#রং(wrong)
#পর্বঃ১৫
Tonni-Tonu
ড্রিম লাইটের মৃদু আলো, সিলিং এ ঝুলানো ফ্যানের ক্যাট ক্যাট আওয়াজ, পাশের রুমে উচ্চ শব্দে বাজানো গান আর বুকের ভিতরে দাউদাউ করে জ্বলা আগুনে পুড়ছে রিমা। তার বোধ শক্তি যেনো শূন্যের কোটায়। জীবনের কিছু মূহুর্ত আসে মনে হয় নিজেকে নিঃশেষ করার জন্যে। অন্ধের মতো বিশ্বাস করে- ঠকে গিয়ে বেঁচে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে যেনো সে। কিছু সময় নিজের মস্তিষ্ক শূন্য মনে হয়। মনে হয় সব যদি দুঃস্বপ্ন হতো! সাদা ধবধবে টাইলসে কাত হয়ে দ স্টাইলে শুয়ে আছে রিমা। চোখের কোণা ছুঁয়ে পড়ছে উষ্ণ নোনতা জল। অদৃশ্য তিক্ত ছোঁয়ায় বুজে আসছে গলা। যেনো কেউ দুহাতে গলা চেপে ধরে আছে। বুকের উপর পুরো পৃথিবীর ভার যেনো চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার। মাথার যন্ত্রণায় নার্ভ যেনো ছিড়ে যাচ্ছে! এতো যন্ত্রণা কেনো? কেনো? কি অপরাধ ছিলো তার! তেলের ঘানিতে টেনে টেনে পিষে ফেলা সরিষা থেকে টুপটুপ করে তেলের সৃষ্টি ঠিক সেরকম বুকের ভেতরের যন্ত্রণা তাকে পিষে পিষে রক্তগুলো যেনো চোখের জলের সৃষ্টি করছে। একফোটা চোখের জল যেনো শরীর থেকে চুষে আনা রক্ত। সে চোখ মুখ খিঁচে কামড়ে ধরে ওষ্ঠধর। ঠকে যাওয়ার এতো যন্ত্রণা জানলে সে কখনোই ভালোবাসাতো না। এর চেয়ে কেউ তাকে দগ্ধ আগুনে পুড়িয়ে মারতো। অথবা কূল কিনারাহীন অথৈ সাগরে ফেলে দিয়ে আসতো। তাহলেও এতো ভুগতে হতো না। রিমা চোখ বন্ধ করে।তখন-ই পাশে থাকা কয়েকটি মেয়ের মধ্যে একজন শব্দ করে ওঠে।শব্দগুলো অনেকটা বোবাদের মতো শোনা যায়। তার কথা বাঁধা পড়ছে স্কচটেপের আড়ালে। রিমা উঠে বসে-নিজের হাতের বাধন খুলে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে মুখোমুখি বসে অচেনা মেয়েটির। মুখের স্কচটেপ একটানে খুলে দেয় রিমা। হাঁপিয়ে ওঠা মেয়েটি চোখ ঘুড়িয়ে দেখে চারপাশ। বড় বড় শ্বাস টানে। বিপদ টের পেয়ে গলা শুকিয়ে আসে তার। জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নেয় ওষ্ঠ কয়েকবার। একগ্লাস পানির খুব বেশী-ই প্রয়োজন। কলিজা অবধি শুকিয়ে গেছে যেনো। মেয়েটি রিমার দিকে তাকিয়ে বলে,
–এতোগুলো মেয়ে এভাবে পড়ে আছে কেনো?
রিমা অল্প বয়সী মেয়েটির চোখ মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারে সে অনেক বেশী-ই ভয় পাচ্ছে। তার শ্বাস উঠানামার অবস্থা বেহাল। রিমা মেয়েটির থুতনিতে আলো করে হাত রাখে। তারপর নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বলে,
— নাম কি তোমার?
— চৈতি…..তুমি কে? আমরা এখানে কেনো?
