#নিবেদিতা
#পর্ব_১১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
নিবেদিতা বসে আছে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন সিটি বিমানবন্দর এয়ারপোর্টে। তাকে নিতে আসার কথা সাবিহার। সাবিহা তার ফেসবুক ফ্রেন্ড। ওর ভরসায় এবং নিজের জেদেই সে এত ভালো ভালো কান্ট্রি রেখে ডেনমার্কে পড়তে এসেছে।
আইইএলটিএসের স্কোর এসেছে ৬.৫। এই স্কোর নিয়ে অনেকগুলো জায়গায় আবেদন করেও সে সিলেক্ট হয়েছে বেশ কিছু ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু সেগুলোর খরচ বেশ ব্যয়বহুল। যেহেতু তার কোনো স্কলারশিপ নেই সেহেতু তার পড়াশোনা, থাকা-খাওয়ার জন্য অনেক টাকা নষ্ট হবে। তার আরো দুটো ভাই আছে। এত টাকা-পয়সা যদি ওর পেছনেই শেষ করে ফেলে তাহলে বাকি দুই ভাইয়ের জন্য আর কী-ই বা বরাদ্দ থাকবে? এখনো তো ওদেরও ভবিষ্যৎ পুরোটা বাকি। ডেনমার্কে যে খরচ একেবারেই নেই তাও নয়। তবে তার ড্রিম কান্ট্রিগুলোর তুলনায় বেশ কম। এখানে সে তাও সার্ভাইভ করতে পারবে হয়তো আর পরিবারের ওপরও চাপটা কমবে। এসব কথা অবশ্য পরিবারের কেউই জানে না। বরং তারা যখন শুনল সুইজারল্যান্ড, কানাডা ও লন্ডন রেখে সে ডেনমার্কে পড়তে যেতে চাইছে তখন সকলেই যারপরনাই অবাক হয়েছে। বাবা এবং ভাই কেউই রাজি হতে চাচ্ছিল না। বিশেষ করে নয়ন চাচ্ছিল নিবেদিতা লন্ডনে গিয়ে পড়ুক। কারণ ওখানে মিদহাদ ও ওর পরিবার আছে। নিবেদিতাকে দেখে রাখতে পারবে। এমনকি মিদহাদের পরিবারও ফোন করে নিবেদিতাকে লন্ডনে আসতে বলেছে। তবে নিবেদিতা কারো কথা শোনেনি। সে আর্থিকভাবে অন্য কারো সাহায্য নিতে চায় না এবং কারো প্রতি নির্ভরশীলও হতে চায় না। সে খুব ভালো করেই জানে যে লন্ডনে গেলে হয়তো তাকে মিদহাদদের বাড়িতেই থাকতে হতো। অনেকটা পরগাছার মতো। সে এরকম কিছু হতে চায় না। তার মূলত উদ্দেশ্য ছিল দেশ ছাড়া। সেই উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে এতেই সে খুশি ছিল। এজন্য কোন দেশে পড়তে যাচ্ছে এটা তার কাছে কোনো ম্যাটার করেনি।
শেষ সময়ে সে এতটাই নার্ভাস হয়ে পড়েছিল যে ভাবতেও পারেনি IELTS-এ সে টিকতে পারবে। সত্যি বলতে এই স্কোরও তার এক্সপেকটেশনের বাইরে ছিল। তার বাইরে পড়তে যাওয়ার খবর খুব অল্প সময়েই পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। ওদের গ্রামে ওই প্রথম কোনো মেয়ে যে দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছে। অনেকে তাই নিবেদিতাকে নিয়ে ভীষণ গর্বও করেছে। অনেকে আবার কানাঘুষা করে বলেছে, ‘মেয়েদের আবার কীসের বাইরে পড়তে যাওয়া? ঐখানে গেলে আর ভালো থাহেনি মাইয়্যা মানুষ?’ এসব কানাঘুষা নিবেদিতা IELTS-এ টিকে যাওয়ার পর হতেই শুনছিল। তবে সে কাউকেই কিছু বলেনি। এডমিশনের রেজাল্ট না পাওয়া অবধি মুখ বুজে সব সহ্য করে যাচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিল, একবার চলে যেতে পারলেই স্বস্তি। তাছাড়া যাদের সামনে এসে কিছু বলার সাহস নেই তাদের কোনো কথা নিবেদিতা গোণায় ধরে না। বেচারারা তো এমনিতেই ভীতু! তাদের আর কী-বা বলবে?
এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে করতে নিবেদিতার একটু ভয়ও হচ্ছিল। যদি সাবিহা তাকে নিতে না আসে? তাহলে কী হবে? সম্পূর্ণ নতুন একটা দেশ, সে তো কিছুই চেনে না। এমনকি থাকার জায়গাটাও সাবিহা ঠিক করে রেখেছিল। কোথাও যেচে ওঠার মতো পরিস্থিতিটাও নেই। তার নিজেকে এত বেশি অসহায় লাগছে এখন! এই প্রথম তার একটু ভয় হতে লাগল। চোখের সামনে মায়ের ক্রন্দনরত মুখটা ভেসে উঠল মুহূর্তেই। এয়ারপোর্টে নিবেদিতাকে বুকে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো যেভাবে কান্না করলেন! নিবেদিতার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল সব প্ল্যান ক্যান্সেল করে দিতে। সে তার মাকে রেখে, পরিবার রেখে কোত্থাও যাবে না। কিন্তু পরক্ষণেই চোখের পানি মুছে যখন সামনে তাকাল তখন দেখতে পেল নির্ণয়কে। সে প্রায় ঘেমেনেয়ে এসেছে। ক্লান্ত চোখ-মুখ। বিষাদিত, উদাসীন চাহনী! সঙ্গে সঙ্গে মনকে সে শক্ত করে ফেলল। এই শেষ সময়ে এসে ভেঙে পড়লে একদম চলবে না। আফসোস কিংবা উপহাস যা-ই বলি না কেন, শেষ সময়ে নির্ণয়ের সাথে নিবেদিতার একটাও বাক্য বিনিময় হলো না, শুধু চোখাচোখি ছাড়া।
“হেই নিবেদিতা!”
হঠাৎ করে কারো কণ্ঠে জোরেশোরে নিজের নাম শুনে আঁতকে উঠল নিবেদিতা। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। বুকে থুথু দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। হেসে ফেলল সাবিহা। নিবেদিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ওয়েলকাম টু ডেনমার্ক। আ’ম সরি ফর লেইট বিকজ আই ওয়াজ স্টাক অন দ্য রোড।”
নিবেদিতা মাপা হাসি দিয়ে বলল,
“ইট’স ওকে।”
“লেট’স গো।”
নিবেদিতার লাগেজটা সাবিহা নিল। বাকি ব্যাগ নিবেদিতা নিজেই বহন করছে। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে নিবেদিতা জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি সবসময় ইংলিশেই কথা বলো?”
সাবিহা হেসে বলল,
“আরে নাহ্! আসলে এখানে আমার বাঙালি বন্ধু-বান্ধব তেমন নেই তো! তেমন বলছি কেন? একটাও নেই। একজন ইন্ডিয়ান ফ্রেন্ড আছে। ও আবার হিন্দি পারে। বাংলা পারে না। তো সবার সাথে ইংলিশে কথা বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে। আমার মনেই ছিল না যে তুমি বাঙালি। যদিও ডেনমার্কের নাগরিকরা ড্যানিশ ভাষায় কথা বলে। তবে আমরা যাইরে বাইরের দেশের বাসিন্দা তারা তো আর সবাই ড্যানিশ ভাষা বুঝি না, পারিও না।”
“তুমি পারো ড্যানিশ ভাষা?”
