কালো শার্ট পরা উঁচা-লম্বা, সুন্দর যেই ছেলেটা এখন আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে তার নাম নির্ণয়। আমার খালাতো ভাই। নাম নির্ণয় হলেও অনুভূতি নির্ণয়কারক হিসেবে তাকে আমি দেবো শূণ্য। পড়ালেখায় তুখোড় ছাত্র ছিল। অবশ্য সেই পাট চুকিয়ে এখন সে তিন বছর ধরে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছে। সে অনেকটা আমাবস্যা চাঁদের মতো। এ কথা বলছি কারণ তার দেখা পাওয়ার জন্য অনেক অপেক্ষা, প্রতিক্ষা করতে হয়। তবুও দেখা পাওয়া মেলা ভার। কোনো দরকার ছাড়া সে গ্রামে আসে না। শুধু দরকার বা যেকোনো দরকার হলেও সে আসবে না। সে আসবে খুব বেশিই দরকার এমন কোনো কাজে। যেমন এবার এসেছে ছোটো মামার বিয়ে বলে। মাঝে মাঝে আমার ভীষণ জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, “তোমাদের কোলাহলপূর্ণ শহর কি আমাদের শান্ত-শীতল, নিরব, ছায়াঘেরা পরিবেশের গ্রামের চেয়েও বেশি সুন্দর?”
কিন্তু আমার শেষ পর্যন্ত আর জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না। কারণ সে কোনো কাজিনের সাথেই খুব একটা মেশে না। উঁহুঁ একটু ভুল বললাম, কথাটা হবে সে কোনো মেয়ে কাজিনদের সাথেই মিশে না। যতটুকু কথা না বললেই নয়, ঠিক ততটুকুই বলে। মাঝেমধ্যে তাকে মনে হয় নাকউঁচু স্বভাবের অহংকারী, গম্ভীর পুরুষ। কিন্তু যখন আবার চোখের সামনে ছেলে কাজিনদের সঙ্গে মিশতে দেখি তখন আমার ধারণা কর্পূরের ন্যায় উবে যায়। এই যেমন, এখন সে আমার ছোটো ভাই রাকিবের সাথে গাছে উঠে আম পাড়ছে। মাঝেমাঝেই আবার কীসব বলাবলি করে হাসাহাসি করছে দুজন।
আমার পরিচয়ই তো দেওয়া হয়নি। আমি নিবেদিতা। পুরো নাম নিবেদিতা আহমেদ। দুই ভাইয়ের একমাত্র আদরের বোন। সেই সাথে বাবা-মায়েরও ভীষণ আদরের কন্যা আমি। বর্তমানে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে হাওয়া খাওয়ার কথা থাকলেও হাওয়া খেতে পারছি না। ভার্সিটিতে এডমিশনের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছি। এজন্য প্রচুর পড়াশোনাও করতে হচ্ছে আমাকে। নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকুও নেই। আমি আহামরি কোনো ভালো ছাত্রী না হলেও এভারেজে আছি। তা সত্ত্বেও পাবলিকে চান্স পাওয়ার স্বপ্ন কার-ই বা না থাকে? আমিও ব্যতিক্রম নই। নানার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব ভ্যানে করে গেলে ত্রিশ মিনিটের পথ। বইয়ে মুখ ডুবিয়ে থাকার দরুণ আমি যখন একই সাথে চরম ক্লান্ত ও বিরক্ত সেই সময়েই উত্তুরে হিমেল হাওয়ার মতো একটা সতেজ খবর পেলাম, ছোটো মামার বিয়ে ঠিক হয়েছে এবং আমরা যেন এক সপ্তাহ্ আগেই নানার বাসায় চলে আসি। বাবা আর বড়ো ভাইয়া কাজের জন্য আসতে না পারলেও আমি, মা আর রাকিব দশদিন আগেই চলে এসেছি। সময় পেলে পড়ব বলে বইগুলোকেও তল্পিতল্পায় বেঁধে নিয়ে এসেছি। আমরা আসার পরপর আমার বাকি কাজিনরাও চলে এসেছে। ওরা আসার আগে টুকটাক পড়া হলেও, এরপর আর বই খোলা হয়নি। সময়ই পাইনি! কিন্তু আজ অনেকদিন বাদে বইগুলোর মাঝখান থেকে ডায়েরিটা বের করলাম সুদর্শন পুরুষটাকে নিয়ে কিছু লিখব বলে। তার সামনে গিয়ে কথা বলার সাহস নেই। তাই ডায়েরিই আমার শেষ ভরসা। তারা এসেছে গতকাল রাতের ট্রেনে। পৌঁছিয়েছে ভোরে। সবার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে কথা হয়েছে। কেবলমাত্র আমিই সামনে যাইনি।
“নিবু, নিবু! কই তুই?”
