#নিবেদিতা
#পর্ব_৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
এক সপ্তাহ্ পার হয়ে গিয়েছে। এর মাঝে নির্ণয় আর ফোন করেনি। নিবেদিতারও সাহস হয়নি ফোন করে কিছু জিজ্ঞেস করার। তবে নির্ণয় যে এতটা প্রতিক্রিয়াহীন থাকবে সেটাও আশা করেনি সে। সত্যি বলতে যে এভাবে ভালোবাসার কথা বলে ফেলবে সেটা তো সে নিজেও জানত না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে গেল নিবেদিতা। প্রতিদিন তার এভাবেই কাটে। কখনো শুয়ে থাকে তো, কখনো ফেসবুকে নিউজফিড স্ক্রল করে। বেশিরভাগ সময় সে নির্ণয়ের আইডিতেই ঘুরাঘুরি করে। আজও ঘুম থেকে উঠেই সে ফেসবুকে গিয়ে নির্ণয়ের আইডিতে ঢুকল। গতকাল রাতে একটা ছবি আপলোড করেছে সে। ঘুমিয়ে পড়ার জন্য ছবিটা আজ দেখল নিবেদিতা। স্বভাববশত কমেন্ট চেক করতে গিয়ে আজ অনেক মেয়ের কমেন্টের মাঝে একটা মেয়ের নাম খুব সহজেই চোখে আটকে গেল নিবেদিতার। ‘সুখী হাওলাদার’ নামটার ওপর ক্লিক করল সে। আইডি লক করা। কিন্তু ছবিটুকু দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা সে-ই সুখী। এতদিন তো তার কমেন্ট দেখা যায়নি। তার মানে ওরা রিসেন্ট ফেসবুকে এড হয়েছে। সুখীর আইডি থেকে আবার নির্ণয়ের আইডিতে এসে সুখীর কমেন্টটি দেখতে গিয়ে দেখল নির্ণয় কমেন্টের রিপলাই দিয়েছে দুটো লাভ ইমুজি। আর কোনো মেয়েকে কোনো রিপ্লাই দেয়নি। জাস্ট সুখীকেই দিল। তাও সকাল সকাল অনলাইনে এসেই! নিবেদিতা না চাইতেও ওভার থিংকিং করা শুরু করে। বুকের ভেতর আবার ব্যথা করছে। প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে। মস্তিষ্কে বিচরণ করছে শুধু একটাই কথা, ‘নির্ণয় তোর না’। কথাটি সত্য হলেও মানতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সেই সাথে একটা চাপা রাগ, জেদও মনে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। শোয়া থেকে উঠে সে কিছুক্ষণ বসে রইল। তার দুচোখ বেয়ে আপনা-আপনি পানি পড়ছে। যারা বলে এক তরফা ভালোবাসায় কোনো কষ্ট নেই, তাদের জন্য নিবেদিতা উত্তম উদাহরণ। ভালোবাসার অপর নামটাই হচ্ছে কষ্ট। কাউকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস দেখালে কষ্টও হাসিমুখে মেনে নিতে হবে।
চোখের পানি মুছে হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তার রুমে গেল সে। বাবা, রাকিব, নয়নও নাস্তা করছিল।
“কীরে নবাবজাদি, আজ এত সকালে উঠেছিস কেন?”
নয়নের পিঞ্চ মারা কথায় নিবেদিতা কিছু বলল না। তার মাঝে এখন আর সেই আগের মতো চঞ্চলতাটুকু নেই। নাসিমা বেগম বললেন,
“বোস। খাবার দিচ্ছি।”
নিবেদিতা বসে বলল,
“আব্বু, কিছু কথা ছিল।”
রতন আহমেদ খেতে খেতে বললেন,
“হ্যাঁ, বল।”
“তোমার কাছে যদি আমি কিছু চাই তাহলে দেবে?”