“একটু একটু। তবে ডেনমার্কের স্থানীয়রা শুনলে খুব হাসে।”
নিবেদিতার হাসি এবার প্রশস্ত হলো।
দুজনের গল্পগুজব চলল আরো কিছুক্ষণ। নিবেদিতা ফেসবুকে খুবই ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের। যেচে কারো সাথে কথা বলে না। একবার সাবিহা ভুল করে তার কিছু ছবি দেশে বোনকে পাঠাতে গিয়ে নিবেদিতাকে সেন্ড করে ফেলেছিল। সেখান থেকেই দুজনের আলাপ এবং এরপর মাঝে মাঝেই কথা হতো দুজনের। যদিও খুবই অল্প সময়েরই কথা। কেননা সাবিহার এখানে ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটে। পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম জব করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেভাবে বাড়তি সময় দিতে পারে না। এরপর নিবেদিতা যখন ঠিক করল সে বাইরের দেশে পড়তে যাবে তখন নিজে থেকেই সাবিহাকে নক করেছিল। ডেনমার্কে পড়াশোনার খরচ কেমন, মান কেমন সবকিছু জিজ্ঞেস করেছিল। এবং সব শুনে তার মনে হয়েছিল ডেনমার্ক তার জন্য উত্তমই হবে। তারওপর এখানে আবার সাবিহাও আছে। যদিও সে নিবেদিতার থেকে দুই বছর এগিয়ে। কিন্তু ভিনদেশে স্বল্প পরিচয়ের হলেও একটা মানুষ তো আছে। এটাই শান্তি!
ট্যাক্সি এসে থামল নির্দিষ্ট গন্তব্যে। সাবিহা ভাড়া মেটানোর সময় নিবেদিতা চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল। রাস্তায় আসার সময় বড়ো বড়ো বাড়ির পরিমাণ বেশি থাকলেও এখানে বাড়িগুলো বেশ ছোটোই এবং জায়গাটাও অনেক ছিমছাম। সাবিহা বলল,
“এটা কোপেনহেগেন শহর থেকে একটু ভেতরের দিকের জায়গা তো তাই এত শান্ত পরিবেশ। রেন্টও শহরের তুলনায় কম। তুমি যদি এখানে কম্ফোর্টেবল ফিল না করো তাহলে পরে বাড়ি চেঞ্জ করে নিও। তবে আমার মনে হয় না, তোমার এখানে থাকতে কোনো অসুবিধা হবে।”
“তুমি এখানে থাকো না?”
সাবিহা রাস্তা বরাবর আঙ্গুলি দ্বারা নির্দেশ করে বলল,
“ঐযে সাদা রঙের একটা বাড়ি দেখতে পাচ্ছ? সামনে যে দুটো নারকেল গাছ?”
“হু।”
“আমি ঐ বাড়িতেই থাকি। কিন্তু ঐখানে দুটো রুমই বুকিং। তাই তোমার জন্য আলাদা বাসা। এই বাসার মালিক ভীষণ ভালো। বয়স্ক দাদুর বয়সী। তবে ভীষণ মিশুক। সে এখানে একাই থাকে। তার এক নাতি আছে। সে মাঝে মাঝে আসে। তবে থাকে না এখানে।”
“ওহ আচ্ছা।”
সাবিহা আর নিবেদিতা এবার বামদিকে বাড়ির দিকে রওনা দিল। ছোটো একটা বাড়ি। তবে অনেকটা জায়গা নিয়ে করা। ঠিক যেন মাঠের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে। বাড়ির চারপাশে অনেক ধরণের লম্বা লম্বা গাছ। নিবেদিতা শুধু নারকেল গাছগুলোকেই চিহ্নিত করতে পারল। এছাড়াও বাড়ির সামনে ও একদম বামদিকে পুরো একটা ফুলের বাগানই আছে বলা চলে। বাগানের সামনেই সাদা রঙের একটা ছোট্ট টেবিল। চারপাশে চারটা চেয়ার। বাড়ির পরিবেশ ও আশপাশ দেখেই নিবেদিতার ভালো লেগে গেল। এ যেন কোনো স্বর্গীয় উদ্যান!
নিবেদিতার উচ্ছ্বসিত চোখ-মুখ দেখে সাবিহা জিজ্ঞেস করল,
“পছন্দ হয়েছে?”
নিবেদিতা আনন্দিত হয়ে বলল,
“ভীষণ!”
“তোমাকে আরেকটা আনন্দের কথা বলি। আমার বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে দশ মিনিট সামনে আগালেই একটা সুন্দর দ্বীপ আছে। দ্বীপটা সাগরের মধ্যে। চাইলেই বোটে করে যাওয়া যায়।”
“সত্যিই?”
