কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী লেখনীতে: নবনীতা শেখ |পর্ব ৮+৯|

0
148

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৮+৯|

রুমের কোনায় রাখা সিঙ্গেল সোফাটিতে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। লজ্জায় মরি মরি অবস্থা আমার। লাইট অন করা। সবকিছু কেমন যেন শান্ত শান্ত হয়ে আছে। অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
চোখ দুটো তুলে সামনে তাকালাম। খাটের ঠিক মাঝবরাবর কুঞ্জ ভাই বসে আছেন। চেহারার ভড়কে যাওয়া ভাব লক্ষণীয়। স্থির দৃষ্টিতে মেঝেতে তাকিয়ে আছেন। গায়ের উপরাংশে একটা সুতোও নেই। সুঠাম দেহের এমন নিখুঁত কারুকার্য দেখে আরেক পশলা লজ্জা আমার সম্মুখে ছেয়ে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম আমি। আচ্ছা লোক তো! এভাবে একটা মেয়ে মানুষের সামনে বসে আছেন, সে খেয়াল কি নেই ওঁর? এতটা বেখেয়ালি কী করে হতে পারেন উনি?
নাহ্! আমার সামনেই তো বেখেয়ালি হবেন। ওঁর সবকিছু তো আমারই। ইন ফিউচার, এরকম কত কিছু হবে!
ধ্যাৎ! আমার লজ্জা করে কেন? আজই গুগলে সার্চ দিতে হবে, “কী করে লজ্জা কমানো যায়?”

আবারও কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। মেঝে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উনিও আমার দিকে তাকালেন। চোখাচোখি হয়ে গেল। ওঁর অসহায় চাহনি আমাকে ঘায়েল করল। নাহ্! এভাবে আমার ওঁর ঘরে ঢোকা উচিত হয়নি। অন্তত একবার তো খেয়াল করা উচিত ছিল!

আমার ভাবনার মাঝেই কুঞ্জ ভাই কাঁথা টেনে নিজের সর্বাঙ্গ ঢেকে রাশভারী কণ্ঠে বলে উঠলেন, “শয়তান্নি! ইবলিশের নানি! তুই আমার দেহ পাবি, মন পাবি না।”

আমি অসহায় কণ্ঠে বললাম, “দেখুন, কুঞ্জ ভাই….”

“ছিঃ! নবু, ছিঃ! শ্যেইম অন ইউ। আমি ভীষণ ভদ্র এবং শালীন একটা ছেলে। ওসব দেখব না আমি।”

“ধ্যাৎ! শুনুন।”

“কী শুনব? আর কী শোনার আছে, নবু? তোর মনে যে এই ছিল, তা আমি জানতাম। কিন্তু এভাবে এসব! ছিঃ! নবু, ছিঃ! শ্যেইম অন ইউ।”

“ধুর! বজ্জাত লোক!”

“এভাবে বলতে পারলি?”

“কী? কীভাবে বলেছি?”

“একে তো আমার সম্ভ্রম নিয়ে খেলছিস, তার উপর আবার গালি দিচ্ছিস। লুচু মহিলা!”

নাহ্! আর শান্ত থাকতে পারলাম না। এবার যেন চটে গেলাম আমি। সিঙ্গেল সোফা ছেড়ে উঠে কুঞ্জ ভাইয়ের সামনাসামনি দাঁড়ালাম। কুঞ্জ ভাই ভ্রু- কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো আমার মতলব বোঝার প্রচেষ্টায় আছেন। তবে ওঁর কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি গায়ের কাঁথাটা এক টানে সরিয়ে দিলাম। কুঞ্জ ভাই চোখ দুটো বিশালাকৃতির করে ফেললেন।
আমি সেসবে পাত্তা না দিয়ে ওঁর গলার দিকে তাকালাম। খেয়াল করলাম, কাঁথা টানার বদৌলতে আমার নখে ওঁর গলায় আঁচড় লেগেছে। আমি বাঁকা হেসে সেই আঁচড়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। কুঞ্জ ভাই ঘামছেন, থরথর করে কাঁপছেন। ওঁর কম্পন আরও বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ওঁর দিকে ঝুঁকলাম। অধর সংকুচিত করে গলার সেই আঁচড়ের দিকে আড়াআড়িভাবে চুমু এঁকে দিলাম।

কুঞ্জ ভাই তৎক্ষণাৎ ছিটকে একদম দেয়ালের সাথে মিশে গেলেন। অবিশ্বাস্য নেত্রে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তেরছা হেসে বললাম, “লুচ্চামির কী দেখলেন? এ তো ট্রেইলার। হাহ্!”