–আমি রিমা… তোমার প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই বোন। তবে এতোটুকু জানি! আমরা বিপদে আছি।
চৈতি ছোট বাচ্চাদের মতো ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে ফেলে।রিমা সাথে সাথে মুখ চেপে ধরে,
— একদম না!এমন সময় কাঁদতে নেই। আমাদের বের হওয়ার রাস্তা বের করতে হবে। এটাই অপশন। কাঁদলে আরও পস্তাতে হবে।
চৈতী ঠেলে আসা কান্নার সামনে যেনো নিজেই পাথর হয়ে বাঁধা দেয়। কান্না বন্ধ করে মূর্তির মতো বসে। হাতদুটো তখনো বাঁধা।এতোগুলো নিষ্পাপ প্রাণ এভাবে নষ্ট হবে ভেবে কূল পায়না রিমা। নিজের জীবন তো নষ্ট-ই। তাই বলে বাকিদের জীবন তো নষ্ট হতে দিতে পারে না। মৃত্যুর আগে সর্বশক্তি দিয়ে বাঁচার তো চেষ্টা করা উচিত। সে নিজে না বাঁচুক। বাকি প্রাণগুলো তার জীবন দিয়ে হলেও বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিত। রিমা ফিসফিস করে বলে,
— বিপদের সময় কাঁদলে কোনো সমাধান হয় না। আমাদের উচিত প্ল্যান মাফিক আগানো। চলো সবাই-কে প্রথমে ডেকে তুলি। তারপর প্ল্যান….
রিমা ধীর গলায় প্রত্যেকটি মেয়েকে ডেকে তোলে। তারপর গোল হয়ে বসে। রিমা প্ল্যান সাজায়। সবাইকে প্রথমে শান্ত হতে বলে,
— আমরা কেউ-ই জানি না তারা কেনো আমাদের তুলে এনেছে। এবং কি চায়। জানা আমাদের উদ্দেশ্য-ও নয়। আমাদের ফোকাস থাকবে এখান থেকে বের হওয়া। তোমরা যখন ঘুমন্ত অবস্থায়, আমি পুরো বাসা দেখে এসেছি। আমরা এখন দো-তলায় আছি। নিচ তলায় পাহারা দিচ্ছে অনেকেই। তো প্ল্যান হলো আমি ছাদের দিকে যাবো। আর এমন ভাবে যাবো ওরা যাতে বুঝতে পারে কেউ পালাচ্ছে। তখন বেশীর ভাগ লোক উপরে উঠে যাবে। আর তোমরা নিচে চলে যাবে। মেইন দরজার চাবি আমার কাছে আছে।দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যাবে।
বাকিদের মুখটা ছোট হয়ে আসে। এতোটুকু সময়ের মধ্যে-ই তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য টান তাদের এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলো,
— তাহলে তোমার কি হবে?
–আমার যাই হোক। ওসব চিন্তার বিষয় না। তোমরা আগে নিজেদের বাঁচাও।
তাদের মধ্যে একজন বলে উঠলো,
— তুমি আমাদের জন্যে এতোটা ভাবছো? আর আমরা তোমাকে বিপদের মধ্যে রেখে চলে যাবো?
— দেখো আমরা সকলেই যদি একসাথে বের হতে চাই। কেউ ই বের হতে পারবো না। আসলে ওরা ঠিক কতো জন আমরা কেউ জানিনা। যদি আমি ছাদের দিকে যাই। ওদের ফোকাস হবো আমি!বাদ বাকি দুই-চার জনের সাথে মোকাবেলা করবে তোমরা।
সবাই মুখ মলিন করে ফেলে। তবে বাস্তবতার সাথে আবেগের জায়গা নেই।এখানে আবেগ দেখালে সবাইকে মরতে হবে। তারা প্ল্যান মাফিক প্রস্তুত হয়। ঠিক তখন-ই মেঝেতে পায়ের খট খট আওয়াজ শোনা যায়। একে অপরের দিকে তাকায় তারা। রিমা ফিসফিস করে বলে,
— কেউ ভয় পাবে না। যার যার জায়গায় শুয়ে পড়। আর এমন অভিনয় করো!যেনো ভাবে তোমাদের ঘুম ভাঙ্গেনি। ওকে?
সবাই রিমার কথামতো আগের মতো শুয়ে পড়ে। যেনো ঘুমে বেঘোর তারা। রিমা আবার বলে,
— আমি দরজার পেছনে দাড়াবো!যে ঢুকবে তাকে এখানেই সাইজ করতে হবে। তবেই একজন কমবে! আর যতো মানুষ কমবে ততো আমাদের রাস্তা সহজ। সবাই বুঝতে পেরোছো?
