#নিবেদিতা
#পর্ব_৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
পরিবার ও গ্রামের মায়া ত্যাগ করে নিবেদিতা ঢাকায় শিফ্ট হয়েছে। নাসিমা বেগমের ক্রন্দনরত মুখটা এখনো নিবেদিতার চোখের সামনে ভাসছে। সে নিজেও ভেতর থেকে ভেঙেচুরে যাচ্ছে কিন্তু সেটা কাউকে বলতে পারছে না। দেখাতেও পারছে না। কখনো কখনো মনে হচ্ছে একটা মানুষের থেকে পালাতে গিয়ে সে অনেকগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে ফেলছে। নিজের পরিবারকে বোধ হয় সে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু তারই বা আর কী করার আছে? চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য কারো সাথে দেখার চাইতে দূরদেশে পাড়ি জমানোটাকেই তার শ্রেয় মনে হয়েছে। মনটাকে নিবেদিতা কঠিন করার চেষ্টা করছে। এভাবে দিনের পর দিন ভেঙে পড়লে চলবে না। তাকে নিয়ে তার পরিবারের অনেক আশা আছে, স্বপ্ন আছে। যেই মানুষগুলো কোনো আগুপিছু না ভেবেই তাকে সাপোর্ট করছে, তারও উচিত তার প্রতিদান দেওয়া। এবং সেটা তখনই সম্ভব যখন সে ভালো কিছু করতে পারবে, ভালো থাকতে পারবে।
নিবেদিতার রুমে সে ছাড়াও আরো দুজন থাকে। দুজনকেই বেশ চুপচাপ মনে হচ্ছে ওর। আসার পর থেকেই দেখছে পড়ায় ডুবে আছে। মাঝখানে একবার শুধু নিবেদিতার সাথে পাঁচ মিনিটের মতো কথা বলে পরিচিত হয়েছিল। নিবেদিতার অবশ্য মন্দ লাগেনি। বরং সে যেন নিজেও চাচ্ছিল একাকি থাকতে। ওর বিছানাটা জানালার সাথে। স্বচ্ছ, সুন্দর আকাশটা এখান থেকেই স্পষ্ট দেখা যায়। নিবেদিতা বিছানায় শুয়ে পড়ল। এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভারী নিশ্বাস নিল। অভিমানী কণ্ঠে নির্ণয়ের উদ্দেশে বলল,
“আমায় একটু ভালোবাসলে কি খুব বেশি সমস্যা হয়ে যেত?”
.
.
একটা ফাইল হাতে নিয়ে বসে আছে নির্ণয়। হঠাৎ করেই মনটা কেমন জানি উদাসীন লাগছে। না চাইতেও নিবেদিতার কথা মনে পড়ছে। অবশ্য শুধু আজ নয়। এমনটা গত নয়দিন ধরেই হচ্ছে। নিবেদিতার কণ্ঠে ‘ভালোবাসি’ কথা শোনার পর থেকেই এক অদ্ভুত পরিবর্তন নিজের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে সে। পরিবর্তনটা হচ্ছে হুটহাট নিবেদিতাকে মনে পড়া। সে কখনোই নিবেদিতাকে সেভাবে লক্ষ্য করেনি। আগের অনেক ঘটনা এখন মনে পড়ছে যেগুলো সে আগে খেয়াল করেনি। নিবেদিতার অনুভূতি, চোখের ভাষা সে কখনো বোঝার চেষ্টা করেনি। অন্য সব কাজিনদের মতোই স্বাভাবিকভাবে দেখত।
“স্যার, বাড়ি যাবেন না? অফিস ছুটি তো।”
নির্ণয় হকচকিয়ে গেল পিওনের ডাকে। ঘড়িতে সময় দেখল। পাঁচটা বেজেছে আরো দশ মিনিট আগেই। সে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, বের হচ্ছি।”
বাড়িতে ফিরে ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল নির্ণয়ের। শরীরের সাথে সাথে মনও ক্লান্ত। আজকাল নিজের মনকে সে বুঝতে পারে না। মন কী বলে, কী চায় সে তাও জানে না। শুধু এইটুকু জানে এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। কেন নিবেদিতাকে তার এত মনে পড়বে? কেন?
