#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৭।
শশী সাফ বারণ করেছে, সে জিনিয়া বেগমকে নিয়ে মাহিরের বাড়িতে উঠবে না। তাকে বোঝানোর কোনো কমতি রাখেননি দাদু। তাও শশী এ কথা মানতে নারাজ। মুখ কালো করে বসে আছেন বৃদ্ধ। মেয়েকে এই অবস্থায় চোখের আঁড়াল করতে চাইছেন না তিনি। শশীর মন গলছে না কোনোমতেই। সে নির্লিপ্ত হয়ে ঠায় বসে তার জায়গায়। অন্বিতা দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে, কী করবে বুঝতে পারছে না। মাহির চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ছিল কতক্ষণ। এবার চোখ মেলে তাকাল। শশীর দিকে চেয়ে নরম গলায় বলল,
‘তুই বুঝতে কেন চাইছিস না, শশী? ফুপি আমাদের এখানে থাকলে উনার সেবা যত্ন ভালো ভাবে হবে। আমি তাইভিদকেও থাকতে বলেছি। আমাদের সবার চোখের সামনে থাকলে চিকিৎসায় কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।’
শশী নিরুত্তাপ সুরে বলল,
‘আমি কি আমার মায়ের সেবা করতে পারব না? মেয়ে হিসেবে ঐটুকু ক্ষমতাও কি আমার নেই?’
মাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘আমি তা বলছি না। ফুপির এখন সবসময় চেকআপের মধ্যে থাকতে হবে। তোদের বাড়ি থেকে নার্সিংহোমে আনা নেওয়াটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আমরা ফুপির সুবিধার কথা ভেবেই বলছিলাম। এখন বাকিটা তোর ইচ্ছে। তুই না চাইলে আমি জোর করব না।’
দাদু তাল মিলিয়ে বললেন,
‘শশী নানুমনি, মাহির যা বলছে মেনে নাও। জিনিয়া আমাদের সাথেই থাকুক। আমরা সবাই ওর পাশে থাকলে ওর সুস্থ হতে বেশি সময় লাগবে না।’
শশী চিন্তায় পড়ল। মস্তিষ্ক জুড়ে শ’খানেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এতকিছুর পর ঐ বাড়িতে থাকতে বড্ড অহমিকায় লাগছে তার। কিন্তু মায়ের অবস্থাও ভালো না। যত’ই মুখে বলুক, সে একা পারবে; তবে মায়ের পাশে এখন তার পুরো পরিবারকেই প্রয়োজন। চিন্তার পাহাড় ভেঙে শশী তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘বেশ তবে, তাই হবে।’
শশীর সম্মতি পেয়ে খুশি হলো সবাই। মাহির তাইভিদকে ডেকে ফুপির রিলিজের ব্যবস্থা করতে বলল।
______________
ভ্রু যুগলের মধ্যখানে একটা ছোট্ট কালো চাঁদ এঁটেছে আভা। তার মৃগনয়না রাঙিয়েছে নিকষ আধারে। ঠোঁটগুলো খালি রাখল। চুলগুলো বেণী করে ঝুলাল পেছনে। আয়নায় নিজেকে দেখে সলজ্জ হাসল। কলিং বেলের শব্দ হলো তখন’ই। ওড়না গায়ে দিয়ে ছুটে দরজার কাছে গিয়েই বাবাকে দেখে থামল সে। হাসল কিঞ্চিৎ। বলল,
‘গানের স্যার এসেছেন বোধ হয়।’
তার বাবা দরজা খুললেন। বাইরে সৌম্যদর্শন এক যুবক দেখে নির্মল হাসলেন তিনি। বললেন,
‘অয়ন? আভার গানের টিচার?’
