বান্ধবীর বিয়েতে গিয়ে দেখি বর আমার প্রেজেন্ট বয়ফ্রেন্ড। আমার বুকটা ধুক করে কেঁপে উঠলো। হৃদপিণ্ডটা থেমে গেলো।আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।কাল রাতে এই মহানায়ক আমাকে বলেছে সে ট্যুরে যাচ্ছে। নেটওয়ার্কের সমস্যা থাকলে ফোন বন্ধ দেখাবে। অথচ সে সোজা বিয়ের পিড়িতে। দুই বছর পনেরো দিনের রিলেশন আমাদের। কতো খুনশুটি আর ভালোবাসার স্মৃতি আমাদের।আমার চোখে রাফি সৎ, নম্রভদ্র ছেলে। তারচেয়ে বড় কথা আমাকে নিয়ে ভিষণ সিরিয়াস সে।খুব কেয়ারিং ছেলে।অথচ ছেলেটা না জানিয়ে সোজা অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে চলে এলো। অথচ আমি টু শব্দটিও জানলাম না।
বিয়েটি যেহুতু ঘরোয়া ভাবে। তাই সবাইকে ড্রয়িং রুমের পাশের রুমটিতে বসানো হয়েছে। অধীর আগ্রহ নিয়ে হবু দুলাভাইকে দেখতে গেলাম। জানালার ফাঁকে চোখ রাখতেই রাফিকে দেখলাম। অনেকগুলো ছেলের মধ্যে রাফি ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পড়ে আছে।
রাফি বলেছিলো রাতের গাড়িতেই সে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। অথচ সে সিরাজগঞ্জ এ। ভাবলাম বন্ধুর বিয়েতে হয়তো এসেছে। পাশে থাকা নিলিমাকে বললাম বর কোনটারে? নিলিমা অনিমার ছোট বোন। সে হাতের ইশারায় দেখালো রাফিকে। আমি পুরো কনফিডেন্ট ছিলাম যে রাফি বর হতেই পারে না। নিলিমা বললো,
–চলো ভিতরে চলো।
আমি বললাম,
— আমার ওয়াশরুমে যেতে হবে তুমি যাও। আমি পরে আসছি।
ও চলে গেলো। পায়ের তলাটা যেনো সুপার গ্লু দিয়ে লাগানো হয়েছে আমার।ওখান থেকে সরতে পারছি না।শরীরের সমস্ত শক্তি যেনো কেউ শুষে নিলো।পুরো পৃথিবীটা যেনো ঘুড়তে লাগলো। আমি নড়তে পারছিনা।এতো ভালোবাসার মানুষটা না জানিয়ে বিয়ে করতে চলে এলো।কিন্তু কেনো?
আজ অনিমার বিয়ে। অনিমা আমার স্কুল জীবনের বান্ধবী।খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব আমাদের।অনিমার বাবাও আমার বাবার ক্লোজ ফ্রেন্ড।বাবার জব ট্রান্সফারের সাথে আমরা শিফট হতে হয়েছে ঢাকায়। তাই দেখা সাক্ষাৎ কম ই হয়। তবে কথা হয় প্রতিদিন।সকালে ঘুম থেকে উঠে জানতে পারলাম অনিমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।পছন্দ হলেই বিয়ে। তাই আমরা যেনো এখনি ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ চলে আসি। বেষ্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে বলে কথা না এসে কি পারি। চলে আসলাম। ঐদিকে রাফিকে বলতে পারিনি।কারণ তার ফোন সুইচঅফ ছিলো।
রাফিকে দেখে মন মানছে না আমার। রাফি আমাকে ভিষণ ভালোবাসে। এমন কাজ সে করতেই পারে না। আমি পরপর কয়েকবার ফোন করলাম। কিন্তু ফোন সুইচঅফ বললো। আমি তড়িঘড়ি করে অনিমার কাছে গেলাম। ওর মুখটাতে লাজুক লাজুক ভাব
ফুটে উঠেছে। আমাকে দেখেই মুখটা নিচু করলো। অন্যে সময় হলে হাসি ঠাট্টার দুটো কথা বলতাম হয়তো। কিন্তু এই মূহুর্তে আমার অন্তর পুড়ে ছাই ছাই। নিজের চোখকে ভুল প্রমাণিত করতে অধীর আগ্রহে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
— তোর বরের নাম কি রে?
অনিমা বললো,
— তা তো মনে নেই। তুই বর দেখেছিস সিনু?