চোখ মেরে অব্যক্ত কথাটা বুঝিয়ে ফোন হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। দরজার চৌকাঠ পেরোতেই বুকে হাত রেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এতক্ষণে মস্তিষ্কে খেলল, একটু আগে রাগের বশে কী করেছি আমি! এত সাহস আমার কোত্থেকে এলো? বাপ রে! দুঃসাহসী নবু!

________
আপির রুমে আজ আর আমার যাওয়া হবে না। তাই আর এখানে দাঁড়িয়ে সময় অপচয় না করে সোজা গেস্ট রুমে চলে এলাম। আজ বিকেলেই আম্মু পরিষ্কার করেছে। কী কারণে পরিষ্কার করেছে, তা আমার অজানা। জিজ্ঞেস করলেই না জানব, সে জিজ্ঞেসটাই তো করি না। তা অবশ্য করব কী করে? মন-মস্তিষ্ক তো সব ঐ বজ্জাত লোকটাকে ঘিরে। কিন্তু এখন ভাবনার বিষয় হলো, কুঞ্জ ভাই হুট করে এখানে কোত্থেকে এলেন? তিনি তো ছিলেন না। রাতে খাওয়ার সময়ও ছিলেন না। তবে?

আমি আমার গন্তব্যের দিক পরিবর্তন করে ফেললাম। সোজা আব্বু-আম্মুর রুমে চলে এলাম। অন্য কিছু না ভেবে সোজা করাঘাত করলাম। মিনিট তিনেক বাদেই আব্বু দরজা খুললেন।

আমাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আব্বু ভ্রু- কুঁচকে ফেললেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার? এত রাতে? ঘুমাননি? কোনো সমস্যা?”

আমি বুঝতে পারলাম, এসময়ে আমার আসা উচিত হয়নি। সকালেও তো আসতে পারতাম। কিন্তু, নাহ্! আমি যে গাঁধি, এটা আমাকে বারবার প্রমাণ করতেই হবে। আমার এমন গাঁধামোর জন্য মনে মনে নিজেকে কষিয়ে এক থাপ্পড় মারলাম।

আব্বু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তা দেখে আমি মেকি হেসে বললাম, “ঘুম আসছিল না, আব্বু। অনেকদিন হলো জমিয়ে গল্প করা হয় না। সময় পাই না। তাই…”

“এত রাতে গল্প করার জন্য এসেছেন?”

প্রশ্ন করে আব্বু হেসে দিলেন। আমিও হাসলাম। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলাম, “ডিস্টার্ব করে ফেললাম?”

আব্বু কিছু না বলে এবারও চমৎকারভাবে হাসলেন। আমি আবারও বললাম, “সকালে তো আপনার অফিস আছে। আমারও কলেজ আছে। আমি বরং যাই। আপনি ঘুমোন।”

আব্বু বুকে হাত গুঁজে বললেন, “গল্প করার লোভ জাগিয়ে দিয়ে এখন পালানো হচ্ছে, হুম?”