খাওয়া বাদ দিয়ে সবাই এখন নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সবার চোখেই নিবেদিতার হঠাৎ পরিবর্তন ধরা পড়েছে এবং সবার ধারণা সেই পরিবর্তনের কারণ নিবেদিতার পাবলিকে চান্স না পাওয়াটা। এটা নিয়ে তাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মেয়ের মন খারাপ দেখলে তাদেরও খারাপ লাগে। আবার এই বিষয় নিয়ে কথা বলে মেয়েকে তারা কষ্টও দিতে চায় না। তাই কিছুদিন নিজের মতো করে থাকতে দিয়েছিল। এখন হঠাৎ আবদারের কথা শুনে একটু অবাকই হলো সবাই। রতন আহমেদ বললেন,
“অবশ্যই মা। আমার সাধ্যে থাকলে চাঁদও আমি তোকে এনে দেবো।”
“আমি আইইএলটিএস (IELTS) দিতে চাই।”
সবার চোখে-মুখে বিস্ময়। নয়ন বলল,
“কেন? এখনো তো গুচ্ছতে পরীক্ষা বাকি আছে। এখানে যদি না হয় তাহলে তোকে ভালো কোনো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেবো।”
নিবেদিতা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“আমি দেশে পড়তে চাই না।”
“দেশের বাইরে পড়তে চাস?” জিজ্ঞেস করলেন রতন আহমেদ।
নিবেদিতা বলল,
“হ্যাঁ, যদি আমাকে পড়ানোর মতো সামর্থ্য হয় তোমাদের।”
নাসিমা বেগম ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললেন,
“অসম্ভব! টাকা-পয়সা তো পরের ব্যাপার। তুই একা সার্ভাইভ করবি কীভাবে? ভিনদেশে আমি তোকে পড়তে যেতে দিতে পারব না।”
নিবেদিতা এবার ক্রন্দনরত স্বরে বলল,
“আমার এখানে কষ্ট হয় মা!”
সবাই চুপ করে আছে। নয়ন বলল,
“পাবলিকে চান্স না পেলে এতটা ভেঙে পড়তে হয়? তুই না আমার স্ট্রং বোন?”
নিবেদিতা এবার কেঁদেই ফেলল। বলল,
“আমি এখানে থাকতে চাই না ভাইয়া!”
রতন আহমেদ বললেন,
“বেশ! তুই যেভাবে চাস ঐভাবেই হবে। তোর সুখেই আমাদের সুখ। জীবনে অনেক বড়ো হ, সফল হ এটাই চাই আমি। টাকা-পয়সা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তোর দাদার জমিজমা কম পাইনি। তাছাড়া তোর বাবারও কম নেই। তুই আমার একমাত্র মেয়ে। তোর একটু হাসির জন্য আমার জীবনটাও আমি হাসিমুখে দিয়ে দিতে পারি।”
এরপর তিনি বড়ো ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“মিদহাদ কি চলে গেছে?”
“না।”
“তাহলে ওর সাথে কথা বল। কোথায় ভালো IELTS এর কোর্স করায় খোঁজ নিয়ে ওকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আয়।”
“ঠিক আছে।”
রতন আহমেদ নিবেদিতাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোর খালার বাসায় থেকে কোচিং করবি?”
নিবেদিতা চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
“না। হোস্টেলে থাকব। আত্মীয়দের বাসায় থাকলে নিজের মতো পড়তে পারব না।”
“ঠিক আছে।”
নাসিমা বেগম কিছুটা বিরক্ত হলেন স্বামীর ওপর। মেয়ে হুট করে একটা আবদার করল আর তাকেও রাজি হয়ে যেতে হলো? একটাবার এটা ভাবল না যে মেয়েটাকে দূরে রেখে তারা কীভাবে থাকবে! আর মেয়ের মাথাতেই যে কীভাবে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ভূত মাথায় ঢুকল বুঝতে পারছেন না তিনি!
.
.
পরেরদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিবেদিতাকে নিয়ে মিদহাদের বাসায় গেল নয়ন। বাড়িতে শুধু কেয়ারটেকার, তার স্ত্রী এবং তাদের ছোটো একটা মেয়ে ছাড়া কেউ নেই। ওর পরিবার লন্ডনে। বাংলোর মতো একটা সাজানো-গোছানো বাড়ি। বাড়ির অধিকাংশ জায়গাজুড়ে শুধু গাছপালা। বিভিন্ন রকমের গাছ আছে এখানে। ফল, ফুল, শাক-সবজি সব। এত এত ফুলগাছ দেখে মন ভালো হয়ে গেল নিবেদিতার। অনেক ফুলের নামও জানে না সে।
“নিবু?”
