কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী লেখনীতে: নবনীতা শেখ |পর্ব ৭|

0
156

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৭|

সন্ধ্যের পরপরই বাসায় চলে এসেছি। ভীষণ চিল মুডে আছি। সাথে খুব হাসিও পাচ্ছে। এখন ঐ মেয়েটা যদি পোস্টটি দেখে ফেলে, তো ব্রেকআপ! আহা! শান্তি, শান্তি! ব্রেকআপ যে কারোর শান্তির কারণ হতে পারে, তা এতদিনে বুঝলাম।

পড়ার টেবিলে বসে বইয়ে মুখ গুঁজে এসব ভাবছিলাম। জীবন কেমন অদ্ভুত! সকালের আনন্দে আত্মহারা মনটা দুপুর হতে না হতেই ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যায়। তবে তা সরতেও সময় লাগে না! এই যে! আমাকেই দ্যাখো!
তৎক্ষনাৎ মাথায় এলো, কুঞ্জ ভাই কি পোস্টটি দেখেছেন? তবে ওঁর প্রতিক্রিয়া কী? রেগে আছেন? না কি বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কে ভেবে চলেছেন, ‘হলোটা কী?’
কথা সেটা না। কথা হচ্ছে, যদি বুঝে ফেলেন কাজটা আমার, তবে?
বিষয়টা ভেবেই আমার উজ্জ্বল মুখখানা পেঁচার মতো হয়ে গেল। নিজেকে সান্ত্বনা দেবার উদ্দেশ্যে শব্দ করেই বলে উঠলাম, “না, না! তা হবে কেন? কীভাবে বুঝবেন! আর বুঝলেই বা কী? ভয় পাই নাকি ওঁকে?”

এতে যেন আমার ভেতরের সত্তা আমাকে ব্যাঙ্গ করে বলে উঠল, “সিরিয়াসলি, নবু? ভয় পাস না?”

আমি মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে বললাম, “না। কেন পাব? হু ইজ হি?”

সে আবারও বলল, “তবে যে তোর কুঞ্জ ভাইয়ের কড়া চাহনিতে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যাস! সে বেলায়?”

আমি আবারও বললাম, “হুটস! পাগল দেখলে মানুষ ওরকম একটু-আধটু সবাই করে।”

“তুই তোর কুঞ্জ ভাইকে পাগল বললি? বলতে পারলি?”

আমি ব্যাপারটা একটু অবজ্ঞা করেই বললাম, “কী ‘তোর কুঞ্জ ভাই’, ‘তোর কুঞ্জ ভাই’ লাগিয়ে রেখেছিস? সে আমার কবে হলো?”

“তাহলে তাঁর জন্য এসব আজেবাজে পোস্ট করছিস কেন?”

“ও এমনিই।”

“সে যাই বলিস…”

“ধুর ছাই! বিদেয় হ।”

মস্তিষ্কের সাথে মনের তর্ক থেকে বাঁচার জন্য পাশ থেকে ফোন হাতে তুলে ফেসবুক ওপেন করলাম। নিউজ ফিড স্ক্রল করতে করতেই আজকের সেই পোস্টটি সামনে এলো। অনেকগুলো কমেন্ট এসেছে। বেশ ধীরে সুস্থে কমেন্টগুলো পড়তে শুরু করলাম। অধিকাংশ কমেন্টে এই ছিল, ‘ডেয়ার নাকি, ভাইয়া?’
এটা দেখে আমার পেট ফেটে হাসির উপক্রম। মানে, সবাই মনে করে কী? কিছু উলোট-পালট কাহিনি মানেই ডেয়ার?
আর কিছু সংখ্যক কমেন্ট এসেছে, ‘কংগ্রাচুলেশন।’

এসব কমেন্ট পড়তে পড়তেই আমার ফোনে একটা আননৌন নম্বর থেকে কল এলো। আমি ভাবতে লাগলাম, এটা কে? পরিচিত কেউ!
ভেবেও যখন কিছু পেলাম না, তখন আমি কল রিসিভ করার জন্য উদ্যত হলাম। ওমনিই কল কেটে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে একটা মেসেজ এলো, “আচ্ছা!”

