#নিবেদিতা
#পর্ব_১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
নিবেদিতা বসে আছে জানালার ধারে। তার রুম থেকে বাইরের সুন্দর একটা ভিউ দেখা যায়। জানালার পাশেই আগে সবুজে ঘেরা বিস্তর মাঠ। সেই মাঠে ছিড়িয়ে-ছিটিয়ে ফুটে আছে কিছু শুভ্র রঙের বুনোফুল। বাতাসের দমকে গাছের বড়ো লম্বা পাতাগুলো মৃদু দুলছে। মাঠ পেরিয়ে অদূরে একটা পাহাড়ের মতো দ্বীপ। দূর থেকে ছোটো মনে হচ্ছে অবশ্য। নিবেদিতা রুমে এসে সব গুছিয়ে অনেকক্ষণ ধরে এখানেই বসে ছিল। তার মন একই সাথে ভালো বলা যায়, আবার খারাপও বলা যায়। ভালোর কারণ হলো এই ছবির মতোন সুন্দর দেশ ও সুন্দর দৃশ্য। আর খারাপের কারণ হলো সে নিজের দেশ, পরিবার ও নির্ণয়কে ভীষণ মিস করছে। এত দূরে এসেও শেষ রক্ষা হলো না। নির্ণয়কে বারংবার মনে পড়ছে। এত বেপরোয়া, বেহায়া মন! নিবেদিতা মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করল।
তার ভীষণ ক্লান্তও লাগছিল। একটু ঘুমানো দরকার। ঘুম থেকে উঠে বাড়িতে ফোন করবে। সব গুছিয়ে সাবিহার সাথে গিয়ে সে একটা নতুন সীম কিনেছে। এই নাম্বার থেকে এখনো কল করা হয়নি দেশে। বাহির থেকে এসেই এই জানালার পাশে বসে আছে। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই তার হঠাৎ করে মনে একটা প্রশ্ন উদয় হলো। IELTS এর প্রিপারেশন, এক্সাম, এডমিশন সব মিলিয়ে এর মাঝে অনেক সময় চলে গেছে। এই এত সময়ের মধ্যে নির্ণয়ের সাথে ওর যোগাযোগ না থাকলেও ঐ বাড়ির প্রায় সব আপডেটই সে জানত তার মায়ের কাছ থেকে। এমন না যে সে নিজে জিজ্ঞেস করত যেচে। মা নিজেই বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলত। এছাড়া খালা-খালুও প্রায়ই খাবার নিয়ে আসতেন নিবেদিতার জন্য। তাই নিবেদিতা না চাইলেও ঐ বাড়ির খবর তার নিকট চলেই আসত। সেখানে নির্ণয় আর সুখীর বিয়ের ব্যাপারে সে কিছুই শোনেনি। হয়তো এই ব্যাপারে কথা ওঠেনি বলেই শোনেনি। কিন্তু নিবেদিতার হিসাব মতে, নিবেদিতা দেশে থাকতেই ওদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তাহলে না হওয়ার কারণ?
নিবেদিতা পাশ ফিরে শুলো। বিরক্ত লাগছে তার। নির্ণয় বিয়ে করুক বা না করুক এসব নিয়ে ভেবে তার কি আদৌ মাথা ব্যথা করার প্রয়োজন আছে? একটা এক তরফা ভালোবাসা আর যাই হোক, এভাবে বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না। সেখানে শুধু কষ্টই থাকে; ভালোবাসা না। নিবেদিতা এখন আর কষ্ট চায় না আর ভালোবাসাও চায় না। সে শুধু ব্যস্ত থাকতে চায়। নিজেকে ভালো রাখতে চায়। বাকিরাও ভালো থাকুক তাদের মতো করেই।
.
.
আজকাল নির্ণয়ের খুব ব্যস্ত সময় কাটছে। অফিসের কাজ শেষ করে তার ভেতরকার ব্যক্তিগত প্রস্তুতি সব মিলিয়েই দম ফেলানোর সময় নেই। রাতে সে কতটুকু ঘুমায় সে নিজেও জানে না। কাজের প্রতি তার ডেডিকেশন সর্বদাই এগিয়ে। সে কাগজপত্র গুছিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। তখন চা নিয়ে রুমে এলেন বিউটি বেগম। ছেলের ক্লান্ত মুখ দেখে বললেন,
“কীরে বাবা, তোকে এত চিন্তিত লাগছে কেন?”
নির্ণয় হাসার চেষ্টা করে বলল,
“কই?”
“এইযে তোর চোখ-মুখ দেখেই তো মনে হচ্ছে।”
“আরে না! বসো।”
আরেকটা চেয়ার টেনে বিউটি বেগমকে বসতে দিল নির্ণয়। ছেলেকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরখ করে তিনি বললেন,
“তুই এত চাপা স্বভাবের কেন হয়েছিস বল তো? মনের কথাও বলিস না কখনো।”
নির্ণয় মেপে হাসল। অনিচ্ছাকৃত হাসি! বিউটি বেগম বললেন,
“মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কিংবা তোর বাবা হয়তো তোর মতো করে তোর সাথে মিশতে পারিনি। তাই না?”
“মা! কেন এসব বলছ আজ? কী হয়েছে তোমার?”
“আমার কিছু হয়নি।”
“তাহলে?”
“তোর কী হয়েছে সেটা বল। আমি কিন্তু একদিন, দুদিন না অনেকদিন ধরেই নোটিশ করছি তুই কিছু নিয়ে খুব ব্যস্ত। রাতও জাগিস অনেক। অথচ আগে এতটা রাত কখনোই জাগতি না।”
“অফিসের কাজ থাকে সেগুলো করি।”
“অফিসের কাজ আগেও করতি তুই। এত রাত জেগে তো নয়।”
নির্ণয় হেসে বলল,
“তুমি কি এখন পুলিশের মতো জেরা করবে আমাকে?”
