#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৪।
ভো ভো শব্দ তুলে অনতবরত ফোনটা বাজছে। সেদিকে খেয়াল নেই অয়নের। সে গিটারটা কোলের উপর রেখে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ। অমিত অফিস থেকে ফিরেছে বেশিক্ষণ হয়নি। ফ্রেশ হয়ে দুই মগ কফি নিয়ে বিছানায় এসে বসল সে। অয়নের দিকে চেয়ে বলল,
‘আসার পর থেকেই দেখছি গিটার নিয়ে বসে আছিস কেবল, সুর তুলছিস না কেন?’
অয়ন ক্ষীণ সুরে বলল,
‘ইচ্ছে করছে না।
‘তবে গিটার নিয়ে বসে আছিস কেন?’
উত্তর দিল না অয়ন। অমিত তার দিকে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘নে, কফি খা।’
উঠে বসল অয়ন। গিটার’টা কোল থেকে সরিয়ে রাখল। তারপর কফির মগ হাতে নিল। অমিত অন্যটাতে চুমুক বসিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ফোন বাজছে তোর, তুলছিস না কেন?’
অয়ন দেখেছে এতক্ষণে। ফোনটা হাতে তুলে। আননোন নাম্বার দেখে কেটে দেয় সে। পরক্ষণেই আবার কল আসে। অমিত জিজ্ঞেস করে,
‘কে কল করছে?’
‘জানি না। আননোন নাম্বার।’
‘রিসিভ কর, হয়তো কারোর প্রয়োজন।’
রিসিভ করে কানে লাগাল অয়ন। ওপাশ থেকে শোনা গেল কারোর অস্থির গলার স্বর,
‘আচ্ছা মানুষ তো আপনি! সেই কখন থেকে কল করছি, অথচ রিসিভ করার নাম’ই নেই। এত ব্যস্ততা আপনার?’
অয়ন কপাল কুঁচকে একবার মোবাইলটা চোখের সামনে ধরে নাম্বার’টা দেখল। না, নাম্বার’টা চেনে না সে। আবারও কানে লাগাল। বিরক্তির সুরে বলল,
‘কে আপনি?’
মেয়েলি স্বর থামল এবার। গাঢ় নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল খানিক। একপল সময় নিয়ে বলল,
‘আমি আভা।’
সঙ্গে সঙ্গেই অয়ন প্রশ্ন করল,
‘কে আভা?’
“আভা’র” নাম শুনতেই চমকে তাকায় অমিত। কফির মগ টেবিলে রেখে অতি উৎসাহে বলে,
‘আরে আভাকে চিনতে পারছিস না, অন্বিতার বান্ধবী।’
কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো অয়নের। এই মেয়ে তার নাম্বার পেল কোথায়? সে বীতঃস্পৃহ সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?’
মুখটা চুপসে যায় অমিতের। ভয় পায় সে। আভা সত্যি বললে তার যে আর রক্ষে নেই। তবে মিথ্যে বলল আভা। বলল,
‘আপনার নাম্বার পাওয়াটা কোনো কঠিন ব্যাপার না। কী করছিলেন?’
আভা এত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে যেন তারা কত পরিচিত। অথচ তিন আগেই প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল দুজনের। অয়নের বিরক্তির মাত্রা তরান্বিত হচ্ছে। এই মেয়ের সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র আগ্রহ পাচ্ছে না সে। তাই বলল,
‘ব্যস্ত আছি আমি, রাখছি।’
‘আরে শুনন তো। এত তাড়া কেন আপনার?’
‘বললাম তো, ব্যস্ত আছি।’
‘মিথ্যে বলছেন জানি।’
অয়ন এবার কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলল,
‘যখন বুঝতেই পারছেন মিথ্যে বলে ফোন কাটতে চাইছি, তবে বিরক্ত করছেন কেন?’
