#নীলের_পরি (৫০)
কাজিনদের ডাকে ঘোর ভাঙে পরির। পরি একটু থতমত খেয়ে যায়। চোখের পানি মুছে মুখের কোনে ফুটিয়ে তুলে মুগ্ধ করা হাসি। কাজিনদের কাছে গিয়ে বসতেই সবাই ফাজলামি শুরু করে দেয়। হাজারো ফাজলামির মাঝে রিফা ফোরন কেঁটে বলে,”এই পরি বল তো নীল কে কি করে পটালি? ঐ রকম হ্যান্ডসাম, চকলেট বয় তোর প্রেমে এত টা মাতোয়ারা হয়ে গেল কি করে?”
পরি ভেংচি কেটে বলল,”দেখো আপু তোমার মতো আমি ছেলে পটাই না। আর নীল কে আমি ভালোবাসি,কখনো বলি ও নি কিন্তু নীল বুঝে নিয়েছে। এটাই ভালোবাসা।”
রুম্পা বিরক্তি নিয়ে বলল,”আরে ছাড় তো ওর কথা। সব সময় পকপক করে। এখন বল নীলের সাথে কেমন কাটল দাম্পত্য জীবন?”
রুম্পার কথাতে পরি লজ্জা পেয়ে যায়। গাল দুটো কমলা রঙ ধারন করে নিয়েছে। পরি কে অপ্রস্তুত হতে দেখে ফারিন বলল,”আহা পরি বেবি এত লজ্জা পেতে হবে না।
আমরা তোমার সিনিয়র বোন, তো আমরা ও একটু আকটু বুঝি শুনি।”
পরি কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঝুমা চেঁচিয়ে বলল
,”এই এই ভাইয়া খুব আদর করেছে তাই না? উফ কি সিন হাতের মাঝে হাত চোখের নজর উতাল পাথাল। ঠোঁটে….”
ঝুমা কে থামিয়ে পরি বলল,”তুই চুপ করবি। ফাজিল মাইয়া কি সব উল্টা পাল্টা কথা বার্তা।”
ঝুমা চোখ নাচিয়ে বলল,”কেন বেপ্পি আমাদের বললে কি হয়?”
পরি বেশ অস্বস্তিতে পরে গেল। এদের মুখে লেইম কথা বার্তা থাকবেই। পরি হাত কাঁচুমাচু করে বলল,”আমাদের মাঝে ঐ রকম কিছুই হয় নি।”
রিফার চোখ গুলো রসগোল্লা হয়ে গেছে। পরি কে এক হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,”এত দিনে কি করলি তোরা? আমরা তো ভাবলাম বাসর কমপ্লিট করে এখন বাচ্চা পুলের খবর দিবি। আর তুই,দিল টুট গায়া রে বেহনা।”
পরি বেচারির মুখ টা হয়েছে দেখার মতো। পরি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,”আমরা এক ঘরে থাকি নি। মাঝে দুই তিন দিন এক ঘরে থাকা হলে ও একদিন ছিল আমাদের সেকেন্ড বাসর রাত, আর অন্যদিন গুলো ছিল আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। ঐ রকম কিছু ই না।”
পরির কথা শুনে সবাই হতাশ হলো। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করল হায়রে!
পরি ভ্রু কুঁচকাতেই রুম্পা বলল,”দেখ বেহনা সারাজীবন শুনে এসেছি ছেলেরা বাসর রাতে বিড়াল মা রে। আমরা হলাম সব স্পেশাল কাজিন ওরা যদি বিড়াল মা রতে পারে আমরা কেন কু ত্তা মা রতে পারব না। তোকে কিন্তু আমাদের মান সম্মান রাখতেই হবে। প্রথম রাতে থুরি তোর আর নীলের তো এটা তৃতীয় বাসর রাত হবে,তো যাই হোক তোকে কুকুর মা রতেই হবে।”
এদের সবাই লেইম কথা বার্তা চলতেই থাকল। বেচারা পরি লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে আর কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে।
সকাল সকাল ই নীল কল দিয়েছে। পরি ঘুমের ঘোরেই ফোন তুলে বলল,”হ্যালো।”
“বউ। তোমার মিষ্টি কণ্ঠে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
“কেন কি হয়েছে কি?”