আমি দাঁত কেলিয়ে হাসলাম। আব্বু তাতে বললেন, “আপনি বসার ঘরে গিয়ে বসুন। আমি ভেতর থেকে আমার চশমা নিয়ে আসছি। এখানে কথা বললে আপনার আম্মুর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে। সবেই ঘুমিয়েছে।”
“আচ্ছা, আব্বু।” —বলেই আমি বসার ঘরের দিকে চলে এলাম। আমার আব্বু একজন চমৎকার মানুষ। আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ মনে হয় তাঁকে। দাদুমার কাছে ছোটো বেলায় শুনেছি, আমার আব্বু নাকি সেকালে তার পরিপাটি স্বভাব এবং মার্জিত ব্যবহারের জন্য বেশ পরিচিত ছিলেন। লেখাপড়াতেও দারুণ। প্রতিটি শিক্ষক তাঁকে অবিরাম ভালোবাসতেন। তবে একটু ব্যতিক্রমভাবে ভালোবাসতেন আব্বুর হাই স্কুলের ইংলিশ টিচার, রমিজ স্যার। ভালোবাসার পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, আব্বুর পুরো ছাত্রজীবনে কেবল এই রমিজ স্যারের কাছেই তিনি মার খেয়েছেন। তাও আবার বেধড়ক মার।
আর সেই স্যারের মেয়েই হচ্ছেন আমার আম্মু। আব্বু এখনও বলেন, “যেমন বাপ, তেমন মেয়ে। খাঁটি দজ্জাল।”

আব্বুর কথাটা আমার সাথেও যায়। সবাই বলে আমি নাকি আব্বুর ফিমেল ভার্সন। আর আপি আম্মুর মতো হয়েছে।

আমি বসার ঘরে এসেই ডিভানে গা এলিয়ে দিলাম। হাতের ফোনের ডিসপ্লের লাইট অন করে দেখলাম, সাড়ে এগারোটা বাজে। আব্বুর ঘুমোতে ঘুমোতে বারোটা বেজে যায়। লিভিং রুমের লাইট তাই বারোটা অবধি জ্বালানোই থাকে।

ডিসপ্লেতে খেয়াল করলাম, আমার একটা ছবি। এটা নানুবাড়ির বাগানে তোলা। আমার পরনে আটপৌরে করে টকটকা লাল রঙের শাড়ি। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক আর চোখে মোটা করে কাজল লাগানো, যা লেপ্টে গেছে। হাঁটু লম্বা চুলগুলো মাঝ বরাবর সিঁথি করে ছেড়ে দেওয়া; বাতাসে উড়ছে। বা’পাশে কানে একটা জবাফুল গুঁজে রাখা।
সেদিন বাগানের ফুলগুলো দেখছিলাম। সময়টা গোধূলি ছিল। ঢলে পড়া সূর্যের ঈষৎ লাল আভা আমার এই সাজকে পরিপূর্ণ করে দিচ্ছিল। সেদিন বাগানের সবগুলো গাছ ফুলে ভরা ছিল। খুশিতে আটখানা আমিটাকে তখন হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডাকে। মুখভঙ্গি না পালটে সেভাবে তাকাতেই কুঞ্জ ভাই এই ছবিটা ক্লিক করেছিলেন।

পরে আমাকে ছবিটি দেখিয়ে বলেছিলেন, “ছিঃ! এত বাজে দেখতে! পুরাই পেত্নী। কয় কেজি আটা মেখেছিস মুখে? আর ঠোঁটে! এটা কী? কার রক্ত খেয়েছিস?”

আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম, “একদম ফালতু কথা বলবেন না, কুঞ্জ ভাই। মুখে ৬০ টাকা কেজি আটা মাখিনি। ফাউন্ডেশন লাগিয়েছি, ফাউন্ডেশন। পুরো গুনে গুনে ৫৩০০টাকা নিয়েছে। আর ঠোঁটের লিপস্টিক! ৩২৫০ টাকা নিয়েছে!”

কুঞ্জ ভাই তখন হাই তুলতে তুলতে বলেছিলেন, “তো দ্যাখ! তোর সামনেই এক্সাম্পল রয়েছে। যতই আটা-ময়দা মাখা হোক না কেন, কাক কখনো বক হয় না।”

সেবার রাগটা এত বেশিই হয়ে গিয়েছিল যে, আমি কুঞ্জ ভাইয়ের চুল টানা শুরু করেছিলাম। তারপর কী যে কান্না জুড়ে দিয়েছিলাম! ভাবতেই হাসি পেয়ে গেল। আমার সব কিছুতেই কুঞ্জ ভাই কেমন করে যেন মিশে আছেন।

“কী ব্যাপার? একা বসে হাসছেন যে!”