অয়ন অপ্রস্তুত হাসল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘জি।’
আভার বাবা দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘ভেতরে এসো।’
অয়ন ভেতরে পা রাখতেই আভার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো। মেয়েটার চোখ মুখের দৈবাৎ উচ্ছ্বাস নজর এড়াল না তার। আভার বাবা বললেন,
‘আভা, স্যারকে নিয়ে তোমার রুমে যাও।’
মাথা হেলিয়ে আভা অয়নকে ইশারায় তার পেছনে আসতে বলল।
পরিপাটি গুছানো রুমটাতে চোখ বুলিয়ে আভার দিকে চাইল অয়ন। বলল,
‘ডাক্তারি ছেড়ে হঠাৎ গান শেখার ইচ্ছা?’
আভা ঠোঁট প্রসারিত করে চমৎকার হেসে বলল,
‘ডাক্তারি করছি বলে কি গান শেখা যাবে না?’
‘না, তা না। ডাক্তারদের তো এমনিতেই অনেক চাপ থাকে, তাই জানতে চাইলাম আরকি। এত চাপ সামলে এইদিকে সময় দেওয়াটা তো কষ্টসাধ্য।’
আভা চোখের পাতা ঝাপ্টে আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল,
‘আমি ঠিক পারব।’
অয়ন আর কথা বাড়াল না। জিজ্ঞেস করল,
‘সঙ্গীতের পরিচয় দিয়ে শুরু করি?’
‘আপনার যেভাবে সুবিধা মনে হয় সেভাবেই শুরু করুন।’
অয়ন গলা ঝেড়ে প্রথমে গানের হাতেখড়ি শেখাল। সুর, তাল সম্পর্কে জ্ঞান দিল অনেক। আভা সব বুঝল কি-না কে জানে। সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে কেবল শুনেছে সব। অয়ন জিজ্ঞেস করল,
‘বুঝেছেন সব?’
আভা মাথা হেলিয়ে বলল,
‘জি।’
‘বেশ, কয়েকটি সুরের ধরন বলুন তো?’
আভার সম্বিত ফেরে। অয়ন যেন কী কী বলেছিল, এখন ঠিক সাজাতে পারছে না। সে মাথা নুইয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবছে। অয়ন শাণিত দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। মেয়েটা যে মোটেও মনোযোগ দিচ্ছে না তা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল। কোনো উত্তর না পেয়ে জলদগম্ভীর স্বরে সে বলল,
‘মনোযোগ না থাকলে অযথা আমার সময় নষ্ট করবেন না। যদি সত্যিই গান শিখতে চান তবে পূর্ণ মনোযোগ দিন।’
আভা চোখ তুলে তাকাল। তার কাজল ভেজা আঁখিতে চোখ রাখল না অয়ন। মেয়েদের কাজল চোখে জাদু থাকে। এক জাদুর কবলে পড়ে তার আজ এই অবস্থা, আবার নতুন করে একই সমস্যায় পড়তে চায় না সে। তাই পিঙ্গলবর্ণ চোখ রাখল খসখসে খাতার কাগজে। বলল,
‘আমি এখানে সব লিখে দিচ্ছি। কাল এসে আবার জিজ্ঞেস করব।’
আভা মাথা হেলিয়ে বলল,
‘আচ্ছা।’
_____________
চোখ মেলে তাকাতে পারলেও মুখে রা নেই জিনিয়া বেগমের। বিছানার উপর পড়ে আছেন একটা জড় বস্তুর ন্যায়। শশী তাকে স্যুপ খাওয়াচ্ছে অতি যত্নে। তিনি ঠোঁটটুকুও ফাঁক করতে পারছেন না। শশীর চোখ ভিজে উঠে। মায়ের মুখে হাত বুলিয়ে বলে,
‘তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো, মা। তোমাকে এভাবে দেখে আমার যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।’
জিনিয়া বেগম নির্বাক। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন মেয়ের ক্রন্দনরত মুখের দিকে। হয়তো কিছু বলতে চাইছেন, পারছেন না। শশী ফের বলল,
‘জানো, তোমার উপর আর কেউ রেগে নেই। তুমি আর কষ্ট পেও না, মা। সবাই তোমাকে অনেক ভালোবাসে।’
শশী চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। ঔষধ খাওয়াতে হবে। অন্বিতা রুমে প্রবেশ করে তখন। হাতে একটা পানির পাত্র আর সুতি কাপড়। শশীর দিকে চেয়ে বলল,
‘আপু, ঔষধ খাওয়ানোর পর ফুপির শরীরটা মুছে দিব।’
শশী ঔষধ দেখতে দেখতে বলল,
‘রেখে যাও, আমি করে নিব।’
অন্বিতা ইতস্তত সুরে বলল,
‘আমি একটু সাহায্য করি?’
