নীলের_পরি (৪৩)

0
7

#নীলের_পরি (৪৩)

সকাল হতে না হতে পরির মুখে এক রাশ কালো মেঘ এসে জড়ো হয়েছে। চোখ দুটো পানিতে টইটম্বর,আর একটু হলেই বুঝি তীব্র অশ্রু বর্ষণ নেমে যাবে। নীল ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে মন টা বেশ অশান্ত। বড্ড কষ্ট হচ্ছে, ইচ্ছে হচ্ছে সব ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। জীবনের প্রতি খুব রাগ হচ্ছে। সুখ নামক পাখিটা জীবনে কিছুতে স্থায়িত্ব পাচ্ছে না। একটা না একটা ঝড় এসে সব উলোট পালোট করে দিচ্ছে। সকালে নাস্তা খেয়ে উঠেছে মাত্র ঠিক তখনই লন্ডনের ম্যানেজার ফোন করে জানাল,”অন্য একটা কোম্পানি টেন্ডার নিয়ে ঝামেলা করছে। যদি আগামি চার মাসের মধ্যে সমস্ত প্রোডাক্ট ঠিক ঠাক না ডেলিভারী হয় তো কোম্পানির বিশাল বড়ো লস হয়ে যাবে। যার জন্য কোম্পানির বিশাল মাপের টাকা অন্যান্য ডিলার দের হাতে চলে যাবে। তার উপর কোম্পানি বেশ কয়েকটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে। সেই গুলো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবে। আর ব্যাংক এর কাছে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ গস্ত হতে হবে। এই লস পুষিয়ে নিতে কয়েক বছর লেগে যাবে। আর কোম্পানি রেঙ্কিং এর সর্বনিম্ন তালিকায় চলে যাবে। যা অত্যন্ত হতাশাজনক আর লজ্জার।”

নীলের মন বিন্দু মাত্র চাইছে না পরি কে ছেড়ে যেতে। নীল জানে পরি কোনোভাবেই নীল কে বাঁধা দিবে না। কারণ এত বড়ো ক্ষতি পরি কখনোই চায় না। কিন্তু পরির মন,মন তো নীল কে চাইছে না ছাড়তে! নীল ও তো পরি কে ছেড়ে যেতে চাইছে না। বিবেক আর মন যুদ্ধ রত। মাঝে দুটো মানুষ পু ড় ছে কঠিন ভাবে ।

নীল পকেট থেকে সিগারেট বের করল। এই সিগারেট জীবনের ভয়ঙ্কর সময়ের সঙ্গী ছিল। অবশ্য এই দশ বারো দিনের মাঝে একটি সিগারেট ও খায় নি নীল। কিন্তু আজ মন অশান্ত,জীবন ব্যথিত,প্রিয়তমা কে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না নীলের। পরি কে যে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে তার ও কোনো উপায় নেই। ইমার্জেন্সি পাসপোর্ট বানাতে গেলে ও দশ দিন লাগবে। আর নীলের হাতে সেই সময় টুকু নেই।
তাছাড়া পরি মেডিকেলে ভর্তি হবে সব মিলিয়ে পরি কে সাথে নেওয়া সম্ভব নয়। নিকোটিনের কালো ধোঁয়া বুকের ভেতর নেওয়া শেষ হলে নীল ব্যলকনি থেকে রুমে চলে আসে। পরি কে অগোছাল লাগছে। পরির বি ধ্ব স্ত মুখ টা দেখে নীলের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল।

নীল পরির কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে মেঝে তে বসল। পরির কোলে মাথা রেখে বলল,”মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে?”

পরি চোখের পানি যথাসম্ভব সংযত রেখে নীলের মাথায় হাত বুলাতে থাকল। কিছুতেই নীল কে দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না। আর র্ন নীলের কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা যাবে।
কিন্তু মন কত ক্ষণ পারবে নিজেকে দমিয়ে রাখতে?এক মিনিট , পাঁচমিনিট, দশ মিনিট করতে করতে চল্লিশ মিনিট পার হয়ে গেল কিন্তু নীল এখনো পরির কোলেই মাথা রেখে বসে আছে। দুজন ই নীরবতা পালন করছে। হাজারো কথা গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। এত কাছে থেকে ও মনে হচ্ছে আজ দুজন বহু দূরে। এই সাময়িক বিচ্ছেদ দু জনের মন কেই বিস্বাদ করে তুলছে। দুজনেই চাইছে একে অপরকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখতে। কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তি বার বার বাঁধা দিচ্ছে। আর সেই দহনে জ্ব লে পু ড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে দুটি হৃদয়।

ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে হাফসা আর দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে অনিক। কি বলবে মেয়েটাকে? এই প্রথম হাফসা কে কাঁদতে দেখছে অনিক। চোখ দুটো লাল করে ফেলেছে! বিগত দু ঘন্টা ধরে এক ই ভঙ্গিতে কেঁদে চলেছে হাফসা। অনিকের কাছে মনে হচ্ছে হাফসা পৃথিবীর একমাত্র জলকন্যা যার চোখের অশ্রু দিয়ে তৈরি হয়ে যায় সমুদ্র কিংবা ঝরনা।