‘আমার আপনার সাথে কথা ছিল। একটু সময় দিন, প্লিজ।’
অয়নে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলল,
‘জলদি বলুন।’
অমিত কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। হাসফাস করছে আভার কথা শোনার জন্য। সে একটু একটু এগিয়ে গিয়ে নিজের কানটা অয়নের মোবাইলের দিকে নিল। যদি কিছু শুনতে পায়। অয়নের সম্মতি পেয়ে আভার মনের চঞ্চলতা বেড়ে যায়। কী কী বলবে মনে মনে সাজিয়ে নেয় সব। তারপর নিজেকে ধাতস্ত করে ধরাস ধরাস বক্ষে হাত রেখে বলে,
‘আমি আপনাকে পছন্দ করি, অয়ন।’
অমিতের কানে ঐটুকু যেতেই সে বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। মেয়েটা কী চতুর আর চটপটে। অপরদিকে অয়ন নিরুত্তাপ, নিরুদ্বেগ। স্বাভাবিক গলায় বলে,
‘কিন্তু আমি করি না।’
অমিত ভ্রু কুঁচকে বন্ধুর দিকে চাইল। তার বন্ধু একটা আস্ত আহাম্মক, এক মেয়ের জন্য সারাজীবন দেবদাস হয়ে থাকার ফন্দি আঁটছে নাকি। আভা বলল,
‘এখন করেন না, ভবিষ্যতে করবেন। আমার অপেক্ষা করতে অসুবিধা নেই।’
অয়ন শক্ত গলায় বলল,
‘এমন কিছু কখনোই হবে না। অযথা আমার পেছনে সময় নষ্ট করবেন না। রাখছি।’
কল কেটে দেয় অয়ন। ঘাড় ঘুরিয়ে ক্ষুরধার চোখে অমিতকে দেখে। তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘ঐ মেয়েকে আমার নাম্বার তুই দিয়েছিস?’
সরে বসে অমিত। আলাভোলা মুখ করে বলে,
‘অসম্ভব। এত বড়ো মিথ্যে অপবাদ তুই তোর বন্ধুকে দিতে পারিস না।’
‘তাহলে মেয়েটা আমার নাম্বার পেল কোথায়?’
অমিত কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
‘আমি কী জানি।’
অয়নের বিশ্বাস হলো না মোটেও। সে শাণিত চোখে চেয়ে রইল কতক্ষণ। অমিত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
‘ওভাবে তাকাবি না, আমার লজ্জা লাগে।’
অয়ন ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। উঠে বারান্দায় চলে গেল। অন্বিতার রুমে আলো দেখে অবাক হলো সে। তবে কি অন্বিতা এসেছে!
____________
মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিল তাইভিদ। ফোনের মাঝেই দেখল এক অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসছে বারবার। মায়ের সাথে কথা শেষ করে সে ঐ নাম্বারে কল ব্যাক করে। রিসিভ হলো তা। তাইভিদ জিজ্ঞেস করল,
‘কে বলছেন?’
‘আমি শশী। আপনি নিশ্চয় তাইভিদ?’
হকচকাল তাইভিদ। শশী তাকে কেন কল দিয়েছে। সে জানতে চাইল,
‘আপনি আমাকে কল করলেন যে? আর নাম্বার পেলেন কোথায়?’
