#নীলের_পরি (৩৯)
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। বেশ রমরমা পরিবেশ বিরাজ করছে। হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। পরির চোখ জোড়া কেমন ঘুম ঘুম পায়। বার বার ঝিমুনি আসে। কয়েকবার ঝিমুতে ঝিমুতে পড়ে যাচ্ছিল, নীল হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে। আর প্রতিউত্তরে পরি দিয়েছে মিষ্টি হাসি। সিটে হেলান দিয়েই বড়ো একটা হাই তুলল পরি। নীল পরির দিকে এক পলক তাকিয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিয়ে বলল,”ঘুম পেলে একটু ঘুমিয়ে নাও। না ঘুমুলো শরীর ক্লান্ত লাগবে।
আমি পৌছে গিয়ে ডেকে দিব।”
পরির বেশ ঘুম পাওয়াতে পরি আর তেমন কিছু বলল না।
শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। তারপর সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শিরশিরে বাতাস অনুভব করতে লাগল। আর মুহূর্তের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ল। ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গাড়ি চালাতে থাকল।
মিসেস রাহেলা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে নিশা কে ডেকে চলেছেন কিন্তু নিশার আসার নাম ই নেই। মিসেস রাহেলার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুনতে পেয়ে আমান কিচেনে এগিয়ে আসল।
মিসেস রাহেলা খুন্তি হাতে মাছ ভাজতে ভাজতে বললেন
“আমান, নিশা কোথায়?”
আমান অবাক হয়ে বলল,”আমি কি করে জানব? দেখো ছাদে গিয়ে বসে আছে বোধহয়।”
মিসেস রাহেলা বিরক্ত হয়ে বললেন,”কি ঝামেলা। এক এ তো কাজের মেয়েটা দু দিন ধরে আসছে না। তার উপর এত কাজ আমি একা হাতে সামলাই কি করে? এত রকমের রান্না করতে হবে। আর সাহায্য করার জন্য কেউ ই নেই!”
আমান মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল,”আচ্ছা আমায় বলো আমি সাহায্য করছি।”
মিসেস রাহেলা গ্যাস অফ করে কড়াই নামিয়ে বললেন,”তুই কি মেয়েলি কাজ পারবি নাকি? পরে হাত পু ড়ি য়ে আরেক ঝামেলা বাড়াবি।”
আমান ভ্রু কুঁচকে বলল,”আমি সব ই পারি। শুধু তোমরা ই বোঝো না।”
মিসেস রাহেলা বিরক্তিকর স্বরে বললেন,”তার জন্যে ই তো গত বছর যখন বলেছিলাম মাং সটা একটু দেখ, আমি দু মিনিটে আসছি। তখন তো মাং সের সাথে সাথে নিজের হাত ও পু ড়ি য়ে বসেছিলি।”
আমান মেকি হাসি দিয়ে বলল,”ঐ টা এক্সি ডেন্ট আম্মু।”
মিসেস রাহেলা টিকিয়া বানাতে বানাচ্ছেন। একটা প্লেট নামিয়ে রাখলেন তিনি।
“হ্যাঁ হয়েছে হয়েছে। এত ঢং দেখাতে হবে না। পারলে সালাত টা কেটে দে।”
আমান মাথা ঝাঁকিয়ে সালাত কাটতে চলে গেল। এক গাদা ফুল হাতে বাড়ি ফিরেছে নিশা আর আফজাল হোসেন।
বাসার কলিং বেল বাজতেই আমান এসে দরজা খুলে দিল।
আমান হা হয়ে তাকিয়ে আছে। আমান কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিশা বলল,”গাঁধা যদি পারিস তো ফুল গুলো ভেতরে নিয়ে যা। গোরুর মতো হা হয়ে আছিস কেন?”
আমান চোখ রাঙিয়ে বলল,”একদম আমাকে গাঁধা বলবি না। আমি তোর বড়ো। বড়ো ভাই বলে ডাকবি।”
নিশা ভেংচি কেটে বলল,”বয়েই গেছে আমার ভাই ডাকতে। পাঁচ মিনিটের বড়ো, তাকে আবার সম্মান দেখিয়ে ভাই বল ডাকতে হবে!”
আমান কিছু বলবে তার আগেই আফজাল হোসেন বললেন
“তোরা থামবি একটু? ফুল সহ জিনিস পত্র গুলো ভেতরে নিতে সাহায্য কর।”
আমান আর কিছু বলল না। সবাই মিলে এক সাথে সমস্ত জিনিস পত্র ভেতরে নিয়ে গেল।
বনানীর বিশাল এক এপার্টমেন্ট এর সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছি নীল। ১৪ তলার বিশাল বাড়ি টা পরিদের। দশ তলার ফার্স্ট ফ্ল্যাট আর সেকেন্ড ফ্ল্যাট নিয়ে পরিদের নিজেদের জন্য তৈরি করা বাসা। নীল গাড়ি থেকে বের হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিল। আজ হয়ত অন্য কিছু ও হতে পারত।
কিন্তু মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে সব ভালো হয়েছে। তিনি চেয়েছেন বিধায় ই পরি আর নীলের সম্পর্ক টা গাঢ় হয়েছে। নীল মুচকি হেসে ঘুমন্ত পরির মুখ টা দেখে নিল।
আজ পরি কে পুরো চমকে দিবে নীল। পরি কে পরিপূর্ণতা দিবে। পরির পরিবার ছাড়া পরি সুখি নয় যে। নীল ঘুমন্ত পরির কপালে উষ্ণ ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। মেয়েটাকে কলিজায় বেঁধে রাখতে পারলে বোধহয় নীলের শান্তি হত। কেন যে এত মায়া!
