#নিবেদিতা
#পর্ব_১৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
“বলুন মিস লতাপাতা, আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
মিদহাদের কথা শুনে বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ পড়ল সূবর্ণলতার। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“লতাপাতা না। সূবর্ণলতা।”
“ওহ সরি। তো বলুন, মিস সূবর্ণলতা আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“আমাকে সামনের মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত একটু লিফ্ট দিবেন?”
মিদহাদ আপত্তি জানাল না। ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিল। সূবর্ণলতা থ্যাঙ্কিউ বলে পেছনে গিয়ে বসল।
ছটফটে স্বভাবের মৌটুসী পেছনে ফিরে ভীষণ আগ্রহী কণ্ঠে বলল,
“আপনাকে দেখে কিন্তু বুঝিনি আপনি বাঙালি।”
সূবর্ণলতাও হেসে বলল,
“কিন্তু আমি তোমাদের প্রথম দেখেই বুঝেছি তোমরা বাঙালি।”
“আপনার নামটা খুব সুন্দর।”
“থ্যাঙ্কিউ ডিয়ার। তোমার নাম কী?”
“মৌটুসী।”
“আরে বাহ্! তোমার নাম তো আরো বেশি সুন্দর। একদম তোমার মতোই প্রিটি।”
মৌটুসী হাসল। কিছুটা লজ্জায় রাঙাও হলো সে। নিজের প্রসংশা শুনলেই সে ব্লাশ করতে থাকে। মিদহাদ ওদের দুজনের মাঝে কোনো কথা বলেনি। চুপচাপ ড্রাইভ করেছে। শুধুমাত্র গন্তব্য স্থানে পৌঁছে সূবর্ণলতার উদ্দেশে বলল,
“এসে পড়েছি।”
সূবর্ণলতা গাড়ি থেকে নামার পূর্বে আরো একবার ধন্যবাদ দিল মিদহাদকে। এরপর মৌটুসীর থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। মিদহাদ আবার গাড়ি চালাতে শুরু করেছে। মৌটুসী আনন্দভরা কণ্ঠে বলতে লাগল,
“আপুটা একদম উপন্যাসের নায়িকাদের মতো সুন্দর।”
মিদহাদ কিছু বলল না। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। মনে মনে বলল,
“প্রাণের চেয়ে বেশি না!”
.
.
নিবেদিতার এখন ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে। ভার্সিটিতে ক্লাস করে সে একটা পার্ট টাইম জব করছে। একটা বেকারিতে। জবটার ব্যবস্থা অবশ্য পল করে দিয়েছে। যদিও সে নিজে বলেনি। সাবিহাও এখানে যোগ মাধ্যম ছিল। সারাদিন ক্লাস, ডিউটি করে বাড়িতে এসে আবার রান্নাবান্না করা, ক্লাসের পড়া কমপ্লিট করা, অ্যাসাইনমেন্ট করা সব মিলিয়ে সে এতটাই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে যে মোটে চার ঘন্টা ঘুমানোর সময় পায় সে। এত ব্যস্ততায় বাড়িতেও খুব একটা কথা বলার ফুরসত হয় না তার। ক্লাসে যাওয়ার সময় যেটুকু সময় হাতে থাকে তখনই বাড়িতে ফোন করে মা কিংবা বাবার সাথে কথা বলে। জব পাওয়ার পরও বেশ কয়েকটা সেমিস্টারের টাকা নিবেদিতা বাবার কাছ থেকে নিয়েছে। এখন সে নিজেই নিজের সেমিস্টার ফি দেয় এবং পাশাপাশি কিছু টাকা সে অল্প অল্প করে জমিয়ে রাখছে। বলা তো যায় না কবে কোন কাজে লেগে যায়।
আজ নিবেদিতার একটা ক্লাস টেস্ট আছে। পরীক্ষা দিয়ে সে বের হতেই সাবিহার সাথে দেখা হলো। সাবিহা এগিয়ে এসে বলল,
“হেই নিঠা, কেমন আছো?”
নিবেদিতা চোখ পাকিয়ে বলল,
“সাবিহা!”
সাবিহা হেসে ফেলল। বলল,
“আহা! রাগ করছ কেন? নামটা তো সুন্দর।”
“ছাই সুন্দর! প্রথমদিনেই নামের বেইজ্জতি!”