সবাই রিমার কথা মতো পজিশন নেয়। রিমা মেইন দরজার লম্বা চাবি হাতের মুঠোয় পুরে দরজার আড়ালে দাঁড়ায়। লম্বা মতো একটা অল্প বয়সী ছেলে ঘরে ঢোকে। সবাই ঠিকঠাক আছে কিনা পর্যবেক্ষণ করে। রিমা পেছন থেকে এগিয়ে আসে। তার শ্বাস অস্বাভাবিক ওঠানামা করছে।ছেলেটি কিছুটা আঁচ করে। ঠিক তখনি পেছন থেকে রিমা সর্বশক্তি দিয়ে লম্বা চাবি মাথার মধ্যে গেথে দেয়। অকল্পনীয় তীব্র আঘাতে ছেলেটি মেঝেতে পড়ে যায়। বাকিরা উঠে দাঁড়ায়।একজন গলার ওড়না খুলে ছেলেটির মুখের মধ্যে ঠেলে দেয়। অন্যজন বাঁধে হাত, নিজেদের বাঁধা হাতের দড়ি দিয়ে বাঁধে ছেলেটির পা। তারপর টেনে খাটের তলায় ঠেলে দেয়।রিমা ফিসফিসিয়ে বলে,
–তোমাদের মধ্যে সাহসী যারা সামনে থেকো। আমি উপরে যাচ্ছি। মনে রেখো- আমি উপরের যাওয়া মানে ওদের ব্রেইনে প্রেশার পড়বে। ওরা একবার এই ঘরে কতোজন আছো দেখতে আসবে। একবার গুণে নিবে। তোমরা আগের মতোই পড়ে থাকবে। ওরা যখন দেখবে একজন নেই। ওদের ব্রেইন প্রেশার দিবে আমাকে ধরার জন্যে। ওরা আমার দিকে ছুটবে।আর নিচে পাহারায় যারা থাকবে ওদের সাথে তোমরা এক হয়ে লড়বে। মনে রেখো, দশের লাঠি এক এর বোঝা। তোমরা স্পর্শকাতর জায়গা গুলোতে আঘাত করবে। যেমন চোখ,নাক। এটা বাড়ি ডুপ্লেক্স আকার। আমি ডানদিক দিয়ে উপরে যাবো। বাম দিকের সিঁড়ি দিয়ে তোমরা নিচে যাবে।দরজায় ভাড়ি পাল্লা দেয়া। উপরে সিটকি লাগানো। দরজা খুলে কেচিগেইট। ওটা খুলতেই চাবি লাগবে। এই নাও চাবি!বাসা থেকে বের হয়ে সামনে বাম দিকের রাস্তা ধরে আগাবে। কোনো মানুষ পেলে ফোন নিবে। ট্রিপল নাইনে ফোন দিয়ে এই লোকেশনে আসতে বলবে। এটাই তোমাদের কাজ। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। রেডি হও তোমরা। দূর্বল হবে না কিন্তু।” বলেই রিমা বেরিয়ে যায়। এর আগে যে রুমে,কয়েকজন মানুষের কথা আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছিলো। ঐ রুমের সামনে দাঁড়ায় রিমা। আসার সময় সাজানো ফুলদানি নিয়ে আসে। হাতের ফুলদানি ছুড়ে ফেলে দেয়। তার শব্দে যেনো সজাগ হয় রুমে থাকা সব ছেলে। একে একে বাইরে বেরিয়ে আসে সকলে। রিমা দৌড়ে বেরিয়ে যায়। কেউ একজন বলে ওঠে,
— সাহেব! কেউ একজন জেগে গেছে। ও তো সামনের দিকে দৌড়াচ্ছে।
সবাই কথা মতো পিছু নেয়।নিচের কিছু ছেলে তেড়ে আসে উপরের দিকে। সবাই ছুটে যায় রিমার পেছন পেছন।বাকি মেয়েরা একে একে বাম দিকের সিঁড়ি দিয়ে নেচে নামে। নিচে কয়েকজন বসে আছে চেয়ারে। চৈতি গুণে নেয়। নিচে তারা মোট পাঁচজন। আর মেয়েরা নয় জন। পাঁচ জন ছেলের সাথে লড়া তাদের মতো মেয়েদের কাজ নয়। তারা পারবেও না। তারা চোখে চোখে কথা বলে নেয়!