#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#অষ্টম_পর্ব
এক সপ্তাহ পরের ঘটনা,
এই এক সপ্তাহে কারো জীবনেই কোনো পরিবর্তন আসে নি। সব চলছে আগের নিয়মে। রিদওয়ানের প্রথম প্রথম নিজের কাছে কেমন যেন লাগত। অনেক বারই ভেবেছে চলে যাবে। রুপককেও জানিয়েছে, তার জন্য বাসা খুঁজে দিতে। রুপক গুরুত্বই দেয় নি। বরং মাছি তাড়ানোর মতো এড়িয়ে গেছে। ইসমত আরা বেগমকে জানালেও কোনো কথায় শুনেন নি। উল্টে ভুলভাল যুক্তি দেখিয়ে তারই মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। পরে কুহুর বাবা একথা শুনে নিজে বলেছেন সে যেন থাকে। বাসার ছেলে হয়ে যেন থাকে। সে যদি থাকে তারা পরিবারের সবাই খুব খুশি হবে।
একথা শুনে সেও কিছু বলার সাহস পায় নি। পারে নি জোর দেখিয়ে চলে যেতে। ওইদিকে তার প্রিন্সিপাল বাবাও বাসায় উঠার জন্য আকার ইঙ্গিত দিচ্ছে,বোঝাচ্ছে সে যেন বাসায় উঠে। বাবা ছেলে একসঙ্গে থাকবেন। উনিও ছেলেকে কাছে পেতে পান। মরা বাড়িটাতে প্রাণ ফেরাতে চান। পুনরায় সেই সংসার নামক স্বপ্নে জোড়াতালি দিয়ে জীবিত করতে চান।
উনি এখন একা। উনার সঙ্গীর প্রয়োজন। প্রয়োজন দুটো মনের কথা বলা মানুষ। একথা শুনে সে শুধুই হেসেছে। এবং
স্পষ্টভাবে জানিয়েও দিয়েছে, ‘যেখানে আমার মা থাকে না, বোন থাকে না, একদিন নিজেও ঠাঁই পায় নি, আজ সেখানে আমিও থাকব না।’
একথা শুনে বাবা কেবল তাকিয়ে ছিলেন। বাবার তাকানোয় তার বুকটা ক্রমশই ভারি হয়ে আসছিল। নিজেকে সেলফিস মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার হাতেও কিছু ছিল না। আজ উনার সঙ্গে তার সম্পর্কের এমন ছাড়া ছাড়া ভাব থাকত না। যদি না তিনি নিজের বাবার মায়ের অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় না দিতেন। বাবা মায়ের কথায় স্ত্রীসহ ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে
দুটোকে নানুর বাসায় রেখে না আসতেন। দীর্ঘদিনছেলেমেয়ে
দুটোকে চোখের দেখা দেখতে যেতেন। কোনো সম্পর্ক এমনি এমনি নষ্ট হয় না। নষ্ট হয় অবহেলায়। অনাদরে। অবিশ্বাসের ছোবল যখন বিশ্বাসকে দংশন করে তখন সম্পর্কে জং ধরে।
মরিচা ধরে বন্ধনে। মায়াতে। আবেগে জর্জরিত মোহতে। সে তবুও উনার সঙ্গে কথা বলে। সন্মান দেখায়। কারণ একটাই উনি তার জন্মদাতা পিতা। উনার রক্ত বইছে তার শরীরে। সে উনার হাতে ধরে হাঁটছে শিখেছে, কথা বলতে শিখেছে, সঙ্গে শিখেছে ‘বাবা’ বলার সুযোগ। তবে আফসোস একটাই তার বাবা তার মিষ্টি মধুর শৈশবকে কেড়ে নিয়েছে। তাদের দুই ভাইবোনকে বাবার আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে।
এগুলো হিসাব কে দেবে?
