#রং(wrong)
#পর্বঃ৭
#তন্নী_তনু
এরকম একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থাকতে বেশীরভাগ পাঠক ইনবক্সে গল্প চেয়েছেন। অনেক রিকুয়েস্ট করেছেন। নিজের মাইন্ড ডায়ভার্ট এবং পাঠকদের মন রক্ষার্তে গল্পের পরের পার্ট দিলাম। গল্পে যেহেতু লুতুপুতু কিছু লিখিনাই। সো আমাকে কেউ খারাপ কথা বলবেন না। গল্পটি অনুপ্রেরণা মূলক হবে। সো খারাপ কিছু নেই। বাকিটা নিচে 👇
#পর্বঃ৭
#লেখনিতেঃতন্নী_তনু
অন্ধকারের ডুবে আছে গারদে’র চার দেয়াল। পাহাড় ধসের মতো নেমে আসা ক্লান্তিতে ঘুমের অতলে ডুবে গেছে সিনথিয়া।বহুদিন তার চোখে ঘুম নেই। তবে আজ শরীর তাকে ছুটি দিয়েছে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেছে তার থেকে অনুমতি না নিয়েই।নিস্তব্ধ, নিশব্দ, নিঝুম রাত পোঁছে গেছে শেষের ঠিকানায়। সিনথিয়া ঘুমে আছন্ন। গারদের লোহার দরজাটা হঠাৎ টুং করে উঠে।ঘুম হালকা হয়ে আসে। ভেসে আসে বহু সাবধানে ফেলা পায়ে’র মৃদু আওয়াজ।গভীর ঘুম বন্য হরীণের ন্যায় ছুটে পালিয়ে যায়।তার অনুভূতি নাড়া দিয়ে বলে- কেউ যেনো তার দিকে’ই গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। তুষারপাতের ন্যায় হীমশীতল হয়ে আসে তার শ্বাস। ঘন হয়ে আসে বুকের মধ্যে। চোখ দু’টো ভয়ে কোটরে লুকাতে চায়।চোখ টেনে তাকানোর সাহস হয়ে ওঠে না। চোখ খুলে কাকে দেখবে সে? জীবনের টানাপোড়েনে আর কতো কি দেখবে সে? এই বদ্ধ চার দেয়ালের ঘরে অচেনা মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়ে!সে ডাঙায় উঠে আসা মাছের মতো ভেতরে ছটফট করে! মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারে না!শ্বাস চেপে রাখে শব্দ হওয়ার ভয়ে। ঠিক তখনই তার খুব কাছে ঘন হওয়া বরফের ন্যায় শীতল শ্বাস তার চোখে মুখের উপর ঠিকড়ে পড়ে। অন্ধকার ঠেলে ভয় ভীতি ছুড়ে ফেলে লাফিয়ে ওঠে সিনথিয়া। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
— কে!!
— কে!!”কে”শব্দটা চার দেয়ালে বারি খায়। কালো মেঘের ন্যায় অন্ধকার কক্ষ, চোখ দু’টো যেনো ছেপে আসে সিনথিয়ার। অন্ধকার হাতড়ে উঠে দাঁড়ায়।পায়ের শব্দটা গাঢ় থেকে নিমিষেই শূন্যের মতো যেনো মিলিয়ে যাচ্ছে। আলো জ্বেলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় সিনথিয়া। “কই কেউ নেই তো! সিনথিয়া গারদে’র দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। কোথাও কেউ নেই! তাহলে এতোক্ষণ যা হলো!তা কি করে সম্ভব?