– চৈতী বলে আমি ঐ দিকের সিঁড়ি দিয়ে নামি। ওরা আমাকে দেখলে তোমরা পেছন থেকে আঘাত করবে। সামনা সামনি আমাদের মতো দূর্বলরা লড়তে পারবো না।” চৈতি এপাশের সিড়ি দিয়ে নামে। নিচের ছেলেগুলো উঠে দাঁড়ায়। পেছেনের মেয়েগুলো একসাথে একজোট হয়ে ছেলেগুলোকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। ঐদিকে রিমা ছাদে উঠে দাঁড়ায়। পায়ের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে সবাই তেড়ে আসছে তার দিকেই। এটাই তো চেয়েছিলো সে। তার জীবনের বিনময়ে বাকি প্রাণ বেঁচে থাকুক। এমনিতেও সে বেঁচে থাকলে বাঁচার মতো বাঁচতে পারবে না। মা-বাবার বোঝা, আর পুরো পৃথিবী তাকে আড় চোখে তাকাতে তাকাতে মারবে। তার চেয়ে ভালোবাসা”র মানুষের হাতে তার প্রাণ যাক। পৃথিবী আরেকবার দেখুক অন্ধ ভালোবাসা কতো ভয়ংকর।সে ছাদের দরজার পাশে দাঁড়ায়। একে একে সকলেই ছাদে ওঠে। এপাশ ওপাশ খুঁজতে শুরু করে। কেউবা ছাদের কার্ণিসে দাঁড়িয়ে উঁকি দেয় নিচে। ঠিক তখন -ই ছাদের দরজা লাগিয়ে দেয় রিমা। ঝুলন্ত তালার চাবি তার চেনা। ড্রয়ার থেকে চাবি আসার আগেই রেখেছে সে। তালা খুলে দ্রুত দরজায় তালা দেয়। চাবি ছুড়ে ফেলে অনেক দূরে। তারপর স্তব্ধ হয়ে বসে পরে। বাকিরা বিষ্মিত হয়ে পিছু ফেরে। মেয়টির মতিগতি বোঝা যাচ্ছে না। কি চায় সে! আবছা আলোয় সকলে ফোনের ফ্ল্যাস অন করে। রিমার যা কাজ ছিলো শেষ। এদের কিছুক্ষণ আটকে রাখতে পারলেই হলো। সে হাঁটু ভাজ করে হাঁটুর ভাজে মুখ লুকিয়ে ফেলে।ছেলেগুলোর পেছন থেকে কেউ একজন অবাকের উচ্চসীমা নিয়ে অতি আক্রোশে বলে,
— “রিমা! তুমি?” গলার স্বর অতি পরিচিত। অতি কাছের জনের। রিমা আরও শক্ত হয়ে বসে। এসব মোকাবেলার শক্তি তার নেই।এখন যা হবে তা শুধুই নাটক। শরীরে নাটক দেখার শক্তি নেই। পেছনের ছেলেটি শুভ্র। তা চোখ না তুলেও জানে রিমা। শুভ্র যেনো ছুটে আসে। যেনো রিমাকে দেখে আকাশ থেকে টুপ করে পড়লো সে।
ইরফাদ দাপিয়ে চালাচ্ছে তার গাড়ি। পাশে জাবির, সিনথিয়া পেছনে বসে আছে। সিনথিয়ার পাশে বসেছে রোহান।তারহাতে ল্যাপটপ। সে পেছন থেকে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। ইরফাদ তালমিলিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঐখানের পরিস্থিতি কেমন? কে আছে?কত জন আছে জানা নেই। তাই কোনো রিস্ক নেওয়া যাবে না। সব রেডি করেই মাঠে নেমেছে ইরফাদ। তবে আপাদত সে একাই যাবে।ঐদিকে চৈতিসহ বাকি মেয়েরা ছেলেগুলোর সাথে পেরে ওঠে না। তাদের আবারও রুমবন্দি করা হয়। রিমা ছাদে পাথরের মূর্তির ন্যায় বসে।শুভ্র”র কোনো কথা তার কানে যেনো প্রবেশ করছে না। শুভ্র পেছনে তাকায়। কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে বলে,
— আরাফ ভাই। ও আমার বউ।
আরাফের চোখ বলছে যেনো সব স্বাভাবিক। সে বলে,
–তো আমি কি করবো?
–আমার বউ আরাফ ভাই!ওকে ছেড়ে দিন!
