নীলের_পরি (১৯)

0
11

#নীলের_পরি (১৯)

আজ প্রায় তিন মাস হয়ে গেল নীলের সাথে একটি বার ও কথা হয় নি পরির। এত বার ম্যাসেজ দেওয়ার পর ও নীল কোনো রিপলে দেয় নি। প্রতি বার ই সিন করে রেখে দিয়েছে। পরির খুব কষ্ট হয়,কেন নীল এমন করে? একটু কথা বললে কি হয়? সে যদি জানতো তার সাথে কথা বলার জন্য পরির মন আনচান করছে প্রতি টা মুহূর্ত দুমরে মুচরে শেষ হয়ে যাচ্ছে তাহলে ও কি নীল কথা বলত না? নাকি নীল তাকে সোজা সাপটা বলে দিতো ‘পরি আমাকে আর ম্যাসেজ দিবে না।’ পরির চোখ দিয়ে অনড়গল পানি ঝরছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোছনা ম্লান করছে সে। আসলে প্রকৃতির কাছে নিজের দুঃখ গুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষ বলে কারো কাছে নাকি দুঃখ প্রকাশ করলে,হালকা হওয়া যায় কিন্তু পরি তো রোজ প্রকৃতির কাছে নিজের দুঃখের কাহিনী বলে বেরায়। তাহলে কেন ওর দুঃখ কমছে না? মন তো ভার ই রয়েছে। পরি চোখের পানি টুকু আড়াল করে হাসার চেষ্টা করল কিন্তু হাসি টা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। তার আগেই পরির চোখ দিয়ে অশ্রু বর্ষন নেমে গেল।

পরি কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে রুমে চলে আসল।
এই গরমের মধ্যে ও পরি গায়ে চাদর জড়িয়ে নিল। রাতটা পরির প্রায় ই নির্ঘুম কেটে যায়। অনুভূতি গুলো হয়ত ম রেই যাচ্ছে। পরি আবার উঠে দাঁড়াল। ওয়াসরুম থেকে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ফিরে আসল। আয়না তে নিজেকে এক পলক দেখে নিল। চোখের নিচ টা বেশ ভালোই কালো বর্ণ ধারন করেছে। পরি মলিন হেসে ফোন নিয়ে বসল। রাত প্রায় ২টা। এত রাতে ও কয়েকজন নিশাচর কে অনলাইন এ দেখা যাচ্ছে। কেউ হয়ত প্রেমিকের সাথে কথা বলছে আর কেউ হয়তোপ্রেমিকের ছবি জড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।
কিন্তু দুজোনের মাঝেই একটা জিনিসের বড়ো মিল আছে। দুজন ই নিশাচর। কেউ সুখে তো কেউ দুঃখে। পরি নীলের প্রোফাইল ঘাটতে লাগল। কখনো নীলের প্রোফাইল এর সেই প্রথম দিন থেকে ঘুরে আসা হয় নি। পরি একের পর এক পোস্ট ছাড়িয়ে নিচে নামতে লাগল। হাজারো পোস্ট হাজারো শেয়ার সব কিছু পরি দেখতে লাগল। একটা লাইভ ও ছিল। পাখি শু ট করার লাইভ। নীলের কণ্ঠের স্বর শুনতে পেয়ে পরি আবার কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে নীলের ছবিটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। মুখ দিয়ে একই বুলি উচ্চারণ করতে লাগল। ‘কেন নীল? কেন এমন করছেন? আমি কি কিছু দোষ করেছি? প্লিজ নীল একটু আপনার কণ্ঠ শুনতে চাই।’

