#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৬।
বিভাবসুর ম্রিয়মান জ্যোতি। তার স্বর্ণাভ আভায় চিকচিক করছে শশীর তেল চিটচিটে মুখটা। সকাল থেকে মুখ ধুয়া অবধি হয়নি তার। বিমর্ষ, ক্লান্ত মুখে চেয়ে আছে মায়ের বিধ্বস্ত মুখের দিকে। একদিনেই কেমন যেন শুকিয়ে গিয়েছে তার মা। চোখের নিচে কালি পড়েছে গভীর। ঠোঁটে গ্রীষ্মের খরা পড়েছে যেন। অনেকক্ষণ মা’কে দেখে বুক ভার হলো তার। মাহিরের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘মা কি কখনোই সুস্থ হবেন না?’
মাহির প্রেসক্রিপশন দেখছিল। শশীর প্রশ্ন শুনে চাইল তার দিকে। তারপর আবার চাইল জিনিয়া বেগমের দিকে। বলল,
‘পরিপূর্ণ সেবা পেলে অবশ্যই হবে।’
শশী পুনরায় কিছু বলল না আর। দাদুর চোখ থেকে সমানে জল পড়ছে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর কাঁদছেন তিনি। অন্বিতা অনেক বুঝিয়েও পারছে না। মেয়ের এই অবস্থার জন্য তিনি নিজেকে দায়ী করছেন। প্রেসক্রিপশন’টা তাইভিদকে বুঝিয়ে দিয়ে মাহির দাদুর কাছে গেল। তার শিউরে বসে কোমল স্বরে বলল,
‘এমন করলে কী করে হবে, দাদু? উঠো এবার, বাড়ি চলো। তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন।’
দাদু হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছলেন। মাথা নাড়িয়ে কম্পিত সুরে বললেন,
‘না না, কোথাও যাব না আমি। আমি আমার মেয়ের কাছেই থাকব।’
‘জেদ করো না, দাদু। ফুপি এখন বিপদমুক্ত। আল্লাহ চাইলে খুব শীঘ্রই সুস্থ হবেন তিনি।’
দাদুর ঠোঁট কাঁপছে। বৃ্দ্ধ’র মন মানছে না কিছুতেই। তিনি ভেজা গলায় বললেন,
‘আমার মেয়েটা এভাবে অসাড় হয়ে পড়ে থাকবে আর আমি কিছুই করতে পারব না? বাবা হিসেবে এত অধম আমি।’
মাহির দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদুকে ধরে উঠাল। এভাবে এখানে থাকলে তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। শশীর দিকে চেয়ে বলল,
‘শশী, তুই দাদুকে নিয়ে বাড়ি যা। আমি আর অন্বিতা আছি এখানে।’
শশী নির্লিপ্ত সুরে বলল,
‘আমি এখান থেকে এক পাও নড়ব না।’
শশীর হৃদয়ের জখম মাহির টের পাচ্ছে। তাই নরম গলায় বলল,
‘তোরও ফ্রেশ হওয়ার প্রয়োজন। চিন্তা করিস না, ফুপির কাছে আমরা সবাই আছি তো।’
শশী বার কয়েকবার চোখের পাতা ঝাপ্টে অনুরোধ করল,
‘আমাকে জোর করো না, প্লিজ। আমাকে মায়ের কাছে থাকতে দাও।’
শশীর ব্যাকুলতায় মাহির পরাস্ত হলো। বলল,
‘বেশ, তোকে জোর করব না। তাইভিদ, আপনি বরং দাদুকে নিয়ে বাড়ি যান।’
‘ঠিক আছে, স্যার।’
দাদু আকুতি জানিয়ে বলল,
‘আমি এখানে থাকি না, দাদুভাই? মেয়েটার কাছে থাকলে আমি যে শান্তি পাই।’
‘আবার আসবে তো। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে তাইভিদ তোমাকে আবার এখানে নিয়ে আসবে। এখন যাও, আমরা সবাই আছি এখানে।’
দাদুর মন না চাইলেও তাইভিদের সাথে তাঁকে বাড়ি ফিরতে হলো। দুজন নার্স সর্বক্ষণের জন্য কেবিনে থাকবে। কেবিন থেকে বের হলো মাহির। তার পেছন পেছন এল অন্বিতা। মাহিরের কেবিনে গেল দুজন। গা থেকে এপ্রোন খুলে চেয়ারে রেখে বসল মাহির। বড্ড ক্লান্ত। চেয়ারে গা এলিয়ে প্রলম্বিত শ্বাস টানল। অন্বিতা বসল বিপরীতে। জিজ্ঞেস করল,
‘মাহির, তোমার কী মনে হয়? ফুপি তাড়াতাড়ি সুস্থ হবেন তো?’
ক্ষীণ সুরে মাহির বলল,
‘এখনই ঠিক বলতে পারছি না, অন্বি। স্ট্রোক এর ফলে মাথায় রক্ত ক্ষরণ হয়েছে বেশ, কোনোরকমে বাঁচাতে পারলেও স্নায়ুগুলো দূর্বল হয়ে পড়েছে একেবারে। সেজন্য শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গগুলো কাজ করছে না। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ নয়। তবে লেগে থাকতে হবে। সঠিক চিকিৎসা আর সেবা পেলে তা অবশ্যই সম্ভব।’
‘এই নার্সিংহোমে আর কয়দিন রাখবে?’