আব্বুর কথা শুনে তাঁর দিকে তাকালাম। হাসি থামেনি, বরং খানিকটা প্রসারিত হলো। আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন? হাসতে পারি না?”

আব্বু আমার পাশেই বসতে বসতে বললেন, “অবশ্যই পারেন। তবে হ্যাঁ! আপনার প্রশ্নের বিপরীতে করা প্রশ্ন কিন্তু ভীষণ ইরিটেটিং।”

আমি ফটাফট আব্বুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, “আর আমার আপনাকে ইরিটেট করতে বেশ লাগে!”

আব্বুও আমার কথার বিপরীতে হাসলেন। কিছু একটা মনে হলো যেন, এমন ভঙ্গিতে শুধালেন, “চুলের যত্ন করেন না?”

আমি চোখ ঘুরিয়ে গালের মাঝে লেপ্টে থাকা চুলগুলোর দিকে একটা নজর বুলিয়ে নিলাম। এরপর ঠোঁট উলটে বললাম, “সময় পাই না তো!”

আব্বু চাপা শ্বাস ফেলে বললেন, “আমার রুমের ড্রেসিং টেবিল থেকে তেল নিয়ে আসুন।”

__________
সোফায় আব্বু বসে আছেন। আমি ঠিক তাঁর পায়ের কাছে বসে আছি। আব্বু বরাবরের মতোই আমার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন আর গল্প করছেন। ইশ! কী যে ভালো লাগছে! কিছুক্ষণ আগেই কথার ছলে আব্বুর কাছ থেকে জানতে পেরেছি, কুঞ্জ ভাই ঘণ্টা খানেক আগেই এসেছেন। ওবাসায় আবারও মামার সাথে ঝগড়াঝাটি হয়েছে। তাই চলে এসেছেন। আর এসেই ঘুম।

“জানেন? আমি একদম আমার দাদিবুবুর মতো হয়েছি। দাদিবুবুর কথাবার্তা, চাল-চলন, সবকিছুই অনেকটা রাজকীয় ছিল। তাঁর চুলগুলো ছিল হাঁটুর সমান। দেখতে ভীষণ সুন্দরী ছিলেন। সবাই বলত, আমি নাকি দাদিবুবুর সৌন্দর্য পেয়েছি, তাঁর মতো হয়েছি। আর আপনি হয়েছেন আমার মতো। আপনার সাথে দাদিবুবুর প্রচুর মিল। আপনি যখন জন্মেছিলেন, আমার আব্বা আপনাকে কোলে নিয়েই বলেছিলেন,‘এটা আমার আম্মা।’ বুঝলেন?”

আমি মিষ্টি করে হেসে বললাম, “হ্যাঁ। বুঝেছি। তাহলে তো আপনার উচিত আমাকে এখন থেকে দাদিবুবু বলে ডাকা!”

কথাটা বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলাম। আব্বুও হাসলেন। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা! আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন কেন করেন? কই? আপুকে কিংবা আম্মুকে তো করেন না!”

“বললাম না? আপনি আমার দাদিবুবুর মতো হয়েছেন। এজন্য।”

“জানেন, আব্বু? আমার না! এটা দারুণ লাগে। কত্ত ইউনিক!”

“আমারও ভালো লাগে।” —কথাটি বলেই আবারও আব্বু বললেন, “বেনুনি করে দেব?”

“হ্যাঁ, দিন তো, দিন। ভালোই হবে।”

______________
সকালে ব্রাশ করতে করতে বাসার আনাচে-কানাচে ঘুরছিলাম। অভ্যেসটা আমার না। অন্য একজনের। ভালো লেগে গিয়েছিল, তারপর থেকে আমিও করি। হাঁটতে হাঁটতেই খেয়াল করলাম, কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের দরজা খোলা। একবার উঁকি দেওয়ার চিন্তা মাথায় এনেও ঝেড়ে ফেললাম। ব্রাশ নিয়ে নিজের রুমের ব্যালকনিতে চলে এলাম। সকালের স্নিগ্ধ এই বাতাসটা আর কিছুটা সময়ই থাকবে। তারপরই ভ্যাপসা গরমে শহরের লোকজন অতিষ্ট হয়ে পড়বে।