“বউ দেখতে ইচ্ছে করে খুব । একটু বুকের সাথে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হয়। মাঝে মাঝে একটু চুমু খেতে ও ইচ্ছে হয়।”
নীলের কথা শুনে পরি ধরমরিয়ে উঠে। একটু জোরেই বলে
“কি!”
নীল মুচকি হেসে বলল,”দেখা করো প্লিজ।”
পরি ধীর স্থির কণ্ঠে বলল,”সম্ভব না।”
নীল মুখ গোমড়া করে বলল,”আমি আসতে চাই তুমি তো তা ও আসতে দিচ্ছ না।”
পরি আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”আর তো তিন চারটে দিন।”
নীল অধৈর্য কণ্ঠে বলল,”আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি তোমার সাথে দেখা করবই। তুমি না চাইলে আমি চলে আসব।”
“এই না না। আমি ই দেখা করব।”
“প্রমিস?”
পরি মিষ্টি হেসে বলল,”পাক্কা প্রমিস।”
নীল আর পরি এক সাথেই হেসে উঠল। তারপর আরো বেশ কিছুক্ষণ দুজন প্রেম কথনের জোয়ারে ভাসতে লাগল।
পা টিপে টিপে বের হচ্ছে পরি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিল কেউ আছে কি না। কাউকে না দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তাড়াতাড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। পরি ডয়িং রুমে আসতে না আসতে মিসেস রাহেলা এসে হাজির। পরি শুকনো ঢোক গিলে নিল। মিসেস রাহেলা মেয়েকে আগা গোড়া পরখ করে দেখে নিলেন। পরি বারং বার মেকি হাসি দিয়ে যাচ্ছে। মিসেস রাহেলা চোখ ছোট ছোট করে বললেন,”কোথায় যাচ্ছিস?’
পরি উত্তর দেওয়ার সময় খানিকটা তুতলিয়ে যাচ্ছিল।
নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল,’আম্মু হিয়া সহ কিছু ফ্রেন্ড কে কার্ড দিতে যাচ্ছি।’
মিসেস রাহেলা নিশ্বাস ফেলে বললেন,”ওহ আচ্ছা। যা রাত করিস না বেশি। সন্ধ্যার মধ্যে ই ফিরে আসবি।”
পরি কোনো মতে সম্মতি জানিয়ে চোরের মতো পালিয়ে আসল। মিসেস রাহেলা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নিজ কাজে চলে আসলেন। সড়কে আসতেই নীল কে কল দিল পরি। নীল ফোন ধরতেই পরি জানাল হিয়ার বাসার সামনে অথবা স্কুলের গেইটের কাছে দাঁড়াতে। নীল জানাল সে স্কুলের গেইটের কাছে ই থাকবে। পরি ফোন রেখে ব্যস্ত পায়ে মেইন সড়কে চলে আসল। মেইন সড়ক থেকে অটো ধরে হিয়াদের বাসায় এল। হিয়া কে কার্ড দিয়ে আর ও কিছু কার্ড দিল সমস্ত ফ্রেন্ড দের দিয়ে দেওয়ার জন্য। নীল কল করছে, পরি ব্যস্ত পায়ে হিয়ার বাড়ি ছাড়ল। হিয়া মিষ্টি হেসে পরি কে বেস্ট অফ লাক জানাল। পরি হিয়া কে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানিয়ে দ্রুত স্কুলের কাছে এল। একশ মিটার দূর থেকেই নীল কে দেখতে পেল পরি। গেটের কাছে পায়চারি করছে নীল। পরি যত এগোচ্ছে পরির বুক ধুকপুক তত বেড়ে চলেছে। অফ হোয়াইট কালারের শার্ট সাথে ব্ল্যাক জিন্স পায়ে সু। বুকে সানগ্লাস রাখা। কি অপরূপ লাগছে নীল কে। পরির ইচ্ছে করছে এভাবেই নীলের দিকে তাকিয়ে এক জনম পার করে দিতে। পরি কে দেখতে পেয়েই নীল মুচকি হাসল। পরি কে রাস্তা পার না হতে বলে নীল ই রাস্তার এপার চলে আসল। রি বার বার মুচকি হেসে চলেছে। তার যে খুব ই লজ্জা লাগছে।
নীল আলত হাতে পরি কে জড়িয়ে বলল,”কেমন আছ পরি?”