নীল পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘুমন্ত পরির চোখ বেঁধে দিল। তারপর মিষ্টি কণ্ঠে পরি কে ডাকতে লাগল। পরির ঘুম নীলের ডাকে হালকা হলো। চোখ মেলে তাকাতেই সব কিছু অন্ধকার দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে গেল পরি। নীল ভরসা দিয়ে বলল,”ভয় পেও না। আমি আছি তোমার পাশে। একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য চোখ বেঁধে দিয়েছি।”
নীলের কথাতে পরি স্বস্তি পেল। দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ছোট করে বলল,”আচ্ছা।
নীল মুচকি হেসে পরির হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিল।
পরি ধীর কণ্ঠে বলল,”কোথায় আছি আমরা?”
নীল পরির হাত ধরে আগাতে আগাতে বলল,” বলা যাবে না। এটা সারপ্রাইজ।”
পরি ও আর প্রশ্ন করল না। পরি জানে নীল যেহেতু বলেছে এটা সারপ্রাইজ,তো এটা নীল কোনো ভাবেই বলবে না।
নীল পরি কে নিয়ে লিফ্টে উঠে দশ তলা সেট করে দিল। মুহূর্তের মাঝে দশ তলায় এসে লিফ্ট থামল। পরির হাত ধরে পরিকে অতি সাবধানে নীল লিফ্ট থেকে বের করে নিল।
পরিদের ফ্ল্যাটের কাছে আসতেই সাদা পিস ফুলের মিষ্টি গন্ধ পরির নাকে এসে লাগল। পরির শরীর কেঁপে উঠল। পরির নিজের বাসার কথা মনে পড়ে গেল। পরি নিজেদের ফ্ল্যাট এর দরজার কাছে অনেক রকমের ফুলের গাছ লাগিয়ে রেখেছে। সেখানে ও সাদা রঙের পিস ফুল হয়। পরির মনে ভর করল বি ষা ক্ত কালো ধোঁয়া । নীল বুঝতে পেরে বলল
“সবসময় মন খারাপ করতে হয় না পরি। ভালো কিছুর জন্যে অপেক্ষা করতে হয়।”
পরি কিছু না বলে মাথা ঝাঁকাল। নীল মৃদু হেসে কলিং বেল বাজায়। কিছুক্ষণের মাঝেই দরজা খুলে গেল। আর নীল পরির চোখের বাঁধন ও খুলে দিল। পরির চোখ খানিকটা ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। একে তো বেশ অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলহ তার উপর ঘুম ভাঙার পূর্বেই নীল চোখ বেঁধে দিয়েছে। পরিবারের সবাই কে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পরির বিশ্বাস হলো না। পরি চোখ কচলে আবার তাকাল। কিন্তু না,সত্যি ই সবাই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ দশ টি দিন সবাই কে ছেড়ে ছিল পরি। পরি টলমল চোখ নিয়ে নীলের দিকে তাকাতেই নীল চোখের ইশারায় ভরসা দিল। সব ঠিক দেখছে পরি। সেটা বুঝতে পেরে নীলের দিকে নীরব কৃতজ্ঞতা জানাল।মিসেস রাহেলা অবিরত কেঁদে যাচ্ছেন। আফজাল হোসেনের চোখের কোণে পানি চিক চিক করছে। কোনো এক অদৃশ্য দেয়াল পানি কে আটকে রেখেছে। নিশা আর আমানের চোখে মুখে স্নিগ্ধ হাসি। বোন কে দেখতে পেয়ে যেন সমস্ত সুখ ওদের চোখে মুখে উপচে পড়েছে। মা মেয়ের ভালোবাসা এক অন্য রকম ভালোবাসা হয়। কারো সাথে তুলনা করা যায় না এটা।
মিসেস রাহেলা হাত বাড়াতেই পরি মা কে আঁকড়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগলহ পরিবারের স্নিগ্ধ এই সুন্দর মূহুর্তের সাক্ষী হয়ে থাকল নীল। নীলের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা মনে অদ্ভুত এক তৃপ্তি। চোখে মুখে অসম্ভব খুশিরা ঝলমল করছে। সে পেরেছে তার ভালোবাসা কে পরিপূর্ণতা দিতে।
নীল পৃথিবীর সব থেকে সুখী প্রেমিক পুরুষের তালিকায় নিজের নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছে নীল আর মুগ্ধ হয়ে দেখছে এক ভেঙে যাওয়া পরিবারের পুন মিল।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি