নীলের_পরি (৪২)

0
6

#নীলের_পরি (৪২)

শীতের কুয়াশা কে ছাড়িয়ে কিছুটা রোদ্দুর প্রকৃতি কে আলোকিত করে যাচ্ছে। ছাদে দাঁড়িয়ে কোমল রোদ্দুর অনুভব করছে পরি। মনে তৃপ্তি,মুখে হাসি,আর সাথে স্নিগ্ধ পরিবেশ। সব কেমন যেন স্বপ্নের মত। নীল কে ভালোবাসি কথাটা আজ ও বলা হয় নি। এই একটি কথার মাঝে কি কখনো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে? হয়ত না। অনেক সময় চোখের কৌতূহল দেখে ও মেপে নেওয়া যায় সে তাকে ভালোবাসে। তবু ও এই ভালোবাসি কথাটা অতি মূল্যবান।
যা শোনার জন্য কত প্রেমিক প্রেমিকারা মাসের পর মাস বছরের পর বছর অপেক্ষা করে থাকে। কেউ এর সার্থকতা পায় তো কেউ পায় না। তবু ও অপেক্ষা করে থাকে। পরি মনে মনে স্থির করে নিল, নীল কে ভালোবাসি কথাটা খুব তাড়াতাড়ি বলে দিবে। কোনো রকম খামতি রাখবে না ওদের সম্পর্কে। পরি কিছুক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে থেকে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসল।

আমান আর নিশা জামা কাপড় সিলেক্ট করতে ব্যস্ত। আপু আর দুলাভাই এর সাথে ঘুরতে যাবে ফিলিংস ই ভিন্ন। পরি রুমে আসতেই নীল তাড়া দিয়ে বলল,”ফাস্ট রেডি হও।
সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে তো।”

পরি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। তারপর রেডি হতে চলে গেল। গুলশানের বিশাল এক রেস্টুরেন্ট এ বসে আছে এক ঝাঁক পাখিরা। সবার হাতেই ওয়েলকাম ড্রিঙ্কস। মাঝে মাঝেই সবাই খিল খিল করে হেসে উঠছে।

নীল মুচকি হেসে বলল,”মিস শ্যালিকা রা আপনাদের বান্ধবীর একটু সিক্রেট খবর গুলো দিন তো।”

রিনি আপসোস এর সুরে বলল,”সেকি দুলাভাই দশ বারোদিন সংসার হয়ে গেল আর এখনো সিক্রেট জানতে পারলেন না?”

নীল মুখ গোমড়া করে বলল,”কি আর বলব শ্যালিকা সাহেবা আপনার বান্ধবী কে গত সাত বছর ধরে দেখে আসছি তাও চিনে উঠতে পারলাম না।”

মলি মুখ কুঁচকে বলল,”সে কি ভাইয়া কি হয়েছে?”

নীল দীর্ঘশ্বাস টেনে বলল,”হায় আর কি বলব। যখন তেরো চৌদ্দ বছরের পিচ্চি বালিকা ছিল তখন আমায় তুই করে বলত। আর এখন আঠারো তে পা দিচ্ছে তারপর ও আপনি করে বলছে। এখন মনে হচ্ছে সত্যি এক পিচ্চি কে বিয়ে করে ফেলেছি আর আমি হয়ে গেছি বৃদ্ধ মহাশয়।”

নীলের কথাতে সবাই অট্টহাসি তে ফেটে পড়ল। আর পরি হতাশ হয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে আছে। বেচারা পরির অবস্থা নাজেহাল করেই ছাড়বে এরা।

তিন্নি হাসি থামিয়ে বলল,”এ কেমন কথা দুলাভাই বউ এর মুখ থেকে তুমি বলাতে পারলেন না!”

নীল হতাশাগ্রস্ত হয়ে বলল,”উফ শালি সাহেবা দুলাভাই বলবেন না। কলিজায় বড্ড লাগে।”

নীলের কথা শুনে সবার চোখ রসগোল্লা হয়ে গেছে।
তিন্নি বিঘ্ন কণ্ঠে বলল,”সেকি দুলাভাই, বউ বুঝি আজকাল মিষ্টি বেশি ই দিচ্ছে। সুগারের প্রবলেম হয়ে যাচ্ছে নাকি?”

তিন্নির কথার প্রতিউত্তরে নীল বলল,”ঝাল, মিষ্টি,টক সব ই দিচ্ছে শালি সাহেবা। কিন্তু আপনি বলে বর থেকে বুড়ো বানিয়ে দিচ্ছে যে।”

এতক্ষণ পরি চুপ থাকলে ও এবার আর থাকতে পারল না।

পরি চোখ রাঙিয়ে বলল,”এই তোরা থামবি? তোদের পাশে যে দুটো বাচ্চা আছে দেখছিস না।”

রিনি মুখ দিয়ে ওহ শব্দ করে বলে,”হায় হায় আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার ডার্লিং যে পাশেই আছে।”

আমান ভেংচি কেটে বলল,”তোমায় আমি আর বিয়েই করব না। হবু বর কে ভুলে যায় যে তাকে বিয়ে করে দেখব আমি আছি বর যাত্রী আছে কিন্তু বউ ই নেই।”

আমানের কথায় সবাই অট্টহাসি তে ফেটে পড়ল। পরির চোখের সাথে নীলের চোখাচোখি হতেই পরি নীল কে ভেংচি কেটে দেয়। আর নীল চোখ মুখ কুঁচকে ইশারা তে চুমু দেখিয়ে দেয়। পরির লজ্জায় রঙিন হতে থাকে। যার ফলে পরির বান্ধবীরা পরি কে পিঞ্চ কাটতে থাকে। পরি বেচারি অসহায়ের মতো সব সয়ে নেয়। কিছু বললেই এরা পরি কে লজ্জায় ফেলে দিবে। তার থেকে চুপ থাকাটাই শ্রেয়।