— বউ টউ বুঝিনা।মেয়ে দিতে বলছে বারো”টা! এমনিই দু”ইটা কম।
–ভাই কি বলছেন!
–ধুর ব্যাটা!কথা বলিস না তো! শুয়েছিস কয়বার!তাই বল!
শুভ্র”র শরীর ভূ-কম্পনের মতো কাঁপে। আরাফ তিক্ত গলায় বলে,
–এমনিতেই একদম ফ্রেশ মা*ল দরকার। মাথা এমনিই খারাপ করে দিলি। আচ্ছা!দুই একবার ব্যাপার না। মেয়ে সুন্দর আছে। চালিয়ে নিবো। এবার সর…..
শুভ্র তেড়ে গিয়ে আরাফের কলার টেনে ধরে। তারপর আগুনের শিখার নেয় জ্বলতে থাকে,
–জীবন থাকতে “বউ” এর গায়ে ফুলের টোকা দিতে দিবো না।
রিমা”র চোখ দু”টো আর বাঁধ মানে না। এই বউ শব্দ’টা আগে হৃদয় স্পর্শ করতো তার। আজ কোনো বানানো গল্প,কোনো স্পর্শকাতর কথা,শুভ্র”র তাকে বাঁচানোর চেষ্টা কিছুই স্পর্শ করছে না। এর পেছনে কারণ যাই হোক? হোক শুভ্র মেইন ক্যারেক্টার নয়তো কোনো উইক ক্যারেক্টার। তবে সাথে তো ছিলো শুভ্র। পৃথিবী উল্টাপাল্টা হলেও সত্যে কোনো দিন মুছবে না।রিমা কোনোদিন আর ক্ষমা করতে পারবে না তাকে। ঐদিকে আরাফ সজোরে ধাক্কা মারে শুভ্রকে। শুভ্র পিছিয়ে যায় অনেকটা। আবার এগিয়ে আসতেই আরাফ রিমার দিকে রিভলবার তাক করে। পিছিয়ে যায় শুভ্র।
ইরফাদ অনেকটা দূরে গাড়ি থামায়। সিনথিয়াকে বুলেটপ্রুফ একটা জ্যাকেট পড়ানো হয়।তারপর ইরফাদ সকলের উদ্দেশ্য বলে,
–আমি ছাদ দিয়ে ঢুকবো। কন্ডিশন বুঝে তোমাদের ডাকবো।
সবাই সম্মতি জানায়। ইরফাদ দক্ষতার সাথে জানালার গ্রিলে দড়ি বেঁধে উপরে উঠতে থাকে। তারপর ছাদে চলে যায়। ছাদ ফাঁকা,ছাদের দরজা দিয়ে নিচে চলে আসে। দোতলায় খুব সাবধানে পা ফেলে। মিউজিক চলছে। পাশের রুম থেকে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। তবে মিউজিকের কারণে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।কান পেতে দেয় ইরফাদ। দরজা কাঁপছে…বাইরে থেকে তালা দেওয়া। ইরফাদ পুরো জায়গাটা নিজের মস্তিষ্কে গেথে নেয়। তখন-ই একজনের নজরে আসে ইরফাদ।ছেলেটি চুপচাপ সরে দৌড় দেয়-খবর দিতে যাবে বলে। ইরফাদ বাতাসের গতিতে তাকে ধরে ফেলে। মুখ চেপে ধরে রিভলবার উল্টো করে একটা মাথায় আঘাত করে। জ্ঞান হারায় ছেলেটি।
যেকোনো ছোট বড় অপারেশন হোক!ইরফাদকে একা ছাড়তে না চাইলেও সে প্রথমে একাই যায়। প্রয়োজন হলে বাকিদের ডাকে। তবে ভেতরের অবস্থা চিন্তা করে বাইরের মানুষ গুলো টেনশনে থাকে। ইরফাদের কানে গুজে রাখা হেডফোন জ্বোনাকি পোকার মতো জ্বলে ওঠে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে রোহানের চিন্তিত গলা,
–আর ইউ ওকে স্যার!
–ডোন্ট প্যানিক। আই”ম ওকে!
–স্যার হেল্প লাগলে কাইন্ডলি জানাবেন। রিস্ক নিবেন না প্লিজ….
–হুম….
