয়ে দিলেও তুমি তো একেবারে কিছুই মুখে নাওনি, এখন কিছু খেয়ে নাও।’

মাহির মলিন হেসে বলল,

‘খিদে নেই এখন। ভীষণ ক্লান্ত, একটু ঘুমোলে বোধ হয় ভালো লাগবে।’

এই বলে মাহির শোয়ার আয়োজন করল। অন্বিতা শুধাল,

‘একেবারে না খেয়ে শুবে?’

ততক্ষণে বালিশ টেনে শুয়ে পড়েছে মাহির। বলল,

‘হ্যাঁ। চিন্তা করো না, আমার অভ্যাস আছে। বাতি নিভিয়ে তুমিও শুয়ে পড়ো।’

মাহিরের ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মনের কথা বুঝতে পেরে অন্বিতা আর তাকে ঘাটাল না। চুপচাপ বাতি নিভিয়ে এসে পাশে শুয়ে পড়ল। অনেক ক্লান্ত বিধায় শোয়ার সাথে সাথেই চোখ লেগে গিয়েছিল তার। তবে কাঁচা ঘুমটা ছুটে গেল মাহিরের আচমকা টানে। অতি নিবিড়, নিগূঢ় ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে সে অন্বিতাকে বুকে জড়িয়ে নিল। যেন ছেড়ে দিলেই সে পালাবে। বুকের সাথে মিশে শ্বাস টানল অন্বিতা। মাহিরের শরীরের পুরুষালী ভারী ঘ্রাণ শরীরে শিহরণ জাগায় যেন। উন্মত্ত চিত্তকে দমিয়ে রেখে অন্বিতাও হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। বিড়বিড় করে কী যেন একটা বলল, যেটা মাহিরের বোধগম্য হলো না ঠিক।

নব্য প্রত্যুষ। বাইরে বিভাবসুর দাপটে খা খা করছে বাতাবরণ। অতীতের আবলুস ভেদ করে বর্তমানের জৌলস বোধহয়। অন্বিতা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। বড়ো করে হাই তুলে দেখল পাশে মাহির নেই। উঠে পড়ল সে। ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।

রুম এখনও ফাঁকা। মুখ মুছে অন্বিতা রুম থেকে বের হলো। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই দেখল সবাইকে। মাহির, দাদু আর তাইভিদ বসার ঘরের সোফায় বসে কথা বলছে। অন্বিতা দাদুকে সালাম দিল। সালামের উত্তর দিলেন দাদু। অন্বিতা প্রসন্ন গলায় শুধাল,

‘খেয়েছেন, দাদু?’

‘হ্যাঁ দাদুমনি, খেয়েছি। তুমি মাহিরকে নিয়ে খেয়ে নাও। ও তোমার অপেক্ষায় ছিল। আর তারপর মাহিরকে নিয়ে তৈরি হয়ে তোমার বাসায় চলে যেও, যদিও কাল’ই যাওয়া উচিত ছিল তোমাদের।’

অন্বিতা চিন্তিত সুরে বলল,

‘দাদু, এখানে কি আপনি একা থাকবেন? আমরা না হয় কয়দিন পর যাব।’

‘চিন্তা করো না, তাইভিদ আছে এখানে। আর আমি একা থাকতে পারতাম, গ্রামে তো প্রায়’ই থাকি। কিন্তু তোমার বর তো নাছোড়বান্দা, তাইভিদকে এখানেই রেখে দিয়েছে।’

‘এটা ভালো হয়েছে, দাদু। তাইভিদ থাকলে আমরাও নিশ্চিন্ত থাকব।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া তো আমার আর উপায় নেই। বেশ, মেনে নিলাম। যাও, এবার খেতে বসো।’

অন্বিতা মৃদু হেসে ডাইনিং এর কাছে গেল। মাহিরও উঠে এল সেখানে।

__________

দাদুর হাতের মোবাইল’টা বাজছে ক্রমাগত। তিনি মোবাইল হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। হাতে ঔষধ নিয়ে সেই রুমে এল তাইভিদ। দাদুর কাছে আসতেই বেজে যাওয়া ফোনটা দেখে বলল,

‘দাদু, কেউ বোধ হয় কল দিচ্ছেন।’

দাদু তাইভিদের দিকে তাকালেন। মোবাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘তোমরা যে কী একটা করো না, যেটা করলে নাম্বার থেকে আর ফোন মেসেজ আসতে পারে না, ঐটা করে দাও তো।’

তাইভিদ প্রথমে বুঝল না। ফোনটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কী করার কথা বলছেন, দাদু?’