পরি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,”হুম ঠিকঠাক আপনি?”
নীল মৃদু হেসে বলল,”ভালো ছিলাম না আমি। তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য মন ছটফট করছিল। খুব ইচ্ছে করছিল তোমাকে জড়িয়ে ধরার। আমি বেহায়া হয়ে যাচ্ছি পরি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না আমি।”
নীলের কথা গুলো শুনে পরির বুকের ভেতর উথাল পাথাল করতে লাগল। আজকাল তার মন ও খুব করে চাইছে নীল কে কাছে পাওয়ার। আগে তো এমন হয় নি। দীর্ঘদিন নীল কে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে গেছে পরি। কখনো শারীরিক আকর্ষণ বোধ করে নি। শুধু ভালোবাসাটা অনুভব করেছে।
কিন্তু আজ যে মন অন্যকিছু চাইবে। আগে তো কখনো এমন অনুভূতি হয় নি। তবে কি বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধন দুজনের মন কে অশান্ত করে দিচ্ছে? দুজন এর মন ই চাইছে বৈধতা কে স্বাদরে গ্রহন করতে? এই উত্তর ওদের জানা নেই।
নীল মুচকি হেসে পরি কে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। মিষ্টি গোলাপি রঙের টপস পড়ে আছে মেয়েটি। চুল গুলো উঁচু করে বেঁধে রাখা চোখে হোয়াইট কাজল ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক। কি ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগছে পরি কে! পরির সৌন্দর্য বারং বার ই নীল কে মুগ্ধ করে। আজ কাল পরির সৌন্দর্য অতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নীল খানিকটা মাথা ঝুঁকে বলল,”লোকে বলে স্বামীর আদর সোহাগ পেলে নাকি স্ত্রীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। তোমার সৌন্দর্য তো বিয়ে করেই বেড়ে গেছে। আমার সোহাগে তুমি তো সৌন্দর্যের অনলে ঝলসে যাবে পরি। প্রেমের অতলে লজ্জায় রাঙা হয়ে যাবে।
এত অনুভূতি কি করে সইবে তুমি?”
পরির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে মা রা যাবে। নীলের কথা মাদকতার মতো কাজ করে। পরি কিছু বলার আগেই পাশের দিকে তাকিয়ে পরির চোখ গুলো স্তব্ধ হয়ে যায়। পরির কথা বলতে ও যেন বেগ পেতে হচ্ছে পরি কোনো মতে উচ্চারণ করল দাদাভাই।
পরির কথা শুনে নীল পাশে তাকায়। পাশে তাকিয়ে পরির কাজিন ইফাদ কে দেখে অবাক হয়ে যায়। ইফাদ পাশ ঘুরলেই পরি আর নীলের সাথে চোখা চোখি হয়ে যাবে।
পরি বার বার ঢোক গিলছে। নীল পরির দিকে একবার তাকিয়ে পরির হাত ধরে ছুটে চলে আসে বাইক এর কাছে।
পরির মাথায় দ্রুত হেলমেট পরিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে দুই কিলোমিটার পারি দিয়ে খোলা রাস্তা তে বাইক ব্রেক লাগায়।
বাইক থেকে নেমে পরি আর নীল দম ফাটিয়ে হাসতে থাকে।
হাসতে হাসতে এক সময় দুজনে রাস্তার সাইডে ঘাসের উপর বসে পড়ে। পরি আর নীলের মুগ্ধ করা সেই হাসি উপভোগ করে স্বয়ং প্রকৃতি। থেকে থেকে বাতাস বইতে থাকে। পাখি রা কলরব শুরু করে। জনমানবশূন্য রাস্তায় শুধু প্রকৃতির খেলা। মুগ্ধ সেই দৃশ্যে দুই তরুন তরুনী একে অপরের হাতে হাত রেখে বসে আছে। নীল হাসি থামিয়ে বলে,”ইউ নো পরি আমি আমার কিশোর জীবনের প্রেম কে অনুভব করছি।
যখন সারাক্ষণ মনে ভয় থাকতে ইস এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল।”
নীলের কথা তে পরি মুচকি হাসল। নীলের কাঁধে মাথা রেখে বলল,”আপনি অনেক সুন্দর করে হাসেন।”
নীল সামান্য ভ্রু কুঁচকে বলল,”আচ্ছা? বরের হাসি এত ভালোলাগে?”