*
*
*
ঝলমলে আলো আর তপ্ত রোদে ফেটে যাচ্ছে সকালবেলা। ভ্যাপসা গরমে আগুনের ন্যায় পুড়ছে সিনথিয়ার শরীর। তবে তার হেলদোল নেই।গুটিশুটি মেরে বসে আছে সেই রাত থেকেই। দু’টো চোখ চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছে একজন মানুষের। যার দেখা পেলেই গড়গড় করে বেরিয়ে আসবে সকল তালাবদ্ধ কথা। “জীবনের এই অভিশপ্ত সময়ে ঐ একজন মানুষ আলোর দিশা হয়ে ধরা দিয়েছে। যার ভরসায় এখনো আশা করে আছে সে”একদিন হয়তো মুক্তি মিলবে।” কিন্তু মানুষটা কি এই তুচ্ছ সিনথিয়ার সন্ধানে আসবে?” অনিশ্চিত জেনেও সিনথিয়া অপেক্ষায় থাকে! কালকে তার উপর ক্ষিপ্ত,রুষ্ট মানুষটি কোনো প্রয়োজনে যদি তার খোঁজে আসে।
—
সকাল সকাল তীব্র রোদে ফেটে যাচ্ছে দক্ষিণমুখী বেলকুনি।রোদে’র তীর্যক রশ্মি চাপা দিতে থাই গ্লাস টেনে,পর্দা ফেলে পুনরায় বিছানায় বসে ইরফাদ। এক’পা বিছানায় ভাজ করে ফেলে তার উপর বালিস টেনে নেয়। ল্যাপটপ তুলে নেয় কোলের উপর।অফিস যাওয়ার আগে আরেক’টু তথ্য দরকার। তাই খাবার সময় টুকু’তে বাকি কাজটাও সেরে নিবে সে।সাইড টেবিলের মিনি ট্রে তে নাস্তা দিয়ে গেছে ইভা। মেয়েটা মায়ের মতো করে যত্ন নেয় তার। বয়সে ইরফাদে’র ছোট। তবে দায়িত্বের বেলায় যেনো বড় বোন। পাঁচ মিনিট আগে ওটস, ইয়োগার্ট,মধু মেখে উপরে ফ্রুটস সাজিয়ে দিয়ে গেছে মিনি ট্রে তে।মেয়েটা খুব শৌখিন। প্রতিদিন এই কমন নাস্তাটা খুব যত্ন করে সুন্দর করে পরিবেশন করে।ট্রে’তে থাকা চামুচে সারভিং ডিস এর ওটস আর ফ্রুটস মেখে নিচ্ছে ইরফাদ। এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে,
— ইরফাদ! তোমাকে (শিমলাপুর- ছদ্মনাম ) যেতে হবে।ওখানে দূর্ঘটনা ঘটেছে। দশটা’র মধ্যে পোঁছাতে হবে। ” প্রভাতরঞ্জন সরকার ফোন দিয়েছেন। উত্তরে ইরফাদ বলে,-“ও.কে স্যার।”
ফোন রাখতেই দরজার ওপাশে থেকে একটি মিষ্টি গলা ভেসে আসে,
— “আসবো মামাই?”
টিয়া পাখির মতো স্বর শুনে দরজার পানে তাকায় ইরফাদ। দরজা হালকা ফাঁক হয়েছে। তবে এপাশের অনুমতি না পেলে টুম্পা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। ইরফাদ ডাকে,
— আসো আম্মু!
টুম্পা নরম তুলতুলে পা ফেলে ভেতরে আসে। মুখ গম্ভীর,থমথমে।চাঁদের মতো মুখটা পানিহীন অর্ধমৃত গাছের ন্যায় নেতিয়ে পড়েছে। ইরফাদ ট্রে’তে ডিস রাখে। ল্যাপটপ’টি এক হাতে ফোল্ড করে রেখে,বিছানা থেকে নেমে পাঁচ বছর বয়সী টুম্পাকে দু’হাতে শূন্যে তুলে কোলে নেয়। মুখ পানে চেয়ে বলে,
— ” কি হয়েছে মা!” টুম্পা কথা বলে না। শুধু চুপচাপ থাকে। ইরফাদ জানে মেয়েটা কখন এতো স্তব্ধ হয়ে যায়। তাই আর জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। ছোট্ট টুম্পার কপালে ছোট্ট হামি দেয় ইরফাদ। তারপর বলে,
— “মামুনি’কে বোকবো! ওকে!” টুম্পা চুপ করে থাকে। যার অর্থ “তার মা’কে বকা যাবে না।” ইরফাদ মৃদু হাসে। তারপর বলে,
— “ওকে,,,তুমি যা চাও তাই হবে, হ্যাপি! নাউ স্মাইল!”
ছোট্ট টুম্পা ঠোঁট ছড়িয়ে দেয়।
*
*
রাতের সেই বিস্ময়কর ঘটনা বলার জন্য সিনথিয়া পথ পানে চেয়ে আছে।কিন্তু ইরফাদ সারাদিনে একবারো এলো না। “সে যদি এই ঘটনা অন্য কাউকে বলে -কেউ গুরুত্ব দিবে না।হয়তো বিশ্বাস ও করবে না।” আবার যদি কাউকে না জানায়!এই গারদে ভয়ে ভয়ে আজ রাতে সে পরপারে চলে যাবে! কাছাকাছি দায়িত্বরত মহীলা পুলিশকে ডাকে সিনথিয়া,
— এসপি সাহেব আসবেন না?
