#নিবেদিতা
#পর্ব_২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
আগন্তুক লোকটার পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। নিবেদিতার ভাই নয়নের বাল্যকালের শহুরে বন্ধু। তার সাথে জরুরী দেখা করতেই মামার বিয়েকে তোয়াক্কা না করে নয়ন ঢাকায় গিয়েছিল দেখা করতে। শুধু তো যায়নি, সাথে করে আবার বন্ধুকে নিয়েও এসেছে। সে নিয়ে আসুক, সমস্যা নেই। তবে নিবেদিতার বিরক্ত লাগছে অন্য জায়গায়। তার কেন জানি মনে হচ্ছে ধাক্কাটি খাওয়ার পর থেকেই লোকটা তাকে নোটিশ করছে। ওহহো, এখন আর তাকে লোকটা বা আগন্তুক না ডেকে নাম ধরে ডাকা যায়। ভাইয়ের কাছেই নামটা জানা গেছে। মোহাম্মদ মিদহাদ হোসাইন। নামটা সুন্দর হলেও নজর সুন্দর না। হতে পারে শুধু নিবেদিতার কাছেই এমন লাগছে। কারণ বাকি মেয়েরা যেভাবে মিদহাদ নামক আগন্তুকটাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে তার একটুখানি আগ্রহও মিদহাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। সে কেবল সুযোগ পেলেই নিবেদিতাকে দেখছে। যেন নিবেদিতা র’ক্তে-মাংসে গড়া কোনো মানবী নয় বরং মিদহাদের প্রাণ-ভোমরা। চোখের আড়াল করলেই কেউ বগলদাবা করে নিয়ে যাবে।
নিবেদিতা চেষ্টা করছিল মিদহাদকে এড়িয়ে চলার। কিন্তু ঐ ধ্বং’সা’ত্ম’ক দৃষ্টি এড়ানো মুশকিল। নয়ন এবং সে এখন ‘মেরি ইয়ার কি শাদি হে’ গানে সমানতালে নাচছে। চারদিকে হৈ-হুল্লোড়। নিবেদিতার বোন, বান্ধবীগুলা তালির সঙ্গে সঙ্গে শিস বাজাচ্ছে। নিবেদিতা সবাইকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে নির্ণয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ণয়ের ঠোঁটে মুচকি হাসি। সেও নাচ উপভোগ করছে। নিবেদিতার মনটাই ভরে গেল নির্ণয়কে দেখে। সবুজ পাঞ্জাবিতে কী সুন্দর লাগছে দেখতে! অবশ্য গায়ে হলুদে আজ সব ছেলেরাই সাদা পাজামার সাথে সবুজ পাঞ্জাবি পরেছে। সে সবাই যা ইচ্ছে পড়ুক গিয়ে। নিবেদিতা তো বারংবার ধপাস করে শুধু এই গম্ভীরমুখো ছেলেটার প্রেমেই পড়ছে।
নয়ন ও মিদহাদের নাচ শেষ হলে তুবা ও ওর বান্ধবীরা এবার নাচে অংশ নিল। বলাই বাহুল্য প্রত্যেকের নাচই একদম চোখ ধাঁধানো। নিবেদিতা মেয়ে হয়েও অবাক হয়ে দেখছিল। ওরা যে এত ভালো নাচ জানে নিবেদিতা নিজেও জানত না। কেন জানি তার চোখ চলে গেল নির্ণয়ের দিকে। এক ভালো লাগায় ছেয়ে গেল তার মন। নির্ণয় ওদের নাচ না দেখে ফোনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওর পাশের চেয়ারেই এখন বসে আছে মিদহাদ। তাই না চাইতেও দৃষ্টি সেদিকে চলে গেল। একই ব্যাপার। মিদহাদও মেয়ে দলটার নাচ দেখছে না বরং খুব মনোযোগ দিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে পানি পান করছে আর বোতলটাকে দেখছে। পানি আবার এত মনোযোগ দিয়ে পান করার মতো কী হলো? হঠাৎ করে মিদহাদ নিবেদিতার দিকে তাকানোতে চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল নিবেদিতা। সেই সাথে বুকটাও ধড়ফড় করে উঠল। এত গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি তার! তবে মিদহাদ এক চিলতে হাসিও উপহার দিল নিবেদিতাকে। নিবেদিতা অবশ্য আমলে নিল না। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।