হাফসার দিকে তাকিয়ে বার কয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিল অনিক। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে জ্বর না বাঁধিয়ে ফেলে!
অনিক নিজেকে শক্ত করে হাফসার দিকে এগিয়ে গেল।
অনিক কে দেখে হাফসার কান্না যেন দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বাড়তে লাগল। হাফসার এমন কান্ডে অনিক আহাম্মক হয়ে গেল।অনিক দীর্ঘশ্বাস টেনে বলল,”কি করছ হাফসা?”

হাফসা ছাদের রেলিং ধরে কেঁদে চলেছে। অনিকের এমন খামখেয়ালি কথাতে হাফসার বেশ রাগ হচ্ছে। কোথায় হাফসাকে জড়িয়ে বলবে এভাবে কাঁদলে আমার ও কষ্ট হয়।
তা না বলে জিজ্ঞাসা করছে কি করছে সে! চোখ কি অন্ধ নাকি? হাফসার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে হলো না অনিক কে উত্তর দেওয়ার।

অনিক রেলিং এ পিঠ ঠেকিয়ে দুপুরের মিষ্টি রোদের দিকে তাকিয়ে ভাবছে মেয়েটা কে কি করে সান্ত্বনা দেওয়া যায়।
এমন ও নয় অনিকের খুব ইচ্ছে হচ্ছে হাফসা কে ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু কোম্পানির স্বার্থে যেতেই হবে। যদি এটা শুধু নীল আর অনিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে অন্য কিছু করতে পারত। কিন্তু কোম্পানির সাথে জড়িয়ে আছে কয়েক শ স্টাফ। তাদের একটা পরিবার আছে। প্রেমিকার থেকে কয়েক মাসের বিচ্ছেদের জন্য এত মানুষের জীবনের রিস্ক নেওয়া টা অন্যায় বই কিছু না। অনিক দীর্ঘশ্বাস টেনে বলে,”হাফসা তুমি যদি না চাও তো আমি লন্ডনে যাব না।
কিন্তু এতে কয়েক হাজার মানুষের জীবন বিপর্যয়ে পড়বে।
তাছাড়া আমার ফ্যামেলি কে তো আমাদের বিষয়ে ইনফর্ম করতে হবে। তুমি ই তো চাও আমরা বি ডি তে যেন থাকি।তার জন্য ও কিছু টা সময়ের প্রয়োজন। এক বছর পর তো আমরা বিয়ে করবই তাই না?-

হাফসা কোনো কথা বলছে না। অনিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাফসার দুই বাহু চেপে ধরে কাছে টেনে নিল।

“তুমি কি কোনো ভাবে ভাবছ আমি তোমার থেকে দূরে গিয়ে তোমায় ভুলে যাব? কিংবা অন্য কারো সাথে….”

অনিক কে আর কিছু বলতে না দিয়ে হাফসা অনিক কে শক্ত করে জড়িয়ে কান্না করতে লাগল। হাফসার হঠাৎ আক্রমণে অনিক কিছুটা বিচলিত ই হলো। তারপর ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলল,”হাফসা আর অনিক এক সূত্রে বাঁধা। তারা কখনো ই আলাদা হবে না। ভালোবাসো তো আমায়?”

হাফসা হিচকি তুলতে তুলতে মাথা ঝাঁকাল। অনিক মৃদু হেসে হাফসা কে ছাড়িয়ে হাফসার কপালে ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে বলল,”ভালোবাসা বিশ্বাসের উপর টিকে থাকে হাফসা। যেমনটা নীল আর পরির ক্ষেত্রে হয়েছে। আল্লাহ না চাইলে কিছুই সম্ভব নয়। তাই আমি তোমার চোখে আর পানি দেখতে চাই না। কি কাঁদবে না তো?”

হাফসা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,”হুম আর কাঁদব না। তাহলে কথা দাও রোজ ফোন করে কথা বলবে আমার সাথে।”

হাফসার কথাতে অনিক মৃদু হাসল। তারপর হাতে হাত রেখে বলল,-কথা দিলাম আমার হাফসার সাথে রোজ ফোনে কথা বলবো। আর মাঝে মাঝে লন্ডন টু বিডি তে ফ্লাইং চুমু ও দিব।”

অনিকের কথাতে হাফসা লজ্জা পেল। সাথে সাথে হাসি রাঙিয়ে বলল,”ধ্যাত।”

অনিক হাফসা কে টেনে জড়িয়ে নিল। আর হাফসা ও শক্ত হাতে অনিক কে আঁকড়ে ধরল। যদি সাময়িক বিচ্ছেদে মানুষের দু মুঠো ভাত জোটে তবে ক্ষতি কি তাতে?

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here