“হ্যাঁ। তোমায় একদিন নিয়ে যাব। আগে সবকিছু তুমি গুছিয়ে নাও।”
“ঠিক আছে। তোমার ফোনটা দেওয়া যাবে? বাড়িতে ফোন করে পৌঁছানোর কথা জানিয়ে দিতাম।”
“শিওর।”
সাবিহা পকেট থেকে তার ফোন বের করে দিল। নিবেদিতা সেই সাদা চেয়ার-টেবিল দেখিয়ে বলল,
“এখানে একটু বসি আমরা?”
“অবশ্যই। চলো।”
নিবেদিতা আরাম করে বসল। তার এত ভালো লাগছে! এখানে তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা একাই কাটিয়ে দিতে পারবে সে। সে বাসায় ফোন করতে যাবে তখন ফরসা করে এক ছেলে ওদের দিকে এগিয়ে এলো। নিবেদিতা আর ফোন করল না। ছেলেটা কৌতুহলী হয়ে নিবেদিতাকে দেখছিল। পরক্ষণে সাবিহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“হেই সাবহা, হু ইজ শী?”
ছেলেটার নাম পল। বাড়িওয়ালীর নাতি। সে সাবিহার পুরো নাম বলতে পারে না। তাই সংক্ষেপে সাবহা ডাকে। সাবিহা বলল,
“শী ইজ ফ্রম মাই কান্ট্রি বাংলাদেশ। নাউ শী উইল স্টে হেয়ার।”
“আই সী! হোয়াট ইজ হার নেইম?”
“নিবেদিতা।”
“হোয়াট?”
“নিবেদিতা।”
পল নিবেদিতার নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে বলল,
“নিভ…”
সাবিহা একটু ধীরে থেমে থেমে বলে,
“নি…বে…”
“নিভ অ্যা…”
ভুল হলেও সাবিহা পরেরটুকু বলল,
“দি…তা”
“ডি…ঠা।”
“নি…বে…দি…তা।”
ভাঙা ভাঙা গলায় পল বলল,
“নিভ অ্যা ডি আ ঠা।”
সাবিহা ফিক করে হেসে ফেলল। নিবেদিতা ভীষণ হতাশ হয়ে পলের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের নামের এমন ভয়ংকর উচ্চারণ শুনে এত বেশি আহত হলো যে ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়েই রইল।
পল বলল,
“ওহ ড্যাম ইট! হেই লেডি, ইওর নেইম ইজ ঠু মাচ লং এন্ড হার্ড। আই কান্ট প্রোনাউন্স ইওর লং নেইম। সো আই ওয়ান্না গিভ ইউ অ্যা শর্ট এন্ড ইজি নেইম। হ্যাভ ইউ এনি প্রবলেম?”
নিবেদিতা কিছু বলার পূর্বেই সাবিহা বলল,
“নো। ইউ ক্যান গিফ হার অ্যা বিউটিফুল নেইম।”
পল একটু ভেবে বলল,
“আ’ল কল ইউ নিঠা।”
নিবেদিতা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল,
“নিঠা?”
সাবিহা হেসে বলল,
“মনে হয় নিবেদিতার ‘নি’ আর ‘তা’ নিয়ে নিতা বলতে চাইছে। ত তো ঐভাবে ওরা উচ্চারণ করতে পারে না। তাই নিতা হয়ে গেছে নিঠা।”
নামের এমন বিশ্লেষণ শুনে নিবেদিতা করুণ চোখে তাকিয়ে রইল। বিদেশ-বিভূয়ে এসে নামের এমন হেনস্তা সহ্য করা যায়? পরক্ষণে মনকে এটা বলে সান্ত্বনা দিল যে, ওর নামের প্রথম অক্ষর ‘প’ আকার ছিল না। তাহলে তো এই ছেলে নির্ঘাত পা’ঠা বানিয়ে দিত নামটাকে। আল্লাহ্ তাও অল্পতে বাঁচিয়েছে বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল সে।
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।
কোনো নতুন চরিত্র এলে বিচলিত না হয়ে গল্পটাকে ইনজয় করুন। যেহেতু মেইন লিড ক্যারেক্টার নিবেদিতা, সেহেতু যেকোনো চরিত্রই আসুক না কেন সব নিবেদিতাকে কেন্দ্র করেই আসবে।]