তুবার কণ্ঠ পেয়েই তড়িঘড়ি করে ডায়েরিটা ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল নিবেদিতা। তুবা তার বড়ো খালার মেয়ে। নিবেদিতার সমবয়সীই। তবে ভীষণ দূরন্ত ও চঞ্চল স্বভাবের। ঝড়ের গতির আগে চলে। এই যেমন এখনো ঝড়ের মতোই প্রবেশ করেছে রুমে। ততক্ষণে অবশ্য নিবেদিতাও ডায়েরিটা লুকিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তুবা এসে ওকে এরকম চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,
“একা একা বসে কী করছিস?”
নিবেদিতা হাসার চেষ্টা করে বলল,
“কিছুই না। জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। তাই বসে আছি।”
“মাঝেমাঝে তোর হাভভাব দেখলে মনে হয় ভূতে ধরেছে! এখন বাইরে চল।”
“বাইরে কেন?”
“নির্ণয় ভাইয়া আর রাকিব মিলে অনেকগুলো আম পেড়েছে। বাড়ির বড়োরা ব্যস্ত। কেউ এখন আম মাখার কাজ করতে পারবে না।”
“তো এখন আমরা কী করব?”
“আমরা কী করব মানে? আমরা কাজিনরা মিলেই আম ভর্তা বানাব।”
“আমি পারব না ভাই! হাত জ্বলবে আমার।”
“তোকে মরিচ ডলতে হবে না। আমাদের সাথে আম ছিলবি। জলদি চল এখন।”
নিবেদিতাকে আর কিছু বলা কিংবা কওয়ার সুযোগ না দিয়েই বগলদাবা করে নিয়ে গেল তুবা।
বাড়ির উঠোনে ততক্ষণে অন্যরা আমি ছোলার কাজে লেগে পড়েছে। অন্য পাশে চেয়ার নিয়ে বসে আছে নির্ণয়, রাকিব, বড়ো মামার ছেলে হৃদয়, চাচাতো ভাই শিহাবসহ ওদের আরো কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব।
নিবেদিতাকে একটা বটি ধরিয়ে দিল তুবা। বলল,
“নে বোস। তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়। আম ভর্তা খেয়ে সবাই মিলে আজ নদীতে গোসল করতে যাব।”
বাকি মেয়েরা খুশিতে হইহই করে উঠল। কেবল নিবেদিতাই মুখটা মলিন করে বলল,
“মা জা’নে মে’রে ফেলবে।”
তুবা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল,
“আরে ধুর! বাড়ির কারোর এখন আমাদের দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই। তাছাড়া ভাইয়ারা তো সাথে থাকবেই। সমস্যা নেই।”
তুবা তো ‘সমস্যা নেই’ বলেই খালাশ। কিন্তু নদীতে যাওয়ার ঝামেলা গঠনের পূর্বেই একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলল নিবেদিতা। অসাবধানতায় ডান হাতের আঙুল কে’টে ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল। চিৎকার শুনে সবার দৃষ্টি ওর দিকেই নিবদ্ধ হলো। সবার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো নির্ণয় নিজেও। জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে?”