এদিক-ওদিক তাকানোর পরই কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের জানালায় চোখ গেল। আমার রুমের ব্যালকনি থেকে কুঞ্জ ভাইয়ের জানালা আড়াআড়ি ভাবে দেখা যায়। জানালার পাশেই কুঞ্জ ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। ফোন কানে তাঁর। মুখভাব গম্ভীর। এভাবে কারো সাথে কথা বলে কেউ? নিশ্চয়ই প্রেমিকার সাথে কথা বলছেন!

আমি সিটি বাজালাম। কুঞ্জ ভাই আড়চোখে তাকালেন। আমি সেটা দেখতে পেয়েই আমার এলোমেলো চুলগুলো গোছানো শুরু করলাম। কুঞ্জ ভাই দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।

আমি এবার ডাকলাম, “ওহ্ হিরো!”

কুঞ্জ ভাই বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি মুচকি হেসে বললাম, “আই ওয়ানা বি ইউর হিরোইন, জানেমন!”

কথাটা শেষ করে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে মারলাম। কুঞ্জ ভাই অতিষ্ট! জীবনটা যেন ভাজা ভাজা করে দিয়েছি এমন ভাবে দাঁতে দাঁত চেপে জোরপূর্বক হেসে বললেন, “হ্যাঁ, তো। আ’ম ওলয়েজ দেয়ার ফর ইউ, সুইটহার্ট।”

আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম, এমন ভঙ্গিতে বললাম, “আও! আমার কলিজা রে!”

“নাহ্। কলিজার টুকরা। মশলা দিয়ে মাখিয়ে ভেজে খেয়ে নাও আমাকে। বেঁচে যাই।”

কুঞ্জ ভাই রাগছেন। কিন্তু কী করলাম? এভাবে রাগার কী আছে? কালকের জন্য? আরে বাবা! ভবিষ্যতে এরকম কত কিছু হবে! তাই বলে এভাবে রাগলে চলে?

আমি তবুও ঠোঁটের হাসি বিলীন হতে দিলাম না। সেভাবেই বললাম, “এখন না। বিয়ের পরে। এখন আমার শরম করে।”

শেষোক্ত কথাটি বলার সময় দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললাম। কুঞ্জ ভাই অসহায় চাহনি নিক্ষেপ করেই ভেতরে চলে গেলেন। ইশ! ওঁর অসহায় ফেইসটাও কত অ্যাট্রাকটিভ!

_____________
“ওঠ! কিন্তু গা ঘেষবি না একদম।”

কথাটা বলেই কুঞ্জ ভাই বাইকে উঠে বসলেন। আমি কি ওঁর কথা শোনার মানুষ? বাইকে উঠে পেছন থেকে একেবারে জাপটে ধরেই বসলাম। কুঞ্জ ভাই তেতে উঠলেন, “ভালো হচ্ছে না, নবু। ঠিক করে বোস। অ্যাক্সিডেন্ট হবে।”

“হলে হোক।”

“কথা শুনছিস না কেন?”

“শুনব না। আপনার কথা শুনতে ভালো লাগে না।”

কুঞ্জ ভাই চাপা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “নাম।”

আমি ভ্রু- কুঁচকে বললাম, “কেন?”

“এই কথাও শুনবি না?”

“কারণ বলুন, শুনতে ইচ্ছে হলে শুনব। নয়তো না।”

“সব তোর ইচ্ছে মতো হতে হবে?”

“অবশ্যই হ্যাঁ।”

“দ্যাখ! তুই এভাবে ধরলে আমার রাস্তায় মনোযোগ থাকবে না। অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে। বাট আই ওয়ান্ট টু লিভ… উইথ ইউ।”

আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। এত নরম স্বরে ওঁর কৈফিয়ত দেওয়াটা কীভাবে যেন বুকের মাঝে তোলপাড় করে দিচ্ছে। আর কী বললেন! উনি বাঁচতে চান? আমার সাথে?