মহিলা পিটপিট করে তাকালো সিনথিয়ার দিকে। যেনো হীরা- পান্না চেয়ে বসেছে। সিনথিয়া নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে কৌশলে জিজ্ঞেস করলো ,
— না মানে! আমার কেস তো তিনিই দেখছেন। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময়- কিছু ইমপরট্যান্ট টপিক ভুলে গিয়েছিলাম । ঐটা মনে পড়লে বলতে বলেছিলো। তিনি কি আসবেন না?
— নাহ! খুব প্রয়োজন ছাড়া তিনি থানায় আসেন না। তিনি হেডকোয়ার্টারে থাকেন।
সিনথিয়ার এতো সময়ের অপেক্ষার উপর এক বালতি পানি ঢেলে পড়লো। তাহলে কিভাবে গত’রাতের ঘটনা বলবে! আবার রাত আসতে চললো। আজ এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে কি হবে? যে করে ই হোক এই কথা তার জানাতেই হবে। সে একটি সুক্ষ প্রচেষ্টা চালালো।
— স্যার তো বলেছিলো বিষয়টি মনে পড়লেই যেনো জানাই। খুব ইমারজেন্সি। তাহলে কিভাবে জানাবো?
— ডিপার্টমেন্টে জানানো হবে। প্রয়োজন হলে আপনাকে ডাকা হবে।
সিনথিয়া একটু হাফ ছাড়লো। একটা তো উপায় বের হয়েছে। এতেও সে একটু সস্তি পাচ্ছে। যে করেই হোক তাকে ঘটনা’টা জানাতেই হবে।
——–
শিমলাপুর নয়াঘাটের পারে দাঁড়িয়ে আছে ইরফাদ। সাথে তার সহকারী কয়েকজন। ঘাটের সিঁড়িতে মিলেছে আরেকটি লাশ। কিন্তু এবারের চিত্রটি ভিন্ন। বিধ্বস্ত অবস্থা পড়ে আছে এক তরুণী।যার হৃদপিণ্ড বুক থেকে চিরে বের করা হয়েছে। র/ক্তে ভেজা শরীর। ডান গালে কালো কালিতে একটি সুক্ষ চিত্রকর্ম।তার মধ্যে কালো কালিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লেখা আছে কিছু একটা। ইরফাদ তার অ্যাসিস্ট্যান্ট এর উদ্দেশ্য বলে, “জাবির দেখোতো কি লেখা আছে ?”
জাবির লাসটির গালের পর্যবেক্ষণ করে। না কিছু বোঝা যাচ্ছে না। হাতে থাকা ম্যাগনিফাইং গ্লাস ধরে জাবির। তারপর বলে,” প্রেমিক!”
*
*
*
“স্যার! মনে হচ্ছে প্রেম ঘটিত বিষয়।” জাবিরের কথা শুনতে শুনতে স্ট্রিয়ারিং ঘুরায় ইরফাদ। লাশ পোস্ট মর্টেমে পাঠানো হয়েছে। ইরফাদ বলে,
— বলো, তারপর!
— আমি বুঝাতে চাচ্ছি স্যার! যেহেতু মেয়েটির হৃদপিণ্ড বের করে নেয়া হয়েছে। আবার এমন একটি ওয়ার্ড লিখে দিয়েছে । মনে তো হচ্ছে প্রেম ভালোবাসার কেস ই হবে।
–তাই!
— এখনকার জেনারেশনে যেমন প্রেম আর কি! একসাথে অসংখ্য অ্যফায়ার কন্টিনিউ করে। ওরকম কিছু টের পেয়ে হয়তো মা/র্ডার টা করা হয়েছে।
–কিন্তু জাবির! আমি তো অন্য কিছু দেখছি!
