#নীলের_পরি (২৪)
বিকেল ৫ টা। বাড়ি ভর্তি মেহমানদের ছড়াছড়ি। সবার উদ্দেশ্য নতুন বউ কে দেখা। পরি হালকা গোলাপি রঙা কটন কাপড়ের থ্রি পিস পড়ে আছে। মুখে নেই কোনো আভিজাত্যের ছোঁয়া। আশে পাশের মানুষেরা খানিকটা অবাক ই হয়েছেন। নতুন বউ তো ভারি জামাকাপড় ব্রাইডাল মেকআপ করে থাকবে কিন্তু না পরি তো একদম সাদা সিধে সেজে আছে। পরির সৌন্দর্য বলতে হলুদ ফর্সা গায়ের রঙ , লম্বা 5’3 , চোখ দুটো মাঝারি সাইজ , যুগল ভ্রু, নাক টা মোটা ও না সরু ও না,ঠোঁট হাল্কা গোলাপি, কোমরের উপর অবধি সিল্কি ভাঙা চুল। গোলাপি রঙা থ্রি পিস এ পরির সৌন্দর্য তরতাজা লাগছে। একদম স্বচ্ছ সতেজ ফুটন্ত ফুলের মতো। খানিকটা যে অসুস্থ তা বোঝা দায়। কে বলবে মেয়েটার উপর গতকাল কতো বড় ঝড় বয়ে গেছে। মেহমানরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরি কে দেখছে। আহামরি সৌন্দর্য খুঁজে না পেলে ও কোনো ত্রুটি খুঁজে পাচ্ছে না তারা। অতএব প্রশংসা করতেই হয় । পরি সবার সাথে কুশল বিনিময় করে কিচেনে গেলে। এক ঘন্টা ধরে পরি আর হাফসা স্ন্যাকস বানিয়েছে। মেহমান আসাতে পরি কে ডেকে নিয়ে যান মিসেস রোজিনা। পরি কিচেনে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল।
হাফসা একা হাতে সামলাচ্ছিল। পরি কে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পরি খুন্তি হাতে ফ্রাই পেন এ টিকিয়া ভাজতে লাগল। সমস্ত কিছু ই প্রায় শেষ। পরি শেষ টুকু ভাজতে ভাজতে হাফসা কে বলল,”হাফসা প্লেট গুলো ক্লিন করে ফেল। আমার প্রায় হয়ে গেছে।”
হাফসা সম্মতি জানিয়ে কাজ করতে লাগল। পরি রান্না বান্না তেমন পারে না। কিন্তু সৌখিন রান্না গুলো তে বেশ এক্সপার্ট।
ভাজা কমপ্লিট করে হাফসা আর পরি মিলে পর পর নাগেটস, টিকিয়া , পকোড়া , মোমো , আর চিকেন ললিপপ সাজিয়ে নিল। ড্রিংকস হিসেবে করে রেখেছে বাদামের সরবত। খাবার রেডি হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সার্ভেন্ট এসে খাবার নিয়ে গেল। সার্ভেন্ট চলে যেতে দেড়ি কিন্তু হাফসা র নাগেটসে কামড় দিতে দেড়ি হয় নি। পরি ভ্যবলার মতো চেয়ে আছে দেখে হাফসা খাবার চিবুতে চিবুতে বলল,”দেখ এতক্ষণ একটা ও মুখে দেই নি। এখন আমি না খেয়ে পারব না।”
হাফসা র কথা তে পরি হাসতে লাগল। পরক্ষণে নিজে ও দুটো নাগেটস নিয়ে খেতে লাগল।