পরির কান্নাতে কেউ সাড়া দিল না। পরি নিশী রাতে চার দেয়ালের মাঝে অশরীরীর মতো আর্তনাদ করতে লাগল।
কান্নার বেগ বাড়ার বদলে কমল না। ভোরের আজান কানে আসতেই পরি উঠে বসল। মুখে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু টুকু আঠার মতো হয়ে গেছে। পরি ওড়না টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিল। আজান শেষ হলে কিছুক্ষণ বসে থেকে বাথরুম থেকে অযু করে এল। নামায শেষ করতেই দেখল ভোরের আলো ফুটছে। পরি ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে
ব্যালকনিতে চলে গেল। সূর্যের কোমল রশ্মি টা নেহাত ই মন্দ নয়। সূর্য পরিপূর্ণ ভাবে ওঠে গেলে পরি রুমে এসে রেডি হতে লাগল। পরির মা এসে মেয়ে কে নিজেই ওঠতে দেখে হালকা হেসে চলে গেলেন। পরি রেডি হয়ে স্কুলের দিকে পা বাড়াল।

পরির চোখ দুটো র ক্ত বর্ণ ধারন করেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরি খুব রেগে আছে। সকাল বেলা শান্ত হয়ে স্কুলে গেল কিন্তু এখন ফেরার সময় এতটা রেগে আছে কেন?
পরির মাথা টা ব্যথায় রিক্ত হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে সমস্ত কিছু ভে ঙে ফেলতে। আজ সকাল বেলা শান্ত মেজাজে স্কুলে গিয়েছিল সে। কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার আগে পরির ক্লাস মেট শেফা বলল,”পরি আজকে ছুটির পর একটু দাঁড়িয়ে যাস। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”

পরি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। এই উত্তপ্ত গরমে সারাদিন ক্লাস করে ক্লান্ত পরি। ক্লান্তি ঠেলে স্কুল গ্রাউনে বড়ো বট গাছের নিচে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর ই হন্তদন্ত হয়ে শেফা পরির পাশে বসল। পরি ভ্রু কুঁচকে বলল,”এভাবে হাফাচ্ছিস কেন?”

শেফা ব্যাগ থেকে ওয়াটার বোতল বের করে ঢকঢক করে এক বোতল পানি নিমেষেই শেষ করে দিল। পরির ভ্রু যুগল আপনি আপনি ই কুঁচকে গেল। পরি সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে। শেফা দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল,”বিষয়টা কনফার্ম হওয়ার জন্য গিয়েছিলাম।”

পরি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,”কোন বিষয়?”

শেফা দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বলল,”আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র আপু আছে না নাম চিনি?”

পরি মাথা ঝাঁকালো। শেফা ঢোক গিলে বলল,”আজকে সকালে ওয়াসরুমে গিয়েছিলাম। তখন চিনির বান্ধবী অনিতা বলছিল নীল ভাইয়ার সাথে নাকি চিনির রিলেশন ছিল। আর ও অনেক কিছু। তারপর আমি সেটা
কনফার্ম হওয়ার জন্য অনিতার কাছে গিয়েছিলাম।”

পরি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে মৃদু স্বরে বলল,”তারপর?”

শেফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”ও যা বলল। এটা শোনার মতো মন মানসিকতা আমার ছিল না।”

পরি এখনো এক ই দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। পরি ছোট করে জিজ্ঞাসা করল।
“কি বলেছে?”

শেফা ভয়ার্ত চোখে বলল,”চিনিরা নাকি সন্ধ্যার পর প্রাইভেট পড়তে যায়। কিন্তু কিছু দিন আগে নীল ভাইয়ার সাথে নাকি নীল ভাইয়ার চাচার নতুন করা খালি বাসাতে দুই তিন ঘন্টা সময় কাঁটিয়েছে। এক সপ্তাহ নাকি এমন করেছে।”

শেফা আর কিছু বলতে পারল না। শেফার গলা ধরে আসছে। পরি সরাসরি না বললে ও শেফা জানে পরি নীলের প্রতি কতটা দূর্বল।

পরি ছোট করে বলল,”ও।”

শেফা বেশ অবাক হয়ে আছে। শেফা পরির এই শান্ত দৃষ্টি নিতে পারছে না। শেফার মাথা টা খোলা হয়ে যাচ্ছে।
পরির এমন শান্ত আচরণ কি করে সম্ভব?