আমি কিছুক্ষন হা হয়ে তাকিয়ে ভাবলাম, “কী আচ্ছা? আর উনি কে?”

হয়তো রং নম্বর হবে। তাই আর মাথা ঘামালাম না। আমার ফোনে তেমন কারোর কল আসে না। এলেও রং নম্বর। তাই ফোন রেখে আবারও পড়তে বসলাম। ঘণ্টাখানেক পরেই আবারও আমার নম্বরে কল এলো। হাতে নিয়ে দেখলাম, আমার ফ্রেন্ড নৌশি কল দিয়েছে।

রিসিভ করেই বললাম, “তোকেই কল দিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ভুলে গেছিলাম। শোন! শীলা ম্যাম তো কাল থেকে আবারও কলেজে জয়েন করবেন। ভুলে গেছিলাম, ম্যামের ছুটি শেষ। এতদিন রাকিব স্যার ক্লাস করিয়েছেন, পড়ে না গেলেও কিচ্ছুটি বলেননি। তাই বায়োলজি সেকেন্ড পেপারের লাস্ট ক্লাসেও অমনোযোগী ছিলাম। কিন্তু… শীলা ম্যাম! ফটাফট নোটসগুলো আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ কর তো!”

নৌশি অস্থির চিত্তে বলল, “ছাড় ওগুলো। এটা বল, কে তোকে প্রপোজ করল?”

মুহূর্তেই যেন আমার মস্তিষ্কে ছোটো-খাটো একটা বিস্ফোরণ ঘটল। তাজ্জব বনে গেলাম আমি। প্রপোজ! কে করবে আমাকে? কার এত সাহস? আমাকে যারা চেনে, তারা ভুলেও আমাকে প্রপোজ করার দুঃসাহস দেখাবে না। কেননা আমি সোজা থাপ্পড় মেরে দিই। আর হাড়গোড় ভাঙার জন্য তো কুঞ্জ ভাই আছেনই!

ব্যাপারটা বেশ ঘোলাটে। আরও পরিষ্কার করার জন্য নৌশিকে বললাম, “কী পাগলের মতো যা-তা বলছিস? কে প্রপোজ করবে?”

নৌশি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আরে, শালি! নিজের টাইমলাইন দ্যাখ!”

কথাটা বলেই কল কেটে দিল নৌশি। আমি কিছুক্ষণ হতভম্বের ন্যায় বসে রইলাম। মিনিট পাঁচেক অতিক্রম করতেই তড়িঘড়ি করে ফেসবুক ওপেন করলাম। নিজের টাইমলাইনের লাস্ট পোস্টটি দেখতেই আমি বিস্ময়ে হতবাক। কুঞ্জ ভাইয়ের টাইমলাইনে করা সেই ফেইক চ্যাটটিই আমার টাইমলাইনে পোস্টেড।
ক্যাপশনে লেখা, “ফাইনালি, হি প্রপোজড মি!”

কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলাম। এটা কী হলো? প্রচুর কমেন্টস আসছে, সাথে মেসেঞ্জারেও অনেকেই জিজ্ঞেস করছে। এটা কে করেছে তা বুঝতে আমার মোটেও বেগ পোহাতে হলো না। আবারও সেই নম্বর থেকে দুটো দাঁত কেলানো ইমোজি মেসেজ এলো।

পরপরই আমি দাঁতে দাঁত চেপে গর্জন করে উঠলাম, “কুউউউঞ্জ ভাইইই!”

_____________
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে আরেক বায়না জুড়ে বসলাম, আলাদা ঘুমনোর। কিন্তু আপি মানছেই না। আচ্ছা! আমি বড়ো হয়েছি তো! আলাদা ঘুমোলে সমস্যাটা কোন জায়গায়? আমাকে কি এরা এখনও বাচ্চা পেয়েছে?

আবারও আপিকে বললাম, “এক রাতই তো!”

আপি সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “পারবি না তুই।”

“পারব, পারব। গেলাম আমি।”

“একদমই না। পরে মাঝরাতে এসে জ্বালাবি। এর আগেও করেছিস। তা হবে না। চুপচাপ এখানেই শুয়ে পড়।”

আমি এবার চটে গেলাম, “বড়ো হয়ে গেছি আমি। ভয় পাই না একা থাকতে।”
তারপর একটু শান্ত গলায়ই বললাম, “ওওও আপিইই! যাই না?”