নিবেদিতা ফুল গাছগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। নয়নের ডাকে নড়েচড়ে উঠল। নয়ন বলল,
“ভেতরে চল।”
“হু।”
কেয়ারটেকার ওদেরকে ভেতরে নিয়ে বসতে দিল। মিনিট দুয়েক বাদেই মিদহাদ এলো ড্রয়িংরুমে। চোখমুখ ফুলে আছে। নয়ন ঘড়ি দেখে বলল,
“শালা বেলা বাজে বারোটা! আর তুই এখনো ঘুমাস?”
মিদহাদ হেসে বলল,
“এমনিতে তো আমি তিনটায় উঠি। আজ তো আর্লিই উঠলাম।”
এরপর নিবেদিতাকে জিজ্ঞেস করল,
“ভালো আছো?”
নিবেদিতা উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল। এর মাঝে বুয়া এসে নাস্তা দিয়ে গেল। মিদহাদ জিজ্ঞেস করল,
“রান্না কতদূর খালা?”
“আর বেশিক্ষণ লাগব না।”
“আচ্ছা, যান।”
মিদহাদ চা পান করতে করতে নিবেদিতাকে জিজ্ঞেস করল,
“হঠাৎ বাইরের দেশে পড়ার ইচ্ছে হলো কেন?”
নিবেদিতা মুখ গম্ভীর করে বলল,
“ইচ্ছে না। ড্রিম।”
“ওহ আচ্ছা। এটা ভালো।”
নয়ন বলল,
“খোঁজ নিয়েছিলি?”
মিদহাদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ।”
“আর হোস্টেলের ব্যাপারটা?”
“ওটাও ডান। আশা করি নিবেদিতার কোনো অসুবিধা হবে না। আমার কাজিনও পাশের হোস্টেলে আছে। কোনো সমস্যা হলে ও নিবেদিতার দেখভাল করবে।”
নয়ন খুশি হয়ে বলল,
“ভাগ্যিস তুই এখন দেশে ছিলি ভাই! নয়তো এখন এসব করতে গিয়ে আমায় যে কত ঝামেলা পোহাতে হতো!”
মিদহাদ মৃদু হাসল। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিবেদিতাকে দেখছে একটু পরপর। গতকাল নয়ন যখন নিবেদিতার বাইরে পড়তে যাওয়ার কথা বলল তখনই ওর কেন জানি মনে হয়েছিল নিবেদিতা ভালো নেই। সবাই যদিও এই ভালো না থাকার পেছনে ওর পাবলিকে চান্স না পাওয়ার বিষয়টাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, কিন্তু মিদহাদ জানে এখানে কাহিনি ভিন্ন কিছু। তবে এটা নিয়ে সে নয়ন কিংবা নিবেদিতা কাউকেই ঘাঁটাতে চায়নি। উপরন্তু বন্ধুকে সাহায্য করা এবং নিবেদিতার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে সে এক রাতের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
নয়ন বলল,
“কোন দেশে গেলে ভালো হয় বল তো?”
মিদহাদ বলল,
“ঐটা ডিপেন্ড করে এখন নিবেদিতা কোন কান্ট্রিতে পড়তে চাচ্ছে।”
নিবেদিতা বলল,
“দেখি। আগে IELTS শেষ করি।”
“তুমি চাইলে লন্ডনেও পড়তে পারো। সেখানে আমি তোমাকে হেল্প করতে পারব।”
নয়ন বলল,
“হ্যাঁ, আমরাও তাহলে একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারব।”
নিবেদিতা আর কিছু বলল না এই বিষয়ে। দুপুরের খাবার খেয়ে ওরা IELTS এর একাডেমিতে গিয়ে ভর্তির কার্যক্রম সব সম্পন্ন করে গেল হোস্টেল দেখতে। হোস্টেলের পরিবেশ বেশ সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নিবেদিতার পছন্দ হয়েছে এবং মনে মনে সে এজন্য মিদহাদকে ধন্যবাদও দিল। কেননা এত অল্প সময়ে ভালো হোস্টেল খুঁজে বের করা নয়নের জন্য আসলেই কষ্টকর হয়ে যেত।
সব কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ওদের সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নিবেদিতা আর নয়ন আজ রাতটা মিদহাদের বাড়িতেই থাকবে। কাল সকালে আবার গ্রামে চলে যাবে। নয়ন ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। নিবেদিতা ড্রয়িংরুমে পানি খেতে এসে দেখল মিদহাদ সোফায় বসে আছে। নিবেদিতাকে দেখে ডেকে বলল,
“শোনো?”