নীল অনিক কে নিয়ে বিকেল বেলাতে বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য বন্ধুদের সাথে আড্ডা। তিন বছর পর দেশে ফিরেছে নীল। তার উপর দেশে ফিরেই ভিলেন এর মতো করে বিয়ে করে এনেছে! একটা ট্রিট কেন দশ টা ট্রিট দিলে ও কম হয়ে যাবে। বন্ধুদের দাবি এখন ছোট খাটো ট্রিট দিয়ে পড়ে যেন বড়ো পার্টি দেওয়া হয়। নীল আর অনিক পৌছাতেই সবাই হৈ হুল্লোড় করা শুরু করে দিয়েছে। বন্ধু ভাই ব্রাদার মিলে প্রায় বিশ জনের মতো এসেছে। সবার সাথে অনিকের পরিচয় হয় নি। তাই প্রথমে অনিকের সাথে সবাই কে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে নীল। অনিক খুব তাড়াতাড়ি সবার সাথে মিশে যাচ্ছে। কেউ দেখলে বলবেই না এই ছেলে লন্ডনের বাসিন্দা। সবাই বিশাল বড়ো, পানির উপরের একটা ক্যাফে তে বসে আছে। কফি হাতে আড্ডা দিতে দিতেই নীল বলল,”তো বলুন আপনাদের কি ভাবে সেবা করতে পারি।”
লিমন বলল,”মামা সেবা কি বল। গভীর সেবা করতে হবে।
আমরা সবাই সিঙ্গেল ম র তেছি আর তুই বেটা কাম সেরে দিলি।”
লিমনের কথা তে সবাই অট্টহাসি তে মেতে উঠল।
অনিক বলল,”লিমন আমাদের নীল কিন্তু বিশাল মাপের প্রেমিক। এই প্রেমিক তার প্রেমিকা কে ভালোবাসার কথা বলে নি আর না প্রেমিকা বলেছে। অথচ দুজনে টুপ করে বিয়ে ও করে নিল!এতে কারো বিন্দু মাত্র অভিযোগ ও নেই।
ইন্টারেস্টিং প্রেমকাহিনী তাই না? ভাবছি এই প্রেম কাহিনীর মুভি বের করব। তারপর আমরা বিলিয়নার হয়ে বিলগেটস কে ও হার মানাব।”
সবাই এক সাথে বলল,”ওহো সেই আইডিয়া।”
নীল হাসতে হাসতে বলল,”এগুলো তোমরা বুঝবা না মামা।”
রাফি আগ্রহ নিয়ে বলল,”কেন বুঝব না? বোঝালেই বুঝব।
আর বুঝিয়ে আমাদের ও হেল্প কর। আমাদের ও তো একটা হক আছে তাই না। পঁচিশ পেরিয়ে গেছে এখন তো আমরা ও বিয়ে করব তাই না।”
সবাই এক সাথে বলে উঠল ঠিক ঠিক ঠিক। নীল কানে হাত দিয়ে বলল,”আব্বে আমার বউ কে, কি বিধবা বানাতে চাচ্ছিস নাকি। এই ভাবে চিৎকার করলে তো যখন তখন হার্ট ব্রেক মে রে দিবে।”
মুহিত নীলের পিঠ চাপরে বলল,”আরে বেটা আগে বল তো কাহিনী টা কি।”
“ওকে বলছি আগে তো অর্ডার টা কর।”
নিশাত বলল,”কার কি লাগবে লিস্ট করে দে। গিয়ে অর্ডার করতে হবে।”
সবাই একে একে খাবারের মেনু লিখে দিল। বাকি সবাই ইটালিয়ান , চাইনিজ নিলে ও অনিক আর নীল বাঙালি খাবার অর্ডার দিল। কারণ ওরা এই সব খেতে খেতে বিরক্ত।
সবাই সফট ড্রিক্ হিসেবে আতা সেক নিল। এটা এই ক্যাফের স্পেশাল আইটেম।
আজ থেকে সাত বছর পূর্বে।
“হোয়াট রাবিস নীল! একটা দশ এগারো বছরের বাচ্চা মেয়েকে তুমি ভুলতে পারছ না। ছিই, কেন পারছো না ভুলতে?”
আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি কে বার বার প্রশ্ন করছে নীল। তিন দিন আগে বন্ধুর বড়ো বোনের বিয়ে তে যায় নীল।
হঠাৎ ই একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে আসে। বাচ্চা মেয়ে টা নীল কে পাস করতে গিয়ে নীলের সাথে ধাক্কা খায়। নীল ফোনে কথা বলছিল। ধাক্কা লেগে ফোন টা পড়ে যায়। নীল বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই ছোট্ট মেয়েটা জড়সড়ো হয়ে যায়। ঘেমে একাকার চোখে ভয়। মনে হচ্ছে আর একটু পর ই কেঁদে দিবে। নাকের ডগা টা লাল হয়ে গেছে। নীল এক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। নীল মেয়েটার যাওয়ার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ধ্যান ভাঙতেই নীল আপন মনে হাসে। মেয়েটা বেশ ভয় পেয়েছিল। নীল ফোন টা তুলে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আজ তিনদিন হয়ে যাওয়ার পর ও নীলের মনে বার বার মেয়েটার কাঁদো কাঁদো মুখ টা ভেসে উঠছে। কি মিষ্টি লাগছিল মেয়েটিকে। কিন্তু এই ছোট্ট মেয়েটাকে বার বার কেন মনে করছে নীল? নীলের মাথা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ১৮ বছর বয়সী ছেলে আর যাই হোক এই এগারো বছর বয়সী মেয়ের মধ্যে এমন কিছু দেখতে পারে না যার জন্য এভাবে মনে পড়বে। নীল নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবে মেয়েটা মিষ্টি ছিল তাই বার বার হয়তো মনে পড়ছে। শারীরিক কোনো মোহ থেকে নয় এক অদ্ভুত ভালো লাগা থেকে এই অনুভূতি হচ্ছে। এসব ভেবে সেদিন নিজেকে সামলে নেয় নীল। মাঝে কেটে যায় দেড় বছর। নীলের এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। ভার্সিটির জন্যে স্কুল থেকে সার্টিফিকেট লাগবে।
সেই দশটা থেকে নীল লাইব্রেরির আশে পাশে ঘুরছে।
কিন্তু হেড স্যার এর দেখা নাই। এগারোটা বাজতে চলল।
স্যার নাকি সপ্তম শ্রেনির স্টুডেন্ট দের ক্লাসে গেছেন।
নীল বিরক্তি ঠেলে সপ্তম শ্রেনির ক্লাসে এ ঢুকলেন। ক্লাসে এ স্যার কে দেখতে না পেয়ে বের হতে লাগল ঠিক তখনি ই একটা কণ্ঠস্বরে নীল থমকে গেল।
“এই তুই আমার সিট এ বসেছিস কেন? আমি প্রথম সিট ধরেছি তুই তোর সিট এ যা।”
নীল পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখল সেই মেয়েটা। নীল অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল।
বারান্দাতে এসে বার কয়েক শ্বাস নিল। এই মেয়েটাকে তো নীল মাথা থেকে ঝারতেই পারছে না। গত দেড় বছরে যখন তখন এই বাচ্চা মেয়েটা মাথায় চলে আসত। নীল তো কোনো সুন্দরী কিশোরী কে দেখে ও এমন ভরকে যায় নি।
আজ এই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে নীলের এমন কেন লাগছে? নীল ক্লাস রুমের সাইটে দেখে নিল। হুম এটা তো সপ্তম শ্রেণির ‘খ’ শাখা তার মানে তো হাফসা ও এই শাখাতেই পড়ে। নীল আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল।
আজ দু সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পর ও নীল মেয়েটাকে ভুলতে পারছে না। বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে। নীলের বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। রাত একটা বাজে। শীত প্রায় চলে এসেছে নীল রুম থেকে বের হয়ে সোজা ছাঁদে চলে আসল।