সে মাথা থেকে নিবেদিতাকে বের করার চেষ্টা করল। জামা-কাপড় নিয়ে চলে গেল গোসল করতে। গোসল করার পর শরীর কিছুটা হালকা লাগছিল। এক মগ কফি ও ল্যাপটপ নিয়ে বসল সে। অফিসের কিছু কাজ আছে। এখন করতে ইচ্ছে করছে না। রাতে খাওয়ার পর ঠান্ডা মাথায় সেরে ফেলবে। এখন আপাতত একটু ফেসবুকে ঢুঁ মারা যায়। ফেসবুকে লগিন করে সে নিউজফিড স্ক্রল করতে লাগল। হঠাৎ করে ‘পিপল ইউ মে নো’ তে নিবেদিতার আইডিটা শো করল। ফেসবুকও কি তার মনের খবর জানে? সে একবার চাইল ইগনোর করতে। এজন্য স্ক্রল করে নিচেও চলে এলো। কিন্তু মনের সাথে পেরে উঠল না। আবার গিয়ে নিবেদিতার আইডিতে ঢুকল। প্রোফাইলে নিবেদিতারই হাস্যজ্বোল একটা ছবি। নির্ণয়ের ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটে উঠল। এই প্রথম এতটা গভীরভাবে সে নিবেদিতাকে দেখছে। বাস্তবে না হোক অন্তত ছবিতে তো দেখছে। নির্ণয় একটু অবাকই হলো। নিবেদিতার লাস্ট পোস্ট আরো ১৫ দিন আগের। এরপর আর কোনো আপডেট নেই। নির্ণয় ঘুরেফিরে আইডিটা দেখল। এরমধ্যে রাতে খাওয়ার জন্য ডাকছিলেন বিউটি বেগম। ল্যাপটপ বন্ধ করার আগে ছবিতে নিবেদিতার মুখে আলতো করে হাত রাখল নির্ণয়। সে নিজেও জানেনা এমনটা কেন করল। তার বারবার মনে হচ্ছে যেন সে না, অন্য কেউ তাকে পরিচালনা করছে।
বিউটি বেগম আবার ডাকলে নির্ণয় ল্যাপটপ রেখে খেতে চলে গেল। চেয়ার টেনে বসে শুনল বিউটি বেগম নিবেদিতাকে নিয়ে বাবার সাথে কথা বলছেন। নাদিম হোসাইন জিজ্ঞেস করলেন,
“আমাদের এখানেই তো থাকতে পারত।”
“এখান থেকে তো কোচিং দূরে হয়ে যায়।”
“কত আর সময় লাগত? ত্রিশ মিনিট! আমি বা নির্ণয়ও মাঝে মাঝে দিয়ে আসতে পারতাম। হোস্টেলে তো কষ্ট হয়ে যাবে মেয়েটার।”
নির্ণয় বুঝতে পারছিল না কীসের কথা বলছে তারা। তবে নিবেদিতার নাম শুনেছে একবার। তাই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
“কার কথা বলছ তোমরা? কে হোস্টেলে উঠেছে?”
“নিবেদিতা।” বললেন বিউটি বেগম।
নির্ণয় অবাক হয়ে বলল,
“নিবেদিতা এখন ঢাকায়?”
“হুম।”
“হোস্টেলে উঠেছে কেন?”
“IELTS এর জন্য। দেশের বাইরে চলে যেতে চায়।”
“পড়তে যাবে?”