নিবেদিতা পানি পান করে এগিয়ে গেল। মিদহাদ বলল,
“বসো।”
নিবেদিতা পাশের সোফায় বসে বলল,
“কিছু বলবেন?”
“হু। দেশ ছাড়তে চাইছ নির্ণয়ের জন্য?”
নিবেদিতা ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। মিদহাদ অভয় দিয়ে বলল,
“ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি কাউকে কিছু বলব না। তোমাকে আমি সেদিন বলেছিলাম, তুমি প্রেমে পড়েছ। কার প্রেমে পড়েছ সেটাও আমি জানতাম কিন্তু বলিনি। আজ বলছি। বলো তো কেন?”
নিবেদিতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিদহাদ বলল,
“কারণ তুমি খুব লাকি।”
নিবেদিতার ভ্রু কুঁচকে গেল আপনা-আপনি। সে লাকি? কথাটা ভীষণ হাস্যকর লাগল তার নিকট। তবে হাসল না। বলল,
“কেন এমন মনে হলো?”
“এইযে তুমি ভালোবাসার মানুষটাকে পাবে না বলে রাগে হোক বা অভিমানে হোক দেশ ছাড়তে পারছ। তার দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতে পারছ। এটা কিন্তু সবাই পারে না। সবার সেই সামর্থ্যটা নেই। তোমার আছে। তোমার বাবার সেই সামর্থ্যটা আছে তোমাকে বাইরে পড়ানোর। এখন কথা হলো, যেই রাগ-অভিমানের জের ধরে তুমি বাইরের কান্ট্রিতে পড়তে চাচ্ছ সেটা শেষ পর্যন্ত থাকবে তো? নাকি পরে সেটা আফসোসে পরিণত হতে পারে?”
“কীসের আফসোস?”
“তোমার মনে হতে পারে যে ঝোঁকের বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। দেশ ছেড়ে ভুল করেছ।”
“আমি ঝোঁকের বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনাকে এটা কে বলল?”
“তোমার চোখ!”
নিবেদিতা থমকে গেল। মিদহাদ বলল,
“তোমার চোখে গভীরভাবে তাকালে যে কেউই বুঝতে পারবে হয়তো। যদি সে বুঝতে চায়!”
“আমি ভেবে-চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখানে আমার কোনো ফিউচার নেই।”
“অন্য দেশে তোমার ফিউচার ব্রাইট হবে এতটা শিওর তুমি কীভাবে হচ্ছ?”
নিবেদিতার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে রেগে গিয়ে বলল,
“আপনার সমস্যাটা কী? কী চান আপনি? আমার দেশের বাইরে যাওয়া নিয়ে আপনার এত মাথা ব্যথা কেন আমি বুঝতেছি না! আর শোনেন, আমি যে ঝোঁকের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি এবং আফসোস যে আমি করব না সেটাও আমি আপনাকে প্রমাণ করে দেবো।”
নিবেদিতা উঠে চলে যাচ্ছিল। মিদহাদ পেছন থেকে ডেকে বলল,
“প্রাণ, আমাকে ভুল বুঝো না! আমি সত্যিই চাই তুমি সবসময় ভালো থাকো। প্রাণোচ্ছল থাকো।”
নিবেদিতা শুনল সব, তবে বলল না কিছু না। চুপচাপ রুমে চলে গেল। মিদহাদ ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিল।
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]