“কিন্তু যাই বলো পল ছেলেটা কিন্তু বেশ ভালো।”
“হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। ও অবশ্য আমার কাছে একটা ট্রিট পেত। অনেকবার অফার করেছি। নেয়নি।”
“পল এমনই। অনেক কাইন্ড একটা পার্সন। যেকোনো হেল্পে ওকে পাবে। কিন্তু বিনিময়ে কখনোই কিছু নেবে না।”
নিবেদিতা মৃদু হাসল। সাবিহা বলল,
“আজ সন্ধ্যায় ফ্রি আছ?”
নিবেদিতা ঠোঁট উলটে বলল,
“না! এইযে এখন বেকারিতে যাব। ছুটি হবে রাত নয়টায়।”
“সমস্যা নেই। পার্টি হবে রাত দশটায়। আমি তোমাকে তোমার বেকারি থেকে পিক করে নিয়ে যাব।”
“কীসের পার্টি?”
“বার্থডে পার্টি।”
“বুঝলাম। কিন্তু বার্থডেটা কার?”
“আমার।”
নিবেদিতা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“তোমার? আগে বলবে না! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ডিয়ার।”
নিবেদিতা জড়িয়ে ধরল সাবিহাকে। সাবিহাও জড়িয়ে ধরে হেসে বলল
“থ্যাঙ্কিউ ডিয়ার। তাহলে রাতে কিন্তু আসছি তোমাকে পিক করতে?”
নিবেদিতা চেয়েও না করতে পারল না। সাবিহা তার অনেক উপকার করেছে এই পর্যন্ত। সেখানে ওর এতবার বলার পরও জন্মদিনে না থাকলে বিষয়টা ভীষণ দৃষ্টিকটু দেখাবে। আর অনেকটা স্বার্থপরের মতোও হয়ে যাবে বিষয়টা। তাই সে হাসিমুখেই বলল,
“ঠিক আছে।”
সাবিহা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল,
“জানো পার্টিটা কোথায় করব?”
“কোথায়?”
“সেই দ্বীপে, যেটার কথা তোমায় বলেছিলাম।”
“রাতের বেলায় দ্বীপে?”
“আরে ডোন্ট ওয়্যারি। ওখানে আরো অনেক মানুষজন থাকবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
মনে মনে কিছুটা ভয় লাগলেও সংকোচে মুখে কিছু বলল না। হাতঘড়িতে সময় দেখে বলল,
“ঠিক আছে সাবিহা। আমি তাহলে এখন যাই।”
“ওকে। সী ইউ সুন।”
নিবেদিতা ও সাবিহা দুজনই দুজনের কর্মসংস্থানে চলে গেল। মেট্রোতে যেতে যেতে উদাস হয়ে সে দেশের কথা, পরিবারের কথা ভাবছে। এই ছবির মতো সুন্দর দেশও এখন তার নজর কাড়ে না। খুব করে তার মন পড়ে থাকে গ্রামের মেঠো পথ, ফসল ভরা ক্ষেত, বৃষ্টিমুখর পরিবেশ, মায়ের আদর-যত্ন, শাসন, বাবার আদর, দুই ভাইয়ের সাথে খুনসুটি সব কিছুই সে খুব খুব মিস করে। এখন আর অসুস্থ হলেই দেখার কেউ নাই। যত্ন নেওয়ার কেউ নাই। আগে সামান্য জ্বর এলেই বাড়িসুদ্ধ লোক পাগল হয়ে যেত। আর এখন ১০৩ ডিগ্রি জ্বর এলেও কিছু যায় আসে না। কাজে যেতে হয়। কাজ করতে হয়। রান্না না করলে খাওয়ার সুযোগও নেই। বিদেশ জীবনটা সহজ নয়। অন্তত একা সার্ভাইভ করা খুবই কঠিন ব্যাপার। নিবেদিতার বুকচিরে ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
মেট্রো থেকে নেমে ভাবল সাবিহার জন্য ভালো একটা গিফ্ট কিনতে হবে। কিন্তু কী দেওয়া যায়? হাতে অবশ্য জমানো বেশ কিছু টাকাই আছে। এতে সে সাবিহার জন্য ভালো গিফ্টই কিনতে পারবে। লাঞ্চ ব্রেকে পাশের শপ থেকে কিছু কিনে নেবে ভাবল সে। পাঁচ মিনিট হাঁটতেই বেকারিতে পৌঁছে গেল। বাইরের সব দুশ্চিন্তাকে বাইরে রেখেই এবার সে মনোযোগ দিল কাজে। তার মালিক এমনিতে খুব ভালো মানুষ। কিন্তু কাজে কোনো ভুল হলে একদম বরদাস্ত করতে পারে না।
নিবেদিতা লাঞ্চ ব্রেকে বাইরে যাওয়ার সময় পেল না। তবে মালিককে বলে রেখেছে আজ যেন ওকে ত্রিশ মিনিট আগেই ছুটি দিয়ে দেয়। বেকারির মালিক নিবেদিতার কাজে শুরু থেকেই মুগ্ধ। এই পর্যন্ত খুব বেশি দরকার ছাড়া কখনোই কোনো ছুটি নেয়নি। এজন্য তিনি আপত্তি করেননি। ত্রিশ মিনিট আগেই ছুটি দিয়ে দিল। নিবেদিতা শপে গিয়ে একটা সুন্দর গিফ্ট কিনল সাবিহার জন্য। এরপর আবার বেকারির কাছে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। এর মাঝে সাবিহা তাকে একবার ফোনও করেছে। তার আসতে একটু দেরি হবে। এই সময়টুকু নিবেদিতা কী করবে বুঝতে পারছে না। ক্লান্তিতে তার ভীষণ ঘুমও পাচ্ছে। একটা কফি খাওয়া যেতে পারে। ক্লান্তি দূর হবে সেই সাথে শরীরটাও একটু সতেজ হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। সে একটা কফিশপে ঢুকে কফি অর্ডার দিল। টেবিলের ওপর হাত রেখে হাতের ওপর মাথা রাখল সে। দুচোখ বুজে আসছে।
“এটা কি ঘুমানোর জায়গা?”
একটা পুরুষালি কণ্ঠ কানে প্রবেশ করলেও ঘোরের মাঝে নিবেদিতা বুঝতে পারল না যে কথাটি ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। সে ঝাপসা দৃষ্টিতে মাথা তুলে তাকাল। তার সামনেই লম্বা একটা লোক দাঁড়ানো। লাইট ঠিক তার পেছনে থাকায় মুখটা দেখা যাচ্ছে না। তবে তার পরনে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট এটুকু বোঝা যাচ্ছে। লোকটা আবার প্যান্টের পকেটে দুহাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। নিবেদিতা কী বলবে বুঝতে পারছে না। এরমধ্যে ওর কফি নিয়ে এলো ওয়েটার। ওয়েটারকে জায়গা করে দিতেই লোকটা সরে দাঁড়াল। সেই সাথে মুখ দেখে সঙ্গে সঙ্গে ৪৪০ ভোল্টেজের শকড্ খেল যেন নিবেদিতা। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। নিজের চোখকেই তার বিশ্বাস হচ্ছে না। নির্ণয় এখানে কী করে আসবে? সে কী স্বপ্ন দেখছে? হতভম্ব নিবেদিতা শুধু বলতে পারল,
“আপনি এখানে! স্বপ্ন দেখছি আমি?”
নির্ণয় ভাবলেশহীন হয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। প্যান্টের পকেট থেকে এক হাত বের করে কপাল চুকাল। নিবেদিতা তখনো হতভম্ব। স্বপ্ন কি এতটাও বাস্তব হয়? নির্ণয় এবার তার হাতটা নিবেদিতার দিকে এগিয়ে দিল,
“ছুঁয়ে দেখো।”
নিবেদিতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
“কী?”
“বললাম ছুঁয়ে দেখো। আমি তোমার স্বপ্ন না; বাস্তব।”
নিবেদিতা কাঁপা কাঁপা হাতে নির্ণয়ের হাত ধরল। তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
“অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব!”
এরপর এক দৌঁড়ে কফিশপ থেকে বেরিয়ে গেল। ওর এই কাণ্ডে এবার নির্ণয় নিজেই হতবাক হয়ে গেছে। নিবেদিতার কফির বিলটা দিয়ে নির্ণয়ও দ্রুত বাইরে বের হলো। দেখল নিবেদিতা একটা বেঞ্চে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। নির্ণয় এগিয়ে গিয়ে বলল,
“পালাচ্ছ কেন?”
“আপনি এখানে কেন?”
নির্ণয় মুখে কোনো জবাব দিল না তৎক্ষণাৎ। মনে মনে বলল,
“তোমার অবচেতন মন আমায় ডেকেছে বলে। সেই ডাক উপেক্ষা করতে না পেরে চলে এসেছি।”
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]