“হু। এটাই ভালো। দেশে থাকার চেয়ে বাইরে সেটল হওয়া ভালো।”
নির্ণয় আর কিছু বলল না। চুপচাপ খেতে লাগল। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল তার। নিবেদিতা দেশ ছাড়তে চাইছে কেন? এটা যেন সে কিছুতেই মানতে পারছিল না। বাবা-মায়ের কথোপকথনের মাধ্যমেই নিবেদিতার হোস্টেলের ঠিকানা জেনে গিয়েছে সে। ভাবল কাল অফিস শেষ করে সে নিবেদিতার সাথে দেখা করতে যাবে।
_________
রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি নিবেদিতার। তবুও আলসেমি ও ঘুম ছেড়ে রেডি হয়ে ক্লাসে চলে গেছে। কিছু জিনিস কেনাকাটা দরকার ছিল। ক্লাস শেষ করেই যাওয়া লাগবে। ক্লাসে যেতে যেতে বাসায় ফোন দিয়ে মায়ের সাথে কথা বলছিল সে। কথা শেষ করে ক্লাসে চলে গেল। ক্লাসে গিয়ে কেন জানি তার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। বাড়ির কথা মনে পড়ছিল। নির্ণয়ের কথা মনে পড়ে বুকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছিল। নিজেকে ও মনকে শক্ত করার চেষ্টা করছিল সে। তবে মনকে ভালো করতে পারল না। মনমরা হয়েই ক্লাস শেষ করল। ওয়াশরুমে গিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছিল। নিজেকে দেখে নিজেরই এত মায়া লাগছিল ওর! দুচোখ ভেঙে অশ্রু নির্গত হচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। কিছুক্ষণ কেঁদে নিজেকে হালকা করে চোখে-মুখে পানি দিয়ে বের হলো। বাইরে গিয়ে দেখল মিদহাদ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। নিবেদিতাকে দেখেই এগিয়ে এলো। ওর ফোলা চোখমুখ দেখে বুঝতে একটুও কষ্ট হলো না যে এই মাত্রই কেঁদে বের হয়েছে মেয়েটা। তবে এই ব্যাপারে সে নিবেদিতাকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না।
নিবেদিতা বলল,
“আপনি এখানে?”
“নয়ন ফোন করেছিল। তোমার নাকি কী কী কেনা লাগবে? চলো।”
“আমি একা কিনতে পারব।”
“জানি। কিন্তু নয়ন দায়িত্বটা আমাকে দিয়েছে। আজ আমার সাথে গিয়ে সব চিনে নাও। পরে একাই কেনাকাটা করতে পারবে। এরপর তো আর আমিও থাকব না।”
নিবেদিতা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মিদহাদ বলল,
“কী? চলো।”
দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিল। কিছুদূর হাঁটার পর সামনে একটা হিজড়া এসে দাঁড়াল। মিদহাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই হ্যান্ডসাম…”
মিদহাদ ভয় পেয়ে নিবেদিতার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। হিজড়া হেসে বলল,
“ভীতুর ডিম! নায়ক নায়ক চেহারা নিয়াও এত ডরাস? নায়িকার পিছনে লুকাইছোস ক্যান?”
মিদহাদ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,
“ভয় লাগে আপু! আপনি দূর থেকেই বলেন কী বলবেন?”
“তুই আগে সামনে আয়। তোরে আমার ভালো লাগছে।”
“লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাহ বিল্লাহ্!মাফ করেন আপু।”
হিজড়ার সাথে এবার নিবেদিতাও হেসে ফেলল। হিজড়া হেসে বলল,
“হইছে আর ডরাইতে হইব না। টাকা দে চলে যাই।”
মিদহাদ একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দিল। হিজড়াটি চলে যাওয়ার আগে নিবেদিতাকে বলল,
“সামলাইয়া রাখিস ওরে সুন্দরী।”
দূর থেকে হাসতে থাকা নিবেদিতাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস নিল নির্ণয়। যাক, অন্তত নিবেদিতা ভালোই আছে। হাসি-খুশি আছে। নির্ণয় আর সামনে গেল না। ওখান থেকেই চলে গেল।
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]