——-
রাত নয়’টা উত্তরমুখি বেলকুনিতে দু’জন কপোত-কপোতি মুখোমুখি আরাম করে বসে আছে । সদ্য ফোটা ফুলের ন্যায় তাদের নতুন জীবন। শোভা আর সুরভীতে ভরপুর তাদের সময়। আর এটাই স্বাভাবিক। দুজনে গল্পে মশগুল।তাদের গল্পের বিষয় জানা নেই তবে কথার ফাঁকে ফাঁকে অল্প বয়সী তরুণ,তরুণীর কোমল হাতের উল্টোপাশে- অধরের শীতল স্পর্শ দিচ্ছে বারংবার। কখনো বা এলোকেশী চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।তাদের খুনশুটি’ই জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছে ইভা।নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষে যখন ফলাফল মিলছে না তখন দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় ঝড়ছে অশ্রুবিন্দু।পাঁচ বছর বয়সী টুম্পা চুপচাপ বসে আছে বিছানায়। শিশু টুম্পা হওতো মা’য়ের কান্নার কারণ জানেনা। তবে কান্না যে ব্যাথা পেলে আসে তা তো সে জানে। আর মা’য়ের কান্না তার স্তব্ধ হওয়ার কারণ। ইভা জানালার পানে চেয়ে চোখের জল ফেলছে। ইরফাদ দাঁড়িয়ে আছে ঠিক পেছনে। সামনের বেলকুনিতে ছোট্ট ভালোবাসার যে ঘর গড়ে উঠেছে। তাদের খুনসুটি দেখেই ইভা’র পুরোনো স্মৃতি জেগে ওঠে, কষ্ট পায়। ছোট্ট টুম্পা বুঝতে না পারলেও ইরফাদ তো বোঝে।এদিকে ভুল কে শক্ত হাতে দমন করা ইরফাদের প্যাশন।তাই পেছন থেকে শক্ত গলায় বলে,
— “ইভা!এক কথা কতবার বলবো তোকে? রুম চেঞ্জ করতে বলেছিলাম না?” পেছন থেকে ইরফাদে’র বজ্রকন্ঠ শুনে ভেতর থেকে কেঁপে ওঠে ইভা। পেছন ঘোরার আর সাহস পায় না। দু’হাতে তড়িঘড়ি করে চোখের জল মোছে। ইরফাদ টুম্পাকে বিছানা থেকে কোলে তুলে নেয়। ছোট্ট হামি দিয়ে নামিয়ে দেয় কোল থেকে। তারপর বলে,
— “বাবা! দেখোতো নানু ভাই কি করে?”
টুম্পাকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়াতে ইভা আরও ভয়ে জমে যায়। ইরফাদ এবার আরও শক্ত গলায় বলে,
— “এদিকে ঘোর! তোকে রুম চেঞ্জ করতে বলছি না?” ইভা জানে! কথা অমান্য করা ইরফাদে’র পছন্দ না। তাই সে কথামত ঘুড়ে দাঁড়ায়।মাথা নিচু করে রাখে। কথার উত্তরে মাথাও নাড়ায়। তারপর ভয়ে ভয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,
— টুম্পা অন্য রুমে শিফট হতে চায় না ভাইয়া। অন্য রুমে গেলে রাতে ঘুমায় না। ঐ জ..জ.ন্য আরকি…
ইরফাদ চোখ রাঙিয়ে বলে,
— ফার্দার যেনো এই জানালায় দাঁড়াতে না দেখি। গট ইট!
ইভা আবার মাথা নাড়ে। ইরফাদ বেরিয়ে যেতে নিয়ে থামে। তারপর বোনের দিকে ঘুরে নরম গলায় বলে,
— ভুল জিনিস স্মৃতিচারণ করে কষ্ট পাওয়া আরেকটা বড় ভুল। তাই যত তাড়াতাড়ি মুভ-অন করবে, ততো ভালো। তোমার কান্নার ইফেক্ট ছোট্ট বাচ্চার উপর পড়ে। সো! ফরগেট ইউর পাস্ট!
