নীলের_পরি (১৮)

0
11

#নীলের_পরি (১৮)

পরির আজ শেষ পরীক্ষা। হল থেকে বের হয়েই নীল কে খোঁজাখুজি করছে সে। কিন্তু নীল আসে নি। সেই প্রথম দিন ই এসেছিল। পরি মুখ গোমড়া করেই রইল। পরির পরীক্ষা গুলো বেশি ভালো হয় নিহ নিশ্চিত রেজাল্ট ভালো আসবে না। পরির মন মেজাজ কিছুই ভালো নেই এখন। এই কয়েকটা দিনে একটা ও বাইরের খাবার খায় নি সে।
আজ মাথা টা বেশ গরম হয়ে আছে পরির। তাই দোকান থেকে চারটে আইক্রিম কিনে নিয়ে আসল। মিসেস রাহেলা মেয়ের হাতে এতো গুলো আইক্রিম দেখে ভ্রু কুঁচকালেন।
পরি কিছু না বলে গাড়িতে উঠে এক এক করে আইসক্রিম খেতে লাগল। মিসেস রাহেলা কিছু বললেন না আর। বেশ কয়েকটা দিন এভাবেই কেটে যায়। নীলের সাথে ম্যাসেজ এ প্রচুর কথা হয়েছে পরির কিন্তু ফোনে একটি বারের জন্য ও কথা হয় নি। পরি নীলের দেওয়া সরি লিখা চিরকুট টা দেখে নিল। সেইদিন কেন্দ্রের মাঠে দিয়েছিল নীল। মিসেস রাহেলার ডাকে পরি ডয়িং রুমে আসল। ডয়িং রুমে এসে চাচাতো কাকা কে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিল। সালাম জানিয়ে পাশে বসল। টুকটাক সবাই কথা বলল। পরি জানতে পারল তার বান্ধবী হিয়ার মামার সাথে নাকি ওর কাজিন ফারিয়ার বিয়ে। পরি খুশি হয়ে গেল। হিয়ার নানুর সাথে ও পরির ফ্যামিলির বেশ ভালো সম্পর্ক। সবাই আত্মীয় কি না। হিয়া বার বার করে বলে দিয়েছি পরি যেন হলুদে তার সাথেই যায়। যেহেতু পরির কাজিনের বিয়ে সাভারের কমিউনিটি সেন্টারে তাই এত দূরে কেউ হলুদ দিতে যাবে না। যার যার বাসাতেই হলুদের অনুষ্ঠান হবে। পরি শাড়ি পরে বুঝে গেছে এই শাড়ি মহা ঝামেলা। তাই পরি ঠিক করেছে এবার আর শাড়ি পরবে না। হলুদের দিন বিকেলে পরি হিয়ার সাথে ওর নানু বাড়ি চলে যায়। বিকেল টা আশে পাশে ঘুরেই কাটিয়ে দেয় ওরা। সন্ধ্যার দিকে সবাই শাড়ি পরতে বলে অনেক জোড়াজোড়ি করলে ও পরি শাড়ি পরতে নারাজ। অবশেষে হিয়ার আন্টি হিয়া কেই সাজাতে লাগলেন। পরি বেডের সাইটে গিয়ে নীল কে ফোন লাগাল।
কিছুক্ষণ ফোন বাজার পর ই নীল কল রিসিভ করল।

“হুম কেমন আছেন?”

“আলহামদুল্লিহ তুমি কেমন আছ?”

“আলহামদুল্লিহ ভালো।”

“হঠাৎ এই সময়।”

“এমনি একটা ফাংশনে এসে বোর হচ্ছিলাম তাই ভাবলাম তোকে কল দেওয়া যাক।”

“হাহাহা। আবার তুই?”

“অবশ্যই আমি আমার অভ্যাস বদলাতে পারব না।
তুমি ইচ্ছে হলে তুই করে বলো না হলে নাই।”

“হাহা তুমি ই ঠিক আছে। তুই বললে কেমন যেন লাগবে।”

“আচ্ছা যা ইচ্ছা। তা কি করবি,ঠিক করেছিস? পড়াশুনা তো মনে হয় এখানেই শেষ।”

“উম কি করবো বলো। পরিস্থিতি টাই যে এমন। দেখি কি করি।”

“আরে পড়াশুনা ছাড়ার কি আছে? পড়াশুনা করলে জীবনে অনেক কিছু করা যায়।”

“হুমমম তুমি এসে সব পড়া কমপ্লিট করে দিয়ে যাও।”

“আমি কেন পড়বে হুম?”

“উম সেটাই তো। তা একটা জি এফ খুঁজে দেও?”

“মোটে ও না। পরে ঐ মেয়ে আমাকে পেটাবে।”

“কেন?”

“কারণ তার ঘাড়ে এমন একটা বজ্জাত ছেলে কে যে দিয়েছি।”

“হা হা হা তোমার সাথে কথায় পারা মুশকিল।”

এমন হাজারো কথা হলো ওদের মাঝে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর পরি ফোন রাখল পরি। বুক ভরে নিশ্বাস নিল। নীল তার নিশ্বাসে পরিনত হয়েছে। পরির ভাবনাতে ছেদ কাঁটল হিয়া ।
হিয়া মিষ্টি হেসে বলল, “কথা হয়েছে?”