তাছাড়া সে মায়ের সঙ্গে রাগ করে মূলত দেশে এসেছে। তার ব্যবহারে মা ভীষণ কষ্টও পেয়েছে। কষ্ট পেয়েছে ছোটো বোন রিমিও। সে হঠাৎ করে এসেছে ঠিকই। তবে অকারণে আসে নি। যেই কাজে এসেছে সেই কাজ ফুলফিল না করে ফিরবে না সুইজারল্যান্ড। এটাই তার ওয়াদা।
বাংলাদেশে আসার পর থেকে তার মা তাকে ফোন করে নি। কথা বলে নি। এখন মা যদি শোনেও সে বাবার সঙ্গে থাকছে তাহলে হয়তো আর কোনোদিন যোগাযোগই করবে না। আর না রিমিকে যোগাযোগ করতে দেবে। তার মা এমনই কঠোর।
বাবাও কম যায় না। আর এই দুই কঠোর ব্যক্তির মাঝখানে পড়েছে তারা দুই ভাইবোন। তারা না পারে বাবাকে ছাড়তে আর না মারে মাকে ছাড়া থাকতে। এভাবেই দীর্ঘ দশটা বছর তারা দেশের বাইরেই কাটিয়েছে। তবে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে
তার প্রায় যোগাযোগ হতো। সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ হতো রুপকের সঙ্গে। রুপক তার জীবনে প্রথম বন্ধু। ভাগ্যে গুনে রুপকের মতো বন্ধু পেয়েছে সে। এজন্য শুকরিয়াও করে।
তার বন্ধু ভাগ্য ভালো, পড়াশোনায় ভালো, কেরিয়ার ভালো,
সবকিছুই ভালো তবে তার আফসোস সে পরিবার পায় নি।
এজন্যই বোধহয় পরিবার জিনিসটাকে তার কাছে বরাবরই সোনার হরিণ মনে হয়। হরিণ সবাই কিনতে পারে না৷ সবার ভাগ্যেরও জোটে না। কারণ এটা কিনতে হয় ভালোবাসার বিনিময়ে। সুখ দিয়ে। বিশ্বাস দিয়ে। কিন্তু বাবা মায়ের মধ্যে কারোই এই এগুলোর একটাও নেই। তাদের আছে মনভর্তি ইগো, আত্মঅহমিকা, ক্রোধ, আর একরাশ অবিশ্বাস। যা সম্পর্ককে ধূলিসাৎ করার জন্য যথেষ্ট। ফলে তাদের সংসার বর্তমানে জলে ভাসা পদ্মের ন্যায় ভেসে যাচ্ছে। ঠাঁই নেই। গতি নেই। নিজের আঁটকে রাখার ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে থাকলেও এখন আর জো নেই। আর তাদের এই ভাসা ভাসা খেলাটাই হয়তো এই বছরে ডিভোর্স নামক মুক্তিতে সমাপ্তি টানা হবে।
বাবার উপর রাগ। মায়ের উপর অভিমান। নিজের ভাগ্যের উপর বড়ই অসন্তুষ্ট রিদওয়ান। এজন্য মেজাজটা সবসময় থাকে খিটমিটে। তবে কুহুদের বাসায় আসার পর থেকে সে
দৈনন্দিন কাজে কিছুটা পরিবর্তনও এনেছে। আনতে বাধ্য হয়েছে। কারণ একা থাকা আর স্বপরিবারে থাকা এক নয়। স্বপরিবারে থাকতে গেলে কিছু নিয়ম মানতে হয়। অন্যের সুবিধা অসুবিধার ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হয়। নিজেকেও নিজ দায়িত্বে কিছু দায়িত্বের বোঝা ঘাড়ে নিতে হয়। তবেই না সে পরিবারের বিশ্বস্ত সদস্যের স্থান পাবে। ভালোবাসা পাবে৷ পাবে শ্রদ্ধা, স্নেহ এবং ভরসা। জগিং করতে করতে এসবই ভাবছিল রিদওয়ান। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। তার টি শার্ট ঘেমে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। রোদ চড়ে গেছে আর দৌড়ানো যাবে না। তাই সে বাসায় পথে পা বাড়াল। বাসায় গিয়ে দেখে ইসমত আরা বেগম ছাড়া কেউ এখনো উঠে নি।
উঠবে আরো পরে। তাছাড়া আজকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা। রিদওয়ানকে বাসায় ঢুকতে দেখে ইসমত আরা বেগম একগাল হাসলেন। মুখভর্তি হাসি নিয়ে বললেন,
-‘আব্বা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও।’
-‘জি আন্টি।’
একথা বলে রিদওয়ানও ভদ্রতাসূচক হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেল। তারপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে রেডি হয়ে বের হতেই দেখে কুহু ড্রয়িংরুমে বসে আচার খাচ্ছে। খালি পেটে কেউ আচার খায়?এখন যদি কিছু বলা হয় তাহলে হয়তো বলবে,
‘কেউ খায় না বলে কি আমি খেতে পারব না?’সে কেন বলল, কি জন্য একথা বলল এই মেয়েটা তো বুঝবেই না৷ এরচেয়ে একে কিছু না বলায় উত্তম। সে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে ইসমত আরা বেগম রান্নাঘর পরিষ্কার করছে। সে গিয়ে সুন্দরভাবে ডেকে বলল,
-‘ আন্টি আমার আর্জেন্ট বাজারে যাওয়া লাগত। রুপক ঘুমাচ্ছে। বলছিলাম যে, বাজারটা যেন কোনদিকে?’