——-
সিনথিয়ার অপেক্ষার ফলাফল শূন্য। ইরফাদ আসেনি। তার ভিতরের জমে থাকা ভয়ভীতি’র রাতের কথা বলা হবে না। আজকের রাত্রি নির্ঘুমে কাটবে নিশ্চিত! ভয়ে ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয় আরও। রাতের কথা ভাবতেই বুক চিরে হাহাকারে চোখ থেকে অনবরত জল পড়তে থাকে। হাঁটুর ভাজে মুখ লুকিয়ে রাখে। এমতাবস্থায় একজন মহীলা পুলিশ এগিয়ে আসেন। নিজের ফোনটি সিনথিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন,
— ” ইরফাদ স্যার কথা বলবেন।” বাক্যটি যেনো সস্তির পরশ হয়ে বকুল ফুলের মতো তার উপর ঝড়ে পড়লো। এই অসহনীয় মূহুর্তে এই একজন মানুষ তাকে আলোর সন্ধান দেয়,সাহস দেয়।সে ছুটে এসে বাঘিনীর মতো থাবা দিয়ে ফোনটি নেয়। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বলে,
–আসসালামু আলাইকুম।
সালামের উত্তর নিয়ে অপর পাশে’র মানুষটা শীতল গলায় বললো,
–“আর ইউ ওকে?”
“প্রচন্ড বিষণ্নতায় প্রতি মূহুর্তে ডুবতে থাকা সিনথিয়ার জীবনে এই বাক্যটুকু বলার জন্যে অবশিষ্ট কেউ ছিলো?ভাবতেই সিনথিয়া শূন্যে তাকিয়ে থাকে। প্রতিনিয়ত চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে সে। তার পাশে আজ কেউ নেই,কেউ না। “সে বেঁচে আছে কি না” এইটুকু দিয়েও হয়তো কারো কিচ্ছু যায় আসে না এখন। “সে ঠিক আছে কি না? ভালো আছে কি না?” এসবে’র দাম এখন শূন্যের কোঠায়। এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে এতো বড় মাপের একজন মানুষের মুখে তার ঠিক থাকার প্রশ্ন শুনে চোখের জল নিরবে গড়িয়ে পড়ে। ভাগ্যের বেড়াজালে! এক অকল্পনীয় মরণ ফাঁদে আটকে পড়া, প্রতি নিয়ত নতুন নতুন যন্ত্রণার স্বাদ পাওয়া! ঝাঝরা হওয়া বুকে ব্যাথাগুলো আগুনের ফুলকি আকারে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বুক ভারী হয়ে আসে। অসহনীয় যন্ত্রণায় গলা ভারী হয়ে আসে। ক্ষীণ হয়ে আসে স্বর।সে ক্ষীণ স্বরে বলে,
–“হুম।” মিলি সেকেন্ডের মধ্যেই ওপাশ থেকে ইরফাদের শীতল কন্ঠে ভেসে আসে,– “কাঁদছো কেনো?”
কথাটি যেন হৃদয়ের অন্তরস্থলে গিয়ে ঠেকে সিনথিয়ার। সেকেন্ডের জন্যে শ্বাস বন্ধ হয়।ঘন হয়ে আসা শ্বাস বেরিয়ে আসে ধুকপুকুনি হয়ে। এই যে তার আত্মার বান্ধবী চোখের পানি দেখেও তো বললো না-কাঁদছিস কেনো? চোখের জলের উপর মুখের কথায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কতজন।আরও কতোশত কাছের মানুষ মুখ ঘুড়িয়ে নিয়েছে তার থেকে।”
যে পৃথিবীতে একই বিছানায় মুখ ঘুড়িয়ে শুয়ে থাকা এমন কিছু স্বামী আছেন যারা স্ত্রী’র পাশে শুয়েও কান্নার শব্দ শুনতে পায়না। পেলেও কনফিউশনে বলে কাঁদছো নাকি?” সে একই পৃথিবীতে ফোনের অপরপৃষ্ঠের মানুষটা তার কেউ না হয়েও, তাকে স্বচক্ষে না দেখে এতোটা দূরত্বে থেকেও একদম শতভাগ নিশ্চিত হয়ে কি করে বললো “কাঁদছো কেনো?”তিনি কোনো কনফিউশান রাখেননি। তিনি বলেননি কাঁদছো নাকি? সে সরাসরি কান্নার কারণ জানতে চেয়েছে। কিভাবে বুঝলেন তিনি? সে তো কেঁদেছে নিরবে, নিঃশব্দে।তাহলে ফোনের অপর পৃষ্ঠের মানুষটি কি করে বুঝলো? সিনথিয়া চুপ করে থাকে। চোখের জল টুপটুপ করে পড়ে। ওপাশে থাকা ইরফাদ শীতল গলায় বলে,
–“ভালো-খারাপের সংমিশ্রণেই জীবণ!খারাপ সময়ের মোকাবেলা যতো শক্ত হাতে করবে,ততই কষ্ট কম পাবে। ভেঙ্গে পরা যাবেনা।জানো তো! রাত যত গভীর হয়,ভোর ততো নিকটে আসে।সো,ডোন্ট ক্রাই!”