আপি নির্বিকার ভঙ্গিতে শুধু বলল, “না।”

আমি বিছানায় এসে বসলাম। আমি অন্ধকারে ভয় পাই। মূলত পাশে কেউ না থাকলেই ভয়টা পাই। এজন্য ছোটো থেকে আমাকে কখনো আলাদা থাকতে দেওয়া হয়নি। যদিও বা বায়না করেছি অনেক। থাকতে গিয়েও পারিনি। একা শুলেই মনে হয়, কেউ আমার পায়ের কাছে বসে আছে। তার নিঃশ্বাস আমার পায়ে পড়ছে। কিংবা খাটের নিচে কেউ বসে বসে গোঙাচ্ছে। মাঝে মাঝে অন্ধকার রুমে উজ্জ্বল চোখও দেখতে পাই। এগুলো অবশ্যই আমার অবচেতন মনের ভ্রম বৈ অন্য কিছু নয়।
মানুষ যখন কোনো কিছু নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকে কিংবা ভয় পায়, তখন এরকম অনেক কিছুই দেখে।
আমিও তাই দেখতাম। মনে করতাম, ভূতগুলো আমাকে খেয়ে ফেলবে। সেবার তো ঘটল এক বাজে ঘটনা।
মাঝরাতে একা শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছিলাম। তখন মনে হলো কেউ আমার পাশে শুয়ে আছে, আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমার আর পাশের এই বস্তুটিকে দেখার ইচ্ছে কিংবা সাহস, কোনোটাই জাগেনি।
গায়ের কাঁথা যেভাবে ছিল, সেভাবেই নিয়ে উঠে আপির রুমে চলে এসেছিলাম। আপি দরজা খুলেই রেখেছিল। এসে দেখি আপি বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। গায়ের কাঁথাটা মেঝের সাথে এমনভাবে লেপ্টে ছিল, যে-কোনো সময় আমি পড়ে যেতে পারতাম। তাই সেটা ভালো করে নিজের সাথে পেঁচিয়ে নিয়েছিলাম। তারপর আপিকে সুন্দর মতো ডাকা আরম্ভ করলাম। আপি জাগ্রত হয়ে আমাকে নিজের সামনে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেবার যা ভয় পেয়েছিল! মোটে এক সপ্তাহে জ্বর মাখিয়ে বিছানায় পড়ে ছিল। এরপর থেকে আমাকে আর একা থাকতে দেওয়া হয় না।

আমি বিছানার উপর মন খারাপ করে বসে আছি। আপিকে কি আরেকবার জিজ্ঞেস করব? যদি মেনে যায়? লাস্ট ট্রাই!

মন খারাপের ভান করে বললাম, “জীবনে কি শখ-আহ্লাদ থাকতে পারে না, আপি?”

আপি ফোন ঘাটছিল। আমার কথা শুনে ফোন থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তা থাকবে না কেন?”

“আমারও একা ঘুমনোর শখ জেগেছে। এখন কি এই শখটাকে হিরো আলমের গানের মতো অ্যাভয়েড করব?”

আমি ছলছল নেত্রে আপির দিকে তাকিয়ে একথা বললাম। আপি বড্ড অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল। কেন যেন মনে হচ্ছে, এতে কাজ হলো!

আপি কিছুক্ষণ ভেবে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল, “যা। তবে সকালের আগে আর এমুখো হবি না।”

আহা! খুশি এবার আমি। অধর কোণে হাসি ছড়িয়ে বললাম, “ওকে! ওকে! ডান!”

নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে কুঞ্জ ভাইয়ের রুমে চলে গেলাম। সন্ধ্যেতে নিজের টাইমলাইনের ওমন পোস্টের কারণে যেই বিস্ময়টা আমাকে জেঁকে ধরেছিল, তা কাটাতে আমার বেশ সময় লেগেছিল। আর কাটানোর পরপরই যেভাবে হাসি শুরু হয়েছিল, তা যেন থামার নামই নিচ্ছিল না। আর যাই হোক! রিভেঞ্জটা দারুণ ছিল। পোস্টটি আর ডিলিট করিনি। ইচ্ছে করেনি। একটা ভ্রান্তি হিসেবেই হোক, তাঁর প্রপোজালই তো ছিল!
তাছাড়া ডিলিট করার প্রয়োজনও নেই। আমার অ্যাকাউন্টে তো আর তাঁর মতো চৌদ্দ গোষ্ঠীর বসত নেই। সবগুলো ব্লক লিস্টে আরাম-আয়েশ করছে।

ভাবতে ভাবতে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। রুমে ঢুকে আর লাইট অন করলাম না। দরজা ভিড়িয়ে দিয়েই রুমের মাঝবরাবর চলে এলাম। বুক ভরে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিলাম। আজ সকালেও কুঞ্জ ভাই এই রুমে ছিলেন! এখনও তাঁর পারফিউমের স্মেল এখানে মিশে আছে। বড্ড প্রিয় এই স্মেলটা! ফোনটা বেডসাইড টেবিলে রেখেই বিছানার উপর গা এলিয়ে দিলাম।

ইশ! মনে হচ্ছে যেন আমি কুঞ্জ ভাইয়ের সাথেই আছি। আমি আর কুঞ্জ ভাই! একা রুমে! উফফ! ভাবতেই আমার ফুলকো গালদুটো সিঁদুর লাল বর্ণ ধারণ করল। নিজের এমন কুরুচিপূর্ণ ভাবনার উপর ছিঃ ছিঃ করতে লাগলাম। সোজা হয়ে শুতেই বাম হাত গেল বিছানার মধ্যাংশে। হাতের নিচের অংশটা বিছানার চাদরের মতো মসৃণ নয়। অন্য কিছুর আভাস পেতেই বুঝলাম, পাশেই অগোছালো হয়ে নকশী-কাঁথাটা ছড়িয়ে আছে। কেউ গোছায়নি নাকি?
কথাটা ভেবেই এই কাঁথাটা নিজের দিকে টেনে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। বিছানার অপর পাশে খানিকটা চেপে আসতেই শক্ত কিছু একটার সাথে ঠেকে গেলাম। দেয়াল নাকি! নাহ্! তবে কী? এই রুমে তো কোলবালিশও ছিল না!
তবে? সে যাই হোক! ভালোই লাগছে! হাত-পা উঠিয়ে এই কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরে শুলাম। কোলবালিশ এত লম্বা হয়? তার উপর কেমন শক্ত, তবুও ভালো লাগছে। কুঞ্জ ভাইও এমন শক্ত। এই কোলবালিশ দিয়ে ওঁর স্মেল পাচ্ছি। ঘুমেরা চোখের মাঝে ভর করছে। আবছা আবছা ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি। কোলবালিশটাকে তার উপর ওঠানো হাত ও পা দিয়ে আরও শক্ত করে চেপে ধরলাম। এবার তো আমি পুরোটাই কোলবালিশের উপরে চার হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। রোমশ কিছুতে নাক ঠেকেছে। কুঞ্জ ভাইয়ের স্মেলটা আরও প্রকটভাবে আসছে।
হঠাৎ কোলবালিশটি নড়ে উঠল। আমার অবচেতন মন জাগ্রত হলো। ফট করে চোখ দুটো খুলে নিলাম। ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি। তবে ব্যাপারটা জটিল হচ্ছে আরও।

কিছু করতে যাব, তার আগেই ভরাট ও গম্ভীর গলায় কেউ একজন চাপা আর্তনাদ করে বলে উঠল, “পেত্নী! ওগো! তোমার হবু সোয়ামির সম্ভ্রম-হরণ হচ্ছে এখানে। রক্ষে করো আমায়। দয়া করে, রক্ষে করো। আমি আর কোনোদিন ঢাবির মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাব না। ওঁরা আমার বোনের মতো। তুমি বাদে সব মেয়ে আমার বোন। ঐ যে! ওবায়দুল কাদের চাচার কথাবার্তার দিব্যি।”

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here