আমার নাম সিনথিয়া। ও ভালোবেসে সিনু বলে ডাকে।
আমি নিজের যন্ত্রণা, চোখের জল লুকাতে চোরের মতো চাহুনি করছি । আর ঢোক গিলে অনেক কষ্টে কোনো রকমে কথা বলছি,
— কেনো তুই দেখিস নি?
–ঘরভর্তি মানুষের মধ্যে কি তাকানো যায়।
লজ্জা লাগেনা বল?
আমি জানি অনিমা লাজুক স্বভাবের মেয়ে। ওর বোকা কথা, লাজুকতা আমার ভালো লাগলেও আজকে অসয্য, অসহনীয় লাগছে। এতো ন্যাকামির কি আছে। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
— নিজের বর না দেখেই রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করছিস। পাগল নাকি। যাকগে নাম কি ছেলের?
— ড্রয়ারে ছেলের বায়োডাটা রাখা আছে দেখ।
আমি তড়িঘড়ি করে উঠে ড্রয়ার খুললাম। মন প্রাণ দিয়ে চাইছি আমার রাফি যেনো না হয়। আমি তখনো ভাবছি রাফির কোনো আত্মীয়র বিয়েতে হয়তো ও এসেছে।নিলিমা ছোট ওর হয়তো বর চিনতে ভুল হয়েছে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। ছেলের নাম রায়হান রাফি। আর ওর ই ছবি দেয়া। আমি বরফের মতো জমে গেলাম। সহ্য করতে পারছিলাম না। গোসল করার নাম করে ওয়াশরুমে ঘন্টা খানিক কাঁদলাম। চোখ মুখ ফুলে একাকার। রাফির কথা অনিমাকে বলা হয়নি। কারণ ও প্রেম ভালোবাসা পছন্দ করতো না। ও জানলে আমার সাথে কথা বন্ধ করতো। তাই বলিনি।
পুরো দেড় ঘন্টা পর আমি ওয়াশরুম থেকে বের হলাম। শুনলাম একটু পর বিয়ে পড়াবে। কাজি এসেছে। অনিমার তেমন সাজগোজ পছন্দ না। সাজানোর দায়িত্বটা আমার উপর পড়লো।খুব সাদামাটা ভাবে সাজালাম। মেরুন কালারের জামদানি। হালকা করে লিপষ্টিক আর একটু চিকন কালিতে চোখটা একে দিলাম। গলায় একটা পাতলা চেইন। ডায়মন্ডের লকেট টা সুক্ষ চেইটাকে অবলম্বন করে আকড়ে ধরে আছে। ফর্সা গলাটায় মাঝখানে পাথরটা ঝিলিক দিয়ে উঠছে। অনিমাকে একদম পরীর মতো লাগছে। আমার ভিতরটা তখন আগুনে দগ্ধ। এ যন্ত্রণা যে পায়নি সে কোনো দিন বুঝবে না।
আমি আসার আগেই ওদের কাগজে কলমে বিয়ে হয়ে গেছে। শুধু ধর্মীয় ভাবে বিয়েটা বাকি।
আমি চাইলে রাফির মুখোমুখি হতে পারি।কেনো করলো এমন জানতে চাইতে পারি। কিন্তু ইচ্ছে মরে গেছে। যে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করতে আসে তার মুখোমুখি আমি কোনোদিন হবোনা। আজ অনিমাকে নিয়ে গেলে সকালের গাড়িতেই ঢাকা চলে যাবো। সব ভুলে যাবো। চোখ দুটো ভিষণ যন্ত্রণা করছে। যতোটা পারছি লোকচক্ষুর আড়াল হয়ে থাকছি।
মাগরিবের আযান হলো।নামাজ শেষে সবাই ড্রয়িং রুমে গেলো।একপাশে বসানো হলো বরসহ কয়েকজনকে।মাঝখানে পর্দা টেনে দেয়া হলো। বর বউ মূলত সামনাসামনি বসে আছে। মাঝখানে পর্দা দেয়া। অনেক জোড়জুড়িতে আমাকে বসতে হলো কণের পাশে। বুকের ব্যাথায় আমি জর্জরিত। কাজী তখন বিয়ে পরাচ্ছেন। আমার চোখের পানি টুইটম্বুর। চোখের পানি লুকাতে মাথায় কাপড় টেনে নিলাম। ওপাশ থেকে কাজী খুতবা পাঠ করে নিলেন। তারপর বিয়ের নিয়ম অনুযায়ী যখন বললেন,