‘মাহিরের নার্সিংহোমের ওয়েবসাইটে পেয়েছি। মাহির আর দাদুকে অনেকবার কল দেওয়া হয়েছে, কিন্তু উনারা তুলেননি। তাই বাধ্য হয়েই আপনাকে কল দেওয়া।’
তাইভিদ ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। বলল,
‘দুঃখিত, আমার মনে হচ্ছে না আমি আপনাকে কোনোপ্রকার সাহায্য করতে পারব বলে।’
শশী আকুতি জানাল,
‘এভাবে বলবেন, প্লিজ। মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, দাদুর সাথে মা’র কথা বলা জরুরি। দয়া করে একটু সাহায্য করুন।’
কাল অবধি যেই মেয়েটার অহমিকায় মাটিতে পা পড়ছিল না, তার মধ্যে এহেন দৈবিক পরিবর্তন দেখে অবাক হলো তাইভিদ। বলল,
‘কিন্তু দাদু উনার সাথে কথা বলতে চাইছেন না, আমি তো আর দাদুকে জোর করতে পারি না।’
‘আপনি বুঝতে পারছেন না, আমার মা অসুস্থ। দাদুকে একবার বুঝিয়ে বলুন, প্লিজ।’
মা অসুস্থ হলে সব সন্তানের মন’ই ব্যাকুল হয়ে উঠে। শশীর উদ্বিগ্ন, চিন্তিত কন্ঠে সেই ব্যাকুলতা স্পষ্ট। মুখের উপর ফোন কাটতে পারছে না তাইভিদ। এইদিকে দাদু সাফ বারণ করে দিয়েছেন, ওদের কারোর সাথেই তিনি আর যোগাযোগ রাখবেন না। তাইভিদের জবাব না পেয়ে শশী বিমর্ষ সুরে বলল,
‘নিজের জন্য না, আমি আমার মায়ের জন্য আপনার কাছে অনুরোধ করছি। আমাকে ফেরাবেন না, তার বিনিময়ে আপনি যা বলবেন তাই করব।’
তাইভিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শশীর এত আকুতি ফেলতে পারছে না সে। তাই বলল,
‘আচ্ছা, আমি দেখছি দাদুকে মানাতে পারি কি-না। পারলে এই নাম্বারে কল করব।’
‘ঠিক আছে।’
কল কেটে দিয়ে দাদুর রুমের দিকে পা বাড়াল তাইভিদ।
__________
অসিত অম্বরে এক ফালি চাঁদ মুচকি হেসে লুকোচুরি খেলছে। তার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে মাহির। মন মেজাজ ঠিক নেই বোধ হয়। বারবার ঘুরে তাকাচ্ছে দরজার দিকে। এক রমণীর প্রতীক্ষায় হাঁপিয়ে উঠেছে সে। অথচ সেই রমণীর দেখা নেই। মা আর খালাকে পেয়ে স্বামীকে দিব্যি ভুলে বসেছে যেন।
বেশ অনেকটা প্রহর অপেক্ষায় জর্জরিত হয়ে কাটানোর পর সেই কাঙ্খিত মানুষের আগমন ঘটে। মাহির তাকে দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে। অন্বিতা দরজা লাগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, ডাক্তারসাহেব? মুখখানা অমন বাংলার পাঁচ করে রেখেছেন কেন?’
মাহির মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
‘এলে কেন? মা আর খালামনির কাছেই থাকতে।’
অন্বিতা গাল ফুলিয়ে বলল,
‘বলেছিলাম মা’কে। কিন্তু মা আমাকে জোর করে এই রুমে পাঠিয়েছেন।’
মাহির রোষপূর্ণ চোখে চেয়ে আছে। মেয়েটা তার কথা বুঝল’ই না। অন্বিতা ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
‘আমার নির্দয়, পাষাণ বউটাকে দেখছি। তোমার স্বামীর প্রতি বুঝি তোমার এইটুকুও মায়া হয়না? তোমার অপেক্ষায় আমি শুকিয়ে মরছি, আর তুমি কি-না আমাকে এভাবে অবজ্ঞা করছো? তাও বিয়ের তৃতীয় দিনেই? বছর খানিক পর তো আর আমাকে চিনতেই পারবে না।’
অন্বিতা ঠোঁট চেপে হাসল। বারান্দায় দাঁড়াল গিয়ে। মাহির ঐসব বানোয়াট অভিমান ফেলে তাকে জড়িয়ে ধরল ততক্ষণাৎ। গ্রীবায় চিবুক ঠেকিয়ে বলল,
‘স্বামীর অভিমান ভাঙাতেও জানো না বুঝি?’
অন্বিতা হাসল। সুর টেনে গাইল,
“ভালোবাসি, ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি, ভালোবাসি…”
এইটুকু গেয়ে থামল সে। মাহির চিবুক সরিয়ে সেই স্থানে অধর ছোঁয়াল। খানিকটা কেঁপে উঠল বোধ হয় অন্বিতা। নিশ্বাস ফেলল জোরে। অতঃপর মাহির গাইল,
“আকাশে কার বুকের মাঝে
ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালোবাসি
ভালোবাসি, ভালোবাসি….”
নির্ঘুম এক জোড়া চোখ তৃপ্তি ভরে হাসল। তার না হোক অন্যকারোর সুরে তার প্রিয়া সুখী আছে, এইটুকুতেই বড্ড খুশি সে।
চলবে….