কুঞ্জ ভাই আবারও বললেন, “নাম।”

আমি নেমে গেলাম। কুঞ্জ ভাই নিজেও নামলেন। মুচকি হেসে বললেন, “চল। হেঁটে যাব।”

এতে যেন আরও খুশি হয়ে গেলাম আমি। বাইকে গেলে পাঁচ মিনিট লাগত; যেখানে হেঁটে গেলে আমি কুঞ্জ ভাইকে আরও কিছুক্ষণ বেশি সময় কাছে পাব। সকালে কুঞ্জ ভাইকে ফোর্সড করলাম, আজকে কলেজে যাওয়ার সময় নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাসা থেকে হেঁটে যেতে ২৫মিনিট লাগে। প্রতিদিন রাহীর সাথেই যাই। আজও যেতাম। কিন্তু কুঞ্জ ভাইকে টিস্ করতে করতে দেরি হয়ে গেল আমার। আর ওদিকে রাহী শাকচুন্নি আমাকে রেখেই বড়ো মামার সাথে চলে গেছে। ভেবেছে, আমি আজ যাব না। কী খারাপ মেয়ে! একদম ভাইয়ের মতোই।
অগত্যা কুঞ্জ ভাইকেই আসতে হলো আমার সাথে।

রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। একদম চুপচাপ। ঠিক সেদিনের মতোই হাঁটছি। কুঞ্জ ভাই সামনে আর আমি কিছুটা পেছনে। এভাবে কুঞ্জ ভাইয়ের হাঁটার ধরণ যে কী দারুণ! উফফ! আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ বাদে কুঞ্জ ভাই থেমে গেলেন। আমি লক্ষ করলাম, উনি করছেনটা কী!
একবার হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন। আবার আমার দিকে তাকালেন। আমি বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “থেমে গেলেন কেন?”

কুঞ্জ ভাই নিজের কোমরের দু’পাশে হাত রেখে এদিক-ওদিক তাকালেন। এরপর আমার চোখে চোখ রেখে ঝাঁজালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “হোয়াটস রং উইথ ইউ?”

আমি বুঝতে পারছি না। শুধু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। কুঞ্জ ভাই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “কাল থেকে কী করছিস এসব? এসবের মানে কী?”

আমি অবুঝ ভঙ্গিতে শুধালাম, “কোন সব?”

“বুঝিস না?”

“নাহ্, বুঝি না। আপনার বোঝাতে হবে।”

“আমি পারব না।”

কুঞ্জ ভাই আমতা আমতা করেই বললেন। আমি মনে মনে একচোট হেসে নিলাম। বুঝি তো, সবই বুঝি। শুধু আপনার এমন লাজুক ঢং বুঝি না। পুরুষ মানুষ হবে নির্লজ্জ। কিন্তু আপনি! আমার ভবিষ্যত অন্ধকার। হ্যাঁ, হ্যাঁ। অন্ধকার।

কুঞ্জ ভাই বললেন, “দাঁড়িয়ে থাকিস না।”

আমি হাঁটা শুরু করলাম। কুঞ্জ ভাই আমার চেয়ে তিন হাত দুরত্ব বজায় রেখেছেন। আমি তাঁর দিকে ঘেঁষতেই, উনি দূরে সরে যান। কেন রে কুঞ্জ? আমার গায়ে কি গোবর মেখে এসেছি?

শেষমেষ আর পারলাম না। ধমকানো সুরে ডাকলাম, “কুঞ্জ ভাই!”

কুঞ্জ ভাই তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, “কী? কী?”

“আপনি দূরে দূরে থাকছেন কেন? আমি কি বাঘ না ভালুক? এভাবে থাকার মানে কী?”

“ও তুই বুঝবি না। তুই হচ্ছিস মহিলা মানুষ। বাঘ-ভালুকের চেয়েও ভয়ঙ্কর।”

“কুঞ্জ ভাই! ভালো হচ্ছে না কিন্তু, বলে দিলাম।”

“ওয়েট অ্যা মিনিট! আমি ভয় পাচ্ছি কেন? ভয় তো তুই পাবি।”

“কেন? আমি কেন আপনাকে ভয় পেতে যাব?”