সিনথিয়া’র দুঃখের সাগরে এক চিমটি ভালোর মূহুর্ত্তের ছোঁয়া পেয়ে যেনো আরও দূর্বল হয়ে পড়ে। চোখের জল বাঁধ ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়ে।নিজেকে সংযত করতে নিজের হাতের আঙুল কামড়ে ধরে। ক্ষাণিকটা সময় পর ইরফাদ বলে,
— কিছু বলবে বলেছিলে!!
সিনথিয়া কান্না মুছে নেয়। স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করে,
–আমার মনে হলো কাল রাতে এইখানে কেউ এসেছিলো!
— মনে হয় কথার কোনো ভিত্তি নেই!
— কিন্তু আমার তো মনে হলো! মনে হলো মানে!কেউ এসেছিলো সিউর!
— “নাইটমেয়ার” হতে পারে!
–কিন্তু…আমার তো সত্যি মনে হলো।
— তুমি সেইফ জোনে আছো সিনথি।রাখছি…
ওপাশের মানুষটার রাখছি বলা উপেক্ষা করে নির্ললজ্জের মতো সিনথিয়া আবার বললো,–“কিন্তু আজও যদি আসে। আমার খুব ভয় করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
ক্ষাণিকটা দম নিয়ে আবার বলে,
— এর আগে রাফির মতো আমাকেও কিডন্যাপিং এর চেষ্টা করা হয়েছে। দু’টো মুখোশধারী মানুষ আমাকে ধরার জন্যে…..
— হোয়াট?
–হুম।
— আমাকে ইনফর্ম করেছো?
— বুঝলেন তো ! অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়। আমি তো সেদিন আপনা’কে তিনটা কল দিলাম। না হলো রিসিভ আর না করলেন কল ব্যাক। আমি তো তখন নিজেকে বাঁচাতে রাস্তা দৌঁড়ে বেড়াচ্ছি। একটা মেসেজ ও করলাম। বাবা থানায় হেল্প চেয়ে অপমানিত হয়ে গেলেন। সেদিন কোনো রকম বেঁচে ফিরলাম। তবে মরে গেলেই ভালো হতো। পরেরদিন মানসম্মান অন্তত যেতো না।
–আমি বি’জি ছিলাম। কিন্তু অন্যসময়েও তো বলা যেতো!
— এই যে আজ বললাম।
–ও.কে, ডিটেলস বলো।
____________
মাঝ রাত রীমা ফিসফিসিয়ে কথা বলছে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে,
— আজ’কে নিউজ দেখেছো? কি যে অদ্ভুত!
— কি?
— একটি মেয়েকে মার্ডার করে ফেলে রাখা হয়েছিলো। তার হৃদপিণ্ড বের করে নেয়া হয়েছে।
— দেখেছি তো!
— আমি খুব ভয় পেয়েছি! এমন অদ্ভুত ঘটনা কখনো দেখিনি। হৃদপিণ্ড কেনো বের করে নিলো বলোতো?
— আমি কি ডাক্তার নাকি পুলিশ বলোতো? আমি এতো রহস্য বুঝিনা।
— আচ্ছা বাদ দাও! আচ্ছা, শুভ্র! এভাবে আর কতো দিন থাকবো? আমার তো একা আর ভালো লাগে না। এই লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করা।
— এই একটা মাস সময় দাও! এর মধ্যেই সব ব্যবস্থা করবো।
— প্লিজ! আর সময় নিও না। সত্য কখনো গোপন থাকে না।
বিকেল পেরিয়ে যাচ্ছে। আর একটু পরেই সন্ধ্যা,তারপরেই রাত।সিনথিয়া বিষণ্ন মনে চুপটি করে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। এক বদ্ধ কুঠুরিতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় এই বন্দি খাঁচা থেকে কবে পাখির মতো উড়াল দিতে পারবে? কবে মুক্ত আকাশ দেখতে পারবে। তার জীবণে কি এমন দিন কখনো আসবে? নাকি আধারের অতল গহীনে ডুবে যাবে তার জীবনের প্রদীপ-শিখা।চোখের জল উথলে পড়ে সিনথিয়ার। আর কতো চোখের জল ফেলবে সে? হাঁটুর ভাঁজ’এ মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদে সে। গারদের ওপাশ থেকে মহীলার কন্ঠ ভেসে আসে। তারপর একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
— “মিস সিনথিয়া “আপনার পার্সেল!”