-‘বাজারে যাবে? একা? দাঁড়াও, কুহুকে সঙ্গে নিয়ে যাও। সে অলিগলি সব চিনে।’
একথা বলে উনি কুহুকে ডেকে যাওয়ার কথা বললেন। কুহু রিদওয়ানকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। তারপর আচার মাখা হাতটা ধুয়ে বলল,
-‘পাঁচ মিনিট দাঁড়ান আমি দশ মিনিটে রেডি হয়ে আসছি।’
একথা বলে কুহু রুমে গেল। তারপর পাক্কা আধাঘন্টা পর সে রেডি হয়ে বের হলো। সাজগোছ কিচ্ছু করে নি। সোনালী রঙের একটা থ্রি পিস পরেছে। আর কাঁটা দিয়ে উচুঁ করে চুল বেঁধেছি। এইটুকুতেই তার আধাঘন্টা লেগেছে। রিদওয়ানের রাগ হলেও নিজেকে সামলে নিলো। তারপর ইসমত আরা বেগমকে বলে যখন বের হবে তখন ইসমত আরা কুহুকে বললেন,
-‘ছেলেটাকে সাবধানে নিয়ে যাবি। খবরদার বলছি একদম হাঁটাবি না। আর যদি ভেবেও থাকিস ছেলেটাকে নাস্তানাবুদ করবি। তবে বলে রাখছি আজ তোর পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙব আমি।’
আম্মুর কথা শুনে কুহু করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল। তার মনের কথা তার মা জানল কিভাবে তাই বুঝল না। সে সত্যি সত্যিই ভেবেছিল রিদওয়ানকে হাঁটাবে। হাঁটাতে হাঁটাতে জান ত্যানা ত্যানা করে ফেলবে। তারা বাসা থেকে বেরোতেই খালি রিকশা দেখতে পেল। কুহু ইশারায় রিকশা থামাতে বলে উঠে বসল। রিদওয়ানও বসল। তবে
এমনভাবে সরে বসল যেন কুহুর গায়ের সঙ্গে তার স্পর্শ না লাগে। আড়চোখে ব্যাপারটা খেয়াল করল কুহু। কেন জানি ভালোও লাগল। টং টাং বেল বাজিয়ে রিকশা চলছে গলির মোড়ের রাস্তা ধরে। তখন কুহু বলল,
-‘কোথায় যাচ্ছি জানতে পারি?’
-‘সবজি বাজার করতে। যে বাজারে টাটকা সবজি পাওয়া যাবে সেখানে চলো।’
-‘মানে কি? আপনি এখন বাজার করতে যাচ্ছেন? তাও হিরো সেজে? বাংলাদেশের সবজি বাজার সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে?’
-‘ধারণা নেই বলেই তোমাকে সঙ্গে নিয়েছি। আর হ্যাঁ যারা হিরো তাদের এক্সটা করে হিরো সাজা লাগে না। বরং যারা
অর্কমা, কাজ থাকে না। তারাই সাজগোজের পেছনে সময় ব্যয় করে।’
কুহু মুখ ভেংচাল। রিদওয়ান দেখেও মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। ভাঙাচোরা চিকন রাস্তা। একটা রিকশা গেলে অন্য রিকশাকে সাইড দিতে দাঁড়াতে হয়। এরমধ্যে ফাঁক গলিয়ে সাইকেল ওয়ালা সেই রাস্তায় ঢুকে পড়ে। এরপর শুরু হয়, বাংলা গালাগালি। বাংলাদেশের এই ব্যাপারটা খুবই খারাপ লাগে তার। ঘন্টার ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয় জ্যামে পড়ে।
যুগের পর যুগ এভাবেই চলে আসছে। তবুও এর সমাধান নেই। মনে মনে বিরক্ত হয়ে এসবই ভাবছিল রিদওয়ান। কুহু চুপ করে বসে আছে। মুখ কখন চকলেট পুরেছে কে জানে। চকলেট কটমট করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। রিদওয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।তাকে তাকাতে দেখে কুহু একটা লাভ ক্যান্ডি
এগিয়ে দিলো। রিদওয়ান নিলো না সে বাচ্চাদের খাবার খায় না। একথা শুনে কুহু বলল,
-‘আসলে মন থেকে দিচ্ছিলামও না। তাকাতে দেখে ভদ্রতা দেখাতে দিচ্ছিলাম। না নিয়ে খুব উপকার করলেন, হে হে। ‘
রিদওয়ান জবাব দিলো না৷ তখন ফোনে টোন বেজে উঠল। স্ক্রিণে ভাসা নাম্বার আর সময় দেখে কলটা রিসিভও করল। কল রিসিভ করা মাত্রই ফোনের স্কিণে পুতুলের মতো দেখতে একটা মেয়ের ছবি ভেসে উঠল। তবে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেয়েটি গড়গড় করে বলল,
-‘আচ্ছা সমস্যা কি তোমার? ফোন করলে ধরো না কেন?