টাউজার এর পকেট থেকে সিগারেট বের করে সুখ টান দিতে লাগল। স্কুল পেড়িয়ে কলেজে যেতেই সিগারেট নামক এক সঙ্গি জুটেছে তার। একের পর এক সিগারেট শেষ করে চার নম্বর সিগারেট টি ধরাল কিন্তু সেটা আর খেল না।
নীলের মনের ভেতর বার বার প্রশ্ন জাগছে কেন ঐ মেয়েটাকে ভুলতে পারছে না? বুকের ভেতর ধুকপুক করছে।
হঠাৎ ই তার এক অনৈতিক ইচ্ছে জাগল। ইস গুলুমুলু মেয়েটার গাল টা টেনে দিতে পারত যদি। নীলের এমন ভাবনাতে নীল নিজেই চমকে গেল। কি ভাবছে ও! মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে কেউ মাথা তে আ ঘা ত মে রে দিয়েছে। নীল মাথা চেপে ধরে বসে আছে। পাগল মনে হচ্ছে নিজেকে। বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হয়। এই অস্বস্তি ভরা যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে ফজরের আযান পড়ে গেল। নীল স্থির হয়ে বসে থেকে মসজিদের দিকে পা বাড়াল। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হতেই সেই মেয়েটিকে মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বুক ধুকপুকানি শুরু করে দিল। ঐ মেয়েটিকে এক মুহূর্তের জন্য হলে ও দেখতে চায় নীল। বাসায় এসে ফ্রেস হয়ে বের হয়ে গেল স্কুলের উদ্দেশ্যে।
সকাল ৭ টা বাজে নীল স্কুলের পাশের ব্রীজ এ বসে আছে।
স্কুল টাইম ১০ টায় কিন্তু নীল এক মুহূর্ত থাকতে পারছিল না তাই চলে এসেছে। প্রায় দুই ঘন্টা আটচল্লিশ মিনিট পর রাস্তা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঐ মেয়েটিকে স্কুলের ফর্মাল ড্রেস আপ এ দেখতে পেল নীল। স্থির হয়ে গেল চোখ। সমস্ত যন্ত্রণা ক্লান্তি দূর হয়ে গেল নিমেষেই। বুকে বয়ে গেল শান্তির ঝড়। মেয়েটি চলে যেতেই নীলের মাথায় টনক নেড়ে উঠল।নীল কি করল এটা? কেন এত আকুলতা! কেন এত ধুকপুকানি। তবে কি নীল,না না এটা কি করে সম্ভব? এমন টা হতে পারে না। আচ্ছা কেন হতে পারে না? প্রায় দেড় ঘন্টা নীল নিজের মনের সাথে যুদ্ধ চালাল। অবশেষে ওর মন মস্তিষ্ক স্বীকার করে নিল এই উনিশ বছর বয়সী যুবক এক বারো বছর বয়সী বাচ্চা মেয়ের মায়া তে পড়ে গেছে। নীল আপন মনে হাসতে লাগল। কি অদ্ভুত তার দুনিয়া! তারপর নিজেকে বলল,”উফ নীল এই পিচ্ছি মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলি।”
নীলের মনে অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে। মেয়েটির খবর নিয়ে জানতে পাড়ল মেয়ে টার নাম জান্নাতুল পরিনীল। পরিনীল নাম টা শুনেই নীল মুগ্ধ হয়ে গেল।
সৃষ্টিকর্তা বোধহয় নীলের সাথে পরি কে বেঁধে দিয়েছেন।
তাই তো পরির নামের সাথে নীল নাম টা কতো সুন্দর স্থান পেয়েছে। ভালোবাসা যখন তখন যার তার উপর হয়ে যায়।
কিশোরী মেয়েদের প্রতি যুবকদের আকর্ষণ বেশি। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে নীল পিচ্ছি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছে।একেই কি তবে ভালোবাসা বলে আর বাকি সব কিছু কি মোহ?
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
| #শেষ_বিকেলের_মায়া আজ সন্ধ্যায় পাবেন ইনশাআল্লাহ। সাধ্য মতো রেসপন্স করার অনুরোধ।|