উপরে একরুমে অনেকগুলো ছেলে আছে। ইরফাদ বাইরে থেকে দরজা লক করে।তারপর ইরফাদ চুপচাপ সিড়ি বেয়ে নিচে নামে। রিভলভার কোমরে গুজে নেয়। সিড়ি দিয়ে নেমে আসা বিশাল আকারের অচেনা মানুষটি দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে ছেলে গুলো। তারপর তেড়ে আসে ইরফাদের দিকে। ইরফাদের উপর হাত তুলতেই ছেলেটির হাত আবদ্ধ হয় ইরফাদের বজ্রমুঠিতে।হাত পেঁচিয়ে পেছনে ঠেকায় ইরফাদ। বাকিরা এগিয়ে আসে। কাছাকাছি আসতেই লম্বা লৌহশক্ত পায়ের আঘাতে অনেকটা দূরে ছিটকে পড়ে তেড়ে আসা ছেলেগুলো। বাকিগুলোকে এক মিনিটে কাত করে ফেলে ইরফাদ।
তারপর উপরে উঠে তালা ভেঙ্গে ফেলে। দরজার ওপাশে মেয়েগুলো কান্না করতে করতে ফুলে ফেপে একাকার। মাঝখানের হালকা পাতলা মেয়েটি ছুটে এসে ইরফাদ”কে জড়িয়ে ধরে। ফুপিয়ে উঠে বলে,
–“চাচ্চু!আমি বাড়ি যাবো।”
চাচ্চু শুনেই ইরফাদ বুঝে নেয় এটাই রিজভী শিকদারের মেয়ে।অল্প বয়সী মেয়েটিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে মেয়েটির। রিভলবার থাকা হাতটি মেয়েটির মাথায় রাখে ইরফাদ। তারপর আশ্বস্ত গলায় বলে,
— “কোনো ভয় নেই! আমার সাথে এসো….”
রোহানের চিনতিত গলা আবার হেডফোনে বাজে।
–ঠিক আছে সব?
–হুম
— কাউকে পাঠাবো?
–জাবিরকে পাঠাও।
–ওকে স্যার!
মেয়েগুলোকে জাবিরের হাতে দিয়ে উপরে উঠে যায় ইরফাদ। বাকি ছেলেগুলো যে রুমে আছে সেখানে যায় ইরফাদ। দরজা খুলতেই রিভলভার হাতে তেড়ে আসে তারা। সামনে পাঁচজন। পেছন থেকে একজন নেতৃত্ব দিচ্ছে। পেছনে একটি মেয়েও বসে আছে।পেছন থেকে আরাফ চেঁচিয়ে ওঠে,
— “ঐ এসপি! বাঁচতে চাস তো রিভলবার নামা।”
ইরফাদের বজ্রকন্ঠিত গলা,
— ঐ চামচিকা!পেছনে ক্যান সামনে আয়।
আরাফ রিভলবার হাতে সামনে আসে।
— কি করবি কর!
সাথে সাথে রিভলবারের ছয়টা বুলেটের পাঁচটাই নিশানা বরাবর লাগায় ইরফাদ। আরাফ পাশে ফিরে দেখে তার সাথের সব গুলো চিতপটাং খেয়ে পড়ে আছে।গলা শুকিয়ে যায় তার। ত্রিশ সেকেন্ডে ফন্দি আটে। রিভলবার ধরে রিমার মাথায়। তার পুরো শরীর রিমার পেছনে। উম্মাদের মতো বলতে থাকে।
–রাস্তা ছাড়!খোদার কসম মেরে দিবো। আমি না বাঁচলে ও বাঁচবেনা।
ইরফাদ আরাফের চোখে জানোয়ারের রূপ দেখতে পায়। এই মূহুর্তে কোনো স্টেপ নিলে মেয়েটির ক্ষতি হবে। সে তো জানতো না এই রুমে কোনো মেয়ে বন্দি আছে। তাহলে অন্যভাবে আগাতো। ইরফাদ পিছিয়ে যায়। আরাফ আবারো চেঁচায়,
— রিভলবার রাখ। না হলে খুলি উড়িয়ে দিবো।
ইরফাদ রিভলবার রাখে। আরাফ রিমাকে টার্গেট করে বাইরে বেরিয়ে আসে। খোলা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে রিমা। পিছনে আরাফ,সামনে ইরফাদ। সাইডের প্রাইভেট কার”এ জাবির রোহান আর সিনথিয়া। জাবির বেরিয়ে আসে। সাথে সাথে রিমাকে দেখে ছুটে আসে সিনথিয়া। জাবির টেনে ধরেও আটকাতে পারে না। ইরফাদের পেছনে দাঁড়ায় সিনথিয়া। তারপর ভেজা গলায় বলে,
–রিমা!