নাচের পর্ব শেষ হলে সবাই এবার একটু বিরতি নিয়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করল। যেই পরিমাণ মিষ্টি আজ ছোটো মামা গিলছে তাতে বেচারার যে কী হাল ভেতরে ভেতরে সেটা ভেবেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে নিবেদিতা। তার মিষ্টি একদমই পছন্দ নয়। মিষ্টিজাতীয় কোনো খাবারই মূলত সে খুব একটা পছন্দ করে না। সবাই মামাকে হলুদ দেওয়ার পর এক সময় নিবেদিতার পালাও এলো। সব কাজিনরা মিলে একই রকম শাড়ি পরেছে, সেজেছে। সে এগিয়ে গিয়ে মামাকে হলুদ লাগানোর সময় চুলগুলো মিষ্টির ওপর ঝুঁকে পড়ছিল। নির্ণয় খুব সাবধানে নিবেদিতার চুলগুলো ধরে রাখল। আবার বুকের কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল তার। এক অজানা ভালো লাগায় বুকটা ছেয়ে গেল। কোনো রকম হলুদ দিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে সেখান থেকে সরে এলো নিবেদিতা। বারংবার লুকিয়ে নির্ণয়কে দেখছিল আর মনে মনে হাসছিল।
হলুদের পর্ব শেষ হলে এবার গানের পর্ব শুরু হলো। এবার সবাই চেপে ধরেছে নিবেদিতাকে। গান গাইতে হবে তাকে। সে গান জানে সমস্যা নেই। কিন্তু এত মানুষের সামনে গান গাইতে হবে ভেবেই লজ্জায় মূর্ছা যাচ্ছে। সে অনুরোধ করল গান না গাওয়ার জন্য। কিন্তু কেউ তার অনুরোধ শুনল না। তুবা ওকে টেনে মাঝখানে নিয়ে গেল। নয়ন ওর হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ডোন্ট বি এফ্রেইড! ইউ আর মাই ব্রেইফ সিস্টার আই নো দ্যাট। সো স্টার্ট!”
সবাই নিবেদিতার নাম চিৎকার করে বলে তাকে উৎসাহিত করছিল। সে আড়চোখে একবার নির্ণয়ের দিকে তাকাল। তার মনে হলো নির্ণয়ও তাকে মাথা দুলিয়ে গান গাইতে ইশারা করল। তার পাশেই মিদহাদ বসা। তার দৃষ্টিতে শূন্যতা। ভাবলেশহীনভাবে বসে আছে। অবশেষে নিবেদিতা মনের জোর বাড়িয়ে গান গাইতে শুরু করে,
“ঠিক এমন এভাবে
তুই থেকে যা স্বভাবে,
আমি বুঝেছি ক্ষতি নেই
আর তুই ছাড়া গতি নেই।
ছুঁয়ে দে আঙুল
ফুঁটে যাবে ফুল, ভিজে যাবে গা,
কথা দেয়া থাক
গেলে যাবি চোখের বাইরে না।
ছুঁয়ে দে আঙুল
ফুঁটে যাবে ফুল, ভিজে যাবে গা,
কথা দেয়া থাক
গেলে যাবি চোখের বাইরে না।”
নিবেদিতার গান শেষ হলে পুরো অনুষ্ঠান বাড়ি যেন হাত তালিতে মুখরিত হয়ে উঠল। না চাইতেও নিবেদিতার দৃষ্টি চলে গেল নির্ণয় ও মিদহাদের দিকে। ওরা দুজনও হাসিমুখে তালি দিচ্ছিল। উপস্থিত জনতার মুখরিত তালি দেওয়া শেষ হলে নয়ন মিদহাদের গান গাওয়ার এনাউন্স করল। উপস্থিত সবাই পূর্বের ন্যায় এবার মিদহাদের নাম বলে তাকে উৎসাহ দিচ্ছিল। তবে মিদহাদকে দেখে মনে হলো সে মোটেও এই এনাউন্সের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে একই সাথে বিস্মিত ও বিরক্ত চোখে নয়নের দিকে তাকিয়ে আছে। নয়ন যেন তা থোড়াই পরোয়া করল। সে নিজে গিয়ে মিদহাদের হাত ধরে প্যান্ডেলে নিয়ে এলো। মিদহাদ এবার ফিসফিস করে বলল,
“এটা কী করলি তুই? আমি গান গাওয়ার জন্য প্রস্তুত না।”
“তুই অপ্রস্তুত গান গাইলেই দেখবি মেয়েরা ফিদা হয়ে পড়ে গেছে। প্রস্তুতি লাগবে না।”
“মেয়েদের ফিদা করার ইচ্ছে আমার নেই।”
“তা আমি জানি। কিন্তু আমি চাচ্ছি কেউ একজন তোর জন্য পাগল হোক। যাতে আন্টিকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারি। তোর জন্য একটা বাঙালি বউ আবদার করেছে আন্টি।”
“তোর কি মনে হয় বিদেশে আমি বিদেশিনী মেয়ে নিয়ে শুয়ে থাকি?”
নয়ন এবার হেসে ফেলল। উপস্থিত সবাই গান শোনার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। নয়ন বলল,
“এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলব। এখন তুই গান শুরু কর।”
মিদহাদকে অথৈ সমুদ্রে ফেলে দিয়ে নয়ন সটকে গেল। মিদহাদ কতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
“আমার আসলে গান গাওয়ার কোনো প্রস্তুতি ছিল না। নয়ন হ’ত’চ্ছা’ড়া’টা যে এভাবে ফাঁসিয়ে দেবে বুঝতে পারিনি। এখন আমার মাথাও ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। যেই গান মস্তিষ্কে আছে সেটা গাওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।”
উপস্থিত সবাই বলল,
“আপনার যেই গান ইচ্ছে শোনান। আমাদের সমস্যা নেই।”
“আমি তাহলে একটা ইংলিশ গান শোনাই। এটাই মনে আছে এখন আমার।”
সবার মাঝে আগ্রহে কিঞ্চিৎ ভাঁটা পড়ল। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই ইংলিশ গান বুঝবে না। তবুও কেউ অস্বীকৃতি জানাল না। মিদহাদ গান শুরু করল,
“You’re the light, you’re the night
You’re the colour of my blood
You’re the cure, you’re the pain,
You’re the only thing I wanna touch
Never knew that it could mean so much, so much.
You’re the fear, I don’t care
Cause I’ve never been so high,
Follow me through the dark
Let me take you past our satellites
You can see the world you brought to life, to life.
So love me like you do, la-la-love me like you do
Love me like you do, la-la-love me like you do,
Touch me like you do, ta-ta-touch me like you do
What are you waiting for?”
সবাই গানের মানে না বুঝলেও এত সুন্দর করে মিদহাদ গানটা উপস্থাপন করেছে যে সবাই মুগ্ধ হয়ে গান শুনে একযোগে করতালি দিতে লাগল। নয়ন মঞ্চে এসে বলল,
“মিদহাদের গান আপনাদের পছন্দ হয়েছে?”
সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল,
“হ্যাঁ।”
“ও কিন্তু খুব ভালো বাংলা গানও গায়।”
সবাই আবার চিৎকার করে বলল,
“আমরা শুনতে চাই।”
মিদহাদ বিড়বিড় করে বকতে লাগল নয়নকে। নয়ন সেসব আমলে না নিয়ে বলল,
“আমরা ওর গান শুনব। তবে ওকে একটা ছোট্ট বিরতি দিয়ে। এর মাঝে আমরা এখন নির্ণয় ভাইয়ার মাতোয়ারা বাঁশির সুর শুনব।”
তৎক্ষণাৎ নির্ণয়ের দিকে তাকাল নিবেদিতা। নির্ণয় ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে আছে। নয়ন যে এভাবে ধরে-বেঁধে সবাইকে বিপদের মুখে নিয়ে হাজির করবে সবার নিকট এখন যেন সব কল্পনাতীত। নিবেদিতার কেন জানি হাসি পেয়ে গেল নির্ণয়ের মুখের হাভভাব দেখে। হাসি আটকে রাখতে না পেরে হেসেও ফেলল। নয়ন এসে নির্ণয়কেও নিয়ে গেল। নির্ণয়ের অবস্থাও এখন মিদহাদের মতোই। মিদহাদ নির্ণয়ের কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিয়ে বলল,
“ভাই, শুরু করেন। মান-সম্মানের ব্যাপার। অনুষ্ঠানটা মিটে যাক। এরপর না হয় সবাই মিলে নয়নকে ধরব।”
দুর্বোধ্য হাসল নির্ণয়। সে বেশ ভালো পিয়ানো, বাঁশি, গিটার বাজানোর পাশাপাশি গানও মোটামুটি ভালো পারে। নিবেদিতার অবশ্য একবারই সৌভাগ্য হয়েছিল নির্ণয়ের গান শোনার। ভেতরের সকল জড়তা কাটিয়ে নির্ণয় ‘অনিকেত প্রান্তর’ গানের সুর বাঁশিতে তোলার সাথে সাথে উপস্থিত সবার মাঝে হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। এরপর সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল আর মাতোয়ারা হচ্ছিল। এত মিষ্টি সুর! নিবেদিতার মনে হচ্ছিল এক কঠিন কল্পনার পথে সে হারিয়ে যাচ্ছে। সুরের উৎস খুঁজতে খুঁজতে বিহ্বল হয়ে যাচ্ছে সে। সতেজতায় ভেতরের অস্থিরতা কমার বদলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এত প্রেম কেন এই সুরে, এত কেন আবেগ!
কখন যে নির্ণয়ের বাঁশি বাজানো শেষ করেছে নিবেদিতা বলতে পারবে না। সবার হাত তালির শব্দে তার কল্পনার তাঁর ছিঁড়ল। তুবা জোরে জোরে হাত তালি দিয়ে বলছে,
“নির্ণয় ভাইয়া কী অস্থির বাঁশি বাজায় রে নিবু!”
নিবেদিতা বিগলিত হাসল। এবার এলো মিদহাদের গান গাওয়ার পালা। তবে এবার সে একা নয়। তার সঙ্গে নয়ন আর নির্ণয়ও থাকবে। নির্ণয় বাঁশি বাজাবে, নয়ন গিটার বাজাবে আর মিদহাদ গান গাইবে। এখন সবার আগ্রহ তিনগুণ বেড়ে গেছে। সবাই একত্রে শুরু করল। মিদহাদও গান গাইতে শুরু করেছে,
“একটা ছিল সোনার কন্যা, মেঘবরণ কেশ
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ,
দুই চোখে তার আহা রে কি মায়া
নদীর জলে পড়লো কন্যার ছায়া।
তাহার কথা বলি
তাহার কথা বলতে বলতে নাও দৌড়াইয়া চলি
তাহার কথা বলি,
তাহার কথা বলতে বলতে নাও দৌড়াইয়া চলি
কন্যার চিড়ল-বিরল চুল
তাহার কেশে জবা ফুল
কন্যার চিড়ল-বিরল চুল,
তাহার কেশে জবা ফুল
সেই ফুল পানিতে ফেইলা
কন্যা করলো ভুল।
কন্যা ভুল করিস না
ও কন্যা ভুল করিস না
আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলবো না।
একটা ছিল সোনার কন্যা, মেঘবরণ কেশ
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ,
দুই চোখে তার আহা রে কি মায়া
নদীর জলে পড়লো কন্যার ছায়া।”
একটু আগেই যে এই লোকটাই ইংলিশ গান গেয়েছে বিশ্বাসই হচ্ছে না। এত ভালো বাংলা গান জানার পরও কেন আগে গায়নি সেটাই ভাবছে সবাই। নয়নের কথামতো আর কোন কোন মেয়ে ফিদা হয়েছে না জানলেও তুবার উন্মাদনা দৃষ্টি এড়িয়ে গেল না নিবেদিতার। তুবা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
“আমি তো পুরো পাগল হয়ে যাব রে নিবু! এই ছেলেটা যেমন কিউট তেমন তার গুন!”
নিবেদিতা তুবার সম্পূর্ণ আগ্রহে এক বালতি স্বচ্ছ পানি ঢেলে দিয়ে বলল,
“আর তুই হলি একটা বেগুন।”
চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাল তুবা। গম্ভীরকণ্ঠে বলল,
“সবসময় তুই আমার সাথে এমন করিস। তোর কি ইচ্ছে হয় না এমন সুন্দর একটা ছেলে তোর দুলাভাই হোক?”
“আরে বাপরে! তুই এতকিছু ভেবে ফেলেছিস?”
“আরে ভাবতে তো আর টাকা লাগে না!”
“এত ভাবাভাবি বাদ দিয়ে তাকে গিয়েই বরং তোর সুরেলা কণ্ঠে বল,’ওগো আমার সুন্দর পুরুষ একখান কথা শোনো, তুমি ছাড়া আমার যে নাই গতি কোনো।’ দেখবি গান শুনেই তোর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া শুরু করেছে।”
তুবা হেসে ফেলল। পাশে যে কখন এসে মিদহাদ দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি দুজনের কেউ। নিবেদিতার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
“সেই সুন্দর পুরুষটা কি আমি?”
নিবেদিতা থতমত খেয়ে পাশে তাকাল। মিদহাদের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। সে নিজেকে সামলো নিয়ে বলল,
“আমি গান গাচ্ছিলাম।”
“তাই নাকি? আমি যে শেষে প্রেমে পড়ার কথা শুনলাম? এত জলদিই প্রেমে পড়ে গেলে?”
“কী আজব! আমি কেন প্রেমে পড়ব? তুবা প্রেমে পড়েছে।”
তুবা নিজেও গেল হকচকিয়ে। গা বাঁচাতে বলল,
“খবরদার! মিথ্যা বলবি না।”
নিবেদিতা আগুন-গরম দৃষ্টিতে তাকাল তুবার দিকে। মিদহাদ এবার অন্যদিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসল।
.
রাত প্রায় একটা পর্যন্ত গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান চলল। সবাই এখন ক্লান্ত। ছেলেরা প্যান্ডেলের কাজ গুছিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। বাকিরাও ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নিবেদিতা ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পানি পান করতে গিয়ে দেখল টেবিলের ওপর বোতল সম্পূর্ণ ফাঁকা। অথচ কিছুক্ষণ আগেই সে বোতল ভরে এনে রেখেছিল।
“পানি কে খেয়েছিস?” জানতে চাইল তুবা।
এক রুমে নিবেদিতা, তুবা, রিনিকা, মীম ও হাসির ঘুমানোর জায়গা করা হয়েছে খাটে। নিচে শুয়েছে চাচি, মামিরা। পুরো বাড়ি মেহমানে ভরতি। খাটে, ফ্লোরে মানুষ গিজগিজ করছে। বাড়ির তরুণ ছেলেরা তো জায়গা না পেয়ে ছাদে বিছানা করেছে ঘুমানোর জন্য। অবশ্য ঘুমানোই শুধু মূখ্য উদ্দেশ্য নয়। এতদিন পর ভাই-ব্রাদার সকলে একত্রিত হয়েছে তাই রাত জেগে আড্ডা দেওয়ার জন্য ছাদের চেয়ে উপযুক্ত স্থান তো আর হয় না।
তুবার চোখে-মুখে প্রচন্ড ঘুম। পানি সে-ই পান করেছে। কিন্তু ভয়ে স্বীকার করল না। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“হাসি আর মীম খেয়েছে।”
“ওরা আরো আগেই ঘুমিয়ে গেছে। আমি পানি আনার আগেই।”
“তাই নাকি? তাহলে মনে হয় রিনিকা খেয়েছে।”
রিনিকা সঙ্গে সঙ্গে খেঁকিয়ে উঠে বলল,
“মিথ্যা বলো কেন আপু? পানি তো তুমি খেয়েছ।”
নিচ থেকে মামি ধমক দিয়ে উঠলেন,
“আহা! রাত-বিরাতে কী শুরু করলি তোরা? পানি খেলে খেয়েছে। যে-ই খাক। বাড়িতে কি পানির অভাব?”
নিবেদিতা রাগী চোখে তাকাল তুবার দিকে। তুবা উড়ন্ত চুমু দিয়ে বলল,
“রাগ করে না লক্ষ্মী। কালকে আমি তোকে পানি এনে খাওয়াব যা। এখন কষ্ট করে পানি নিয়ে আয়।”
নিবেদিতার মেজাজ খারাপ হলেও কিছু বলল না। রান্নাঘরে গেল পানি আনতে। ফিল্টারে পানিও নেই। ফ্রিজ খোলার সাথে সাথে কারেন্ট চলে গেল। আরো এক ধাপ মেজাজ খারাপ হলো তার। অন্ধকারে ফ্রিজের ভেতর হাত দিয়েও পানির বোতল আন্দাজে কোথাও খুঁজে পেল না। উলটো কোন খাবারের মধ্যে যেন হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। রাগে গজগজ করতে করতে সে অন্ধকারেই কিচেনে হাত ধুচ্ছিল আর মনে মনে তুবার পি’ণ্ডি চটকাচ্ছিল। রান্নাঘরের জানালার কাচ গলে হালকা মৃদু আলো আসছিল। সেই সাথে ঝিঁঝিঁপোকার ডাকও শুনতে পাচ্ছিল সে। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দও নেই। সবাই বোধ হয় ইতোমধ্যে ঘুমিয়েও পড়েছে। পানি খাওয়ার আশা ত্যাগ করে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বাহির থেকে অনেকগুলো কুকুরের একসাথে চিৎকার শুনে ভয়ে কেঁপে উঠল নিবেদিতা। তার মনে হচ্ছিল যেন কুকুরগুলো বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে আসছে। ভয়ে দৌঁড়াতে গিয়ে অন্ধকারে ড্রয়িংরুমে মানব অবয়ব দেখে আগ-পিছু না ভেবেই শক্ত করে প্রথমে হাত জড়িয়ে ধরল। কুকুরের চিৎকারের শব্দ বাড়লে এবার সে অবয়বটিকেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মনে মনে দোয়া-দুরুদ পড়তে লাগল।
অবয়বটি নিবেদিতাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
“নিবেদিতা! কী হয়েছে? শান্ত হও!”
কণ্ঠ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল নিবেদিতা। নির্ণয়! বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হচ্ছে। একই সাথে দুই ভয় যেন জেঁকে ধরেছে তাকে। কী অদ্ভুত! তখনো সে নির্ণয়কে শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। অদূরে ছাদ-সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেউ একজন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। সেই মুহূর্তে কারেন্ট চলে এলে নির্ণয়ের থেকে কিছুটা দূরে পেছনে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মিদহাদকে। সঙ্গে সঙ্গে সিটকে দূরে সরে গেল নিবেদিতা।
চলবে…
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]