তুবা ততক্ষণে নিবেদিতার আঙুল চেপে ধরেছে, যাতে র’ক্তক্ষরণ বেশি না হয়। সে বলল,
“হাত কে’টে ফেলেছে ভাইয়া।”
নির্ণয় ভাবলেশহীনভাবে বলল,
“যে কাজ পারে না তাকে কাজ করতে দাও কেন?”
মুহূর্তেই মুখটা মলিন হয়ে গেল নিবেদিতার। অপমানে মুখ থমথমে হয়ে আছে। কে বলেছে নিবেদিতা কাজ পারে না? এইটুকু বয়সেই নিবেদিতা সব ধরনের রান্না জানে এবং তার রান্নার হাতও বেশ ভালো। বাবা-মায়ের আদরের কন্যা হলেও কোনো কাজ শেখাতে বাকি রাখেননি মা নাসিমা বেগম। এমনকি কাঁথা সেলাইও আয়ত্ত্বে আছে নিবেদিতার। এই পাষণ্ড মনের গম্ভীর পুরুষ কিনা বলছে নিবেদিতা কাজ পারে না?
হৃদয় এর মাঝেই ঘর থেকে ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে এসেছে। হাত পরিষ্কার করে আঙুল ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলল,
“তোর আর কাজ করতে হবে না। পাশে বসে থাক চুপচাপ।”
নিবেদিতা কোনো কথা বলল না। আম ভর্তা মাখানো হলে তা সে মুখেও তুলল না অভিমানে। রাকিবকে দিয়ে দিয়েছে সব। খাওয়া শেষে সবাই যখন নদীতে গোসল করতে যাবে বলে ঠিক করল তখন নিবেদিতা বেঁকে বসল। সে না গেলে অন্যরাও মজা পাবে না। তাই সব মেয়ে কাজিনরা মিলে তাকে তোষামোদ করে অবশেষে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছে। মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সবার সঙ্গে নদীতে গোসল করতে গেল নিবেদিতা।
নদীতে নামার পূর্বে নির্ণয় সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“যারা সাঁতার পারো না তারা নদীর গভীরে নেমো না। কিনারেই থেকো। পরে না আবার কোনো দুর্ঘটনা ঘটে কোনো।”
নিবেদিতার কেন জানি মনে হলো নির্ণয় কথাটা তাকেই উদ্দেশ্য করে বলেছে। সে ভেবেছেটা কী? একটু হাত কে’টেছে বলে কি নিবেদিতা অকর্মা? সে গ্রামের মেয়ে। সাঁতার তার র’ন্ধ্রে র’ন্ধ্রে। আর এটাই সে এখন নির্ণয়কে প্রমাণ করে দেবে। ওড়না ভালো করে বেঁধে সে নদীতে নেমে গেল। প্রচুর স্রোত এখন পানিতে। তবুও মনে প্রবল জেদ। সাঁতার কেটে তাকে ঐপাশে যেতেই হবে। নির্ণয়ও মনের সুখে সাঁতার কাটছিল বাকিদের সঙ্গে। কিন্তু শহুরে ছেলে বিধায় নদীর স্রোতের সঙ্গে তার বনিবনা ঠিক হচ্ছিল না। স্রোতের সাথে সে কোনো রকমভাবেই পেরে উঠছিল না। বিষয়টা প্রথমে কেউই বুঝতে পারেনি, যখন বুঝেছে তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছিল সে। সবাই তার থেকে বেশ দূরে অবস্থানরত। নিবেদিতাও ঐপাড়ের প্রায় কাছাকাছি তখন। সবার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে যখন পাশ ফিরে তাকাল তখন তার অন্তরআত্মা কেঁপে ওঠার উপক্রম। যত দ্রুত সম্ভব সাঁতার কেটে সে নির্ণয়ের কাছে পৌঁছে এক হাত টেনে ধরল। নির্ণয়ের মতো সুঠামদেহি এক পুরুষকে টেনে তোলা তাও আবার স্রোতের সাথে যু’দ্ধ করে বিষয়টা নিবেদিতার জন্য ভীষণ কঠিন ছিল। তবুও হাল ছাড়ছিল না সে। প্রাণপণে চেষ্টা করছিল নির্ণয়কে স্রোত থেকে টেনে কিনারে নেওয়ার। তার চেষ্টায় অনেকটা সফলও সে। ততক্ষণে হৃদয়, শিহাবও সাঁতরে চলে এসেছে এদিকে। অবশেষে ওদের সাহায্যে নির্ণয়কে পাড়ে নিতে সক্ষম হয় নিবেদিতা। সে প্রচণ্ড হাঁপিয়ে গেছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। নির্ণয়ের শরীর প্রায় অসাড়। সে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে। হৃদয় ওর পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর নির্ণয় কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। নিবেদিতার দিকে তাকিয়েও কিছু বলতে পারছিল না। তার কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে আছে। নিবেদিতাও এখন কিছুটা স্বাভাবিক। সে জিজ্ঞেস করল,
“ঠিক আছেন এখন আপনি?”