শশী ঔষধ পানিতে গুলিয়ে মায়ের কাছে এল। একবার অন্বিতার দিকে চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল সে। মায়ের মুখে ঔষধ তুলে দিয়ে বলল,
‘প্রয়োজন নেই, আমি পারব। তুমি রেখে যাও।’
অন্বিতা আর জোর করার সাহস পেল না। শশীর মন মেজাজ ঠিক নেই সে জানে। মায়ের এমন অবস্থার জন্য পরোক্ষভাবে হলেও সে যে অন্বিতাকে দায়ী ভাবছে এইটুকুও বুঝে গেছে সে। তাই অযথা কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল।
মাহির ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে অন্বিতাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তার পাশে বসল। জিজ্ঞেস করল,
‘কী ব্যাপার, মন খারাপ?’
অন্বিতা মাথা নাড়িয়ে “না” বলল। মাহির মলিন হেসে বলল,
‘মায়ের কাছে দু’দিনও থাকতে পারোনি। চলে আসতে হয়েছে। মন খারাপ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।’
অন্বিতা ক্ষীণ সুরে বলল,
‘না না, সেজন্য আমার একেবারেই মন খারাপ না। তবে ফুপির জন্য মন খারাপ হচ্ছে। আচ্ছা, ফুপির এই অবস্থার জন্য কি আমি দায়ী?’
মাহির উদ্বিগ্ন সুরে বলল,
‘এসব কী বলছো? তুমি কেন দায়ী হবে? অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার জন্য এমনটা হয়েছে। এখানে কেউ দায়ী নয়।’
‘দুশ্চিন্তাটা তো আমার জন্য’ই তৈরি হয়েছে, তাই না?’
মাহির এগিয়ে এসে অন্বিতাকে বুকে জড়িয়ে নিল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘একদম এসব ভাববে না। তোমার জন্য কিচ্ছু হয়নি।’
____________
ঘুম আসছে না শশীর। বসার ঘরের বড়ো বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে আগে থেকেই কারোর উপস্থিতি দেখে ভ্রু কুঁচকাল সে। জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি এখনও ঘুমাননি?’
আচম্বিত কারোর গলার স্বর পেয়ে চমকে পেছনে তাকাল তাইভিদ। শশীকে দেখে প্রসন্ন হাসল। বলল,
‘না, ঘুম আসছিল না।’
শশী এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়াল তার। দূরত্ব রাখল বেশ। বলল,
‘আপনার ঘুম না আসার কারণ কী?’
‘কফি খেয়েছিলাম কড়া করে, হয়তো সেজন্য।’
শশীর দৃষ্টি বাহ্যজগতে। রাস্তায় সোডিয়ামের আলোগুলোকে কয়েক শ পোকা ঘিরে ধরেছে। মনে হচ্ছে যেন এই আলোর সমস্তটুকু নিজেদের মধ্যে শুষে নিচ্ছে তারা। শশীর মাঝে হঠাৎ নীরবতা তাইভিদকে অস্বস্তিতে ফেলে। সে চলে যেতে উদ্যত হয়। তখনই শশী প্রশ্ন করে,
‘আচ্ছা তাইভিদ, আমি কি খুব বেশি খারাপ?’
চলবে…..
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/