কুঞ্জ ভাই বাঁকা হেসে বললেন, “ভুলে গেছিস? ঐ যে, ভিডিয়ো! ওটা এখনও আমার কাছে আছে। ফুপিকে দেব?”

আমি কিছুক্ষণ কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। সেকেন্ড পাঁচেক এক দৃষ্টিতে এই আজব জন্তুটিকে দেখেই এদিক-ওদিক তাকালাম। আমাদের থেকে কয়েক ফুট দূরেই একজন স্বাস্থ্যবতী মহিলা। আমি কুঞ্জ ভাইয়ের পাশ কাটিয়ে ঐ মহিলার কাছে গিয়ে তাঁর রাস্তা আটকালাম।

“এই মেয়ে! কী হয়েছে? সরো সামনে থেকে।”

ভদ্র মহিলার কথায় আমি দাঁত কেলিয়ে হাসলাম। উনি আবারও বললেন, “এ কী? সরছ না কেন?”

আমি এবার মুখ খুললাম, “আন্টি! আমারে নিয়া যান। আজ থেকে আপনি আমার আম্মা, আমি আপনার মাইয়া। নিয়া যান আমারে। সকাল-বিকাল আপনার কাছে আপনার শ্বশুর বাড়ির নামে বদনাম করব। আমারে শুধু থাকতে আর খাইতে দিয়েন। আমারে নিয়া যান, আম্মা, নিয়া যান। আমার পুরান আম্মা আমারে ভালোবাসে না। একটা হিটলাররে ভালোবাসে। আমার বাড়িতে আমার কথা না, ঐ হিটলারের কথা চলে। ও আম্মা! নিয়া ও নিয়া যান। আমারে নিয়া রে নিয়া যান।”

শেষোক্ত দুই লাইন গানের সুরেই বললাম। ততক্ষণে কুঞ্জ ভাই আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভদ্র মহিলা হা করে আমার কথা গিলছিল। আমার পাশে আরেকজনকে এসে দাঁড়াতে থেকে উনি তাঁর দিকে তাকালেন। ভদ্র মহিলার চাহনি দেখে কুঞ্জ ভাই বললেন, “স্যরি, আন্টি। এর মাথায় একটু সমস্যা। আসলে এটা পাবনা থেকে পালিয়ে এসেছে।”

ভদ্র মহিলা এবার একটু করুণ চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আল্লাহর এই দুনিয়াতে মানুষ কতরকমেরই হয়! এই যে! এত সুন্দর একটা মাইয়া। সে নাকি আবার পাগল! মাইয়াটারে দেইখা মায়া লাগতাছে। তা বাবা, মাইয়াটা কি জন্ম থেকেই এমন? না কি…”

আমি চেতে উঠলাম, “এ্যাই, মহিলা! আমাকে পাগল বলেন কেন? আপনি পাগল, আপনার জামাই পাগল। আপনার চৌদ্দ গুষ্টি…”

আর কিছু বলার আগেই কুঞ্জ ভাই আমার মুখ চেপে ধরলেন। আমি শুধু “উমম, উমম” করে গেলাম।

কুঞ্জ ভাই অসহায় চোখে তাকিয়ে বললেন, “এটা জন্ম পাগল। বয়সের সাথে সাথে পাগলামো বাড়ছে।”

ভদ্র মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে আফসোস করে বললেন, “আল্লাহ তোমার ভালা করুক। অকালে মাইয়াটা পাগল হইসে। আহারে, আহারে।”

উনি চলে গেলেন নিজ মনে বিলাপ পারতে পারতে। এদিকে আমি কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে আছি। আমি পারি না ওঁকে খেয়ে ফেলতে।

চলবে…

[দুই পর্ব একসাথে দিলাম। কালকে অফ রাখি গল্পটা। আগামী পর্ব বুধবারে দেব। ভালোবাসা অবিরাম।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here