পরি মাথা ঝাকাল। একমাত্র হিয়া ই জানে পরি যে নীল কে ভালোবাসে। পরি লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে বলল” হুমমম চল।”

হিয়া মিষ্টি হেসে বলল,”পুরো পাগল মেয়ে।”

পরি লজ্জাতে লাল হয়ে হিয়ার সাথে অনুষ্ঠান মঞ্চে চলে গেল। আজ রেজাল্ট দেওয়ার পালা। ভয়ে পরির হাত পা কাঁপছে। সে জানে এ প্লাস পাবে না। নিশ্চয়ই এ গ্রেট পাবে তাহলে। কিন্তু পয়েন্ট টা ও তো দেখতে হবে। পরির সকাল থেকে সব কেমন উলট পালোট লাগছে। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। ১২ টার পর যখন পরি তার জে এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট জানাল তখন স্তব্ধ হয়ে রইল। একি শুনলে সে? পরি যেন নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না। এক মুহূর্তে সব কিছু কেমন উলোট পালোট হয়ে গেল ওর। পরির রেজাল্ট এ মাইনাস এসেছে। পরি কাঁদতে লাগল। যে মেয়ের এ প্লাস নিয়ে আশা সে এ প্লাস তো দূরে থাক এ গ্রেট ও পায় নি।
পরির কাঁদতে কাঁদতে খারাপ অবস্থা। বাসার কারো ই মন ভালো নেই। আশে পাশের সবাই পরি কে হালকা সান্ত্বনা দিলে ও সবাই পরির প্রতি হতাশ। পরি কে দিয়ে এমন রেজাল্ট কেউ ই আশা করে নি বোধহয়। পরি বেশ কয়েক দিন ঠিক ঠাক খেল না, কথা ও বলল না। এমন রেজাল্টে কেউ কি ঠিক থাকতে পারে?

আজ বহু দিন পর নীলের সাথে কথা হলো পরির। বেশ অনেকদিন পর পরি অনলাইনে আসল। নীলের সাথে কথা বলে হালকা লাগছে খুব। পরি নবম শ্রেণিতে ভর্তি হলো। গ্রুপ হিসেবে ছোট থেকেই ইচ্ছে সাইন্স নিয়ে পড়ার। তাই একটা রেজাল্টে তো সাইন্স নিয়ে পড়তে পারবে না এমন নয়। তাই সাইন্স ই বেছে নিল। গ্রামের দিক হওয়াতে সাইন্স এ মাত্র ২০ জন স্টুডেন্ট। হাফসা কমার্স নিল। তাই পরির সাথে হাফসা র সম্পর্ক টা আলগা হয়ে গেল। হিয়া সাইন্স নেওয়াতে হিয়ার সাথে সম্পর্ক আরো ও জোড়াল হলো।
হিয়া কে সব কিছুই বলেছে পরি। হিয়া পরি কে সমর্থন ও করল। কারণ হিয়া নিজে ও কারো ভালোবাসা তে বন্দি।
তাই অন্যের ভালোবাসা টা হিয়া বুঝতে পারে। এভাবেই কেটে যেতে লাগল দিন। খারাপ সময় আসবেই তাই বলে সেটা নিয়ে শুধু আপসোস করলে চলবে না। নিজে কে ঘুরে দাঁড়াতে ও তো হবে। সাইন্স এর ক্লাস গুলো পরির বেশ ভালোই কাঁটে। একটা ক্লাস পর পর ই বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পায় সেই সুযোগে আশে পাশ টা ও ঘুরে আসে ওরা।
অথচ অন্য গ্রুপের স্টুডেন্ট রা ক্লাস করতে করতে একঘেয়েমি তে বসে থাকে। পরি মনে মনে ভাবে ভাগ্যিস সাইন্স টা নিয়েছিলাম।

সাইন্স নেওয়াতে পরির তিনটে বিষয়ে কোচিং করতে হয়।
অন্য বিষয় গুলো সময় স্বল্পতার জন্য পড়া হয়ে উঠে না।
সেই কাক ভোরে উঠে স্কুলে যায় আর আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। শরীর টা আর সয় না পরির। টিফিন মাঝে মাঝে নিয়ে যায় আর না হলে বাইরের জাঙ্কফুড খায়। সকাল বেলা ভাত খাওয়া সম্ভব নয়। সকাল ছয় টা বাজে ঘুম থেকে উঠে ভাত খাওয়া টা অসম্ভব বিষয়। তাই হালকা নাস্তা করেই পরি প্রাইভেটের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। মাঝে মাঝে না খেয়েই চলে যায়। মিসেস রাহেলা মেয়েকে তেমন কিছু বলেন না।
কারণ সকাল বেলা খাওয়া টা কতটা অস্বস্তির তা ওনি ও জানেন। কিন্তু এভাবে থাকলে পরি অসুস্থ হয়ে যাবে। তাই মাঝে মাঝে তো জোর করে খাবার ব্যাগে দিয়ে দেন। যাতে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে খেয়ে নেয়। এতো সকাল বেলা টিফিন এ ভাত নেওয়া ও সম্ভব না। তাই শুকনো খাবার যেমন : রুটি , নুডলস, রোল কিংবা আলু পরোটা নিয়ে যায় পরি। সেটা ও মাসে দুই তিন দিন। বাইরের খাবার খেতে খেতে শরীর টা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। তারপর উচ্চতর গনিত আর পদার্থ বিজ্ঞানের অপদার্থের মতো আচরণ। পরি আর নিতে পারে না। এত চাপে মেয়েটি যেন অসুস্থই হয়ে
পড়ল।