দুটো ওয়েটার এসে খাবার সার্ভ করে দিল। সবাই একসাথে লাঞ্চ করে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে।

গুলশান এক নাম্বারে আসতেই বিশাল বড়ো একটা বিল্ডিং চোখে পড়ে পরির। এই বিল্ডিং টার কাজ চলছে। পুরো বিল্ডিংটার ডিজাইন ইউ এস এর মডেলের। আঠারো তলার এই বিশাল বিল্ডিং যে কারো নজর কারতে সক্ষম। রাস্তার ধার দিয়ে যারাই যাচ্ছে তারাই এই বিল্ডিং এর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকছে। বিডিতে আমেরিকান মডেলের বিল্ডিং সবাই কে বিচলিত করছে। পরি অবাক হয়ে দেখছে সব। নীল মুচকি হেসে বলল,”কি দেখছো?”

পরি মৃদু হেসে বলল,”এক দেড় বছর আগে আমি এই রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম। তখন এই প্লট টা খালি ছিল আর আজ কি সুন্দর এই বিশাল মাপের বিল্ডিং তৈরি হয়ে গেছে।”

নীল মৃদু হেসে বলল,”বালিকণা জমতে জমতেই বিশাল বড়ো দ্বীপের সৃষ্টি হয়। ঠিক তেমনি সূক্ষ্ম ভালোবাসা জমতে জমতে বিশাল মাপের ভালোবাসা তৈরি হয়। অর্থাৎ সব কিছুই সূক্ষ্ম থেকে বৃহত্তর হয়।”

পরি মুচকি হেসে বলল,”আজকাল আপনি বড্ড বেশি বুঝেন।”

নীল পরি কে চোখ মে রে বলল,”আগে থেকেই শুধু তোমাকে ই বুঝতে দেই নি।”

পরি ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,”ঢং?”

নীল হাসতে হাসতে বলল,” সেটা ও তো তোমার অংশ।”

“ইস।”

“আচ্ছা পরি এই বাড়িটা কি সত্যি ই খুব সুন্দর হয়েছে?তোমার ভালো লেগেছে?”

পরি ভাবলেশহীন ভাবে বলল,”অবশ্যই। আমেরিকান মডেলের প্রতিটি জিনিস ই অনেক সুন্দর হয়।”

নীল কপালে হাত দিয়ে বলল,”আয় হায় কি বলো। এখন আমি নিজেকে কি করে আমেরিকান মডেল বানাই বলো তো?”

নীলের কথাতে পরি মুচকি হেসে বলল,”আমার আমেরিকান মডেলের বর চাই না। ইনফেক্ট অন্য কাউকেই চাই না।”

নীল মুচকি হেসে বলল,”নতুন করে প্রেমে পড়ছো বুঝি?”

পরি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,”মোটে ও না।”

নীল হাসতে হাসতে বলল,”সামথিং সামথিং।”

পরি মুখ ঘুরিয়ে বলল,”নাথিং নাথিং।”

তখনই আমান আর নিশা এসে হাজির। হাতে এক গাদা জিনিসপত্র। নীল মুচকি হেসে বলল,”কি সব ঠিক ঠাক তো?”

আমান আর নিশা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,”100% ঠিক ঠাক এটিএম কার্ড।”

ওদের কথা শুনে নীল আর পরি হাসতে লাগল। তারপর সবাই গাড়িতে উঠে বনানীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

রাতে ডিনার কমপ্লিট করে ঘুমাতে এসেছে নীল ও পরি।
পরি বেশ ক্লান্ত। সারাদিনের ঘোরাফেরার কারণে চোখ দুটো অষাঢ় হয়ে গেছে। পরি বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে ও ঘুম কে আটকে রাখতে পারল না। মুহূর্তের মাঝেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। নীল ল্যাপটপ হাতে কাজ করে যাচ্ছে। বিডিতে বেশ কয়েকটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে ওর কোম্পানি তার ওপর বিডিতে মেইন বিজনেস সেট করবে। সব কিছু মিলিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে নীল কে। নীল কাজের ফাঁকে ফাঁকে পরি কে দেখে নিচ্ছে। ক্লান্ত ভরা শরীরটা পরির মায়াবী মুখটার কাছে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নীল মুচকি হেসে পরির কাছে এসে বসল। ঘুমন্ত পরির মুখটা আরো ও বেশি মায়াবী লাগছে। নীল টুপ করে পরির ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল।
কি ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগছে পরিকে, রোজ মনে হচ্ছে একটু একটু করে সৌন্দর্য আরো ও বেড়ে যাচ্ছে। লোকে বলে মানুষের অনুভূতি নাকি দিন কে দিন বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু নীলের অনুভূতি তো দিন কে দিন গাঢ় হচ্ছে। ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে চলছে।

নীল দু হাত দিয়ে পরির গাল দুটো আকড়ে ধরে বলল,”মায়াবিনী এতো মায়া কেন তোমার মাঝে? এই দহনে ঝলসে যাচ্ছি আমি। এই অনুভূতি আমায় শেষ করে দিচ্ছে।
কি করলে মিলিবে শান্তি? অশান্ত বুকে তোমার মাথা গুঁজে শান্ত কর আমায়। আমি যে শেষ হয়ে যাচ্ছি।”

এই সব বুলি আওরাতে আওরাতে নীল পরি উপর ই কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল তা নীলের অজানা। শীত কালের শীতের মাঝে দুজন দুজনার উষ্ণতা পেয়ে একে অপর কে আঁকড়ে ধরে নিল। দুজনেই ঘুমের মাঝে একে অপরকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে থাকল।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here