এই ভালোবাসো আমাকে? এটা ভালোবাসার নমুনা? আম্মু ঠিকই বলে তুমি একটা মিথ্যাবাদী। মিথ্যা কথা বলে দেশে গিয়েছ তুমি।’
পাশাপাশি বসে থাকায় কুহু একবার উঁকি মেরে মেয়েটাকে দেখল। সত্যিই মেয়েটা দেখতে একটা পুতুল যেন। গফ টফ হবে বোধহয়। এমন খারুস লোকের এত সুন্দর গফ! বাপ্রে ভালোই পটিয়েছে। কুহু আরো কথা শুনতে কান খাঁড়া করে রাখল। আরো দু’একটা কথা শুনে বুঝল, এদের অভিমানের চ্যাপ্টার চলছে। রিদওয়ানকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছে না মেয়েটি। নিজেই গালমন্দ করে যাচ্ছে। তা সেটা কুহু খুশিই হলো। মেয়েটাকে বাহবা দিতে ইচ্ছে করল। তখন রিকশার চাকা গর্তে পড়ল, আর রিকশার হুডের সঙ্গে তার মাথাটা বারি খেল। ব্যথা পেয়ে একা একাই মাথা ঠলতে ঠলতে বলে বসল, ‘মা গো, মাথাটা গেল আমার। এই রিকশা মামা দেখে রিকশা চালান। বিয়ে হয় নি এখনো।’
একথা বলা মাত্র মেয়েটা হইহই করে বলল,
-‘তোমার পাশে ওটা কে? তুমি কাকে নিয়ে ঘুরছো? আমরা তোমার টেনশনে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়েছি। আর তুমি কি না তোমার গফকে নিয়ে ঘুরছো?’
মেয়েটাকে এবার রিদওয়ান ধমকে উঠল। হঠাৎ ধমক খেয়ে কিউট মেয়েটি চুপ করে গেল৷ তারপর কুহুর মুখের সামনে ফোনটা ধরে ভালো করে দেখাল। কুহুকে দেখে মেয়েটা কল কেটে দিলো। কল কাটা মাত্রই একটা মেসেজ এলো, ‘ এটা রুপক ভাইয়ার বোন? এর জন্যই দেশে গিয়েছো তুমি? ভাবি কিন্তু মাশাল্লাহ ভাইয়া। পাশাপাশি দারুণ মানিয়েছে৷ ভাবির ঠোঁটের পাশের তিলটা কি রিয়েল? জানাবে কিন্তু। আর হ্যাঁ,
ভাবিকে দেখানোর জন্য এমন নাটকের মানে বুঝল না।’
রিদওয়ান এবার মেসেজ করল,
‘ বুঝতে হবে না। তবে শোন বাবার জন্য বাঁশ রেডি। তুই আবার ওভার একটিং করে সব গড়বড় করে দিস না। সো বি কেয়ারফুল।’
To be continue……..!!