আজ বেশ অনেকদিন হয়ে গেল নীলের সাথে কথা হয় না পরির। ফোন দেওয়ার তেমন কোনো সুযোগ পাচ্ছে না পরি।
আর ম্যাসেজ দিলে নীল কোনো রিপলে ও দিচ্ছে না।
বড্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। বুকের ভেতর চাঁপা কষ্ট টা খানিকক্ষণ পর পর ই শিউরে উঠছে। হঠাৎ করে নীল কেন এমন করছে? পরি কি কোনো ভুল করেছে? নীল কে ছাড়া অনলাইন টা আজ বি ষা ক্ত মনে হয়। পরি তো বলে ও নি যে ও নীল কে ভালোবাসে। তাহলে কেন নীল ওর সাথে কথা বলে না? নীল কেন এমন করছে? পরির ইচ্ছে করছে নিজেকে শেষ করে দিতে। এতো যন্ত্রণা পরি নিতে পারছে না। সব তো ঠিক ই ছিল তাহলে আজ কেন এমন করছে নীল। তবে কি কখনো ই নীল কে পাওয়া হবে না? পরির মাথা টা ফেঁ টে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। অসহায়ের মতো আকাশের অর্ধচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছে পরি। আজ তারা রা ও পরির সাথে অভিমান করেছে। তাই তো তারা জোছনা ছড়াচ্ছে না। পরি জানালা দিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইল। থেকে থেকে কয়েকটা জোনাকি আলো ছড়াচ্ছে। কিন্তু এত আঁধারের মাঝে সুপ্ত আলোটাকে পরির কাছে স্নিগ্ধ লাগছে না। কথায় আছে না মনের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক। মন ভালো তো সব কিছু ই সুন্দর আর মনে কষ্ট জমে থাকলে হাজারো সৌন্দর্য কে ও বি ষা ক্ত মনে হয়।
পরির ইচ্ছে করছে ছন্দ মেলাতে কিন্তু পারছে না। সব কিছু যেন থমকে গেছে। জীবনে এতটা নিষ্ঠুর সময় পার করবে পরি কখনো কল্পনা ও করে নি। অবশ্য সব কিছুই ঘটছে পরির কল্পনার জগত থেকে বাইরে। নীল কে হঠাৎ ই এতো ভালোবেসে ফেলা আবার আলোকবর্ষ দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া।
জানালার গ্রিল শক্ত করে ধরে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরি। অনড়গল চোখ থেকে অশ্রু বর্ষন হচ্ছে। পরি সিরিয়ালে দেখেছে অনেক গল্প তে ও পড়েছে মনের ভেতর নাকি ঝড় হয়। কিন্তু এই সব কিছু পরির কাছে নিতান্ত ই হাস্যরসিকতার মনে হত। কিন্তু আজ সেই সব কিছু নিজের জীবনেই উপলব্ধি করছে সে। জীবন টা বোধহয় সিনেমা হয়ে গেছে। আর না হলে গোটা কয়েকশো পাতার বইয়ের মাঝে আটকে আছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর কিন্তু গলা দিয়ে একটি শব্দ ও আসছে না। বোধহয় বাকযন্ত্র টা ও আজ পরির বিপক্ষে। এই পৃথিবীতে তবে কি একা হয়ে গেল সে? না না একা কেন হবে চোখের বিরতীহীন অশ্রু কণা তো তার সাথে আছে। কিন্তু এ অশ্রু কণা যে বড্ড যন্ত্রণা দায়ক। পরি বাথরুমে চলে গেল। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে হাঁটু তে মুখ গুঁজে বসে রইল কিছু সময়। শরীরের প্রতি টা নিউরন যেন কষ্ট দেওয়ার জন্য যেকে বসেছে। পরির জীবন স্থির হয়ে গেছে। ভালোবাসার এ কি নিদারুণ যন্ত্রণা।হাজারো যন্ত্রণার মাঝে ও যদি নীল কে পেতো সে। ইস আক্ষেপ টা কি তবে রয়েই যাবে। খাপছাড়া হয়েই কি জীবন তার নিজ গতিতে পর্দাপন করবে ?

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

পড়ুন “যেখানে মেঘ সেখানেই রোদ্দুর”
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/299955645898670/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here