পরি মাথা কাত করায় যার অর্থ হ্যাঁ। নীল মুচকি হেসে পরি কে এক হাতে জড়িয়ে বলল,”আমরা আমাদের কৈশোর জীবনের প্রেম কে অনুভব করছি পরি। আমাদের বৈবাহিক জীবন এর থেকে ও হাজার গুণ স্নিগ্ধ হবে। ভালোবাসার জোয়ার থাকবে। বিশ্বাস থাকবে, দুষ্টু মিষ্টি প্রেম হবে। চোখে চোখে কথা হবে। ঘুমের সাথে হবে আড়ি,সারা রাত পার হবে,
প্রেম সাগরের বুকে দিব পারি। শেষ রাতে ঘুম ভাঙবে পাখির কূজন এ। জড়িয়ে নিব তোমায় প্রেমের আলিঙ্গনে। আমরা আমাদের প্রতি টা মুহূর্ত কে রঙিন করব। প্রতি টা পদক্ষেপে মনে হবে স্নিগ্ধতা বাড়ছে। আমাদের ভালোবাসা কখনোই কমবে না পরি। কখনোই না।
পরি নীলের বাহু জড়িয়ে বলল,”আপনি তো কবি কে হার মানাবেন নীল। মুগ্ধ আমি। আপনার আলিঙ্গনে স্নিগ্ধ হতে চাই। সর্বাঙ্গে শুধু থাকবে আপনার ভালোবাসা। আমি তো হারাতে চাই নীল। গভীর ভাবে হারাতে চাই আপনার মাঝে।”
নীল মুচকি হাসে। দুজনের মাঝেই প্রেমের জোয়ার ভাটা চলছে। নীল থেকে থেকে দুষ্টুমি করছে। এই যখন তখন গালে চুমু খেয়ে নিচ্ছে। আর পরি র ক্ত চক্ষু দেখাচ্ছে।
দুজনো ই নীরবতা থেকে হঠাৎ খিল খিল করে হেসে উঠছে।
মনে হচ্ছে বসন্ত এসে ওদের কাছে ধরা দিয়েছে। বিকেল টা ঘুরেই কাটিয়ে দিল নীল আর পরি। দুজনের ই বেশ আনন্দে কেটেছে। এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে। মনে হচ্ছে পৃথিবী টা রঙিন আলোয় ঝলমল করছে। নীল আর পরি হাত ধরে হেঁটে চলেছে। সন্ধ্যা যখন ছুঁই ছুঁই তখন পরি আর নীল একটা ক্যাফে তে চলে আসে। কোল্ড কফি সাথে চিকেন চাপ আর রুমালি রুটি দিয়ে নাস্তা সেড়ে নেয়।
দুজনে ফ্রেম বন্দী করে নেয় হাজারো স্মৃতি। পরি কে সাবধানে বাসায় পৌছে দেয় নীল। পরির বাসার অপজিটে বাইক এসে থামে। নীল আর পরির মধ্যে পিনপতন নীরবতা চলে। দুজন ই একে অপর কে ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক নয়। তবে কিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেই হয়। দুজন ই স্নিগ্ধ হাসি হেসে উঠে। নীল পরির কানে কানে ফিসফিস করে বলল,”এটাই আমাদের লুকিয়ে প্রেমের শেষ দিন। সময় টা অদ্ভুত হলে ও সুন্দর ছিল। বউ এর সাথে লুকিয়ে প্রেম করতে পারে কয় শালায়? ভাগ্য লাগে ভাগ্য। আর লাগে মিষ্টি একটা বাচ্চা মেয়ে। যে এভাবে ভালোবাসা দিবে।”
নীলের কথাতে পরি খিলখিল করে হাসে। ছেলেটা বড্ড ফাজিল। নীলের গালে ধর্ম মতে বিয়ে সম্পূর্ণ হওয়ার আগে লুকিয়ে প্রেমের শেষ চুমুটা দিয়েই পরি বাসার দিকে ছুট লাগায়। আর নীল হাসতে হাসতে মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকে তার ছোট্ট মিষ্টি ফুটন্ত গোলাপের মতো বউ কে।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
যারা এখনো “ফুলটুশি” পড়েন নি। চট করে পড়ে আসুন।
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/335683288992572/?app=fbl