দাদু খানিক বিরক্ত নিয়ে বললেন,

‘আরে ছেলে, কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে না করলে তার নাম্বারটা কী জানি একটা করো, নামটা তো মনে পড়ছে না আমার…’

দাদু ভাবছেন। তাইভিদের টনক নড়ে। বলে উঠে,

‘ব্লক করার কথা বলছেন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই। এই নাম্বারটা ব্লক করো।’

এতক্ষণে স্ক্রিনের দিকে তাকাল সে। জিনিয়া নামটা দেখে ফ্যালফ্যাল করে চাইল দাদুর দিকে।

‘আমার দিকে চেয়ে আছো কেন? ব্লক করো।’

তাইভিদ ইতস্তত বোধ করে। তাও দাদুর আদেশ পালনে পিছপা হয় না সে। ব্লক করে ফোনটা দাদুর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বলে,

‘আপনার ঔষধ নিয়ে এসেছিলাম।’

____________

মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের জন্য এলাহি আয়োজন করেছেন আসিয়া বেগম। খালামনি চলে যেতে চাইলেও তিনি তাঁকে জোর করে রেখে দিয়েছেন। পাক্কা দুই দিন দুই রাত পর নিজের ঘর, নিজের কামরায় ফিরে মনটা প্রশান্তিতে যেন ভরে উঠল অন্বিতার। নিজের রুমের বিছানায় হাত মেলে শুয়ে পড়ল। তার পাশে এসে বসল মাহির। এর আগে আসলেও ওভাবে মনোযোগ দিয়ে রুমের কিছু দেখেনি সে। আজ দেখছে। দেয়ালে একটা ছবি দেখিয়ে বলল,

‘উনি তোমার বাবা?’

অন্বিতা সেদিকে চাইল। বলল,

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি পুরো তোমার বাবার মতো হয়েছ।’

সপ্রতিভ হয়ে অন্বিতা বলল,

‘হ্যাঁ, সবাই তাই বলে।’

আশেপাশে চোখ বুলিয়ে উঠে বারান্দায় গেল মাহির। তার পেছন পেছন গেল অন্বিতাও। স্বভাবতই পাশের বারান্দায় চোখ গেল তার। মাহির জিজ্ঞেস করল,

‘অমিত আর অয়ন ঐ ফ্ল্যাটেই থাকে?’

‘হু।’

‘অয়ন তোমাকে একটা উপহার দিয়েছিল, সেটা তো খুলে দেখলে না।’

এই উপহারের কথা বেমালুম ভুলে বসেছে অন্বিতা। মনে পড়তেই বলল,

‘মনে ছিল না, বাসায় ফিরে গিয়ে খুলব।’

মাহির নয়নতারা গাছের দিকে তাকাল। গোধূলির কমলা রঙা আলোয় তাকে কমলা সুন্দরী লাগছে। ফুলের ভারে বেচারি নুইয়ে পড়েছে বোধ হয়। মাহির এগিয়ে গিয়ে সেখান থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে। তারপর নির্মল হেসে অন্বিতার সমীপে দাঁড়িয়ে যত্ন করে সেই ফুল গুঁজে দেয় তার কানে। মুচকি হাসে অন্বিতা। অস্তগামী ভানুর সমস্ত রঙে মেয়েটার সফেদ গায়ের রং চকচক করছে যেন। মাহিরের লোভ হলো বড্ড। নরম পাপড়ির ন্যায় কপোলে ঠোঁট বসিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো সে। হকচকিয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল অন্বিতা। গালে হাত দিয়ে আশেপাশে চেয়ে দেখল কেউ দেখছে কি-না। অন্বিতার ভীত দৃষ্টি দেখে মাহির রগড় হেসে বলল,

‘দেখেনি কেউ।’

অন্বিতা গাল ঘঁষে বিড়বিড় করে বলল,

‘অসভ্য।’

পরক্ষণেই আবার আরেক গাল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘আরেক গালেও দাও, নয়তো বিয়ে হবে না।’

মাহির ক্ষুরধার চাহনি বর্তিয়ে তীক্ষ্ণ সুরে বলল,

‘তুমি আরো বিয়ের কথা ভাবছো?’

অন্বিতা দায়সারা ভাবে বলল,

‘ভাবতেই পারি।’

মাহির কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

‘তবে ঐ গালে জীবনেও চুমু দিব না। আজীবন এক গালেই চুমু দিয়ে যাব।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here