“না। আমি জানতে চাচ্ছি আমার ছেলের মনের ভেতর কী চলছে?”
“কিচ্ছু না মা। রাত প্রায় বারোটা বাজে। তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ না কেন?”
“কথা ঘুরাবি না নির্ণয়। আমাকে বল সত্যিটা।”
“তুমি হঠাৎ আজ আদাজল খেয়ে আমার পেছনে পড়লে কেন? তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে?”
“কী বলবে?”
“তা তো জানিনা।”
“তাহলে এই প্রশ্ন করলি কেন?”
“এমনি।”
“আমার প্রশ্নের উত্তর দে।”
“কী?”
“তুই বাইরের দেশে যাওয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছিস তাই না?”
নির্ণয় কিছুটা চমকে গেল যেন। বিউটি বেগম সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“অবাক হলি কেন?”
“তোমাকে এসব কে বলেছে?”
“কেউ না। আমি নিজে দেখেছি। তোর ঘরে IELTS এর বই। তুই যে ক্লাসও করিস, কোর্স করছিস, রাত জেগে এর পেছনে সময় দিচ্ছিস আমি সেটা জানি।”
নির্ণয় চুপ করে আছে। তিনি বললেন,
“সুখীর বিয়ের কথাবার্তা চলছে।”
নির্ণয় এবার ভাবলেশহীনভাবে রইল। তিনি বললেন,
“হয়তো বিয়েটা হয়ে যাবে।”
“জানি।”
“জানিস?” ভারী অবাক হলেন বিউটি বেগম।
নির্ণয় মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“যেই ছেলের সাথে বিয়ের কথা চলছে সেই ছেলে আমার কলিগ। আমার মাধ্যমেই ওদের পরিচয় হয়েছিল। ওদের বিয়ের ব্যাপারেও আমি জানি।”
“এসব কীভাবে হলো?”
“দুজন দুজনকে ভালোবাসে তাই।”
“কিন্তু সুখীর সাথে আমরা তোর বিয়ের কথা বলছিলাম।”
“হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের মাঝে কোনো ভালোবাসা ছিল না। জাস্ট পরিচিত ছিলাম এটুকুই।”
“ঐ ছেলের সাথে কি সম্পর্ক ছিল তাহলে?”
“না। পরিচয় হওয়ার পর বন্ধুত্ব ছিল আগে। পরে দুজন দুজনকে জেনেছে, বুঝেছে। ওদের মেন্টালিটি ম্যাচ করেছে তাই এখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
“তুই কোনদিক দিয়ে কম ছিলি?”
“এখানে প্রসঙ্গ তো কমবেশির না, মা। এখানে বিষয়টা মেন্টালিটির। আমাদের মেন্টালিটি ম্যাচ করেনি। আমি কেমন তুমি তো জানোই? ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের ছেলে-মেয়েদের সাথে সবাই মানিয়ে নিতে পারে না। অন্তত সংসারের ক্ষেত্রে। তবে আমি এবং সুখী এখন ভালো বন্ধুর মতোই বলতে পারো। কাজ নিয়ে, পারিপার্শ্বিক অনেক কিছু নিয়েই আমরা মাঝে মাঝে কথাবার্তা বলি।”
“তোরা নিজেরা নিজেরা যে এত কিছু ভেবেছিস, করেছিস একটাবার আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?”
“সরি মা!”
“তুইও মন থেকে চাইছিলি না সুখীর সাথে তোর কিছু হোক আর এজন্যই সেদিন তুই আমার কাছে সময় চেয়েছিলি?”
“হু।”
“নিবেদিতাকে ভালোবাসিস?”
নির্ণয় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। কোনো জবাব দিল না। বিউটি আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। নয় মাস এই ছেলেকে তিনি পেটে ধরেছেন। ছেলে তার যতই চুপচাপ হোক না কেন মনের খবর সে একজন মা হিসেবে চোখ দেখেই বুঝতে পারলেন। কবে, কখন, কীভাবে নির্ণয়ের মতো একজন ছেলে ভালোবেসে ফেলল তাও তিনি একটাবার জিজ্ঞেস করলেন না। এতদিনেও যখন নির্ণয় তাকে কিছু বলেনি, এখনো বলবে না। শুধু শুধু জিজ্ঞেস করে নিজেদের মধ্যে কোনো বাকবিতণ্ডা তিনি সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন না। ছেলে সময় চাচ্ছে, তিনিও সময় দিলেন। সঠিক সময় এলে হয়তো নিজে থেকেই সবটা বলবে।
তিনি বসা থেকে উঠে গেলেন। নির্ণয়ের পান করা খালি চায়ের কাপটি তু্লে নিয়ে বললেন,
“তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়িস।”
তিনি প্রস্থান করার পর নির্ণয় ফের চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। শরীর ব্যথায় ম্যাজম্যাজ করছে। হয়তো দীর্ঘ সময় এখন বসে থাকা হয় তাই। সে ল্যাপটপে কাজ রেখে ফেসবুকে লগিন করল। নিবেদিতার আইডিটা সার্চ দিয়ে ছবি দেখল। মেয়েটা কেমন যেন বদলে গেছে! ডেনমার্কে গিয়েও কোনো আপডেট দেয়নি। এমনকি সিঙ্গেল কোনো পোস্টও না দেশ ছাড়ার! ছয় মাস আগের দেওয়া প্রোফাইলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল নির্ণয়। স্বগতোক্তি করে বলল,
“আমি আসছি।”
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]