‘এখান থেকে কাল’ই রিলিজ দেওয়া যাবে। তবে বাড়িতে গেলে শশী একা কুলিয়ে উঠতে পারবে কি-না সেটাই ভাবছি।’
অন্বিতা এক পল ভেবে বলল,
‘একটা কাজ করলে কেমন হয়, প্রথম কিছুদিন নাহয় ফুপি আর শশী আমাদের বাড়িতেই থাকুক। তারপর ফুপির অবস্থা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।’
মাহির বিভ্রান্ত চোখে চাইল। অন্বিতার সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে বলল,
‘এত দুশ্চিন্তা করো না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে উনি তোমার ফুপি, তোমার বাবার বোন। ডাক্তার আর ভাতিজা উভয় হিসেবে উনাকে সুস্থ করাটাই এখন তোমার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।’
অন্বিতা উত্তরে কিছুটা স্বস্তি পেল মাহির। বলল,
‘তাইভিদকেও তাহলে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিলে কেমন হয়? উনি বাসায় থাকলে দাদুকে নিয়েও আমার আর এত চিন্তা করতে হবে না। আর আমরা দুজন নার্সিংহোমে থাকলে ফুপিকেও উনি দেখতে পারবেন।’
‘বেশ তো। তুমি কথা বলে দেখো তাইভিদের সাথে।’
______________
“সঙ্গীত চর্চা” নামের এক কোচিং সেন্টারের এর বাইরে তখন থেকে পায়চারি করছে আভা। একটু পরপর নখে কামড় বসাচ্ছে আবার তাকাচ্ছে গেইটের দিকে। তপনের পতন ঘটেছে বেশ কয়েক পল আগে। অমিতের ভাষ্যমতে এখন’ই তো কাঙ্খিত মানুষের বাহির হবার কথা। কিন্তু সে আসছে না কেন? আভা পা থামাল। এভাবে পায়চারি করতে করতে পা’য়ে ব্যথা ধরেছে তার। গেইটের পাশে উঁচু পাকা জায়গাটাতে এবার বসে পড়ল সে। বিরক্তিতে মুখ ক্রমশ লাল হচ্ছে। হাত ঘড়িতে চেয়ে বিড়বিড় করে আওড়াল,
‘আর সাত মিনিট অপেক্ষা করব, এর মধ্যে না এলে সোজা ভেতরে।’
পাঁচ মিনিটও শেষ হলো না বোধহয়। এর মাঝেই বেরিয়ে এল মানুষটি। প্রথমে আভা টের’ই পেল না। মানুষটি কয়েক কদম সামনে গিয়ে রিক্সা ডাকতেই টনক নড়ল তার। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গেল তার সামনে। আচম্বিত তার আগমনে চোখ মুখ কুঁচকে গেল অয়নের। আভাকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
‘আপনি এখানে কী করছেন?’
আভা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
‘দেখতে এসেছি।’
অয়ন ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,
‘কী?’
আভা মাথা চুলকে বলল,
‘না মানে, শিখতে এসেছি।’
অয়ন ঊর্ধ্বশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘কী শিখতে এসেছেন?’
‘গান।’
‘ভেতরে গিয়ে আলাপ করুন।’
এই বলে সে রিক্সা ডাকার জন্য হাত তুলে। আভা অস্থির গলায় বলে,
‘না না, আমি কোচিং এ শিখব না। আপনার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে শিখব।’
হাত নামায় অয়ন। গুমোট স্বরে বলে,
‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে গান শিখাই না। শিখতে হলে কোচিং এ ভর্তি হোন।’
‘এমন করবেন না, প্লিজ। আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না, আমি আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
‘বললাম তো, ব্যক্তিগত ভাবে আমি কাউকে গান শিখাই না। আপনি অন্যকারোর সাথে যোগাযোগ করুন।’
‘কিন্তু অন্বিতা তো আমাকে আপনার কথাই বলেছে। ও বলাতেই আমি আপনার কাছে এসেছি, নাহলে তো আসতাম না।’
অয়নের ভ্রু সোজা হলো। জিজ্ঞেস করল,
‘অন্বিতা বলেছেন আমার কথা?’
‘জি। ওর কথাতেই আমি আপনার কাছে এসেছি।’
অয়ন মুখ ঘুরিয়ে চিন্তায় পড়ল। আভার মুখের উপর না করলে অন্বিতার খারাপ লাগতে পারে। আবার এই আভার হাবভাবও তার সুবিধার ঠেকছে না। কী যে করবে!
কিয়ৎক্ষণ ভেবে অয়ন বলল,
‘ঠিক আছে, আপনার বাবাকে আমার সাথে কথা বলতে বলবেন।’
আভার চঞ্চল মন খুশিতে লাফিয়ে উঠল। ত্বরিত গতিতে মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘অবশ্যই বলব।’
অয়ন আর অপেক্ষা না করে রিক্সা ডেকে উঠে পড়ল তাতে। আভা দাঁড়িয়ে রইল এক জায়গায়। অয়নের রিক্সা যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ সে নড়ল না।
চলবে…..
(পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত।)
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/