ইরফাদ সিনথিয়ার কথা শুনে বলে,
–গাড়িতে বসো!
সিনথিয়া বরফের মতো জমে যায়।যদি এখন জানোয়ারটা শ্যুট করে দেয়, রিমা”কে চিরতরে হারাবে সিনথিয়া। একের পর এক আঘাত তার ছোট্ট হৃদয়ে আর জায়গা দিতে পারছে না। চোখের সামনে প্রিয়জনের মুমূর্ষু অবস্থা আর সহ্য হচ্ছে না। এদিকে ইরফাদ চাইলেও শ্যুট করতে পারবে না। আরাফ”কে জীবিত না পেলে এর চেয়ে বড় চক্রকে সে ধরতে পারবে না। এই জন্যে পুরো বিষয় টা ভেবে চিন্তে করতে হবে। আরাফ রিমার মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। ইরফাদ শূন্য হাতে শুধু উপায় খুঁজছে।এরমধ্যে সিনথিয়ার একটা কথা মাথায় খেলে যায়। সিনথিয়া বলে,
— স্যার! রিমা মার্সাল আর্ট জানে। ও নিজেকে রক্ষা করতে জানে।আমার পরের বছর ও মার্সাল আর্ট-এ ভর্তি হয়েছিলো। আমাদের অন্যসকল কোর্স এখনো চলমান….
ইরফাদ খুব বিরক্ত হয়। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–যাও প্লিজ!
জাবির ওকে গাড়িতে বসিয়ে লক দিয়ে রাখুন।
আরাফ সুযোগ খুঁজছে।ইরফাদকে ঠেকানো না গেলে আজ তার মুক্তি নেই। আরাফ রিভলবার ইরফাদের পায়ের দিকে দ্রুত তাক করে ট্রিগার চাপে। তার লক্ষ্য ইরফাদ যেনো হাটতে না পারে।হাটতে না পারলেই আজ ওর মুক্তি। ইরফাদ সরে দাঁড়ায়। ইরফাদ এই সুযোগে পায়ে গোজা আরেকটা রিভলবার বের করে আরাফের পায়ের দিক তাক করে ট্রিগার চাপে।জাবির হাতের গুলি করে। নিশানা বরাবর বুলেট লেগে আরাফ মাটিতে পড়ে। রিমা”কে সরিয়ে আনে জাবির। বাকিরা আরাফ”কে গাড়িতে তোলে। রিমা অস্ফুট স্বরে বলে,
— “শুভ্র”কে পানির ট্যাংকিতে রাখা হয়েছে। উপরের ঢাকনা তালা দেয়া।” বলেই জ্ঞান হারায় রিমা।
____________
ব্রেকিং নিউজ শহরে দিয়েছে নতুন জন্তু। গতকাল একটি ছেলে ও একটি মেয়ে শহরের শূন্য গলি দিয়ে হাঁটছিলো। হঠাৎ তারা সামনে একটি কালো ছায়ার মতো দেখতে পায়। দু”জন ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়।এমন অবস্থায় রাস্তার লাইটগুলো নিভে যায়।ধীরে ধীরে কালো কিছু একটা তাদের সামনে আসতে থাকে। তারা পেছন ঘুরে দৌড়াতে থাকে। একপর্যায়ে মেয়েটি দেখে তার কলিগ পাশে নেই। সে দৌড়ে আশে পাশের মানুষজন ডেকে নিয়ে যায়। যাওয়ার পর দেখে ছেলেটির বেহাল দশা। রক্তাক্ত হয়ে আছে তার শরীর। ছেলেটিকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। রাতে সকলকে সাবধানে চলাচল করার নির্দেশ।
চলবে???
প্রত্যেক পর্বে সিনথিয়া,আর ইরফাদকে নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। তাহলে বাকি চরিত্র ফুটবে না। ধৈর্য্য ধরুন সবাই। আজকে যদি দেখি শুধু নেক্সট বলছেন। সত্যিই গল্প লেখা বাদ দিবো।