#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#নবম_পর্ব
-‘এটা রুপক ভাইয়ার বোন? এর জন্য দেশে গিয়েছো তুমি? ভাবি কিন্তু মাশাল্লাহ ভাইয়া। পাশাপাশি দারুণ মানিয়েছেও৷ আচ্ছা ভাবির ঠোঁটের পাশের তিলটা কি রিয়েল? জানাবে কিন্তু। আর হ্যাঁ,ভাবিকে দেখানোর জন্য এমন নাটকের মানে বুঝল না।’
রিমির ম্যাসেজ দেখে রিদওয়ান আড়চোখে পাশে তাকাল। কুহু চকলেট চিবুতে চিবুতে পথঘাট দেখছে। দেখছে মানুষ।
গাছগাছালি। একটা কুকুর ছানাদের দুধ খাওয়াচ্ছে। সেটাও মনোযোগ সহকারে দেখল৷ তারপর হাসল। তাকে নিঃশব্দে হাসতে দেখে রিদওয়ান সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অভিজ্ঞ
হাতে টাইপ করল,
– ‘ বুঝতে হবে না। তবে শোন বাবার জন্য বাঁশ রেডি। তুই আবার ওভার এক্টিং করে সব গড়বড় করে দিস না। সো বি কেয়ারফুল। আর যাকে তাকে ভাবি ভাবা বন্ধ কর। পাশে বসলেই ভাবি হয়ে যায় না৷ ভাবি হতে গেলে তোর ভাইয়ের সঙ্গে আগে বিয়ে হতে হবে। তারপর ভাবি ডাকার সুযোগ পাবি। হ্যাঁ, এটা রুপকের ছোটো বোন। সঙ্গে আমার ছাত্রীও। তাই ফান করেও এসব বলবি না আর৷ ফান জিনিসটা মাঝে মাঝে সম্পর্ক নষ্ট করে। এসব ফান রুপকের নজরে পড়লে ব্যাপারটা খুবই খারাপ হবে৷ আমি নিজেও লজ্জিত হবো।
তাছাড়া প্রতিটা সম্পর্ককে আগে সুন্দর নজরে দেখতে হয়, জানতে হয়, ভাবতে হয়, এরপর সেটার মন্তব্য করতে হয়৷
তুমি যেটা করছো এটা মোটেও ঠিক না। বরং এভাবে বলা অন্যায়। আর ‘ওর জন্য দেশে এসেছি’ এইকথার মানে কি? এমন এক চটকানা দিবো না, একমাস গাল নাড়াতে পারবি না, বেয়াদব। আমি দেশে এসেছি শুধু বাবা মায়ের ডিভোর্স ঠেকাতে। কোনো বন্ধুর বোনের জন্য নয়। বোঝা গেল?তোর গোবরভরা মাথায় কথাটা ঢুকল? নাকি আবার বলতে হবে?
আর একটা আজাইরা কথা বললে তোমারর কপালে দুঃখ আছে৷ পাজি কোথাকার।’
উক্ত মেসেজটি সেন্ড করে রিদওয়ান ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। রিমিটা দিন দিন বড্ড বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। আবার বলে কি না, ‘ভাইয়া তুমি ভাবিকে নিয়ে ঘুরছো?’
দেশে আসা দুই সপ্তাহ হলো না এর মধ্যে নাকি ভাবি জুটিয়ে ফেলবে। এসবকিছু এত সহজ? পাশের এই তারকাটা পাগল মেয়েকে আর যাই হোক রিমির ভাবি বানাবে না সে। কখনো না। তাহলে জীবনে শান্তি বলে যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেটাও চলে যাবে। তাছাড়া বাবা মায়ের সম্পর্কের অবস্থা দেখে তার বিয়ের প্রতি কেন জানি অনিহা কাজ করে। সম্পর্কগুলোকে জটিল সমীকরণ মনে হয়। হঠাৎ একটা কথা মনে হেতেই সে
আরেকবার কুহুকে দেখে নিলো। আসলে কুহুকে নিয়ে বের হওয়া পরিকল্পনার অংশমাত্র। এর পরিকল্পনাদাতা কেবলই রুপক। আজ রুপকের ছোট্ট একটা অপারেশন হবে। তার পায়ের টিউমার। একথা সবাই জানলেও শুধু কুহু জানে না।
এতক্ষণ ইসরাত আরা বেগম, রুপক, আর তার বাবা হয়তো বেরিয়ে গেছে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। কাজ হয়ে গেলে সেও যাবে কুহুকে সঙ্গে নিয়ে। এমন করার কোনো কারন ছিল না। ভাইয়ের অপারেশন অথচ বোন জানবে না ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায়। রিদওয়ানের কাছের ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু লাগছিল। পরে জানতে পারল, বছর তিনেক আগে রুপক আর কুহুর
একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেদিন তারা দুইভাইবোন বাইক করে বাসায় ফিরছিল। সেই এক্সিডেন্টে রক্ত, কাঁটাছেড়ায়
কুহুর মনে ভাইকে হারানোর ভয় জেঁকে ধরেছিল। সেই ভয় কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘদিন সময়ও লেগেছিল। তাছাড়া কুহুর রক্ত ফোবিয়া আছে। রক্ত দেখলে তার হাত পা থরথর করে কাঁপে। মাথা ঘুরে। আপনাআপনি চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মনে পড়ে যায় ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহের কথা। সেদিনের কথা ভেবেই রিদওয়ানকেও এই পরিকল্পনায় অংশ নিতে হয়েছে।
মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে কুহুকে নিয়ে বের হয়েছে। তবে বের যখন হয়েছে আরেকটা কাজ সেরে যাবে। যে কাজের জন্য তাকে এতদূর ছুটে আসতে হয়েছে। অভিমান ভুলে বাবার কলেজে গেস্ট টিচার হিসেবে জয়েন্ট করতে হয়েছে। মনে মনে আরেকটা পরিকল্পনা সাজিয়ে রিকশা থামিয়ে কুহুকে নামতে বলে, সে নিজেও নামল। কুহু বলল, সবজি বাজারে যেতে পাঁচ মিনিট লাগবে। এখানে নামলে হাঁটতে হবে। তখন যেন তাকে দোষ দেওয়া না হয়। রিদওয়ান তার কথা জবাব দিলো না রিকশার ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা ধরল। তা দেখে কুহুও নামল। দ্রুত হাঁটা ধরল রিদওয়ানের পিছু পিছু। এই লোকটা এমনভাবে হাঁটে তার সঙ্গে পেরে ওঠে না। রিদওয়ান কুহুকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে আরেকটা রিকশায় উঠে বসল। কুহুকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না শুধু বলল,
-‘যেখানেই যাচ্ছি সেইভ থাকবে। যেভাবে এনেছি। সেভাবে বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে দেবো। শুধু ধৈর্য্য ধরে মুখটা বন্ধ করে বসে থাকো। যতক্ষণ না আমি কিছু জিজ্ঞাসা করবে ততক্ষণে নিশ্চুপ, ওকে?’
কুহু ঘাড় নাড়িয়ে ‘ওকে’ বোঝাল। এখন রিকশা চলছে গলি বেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে। এটা আবাসিক এলাকা। রাস্তাও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এই লোকটা কোথায় যাচ্ছে কে জানে?
তবে সেখানেই যাক রিকশা চড়ে ঘুরতে তার মন্দ লাগছে না।
অনেকদিন এভাবে ঘোরা হয়নি। ইশ! বৃষ্টি হলে দারুন হতো।
কিন্তু হবে না। আকাশ ফকফকে পরিষ্কার। তখন রিকশাটা
একটা গলি পেরিয়ে তিনতলা বিশিষ্ট একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। ভাড়া মিটিয়ে বাড়িটার সদর দরজাটা নক করল।
দারোয়ান তাকে দেখামাত্র দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলো।
সালাম দিলো। কুশল বিনিময় করল। রিদওয়ান সালামের জবাব নিয়ে কুহুকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। বাড়ির দুই ধারে দুটো বাগান। একটা ফলের। আরেকটা ফুলের। কত রকমের ফুল! কুহু চোখ জুড়িয়ে ফুল দেখছে। ভীষণ সুন্দর বাড়ি। বাড়ির আশপাশ। কেউ যে যত্ন করে এসব লাগিয়েছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তারা আরেকটু সামনে এগিয়ে বাসার দরজায় কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই টুটুল এসে দরজা খুলে দিলো। রিদওয়ানকে দেখে সে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে উচ্চশব্দেই উচ্চারণ করল, ‘আরে ভাইজান!