নির্ণয় মুখে কিছু বলতে পারল না। শুধু মাথা ঝাঁকাল কোনো রকমে।
.
.
ছোটো মামার গায়ে হলুদের প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে বাড়ির বিশাল বড়ো উঠানেই। নিবেদিতার বড়ো ভাই নয়ন এসেছে ঠিক হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে। গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে তাকে শহরে যেতে হয়েছিল বলে আগেই আসতে পারেনি। ছোটো মামার সাথে নয়নের বেশ খাতির। যদিও তাদের বয়সে বেশ গ্যাপ রয়েছে কিন্তু তা দেখে বোঝার উপায় নেই।
নয়ন দেরি করে আসায় ছোটো মামা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। রসিক নয়ন মামার গাল ধরে টেনে বলল,
“আহা নতুন জামাই এমন গাল ফুলিয়ে বসে থাকলে ভালো লাগে নাকি? হাসো তো দেখি হাসো!”
মামা আর রাগ করে থাকতে পারলেন না। নাসিমা বেগম নিবেদিতাকে বললেন,
“ওদের ঢং দেখতে গেলে সময় চলে যাবে। ঘরে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হলুদের বাটিগুলো নিয়ে আয় যা।”
নিবেদিতা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে আচানক একজনের সাথে ধাক্কা লেগে যায় তার। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে আশ্রয় হিসেবে কোনো কিছুই পেল না বিধায় আগন্তুকের পাঞ্জাবির কলার টেনে ধরেছে নিবেদিতা। ভয়ে সে জড়োসড়। আগন্তুকও নিবেদিতার হাত ধরে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে কোনো রকম বাঁচাল। অসহায় কণ্ঠে বলল,
“কলারটা ছাড়ুন প্লিজ! দম আ’ট’কে না হয় ম’র’ব।”
নিবেদিতা সঙ্গে সঙ্গে কলার ছেড়ে নিজের হাতও ছাড়িয়ে নিল। রাগে কটমট করে তাকিয়ে বলল,
“দেখে চলতে পারেন না?”
“দেখেই তো পড়লাম, পূর্ণিমার চাঁদ!”
“মানে?”
“কিছু না। সরি।”
হলুদ আনতে দেরি হচ্ছিল বিধায় নাসিমা বেগমের গলার আওয়াজ ভেসে এলো,
“নিবেদিতা…কইরে? এতক্ষণ লাগে?”
নিবেদিতাও এখান থেকেই চিৎকার করে বলল,
“আসছি মা।”
এরপর তড়িঘড়ি করে ঘরের ভেতর চলে গেল হলুদ আনতে। আগন্তুক ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“নিবেদিতা? নাইস নেইম। হার নেইম ইজ ঠু মাচ প্রিটি লাইক হার। নিবেদিতা। নিবেদিতা প্রাণ!”
চলবে…
#নিবেদিতা
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। সবাই রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন। আপনাদের অনুপ্রেরণা আমার লেখার উৎসাহ প্রবল করবে।]