—— #লেখনিতেঃতন্নী_তনু……
সিনথিয়া সাদা রঙের প্যাকেটটি খুললো। কটনের মধ্যে পিউর নীল রঙের লং কুর্তি। সাথে একটি ল্যাডিস প্যান্ট। পায়ের কাছটায় দু’টো জিপার। চোখ মুখ কুচকে এলো সিনথিয়ার। মনের সাথে কথা চলছে তার ” কে দিলো?” অপর পক্ষ যেনো উত্তর দিলো,” আমরাও তাই ভাবছি, কে দিলো?” অবাক হওয়া চোখ দু’টো উচ্চ সীমায় পৌছে গেলো যখন আরেকটি প্যাকেট থেকে বের হলো সাদা রঙের স্লিপার। “কে দিলো এসব?”
—–
শিমলাপুরের মতো আরও কিছু জায়গায় আরও চারটি লাশ উদ্ধার! গল্প প্রায় একই! সবগুলো লাশের হৃদপিণ্ড বের করে নেওয়া হয়েছে! এবং লাশের গালে আলাদা আলাদা চিত্র আঁকা। এবারে চিত্রগুলি ভিন্ন কথা বলে! কিছু চিত্র গুলোতে অক্ষর লেখা আছে। যেগুলো সাজালে শব্দ গঠন হচ্ছে। শব্দ গুলো যেনো একই জিনিস ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ঐ দিকে প্রত্যেক পরিবারের ভাষ্যমতে,” কিলার প্রথমে সতেরো-আঠারো বয়সী মেয়েদের কিডন্যাপ করেন। এরপর মুক্তিপণ দাবি করেন, এবং ব্ল্যাকমেইল করেন”যদি মুক্তিপণ যথাস্থানে না পোঁছায় তাহলে মেয়েদের সাথে রে/প করা হবে এবং সেই ভিডিও অনলাইনে ছাড়া হবে।” ভুল করেও পুলিশকে জানানো হলে! তাদের মেয়েকে চিরতরে হারাবেন। ঠিক এই কারণে অনেকেই দিয়েছেন মুক্তিপণ। এতপরও তারা তাদের সন্তান জীবত অবস্থায় ফেরত পাননি। তাদের প্রত্যেকের কাছে ফোন কলগুলো করা হয়েছে স্প্যাম নম্বর থেকে। দেশ জুরে উত্তাল এই খবরে। ভয়ে বাচ্চাদের ঘরের বাইরে পাঠাচ্ছেন না অভিভাবক। আতঙ্কে আতঙ্কে কাঁপছে শহর থেকে গ্রাম। স্কুল কলেজে টিচার আসলেও আসছেনা শিক্ষার্থীরা। সব মিলিয়ে প্রেশার এসে পড়ছে পুলিশদের উপর।
*
*
*
গোধূলি বেলায় সিনথিয়া’র চোখ পুড়ছে। রাতে ঘুমিয়েও পরিপূর্ণ ঘুম হলো না। পরপর কয়েক রাত ঘুম না হওয়ায় চোখ ফুলে গেছে। সিনথিয়া বসে বসে ঝিমাচ্ছে। এর মধ্যে গারদের ওপাশ থেকে কারো গমগমে গলা ভেসে এলো। সিনথিয়া চোখ তুলে তাকায়, গারদের ওপারে মহীলা পুলিশ দাঁড়িয়ে বলছেন,
— মিস সিনথিয়া! স্যার দশ মিনিটের মধ্যে আপনাকে নিতে আসবেন। বাইরে যাওয়ার জন্যে আপনি রেডি তো?
পাঠক আপনারা রেডি তো?
# পরের পর্ব থেকে ধীরে ধীরে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে। চেষ্টা করেছিলাম এই পর্বে কিছুটা ক্লিয়ার করার কিন্তু হবে না। এই পর্ব পড়ে একটু ধৈর্য্য ধরে থাকবেন। অতি শিঘ্রই পরের পর্ব আসবে ইনশাআল্লাহ।