ওহ চাচাজান বড় ভাইজান আইছে। কই আপনে, তাড়াতাড়ি আহেন।’
তাকে চেঁচাতে দেখে রিদওয়ান ভীষণ বিরক্ত হলো। তারপর টুটুলকে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। আদেশ করল বাসার মালিককে গিয়ে খবর দিতে। হাতে সময় নেই৷ জরুরি কথা বলে বেরিয়ে যাবে। একথা শুনে টুটুল তার গলায় ঝুলানো গামছায় হাত মুছতে মুছতে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। আর কুহু অবাক হয়ে ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে ঝুলানো ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। কারণ ছবিটি রিদওয়ানের। রিদওয়ানের বাম পাশে কিছুক্ষণ আগের দেখা সেই পুতুল মেয়েটি। যার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছিল রিদওয়ান। দু’জনের মুখের মিল আছে। এটা তখন খেয়াল না করলেও এখন খেয়াল করল সে। এবং বুঝেও গেল এরা ভাইবোন। ছিঃ! ছিঃ! আর সে কী না গফ টফ ভেবে বসেছিল। সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবার তাকাল, এবং আরেকদফা অবাক হলো রিদওয়ানের সঙ্গে কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারকে এক ফ্রেমে দেখে। উনার সঙ্গেও খুব মিল
পেল। এতদিন এসব খেয়াল না করলেও ছবিতে পাশাপাশি থাকায় সহজে সমীকরণ মিলিয়ে নিলো। তবে রিদওয়ানকে কিছু বলল না। আশেপাশে তাকিয়ে ড্রয়িংরুমটা পরখ করে
নিলো। সঙ্গে পরিস্থিতি বুঝে ভদ্র হয়ে বসে রইল। একটুপরে প্রিন্সিপাল স্যার এলেন। রিদওয়ানকে দেখে উনার দু’চোখ
খুশিতে ঝলমল করে উঠল৷ উনি টুটুলকে ডেকে দ্রুত নাস্তা পানি আনার আদেশ করলেন। রিদওয়ান তখনো ফোন স্কল করতে ব্যস্ত। দৃষ্টি তুলে তাকায় নি বাবার দিকে। টু শব্দ করে নি। স্যার এবার তাকালেন কুহুর দিকেও। মেয়েটিকে ভালো করে চিনতে পেরেছেন। এবং কুহুকে রিদওয়ানের সঙ্গে দেখে উনি অবাক হলেন না। যেন রিদওয়ানের পাশে কুহু থাকাটাই স্বাভাবিক। উনি কুহুকে কিছু বললেন না নিঃশব্দে হাসলেন।
কুহুও ভদ্রতাসূচক সালাম দিলো। তখন রিদওয়ান বলল,
-‘আগামী সপ্তাহে ফিরে যাচ্ছি আমি। এসেছিলাম আম্মুর পাঠানো ডিভোর্স পেপার আপনার নিকট পৌঁছে দিতে। এই পেপারে সাইন করুন।’
ছেলের কথা শুনে স্যার হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জবাবে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না তিনি। কিয়ৎকাল নিশ্চুপ থেকে বললেন,
-‘তোমার সঙ্গে আমিও যাব। তোমার আম্মুর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। যেগুলো সামনাসামনি বলা দরকার।”
-‘এতদিন মনে হয় নি কথা বলা দরকার? মনে হয় নি এই সম্পর্কটাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করার দরকার? মনে হয় নি, ছেলেমেয়ের কথা ভেবে ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার। তবে আজ কেন? আমি এতকিছু জানি না, আম্মুর আদেশ সাইন করিয়ে তারপর এখন থেকে যেতে। উনি এসব থেকে মুক্তি চান। আর ডিভোর্সটা হওয়া খুব দরকার কারণ ডিভোর্স হয়ে গেলে আমি নিজে দাঁড়িয়ে আম্মু সেকেন্ড বিয়ে দিব। একটা ভুল সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর প্রশ্নই আসে না।’
রিদওয়ানের কথা শুনে কুহু বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। এরা বাবা ছেলের তর্ক যুদ্ধ করছে! একজনের যুক্তিতে আরেক জন পাল্টা যুক্তি ছুঁড়ছে। তাদের সামনে পড়ে আছে ডিভোর্স পেপার। এদের বাবা ছেলের মাঝে সে নীরব দর্শক। কিছু বলা তো দূর এদের কথা শুনে নড়াচড়া করতেও ভুলে গেছে সে। সে অনড় হয়ে বসে থেকে রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিদওয়ানকে নিষ্ঠুর বলে জানত সে। কিন্তু সে এতটা
নিষ্ঠুর কল্পনা করে নি। এদের কথা শুনে কুহু মনে মনে বলল,
-‘এই আবার কেমন জাতের ছেলে, বাবা মায়ের ডিভোর্স করাতে উঠে পড়ে লেগেছে?
To be continue…………….!!
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/