— বলো মা কবুল।
অনিমা তখন চুপ করে রইলো।পাশে বসে থাকা অনীমার ভাবি অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— কবুল বল।
অনিমা হুহু করে কাঁদলো। আমার বুকটা যন্ত্রণায় ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। হাত পা কাঁপছে। চোখের পানিতে ভিজে উঠছে আমার ওড়না। সবাই ভেবে নিচ্ছে বান্ধবীর জন্যে বুক ভাসাচ্ছি। ওর সাথে সবাই আমাকেও শান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু কেউ আমার বুকের ব্যথা দেখছে না।
অনিমা তিনবার কবুল বলা শেষ করলো।কাজী যখন রাফিকে কবুল বলতে বললো। আমার জানটা মনে হয় বেরিয়েই যাবে এখন।
ওপাশ থেকে কাজী বলে উঠলো,
— বলো বাবা কবুল।
আমার ভালোবাসার মানুষটা পরপর তিনবার বললো,
— আলহামদুলিল্লাহ্। কবুল।
আমার ভিতরটা শূন্য হয়ে গেলো। হারিয়ে গেলো আমার রাফি। বিষাক্ত তীর যেনো একের পর এক আমার বুকে বিদ্ধ হলো। আমার বুকটা এঁফোড় ওফোড় করে দিলো। আমি চিরদিনের জন্যে তাকে হারিয়ে ফেললাম।
অনিমা হুহু করে কাঁদছে। ভাবী, চাচী আম্মা, ওকে বোঝাচ্ছে। ঠিক তখন ই পর্দার ওপাশে গলা খাকারি দিলো। কেউ একজন বললো, বর ওপাশে যাবে।
পর্দা ঠেলে এপাশে কেউ এলো রাফি। আমি মাথায় কাপড়ের সাথে মুখটাও ঢেকে নিলাম। রাফিকে দেখে চাচী আম্মা চলে গেলেন। আমি ও পিছিয়ে গেলাম। নিজেকে ঢেকে ফেললাম রুমের পর্দার আড়ালে।অনিমার ক্রন্দনরত মুখটা তখন পাতলা ফিনফিনে দোপাট্টায় ঢাকা। রাফি সোজাসুজি অনিমার সামনে দাঁড়ালো। অনীমার কান্নার দরুন হেঁচকি উঠে গেছে। রাফি পূর্ণ অধিকারে নির্ধিধায় দুহাতে দোপাট্টা তুলে ধরলো। চাঁদের মতো মুখটা তখন কান্নায় ভেজা। রাফি মনেমনে কিছু বললো। মনে হলো দোয়া পড়ছে। তারপর দুহাতের আজলে অনিমার মুখ রেখে কপালে চুমু খেলো রাফি। অনিমার মুখটা তখন লজ্জায় গোলাপী রঙ ধারণ করেছে। আর আমার মুখ বিষাক্ত ছোবলে হলো নীল। আমি আবার দৌড়ে গেলাম ওয়াশরুমে। ঝর্ণা ছেড়ে বসে রইলাম কতোক্ষণ তা সত্যিই জানা নেই।
অনিমাকে বিদায় দেয়া হলো। আমি আর বের হই নি। কারণ রাফির মুখোমুখি হতে চাই না। ভোরের গাড়িতে ঢাকা ফিরতে চাইলাম।কিন্তু অনিমা খবর পাঠিয়েছে আমাকে আর নিলিমাকে যেনো সকাল সকাল পাঠায়। অনেক ছলছুতো দিয়েও বাঁচতে পারলাম না।তাই আমার আর নিলিমা কে সকাল সকাল পাঠানো হলো। না চাইতেই আরেকবার ফেঁসে গেলাম। নিলিমা বোরখা পড়ে তাই ওর একটা বোরখা পড়ে নিলাম। সবাইকে বললাম নিলিমা ছোট তবুও নিকাফ পড়ে যাবে আর আমি ড্রেস পড়ে যাবো। ভালোদেখাবে না বিষয়টা।তারচেয়ে বোরখা পড়েই যাই।
রাফি কখনো বোরখা পড়ে দেখেনি। নিকাফে তো নয় ই। তবুও যদি কথা হয় রাফি ঠিক ই বুঝবে আমি কে।রাফির মুখোমুখি হলে কি হবে এই ভাবতে ভাবতে রাস্তা ফুরিয়ে গেলো। রাফির কাজিন এলো আমাদের অনিমার কাছে নিয়ে যেতে। আমি ঘরে ঢুকলাম। অনিমা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। কখনো বোরখা না পড়ার কারণে অনিমা হয়তো চিনতে পারছে না। আমি নিকাব তুললাম। সে সোজা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অনিমা সালোয়ার কামিজ পড়ে আছে। আমি যাওয়ার সাথে সাথে সে বললো,