পরি ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,”শেফা অনেকটা দেড়ি হয়ে গেছে।
বাসায় যা।”

শেফা কিছু বলতে গিয়ে ও বলল না। শেফা মাথা ঝাঁকিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পরি ধীর পায়ে হেঁটে চলছে। আজকে আর গাড়ির জন্য অপেক্ষা করল না। হাঁটতে হাঁটতেই পরির চোখ দুটো জলন্ত লাভার মতো অগ্নিরূপ ধারণ করল।

বাসায় পৌছে ব্যাগ টা সোফা তে রাখল। পায়ের জুতো দুটো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। পরির চোখ দুটো দেখেই মিসেস রাহেলা আঁতকে ওঠলেন। মেয়ের সচরাচর এমন অগ্নি রূপ দেখেন নি ওনি। মিসেস রাহেলা কিছু জিঙাসা করতে গিয়ে ও করলেন না। অসম্ভব রেগে আছে পরি। এই মুহূর্তে কিছু বলা মানেই পরির সমস্ত রাগ তার ওপর ওঠে যাবে। তার থেকে ভালো পরি কে একা থাকতে দেওয়া। মিসেস রাহেলা দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে রান্না ঘরে চলে গেলেন। সন্ধ্যা প্রায় ছুঁই ছুঁই তাই কফি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কফি বানিয়ে এক মগ কফি নিয়ে পরির রুমের দিকে হাঁটা লাগালেন।
রুমে এসে দেখলেন পরি নেই। বাথরুমের দরজা টা বন্ধ দেখে বুঝতে পারলেন পরি শাওয়ার নিতে গেছে। মিসেস রাহেলা টি টেবিলে কফির মগ টা রেখে চলে গেলেন। প্রায় দশ মিনিট পর শাওয়ার নিয়ে বাথরুম থেকে ফিরল পরি।
মাথা টা এখন একটু হলে ও ঠান্ডা হয়েছে। ঐ রকম কথা শুনলে অস্বাভাবিক হয়ে পড়া টাই স্বাভাবিক ব্যাপার।
টেবিলে কফির মগ দেখতে পেয়ে হালকা করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যে পরিমান গরম পড়েছে এই মুহূর্তে একটা কুল কফির সত্যি খুব প্রয়োজন ছিল। পরি মাথায় ভালো করে তোয়ালে পেঁচিয়ে কফি হাতে নিল। বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেছে বিধায় বরফ গুলো গলে গেছে। কিন্তু এখনো প্রচন্ড ঠান্ডা কফিটা। পরি এক নিশ্বাসে কফি শেষ করে নিল।
কফি টা খাওয়ার দরুন পুরোপুরি শান্ত অনুভব করছে সে ।
কিন্তু মাথা তে বার বার ঘুরছে শেফা র বলা কথা গুলো।
নীল কে বলার ও উপায় নেই। নীল তো একটা ম্যাসেজ এর রিপলে ও দিচ্ছে না। পরি রোজকার মতো বেডে ওপর হয়ে শুয়ে নীল কে ম্যাসেজ দিল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ও নীলের রিপলে আসল না। পরি কপালে হাত দিয়ে ফোন টা মাথার কাছে রেখে শুয়ে রইল। প্রায় পঁচিশ মিনিট পর ম্যাসেজের টুং আওয়াজে পরি চমকে ওঠল। হন্তদন্ত হয়ে ফোন হাতে নিল। নীলের রিপলে দেখে পরির চোখের কোণে পানি চিক চিক করতে লাগল। কত দিন পর নীল রিপলে দিল! পরির চোখ দুটো ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খানিক পরে ই সমস্ত অভিমান আর রাগ চড়াও করে ওঠল। নিজেকে শক্ত করে ম্যাসেজ লিখল।

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

যারা ২৫% ছাড়ে আমার ই-বই গুলো সংগ্রহ করেন নি। করে ফেলুন। লিংক কমেন্টে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here