— বোরখা খোল
আমি না করলাম। ও একটু অবাক হলো হয়তো। তারপর অন্য কথায় গেলাম।
— পার্লারে সাজাতে চেয়েছিলো রে সিনু। তুই তো জানিস আমি কেমন। আমার ওতো সাজগোজ পছন্দ না। বলেছি সাজবো না। অন্যের কাছে শাড়ি পড়তে লজ্জা লাগে। তুই পড়িয়ে দে।
ও আমাকে নীল রঙের শাড়ি হাতে দিলো। দরজা জানালা বন্ধ করে লাইট জ্বেলে দিলো। ব্লাউজ পেটিকোট পড়ে অনিমা আমার সামনে এলো।
বললো,
— তাড়াতাড়ি পড়া। সবাই আসার আগে।
আমার প্রথমেই চোখ পড়লো অনিমার গলায়। ধবধবে গলায় পাশে গোল গোল হয়ে রক্ত জমে আছে। অনিমা আমার চোখে চেয়ে লজ্জা পেলো।সাথে সাথে আমার রক্ত ছলকে উঠলো।বুকের মধ্যে ঝড় শুরু হলো। আমার একান্ত কাছের মানুষটা অন্যেকে স্পর্শ করেছে। আমাকে এটাও দেখতে হচ্ছে।চোখ সরিয়ে নিলাম। শাড়ির কুচি করতে গিয়ে এরকম অসংখ্য দাগ আমার চোখে পড়লো। সে যে তাকে গভীর ভাবে ছুঁয়েছে তা বুঝতে পারলাম। দুচোখ ফেঁটে রক্ত বের হবে যেনো। তবুও চুপচাপ শাড়ি পড়ালাম।
আমি ভালোবাসার মানুষটাকে চোখের সামনে অন্যের হতে দেখলাম। কবুল বলতে শুনলাম। ভালোবাসার স্পর্শ দিতে দেখলাম। আবার স্পর্শের চিহ্ন গুলোও দেখলাম। তার বউ দেখলাম। বউয়ের ভেজা চুল দেখলাম। আমার তো হৃদয় পুড়ে ছাড়খাড়। আমার সমস্ত শরীর আগুনের মতো পুড়ছে।
আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না। অনেকক্ষণ পর পুরো অসুস্থ হয়ে গেলাম। অনিমা আমাকে স্যালাইন খাওয়ালো।
নিজের শরীরের ভার আমি টানতে না পেড়ে ফুলের সাজানো বিছায়ায় শুয়ে পড়লাম। চোখের পানিতে ভিজলো আমার ভালোবাসার মানুষের বালিস। সে কি কখনো জানবে? জানলেও কি বুঝবে আমার কতো যন্ত্রণা হয়েছে। জেনে বুঝে কেনো এমন করলো সে? কতো স্বপ্ন তো রাফি আমাকে দেখিয়েছিলো। তাহলে সে এতোবড় বিশ্বাসঘাতকতা কেনো করলো? বিয়ে করতে পারবে না। অন্যত্র বিয়ে করবে আমাকে জানাতো। কিন্তু লুকিয়ে চুড়িয়ে কেনো বিয়ে করলো। চাইলেই সামনাসামনি হতে পারি। কিন্তু বান্ধবীর সুখের ঘর আমি ভাঙতে চাই না। তাই চুপ করে রইলাম।
এরমধ্যে রাফি একবার অনিমার কাছে থেকে ঘুড়ে গেলো। আমি অসুস্থ আর ঘুমিয়েছি ভেবে আর সাক্ষাৎ হলো না। বাড়িভর্তি মানুষের ভীড়ে রাফির আর সময় হলো না উপরের ঘরে আসার। মুখোমুখি হতেও হলোনা।অসুস্থ এই আমাকে নিয়ে বাবা মা দ্রুত ঢাকায় ব্যাক করলেন।
আমি সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারালাম। দুদিন হাসপাতালে ভর্তি রইলাম। যেদিন ফিরলাম সেদিন রাতে ফোনের স্ক্রেনে ভেসে উঠলো,
“কলিং রাফি”।
ফোন ধরলাম না। কয়েকবার ফোন বাজলো। রাত দশটায় মেসেজ এলো। মেসেজ ওপেন করে আমি ঘেমে উঠলাম।
চলবে??
#রং(ভুল)
#তন্নী_তনু